২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
উৎসের উচ্চারণ

পশ্চিমা সাহিত্য ও চিন্তায় মুসলিম প্রভাব : একটি গ্রন্থের আলোকে

পশ্চিমা সাহিত্য ও চিন্তায় মুসলিম প্রভাব : একটি গ্রন্থের আলোকে - ফাইল ছবি

নবম থেকে ষোড়শ শতক অবধি পশ্চিমা বিশ্বে আরব চিন্তা ও সাহিত্যের প্রভাব ছিল অপ্রতিহত। ল্যাটিন ভাষার বিখ্যাত লেখক আল গারোর এ নিয়ে খুবই মর্মবেদনা প্রকাশ করেন। Some glittering aspects of the Islamic civilization গ্রন্থে ড. মোস্তফা আস সিবায়ী উদ্ধৃত করেন তার বক্তব্য। আল গারোর লিখেন, ‘অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে যে, আমাদের তরুণরা নিজেদের সংস্কৃতি ছেড়ে মুসলিমদের পিছে ছুটছে। তাদের মন-মানসিকতায় আরবি সঙ্গীত জাদুকরী প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণে তারা ল্যাটিন ভাষাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখে এবং অন্যান্য ভাষা ছেড়ে প্রভাবশালী লোকদের ভাষা শেখে। স্বদেশপ্রেমে উদ্বেলিত কিছু লোক এ কারণে চরম উদ্বেগ ও বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আমাদের খ্রিষ্টান ভাইয়েরা আরবি কবিতা ও গল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন। তারা কেবল অধ্যয়ন করেন ওই গ্রন্থাবলী, যা লিখেছেন মুসলিম দার্শনিক অথবা ফকিহরা। তারা এগুলো পড়ছেন প্রতিবাদ করার জন্য নয়, কিংবা নয় ভুল সংশোধনের জন্য। বরং তারা উন্নত আরবি শেখার নেশায় অধীর হয়ে এসব বইয়ের দ্বারস্থ হচ্ছেন।

তাওরাত ও বাইবেলের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ধর্মের অনুসারী ছাড়া কে পড়বে? কিন্তু খুব কম সংখ্যক খ্রিষ্টান সেগুলো ছুঁয়ে দেখে। দুঃখের বিষয়, আধুুনিক খ্রিষ্টান যুবকরা আরবি সাহিত্য ছাড়া আর কোনো সাহিত্যের দিকে চোখ তুলেই তাকাচ্ছে না। আর আলো সংগ্রহ করে আরবদের গ্রন্থ থেকে। তারা পাঠাগার সমৃদ্ধ করে এসব গ্রন্থ দিয়ে। সবার মুখে মুখে এসব গ্রন্থের প্রশংসা। খ্রিষ্টান সাহিত্যের কথা তাদের শুনানো হলে তারা ভ্রু কুঁচকায়। নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বলে, ওসব তো পাঠযোগ্যই নয়। আফসোস! খ্রিষ্টানরা ভুলে যাচ্ছে নিজেদের ভাষাটিকেও। তাদের এক হাজারজনের মধ্যে একজনও এমন পাবেন না, যে বন্ধুকে নিজের ভাষায় চিঠি লেখে। অথচ আরবি ভাষার চর্চা তারা গভীর আগ্রহ ও ঐকান্তিকতার সাথে করে। সেই ভাষায় লেখে গল্প-কবিতা। যেগুলো এতই মানসম্মত হয় যে, কখনো কখনো আরবি ভাষাভাষীদের লেখাকেও তা ছাড়িয়ে যায়।’

আল গারোর কিংবা অন্যদের উৎকণ্ঠা কিন্তু আরবি চর্চা ও আরব সংস্কৃতির অনুকরণ থেকে তৎকালীন নব্য ইউরোপীয়দের ফেরাতে পারেনি। যদি তারা ফিরত, তাহলে ইউরোপের জাগরণের ভ্রƒণই তৈরি হতো না। সেই সময় তারা এত গভীরভাবে আরব্য জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, ভাষা ও সাহিত্যে ডুব দিয়েছিল যে, তাদের অনেকেই আরবি নাম পর্যন্ত গ্রহণ করতেন গর্বিতচিত্তে। শিক্ষিতদের মধ্যে আরবিনির্ভরতা এতই ছিল যে, গুস্তাব লিভানের সাক্ষ্য অনুযায়ী তৎকালীন ও পরবর্তী ইউরোপের শ্রেষ্ঠ চিন্তানায়ক ওজাহানেস স্কটাস এরিগেনা, আলবার্টাস ম্যাগনাস, রজার বেকন, ফ্রান্সিস বেকন, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রবার্ট গ্রসেটেস্ট, র্যামন লাল, জন ডান্স স্কোটাস প্রমুখ একমাত্র আরবি গ্রন্থ থেকে আলো সংগ্রহ করতেন।

তেরো শতকে পশ্চিম ইউরোপে যেসব রূপকথা, উপকথা, গল্প, নীতি-কাহিনী, প্রবাদ-প্রবচনের উদ্ভব ঘটে, ফিলিপ কে হিট্টির ভাষ্যমতে, এগুলোর মূলে ছিল আরবি সাহিত্য। আরবি কালিলা ও দিমনা যখন ইউরোপে গেল, এর প্রভাব পড়ল খুবই ব্যাপক। ক্যাস্টাইল ও লিয়নের প্রাজ্ঞ এলফনসোর দ্বারা সেটা স্পেনীয় ভাষায় অনূদিত হলো। এরপর ইহুদি থেকে খ্রিষ্টান হওয়া এক মহিলা ল্যাটিনে অনুবাদ করলেন। ফরাসি অনুবাদের সূত্র ধরে ফরাসি সাহিত্যের অনন্য কীর্তি লা ফন্টেইন-এর অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে গ্রন্থটি। লা ফন্টেইন এর কবি নিজে এটি স্বীকার করেছেন। হারিরীর মাকামা যখন ইউরোপে গেল, কিছু দিনের মধ্যে স্পেনীয় গদ্যের রূপ পাল্টে দিলো। এর ধারায় গল্প-উপন্যাস রচনা হয়ে উঠল সর্বোচ্চ প্রগতিশীলতা। ফিলিপ কে হিট্টির ভাষায়- আরবি ভাষা তার অসাধারণ প্রকাশভঙ্গির মারফত যেটুকু প্রকাশ করেছে, তা মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় সাহিত্যকে তার পুরোনো সঙ্কীর্ণতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে। স্পেনীয় সাহিত্যের ঔৎকর্ষের মূলে কাজ করেছে আরবি সাহিত্য। কবিতায় শব্দ ব্যবহারের নানা কৌশল, শ্রুতি মাধুর্য, আকর্ষণ সৃষ্টি এগুলো আরবদের থেকে এসেছে।

আরবি কবিতার স্বাভাবিক গীতলতা দেশীয় খ্রিষ্টানদের প্রবলভাবে আকর্ষণ করে এবং নতুন এক ধারার সৃষ্টি হয়। ক্যাস্টাইলের জননন্দিত ভিল্লান সিকো কবিতা আরবি গীতি কবিতা থেকেই গড়ে ওঠে। এ কবিতা খ্রিষ্টানদের ধর্মীয় প্রার্থনা এবং বড়দিনের আনন্দ সঙ্গীতে বিশেষভাবে ব্যবহৃত হতো। অষ্টম শতকে স্পেনীয় সাহিত্যে যে প্লেটোনিক প্রেমের প্রকাশ ঘটে, তা আরব কবিতারই দান। প্রভেন্সাল কবিদের আবির্ভাব ঘটে দক্ষিণ ফ্রান্সে। এগারো শতকে এরা অসাধারণ দক্ষতা ও কল্পনা শক্তির বিচিত্র প্রকাশে প্রেমকে ব্যক্ত করে। বারো শতকে দেখা দেন ট্রাভেরদূর কবিদল। গজলের অনুকরণে তারা সৃষ্টি করতেন সর্বাধুনিক কবিতা। গজলের অনুকরণ স্পেনীয় কবিতায় পরেও থেকে যায়। এর দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন স্বয়ং লোরকাও।

ইউরোপীয় প্রাথমিক যুগের সাহিত্যে চ্যানসন ডি রোলান্ড-এর তো কোনো তুলনাই নেই। ১০৮০ সালে লিখিত এ গ্রন্থটি নতুন এক ধারার সূচনা করে। এ গ্রন্থে রোপিত ছিল পশ্চিমে পরবর্তীতে উজ্জীবিত সভ্যতার চারা। গ্রন্থটি মুসলিম চিন্তা ও জীবনাচারের প্রত্যক্ষ ঋণে ঋণী। এমনকি এ গ্রন্থের উৎপত্তি হয় মুসলিম স্পেনের এক সামরিক সংঘর্ষে থেকে। ইংরেজি সাহিত্যে আধুনিক কাব্যের জনক চসার আরবি সাহিত্যের ঝর্ণাধারায় স্নাত হন। তিনি তার বিশ্ববিখ্যাত ক্যান্টারবেরি টেলস রচনা করেন বোকাশিও কর্তৃক প্রভাবিত হয়ে। ইতালিতে তার সাক্ষাৎ হয় আরবি সাহিত্য ও চিন্তাচর্চার দূত বোকাশিওর সাথে। বোকাশিওর রচিত উপাখ্যান দ্বারা বিপুলভাবে প্রভাবিত হন শেকসপিয়র। তার কোনো কোনো নাটকের বিষয়বস্তু তো সরাসরি বোকাশিও থেকে গৃহীত। জার্মানির নাট্যকার লাসিং তার নাটকে নাতান হাকিমের প্লট সংগ্রহ করেন বোকাশিওর গ্রন্থ থেকে। মহাকবি দান্তের ডিভাইন কমেডি আবুল আলা মায়াররির গোফরান গ্রন্থ ও ইবনুল আরাবির কিতাবুল জিনের ছায়ায় গঠিত।

সম্রাট ফ্রেডারিকের শাসনকালে তিনি সিসিলিতে অবস্থান করেন। সেখানে রাসূল সা:-এর জীবন, মে’রাজ কাহিনী ও মহাকাশ সম্পর্কিত কুরআন হাদিসের চর্চার ঐতিহ্য ছিল পুরোনো। ডিভাইন কমেডিতে তিনি অন্য এক জগতে সফরের কাহিনী লিখেছেন। এতে প্রবলভাবে এ অবগতির প্রভাব ক্রিয়াশীল রয়েছে। এখানে কিছু উদাহরণ উল্লেখ করলাম এটা বোঝাতে যে, আরবি সাহিত্য ইউরোপের মানসজগতে যে বিশাল প্রভাব ফেলেছিল, তারই বিকিরণ ঘটেছে তাদের শ্রেষ্ঠতম কবি-সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্মে।

আরবি সাহিত্যের এ প্রভাব কত ব্যাপক ও সুগভীর, তার অনুমান পেতে আমরা সুদীর্ঘ তালিকার দিকে যাচ্ছি না। মাত্র একটি গ্রন্থের পটভূমিকায় গোটা বিষয়টিকে আশা করি পাঠক ধরতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আমরা বেছে নিতে পারি হাই ইবনে ইয়াকজান গ্রন্থটিকে। আবু বকর মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল মালিক ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তোফায়েল আন্দালুসি গ্রন্থটি রচনা করেন। ইবনে তোফায়েল ছিলেন ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, সরকারের উজির ও চিকিৎসক। ১১৬০ সালে লেখা এ বই এত ব্যাপক ও সুগভীর প্রভাব সৃষ্টি করে যে, ১৭, ১৮ ও ১৯ শতকেও পশ্চিম ইউরোপে তা ছিল বেস্টসেলার। পশ্চিমা চিন্তা ও সাহিত্য জগৎকে আলো দিয়ে মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কালখণ্ডে উত্তরণে বইটির ভূমিকা স্বীকৃতি হয়েছে ঐতিহাসিকদের কণ্ঠে।

পাশ্চাত্য দর্শনে এর যেমন সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে, তেমনি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রভাবও পড়ে বিস্তর। যার অনিবার্য দাবি ছিল চিন্তার মুক্তি ও বিজ্ঞানের রেনেসাঁ। ১৮ শতকে যখন ইউরোপে রেনেসাঁ সূচিত হলো, দেখা গেল, এ বই তাতে অগ্রদূত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বইটি টাবুলা রাসা বা সাদা স্লেটের মতো মনের ধারণা দান করে। যার বয়ান উপস্থাপন করেন রেনেসাঁ যুগের দার্শনিক জন লক। তার অ্যান অ্যাসে কনসার্নিং হিউম্যান আন্ডারস্ট্যান্ডিং বইটি মূলত টাবুলা রাসা তত্ত্বের ব্যাখ্যা মাত্র।

হাই ইবনে ইয়াকজানের বিভিন্ন ধারণা বিবর্তিতভাবে ফুটে উঠল টমাস হবসের চিন্তাধারায়, রেনেসাঁর চিন্তানায়ক ফরাসি দার্শনিক ভল্টেয়ারের দর্শনে, ইমানুয়েল কান্টের চিন্তায়, জার্মান দার্শনিক গটফ্রিড লিবনিজের লেখাজোখায়। আইজ্যাক নিউটনের জ্ঞানচর্চা যেন হাই ইবনে ইয়াকজানের বাস্তব রূপায়ণ। এন্থনি প্যাস্টর হাই-এর প্রভাবের বিষয়টি বিশ্লেষণ করেছেন বিস্তৃত পটভূমিকায়। ১৯৩০ সালে প্রকাশিত দি আইডিয়া অব রবিনসন ক্রুসো বইয়ে তিনি বানান করে দেখিয়ে দিয়েছেন-ডেনিয়েল ডিফোর লেখা ইংরেজি সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস রবিনসন ক্রুসো হাই ইবনে ইয়াকজানের ধারাবাহিক অনুকরণমাত্র। কিভাবে প্রতিটি পর্যায়ে ইবনে তুফায়েলের ছায়া ধরে ডিফো হেঁটেছেন, তা পরিষ্কারভাবে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।

হাই-এর সাথে ডিফোর পরিচয় সম্ভবত ১৭০৮ সালে প্রকাশিত সাইমন ওকলের ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য ইমপ্রুভমেন্ট অব হিউম্যান রিজন : এগজিবেটেড ইন দ্য লাইফ অব হাই ইবনে ইয়াকজান’-এর মধ্য দিয়ে। এর আগে ১৬৭৪ সালে জর্জ কেইথ বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেন। জর্জ অ্যাশওয়েলের অনুবাদ ছাপা হয় ১৬৮৬ সালে। সর্বপ্রথম বইটি অনূদিত হয় হিব্রু ভাষায়। ১৪ শতকের প্রথম পাদেই। ‘ফিলসফাস অটোডিডাকটাস’ নামে ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন এডওয়ার্ড পোকক জুনিয়র। আরবি টেক্সটসহ অক্সফোর্ডে তা ছাপা হয় ১৬৭১ সালে। এরপর ইউরোপের অধিকাংশ ভাষা বইটিকে নিজের মতো করে পড়তে চাইল। বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হতে থাকল একে একে।

জনপ্রিয় ডেনিস লেখক সেডিবি ডাচ ভাষায় এর অনুবাদ করেন ১৯৭২ সালে। অনুবাদটি খুবই গৃহীত হলো ওলন্দাজ সাহিত্যপাড়ায়। জার্মান ভাষায় সম্ভবত সবচেয়ে ভালো অনুবাদটি করেন জেজি আইকহর্ন। ১৭৮৩ সালে তার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। অবশ্য ১৭২৬ সালে ছাপা হওয়া জর্জ প্রিটানিয়াস এর অনুবাদও যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। জার্মানিতে বইটি কেনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে লাইন পড়ে যেত।

বইটি সম্পর্কে ইউরোপীয়দের এ আগ্রহ কেবল কয়েক শ’ বছর আগের ব্যাপার নয়। বরং উনিশ শতকেও দেখা গেছে এর অব্যাহত চর্চা ও অনুবাদ।

১৯২০ সালে রুশ ভাষায় বইটি মূল্যবান ভূমিকাসহ অনূদিত হয়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত এর স্পেনিশ অনুবাদ খুবই মূল্যায়িত হয়। আঠারো-উনিশ শতকের আলোড়নময় দর্শনগুলোতেও হাই উপস্থিত ছিলেন প্রবলভাবে। কাল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ হাই এর বস্তুবাদ সম্পর্কিত ধারণার সাথে মেলে। হাই আচ্ছন্ন করে রাখে স্কটিশ মিশনারি রবার্ট বার্কলেকে। ফরাসি বিজ্ঞানী মেলশিডেডেক টেভেনট, ইংরেজ গণিতিবিদ ওয়ালিস, ওলন্দাজ গণিতবিদ ক্রিশ্চিয়ান, হাউজেন্স, জার্মান গণিতবিদ স্যামুয়েল হার্টলিব- প্রত্যেকেই ঘোরগ্রস্ত ছিল হাই দ্বারা। হাই-এর ঘোর এতই ক্ষমাশীল যে, রবার্ট রয়েলকের দি এসপায়ারিং ন্যাচারালিস্ট রুশোর এমিল রুডিয়ার্ড কিপলিং-এর জাঙ্গল বুক এবং এডগার রাইস বারোর টারজানে সে নিজের উপস্থিতি বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করে। জাঙ্গল বুকের কাহিনী তো একদম হাইয়ের মতো। নির্জন দ্বীপে এক পরিত্যক্ত মানব শিশু। তাকে প্রতিপালন করেছে নেকড়ে মা....।

অবিশ্বাস্যই বলতে হবে হাই এর ক্ষমতা। আসলে কী সেই ক্ষমতা, যা গ্রন্থটিকে কালাতিক্রমী বৈভব ও আশ্চর্য জীবনীশক্তি দান করল? বইটিতে আছে রহস্য রোমান্সপূর্ণ প্রতিকাশ্রয়ী দার্শনিক কাহিনী। সুফিবাদ আর আভোসিনিজম (ইবনে সিনাবাদ) মিলে একাকার হয়েছে বইটিতে। একদিকে আছে নিরন্তর আত্ম আবিষ্কার ও মুক্ত বিশ্লেষণের প্রণোদনা, অন্যদিকে বিশ্বব্যবস্থার একাত্মতার ধারণা বিচিত্র আঙ্গিকে জীবন্ত হয়ে উঠছে। মানসিক শক্তির স্ফুরণের পথ বলে দেয়া, সত্যে উপনীতির ডাক শুনিয়ে যাওয়া এবং আত্মাকে মেলে ধরবার এমন উজ্জ্বল ও কার্যকর উৎসাহ দ্বিতীয়টি আর হয় না। প্রকৃতিকে বুঝবার এবং ব্যাখ্যা করবার, ঘটনা ও কার্যকারণসমূহ উদঘাটন করার যে উসকানি এ গ্রন্থের শিল্পিত তরঙ্গে ফেনায়িত তার সম্মোহনে উদ্বেলিত না হয়ে পারা যায় না। বস্তু ও অবস্তুর সারসত্য বুঝবার ও খুঁজবার ঝোঁক আছে, আছে দুঃসাহসের উদ্দামতা, আছে জীবন জিজ্ঞাসার উত্তর উদঘাটনের দার্শনিকতা- কিন্তু কোনোটাই স্থূলোভাবে নয়, বিগলিতভাবে। কাহিনীর জলস্রোতে লুকিয়ে থাকা মাছের মতো জীবন্ত তবে প্রচ্ছন্নভাবে।

হৃদয় ও আত্মার সুস্থির অনুশীলনের মধ্যে শিল্প ও দর্শনের যে আকাক্সক্ষা রয়েছে, বইটি তার প্রকৃষ্ট ও বিশ্বস্ত আয়না। স্বজ্ঞা ও প্রজ্ঞা উভয়ের সমন্বয়ে চিন্তাপদ্ধতির বিপ্লবাত্মক সমুন্নতি নির্দেশ করে বইটি। ‘হাই ইবনে ইয়াকজান’ কোনো ধরনের প্রশিক্ষণের অধীন নয়, এমন ব্যক্তির বুদ্ধি ও প্রত্যক্ষণের ক্রমিক ও পর্যায় ক্রমিক বিকাশের প্রতিবেদন।

বিচিত্র বৈশিষ্ট্যাবলির চেয়ে কম চমকপ্রদ নয় মূল কাহিনী। কাহিনীর শুরু জনশূন্য এক দ্বীপে। সেখানে এক শিশু। হাই ইবনে ইয়াকজান। শিশুটি এলো কোত্থকে? কোনো জবাব নেই এ প্রশ্নের। অতএব শুরু হয়ে গেল কঠিন বাহাস। বস্তুবাদী দার্শনিক হাই ইবনে ইয়াকজান পড়তে শুরু করে এ জায়গায় এসে মুশকিলে পড়ে যাবেন। বাচ্চাটি কিভাবে জন্ম নিলো? স্বতঃস্ফূর্তভাবে? নাকি কয়েকটি পদার্থের মিশ্রণ ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছল এবং রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে দহন সৃষ্টি হলো, আত্মা জাগল আর বিবর্তনের পরিক্রমায় মানবসন্তান হয়ে উঠল? এভাবেই ভাবলেন কেউ কেউ। ডারউইনের জন্মের শত শত বছর আগে হাই-এর কোনো কোনো পাঠক এমন চিন্তায় তাড়িত হয়েছেন। হাই তাদেরকে বিবর্তনবাদী বানিয়ে ছাড়ত। কিন্তু ভাগ্যটা ডারউইনের! যে গল্পটি তিনি রচনা করে খ্যাতি পাবেন, সেই গল্পের ‘জনক’ তারা হননি কেউ।

কেউ আবার ভেবেছেন উল্টো। সন্তানটি মাতৃগর্ভেই জন্মেছে। পাশের দ্বীপের এক নারী তার মা। আত্মীয় ইয়াকজানের সাথে মহিলাটির বিয়ে হয়। মহিলার ভাই এ বিয়ে সম্পর্কে জানতেন না। তিনি সেই দ্বীপের রাজা। নিজের বোনের জন্য উপযুক্ত কোনো পুরুষ তার চোখে পড়েনি। ভাইটি এক ধরনের মূঢ়তা নিয়েই থাকলেন। বোনটি নিজের প্রতি দায়িত্বহীন হয়ে রইল না। বিয়ে করল। তারপর সন্তান ...। ভাইয়ের ভয়ে এক বাক্সে ভরে বাচ্চাটিকে সাগরে ভাসাল। বাক্সটি ভাসতে ভাসতে এখন এই দ্বীপে। এ হলো রক্ষণশীলদের ব্যাখ্যা।

হাই কাঁদছে। কান্নার আওয়াজে চমকে উঠল এক হরিণী। সে সদ্য হারিয়েছে নিজের শাবককে। মাতৃত্বের ঢেউ তার সত্তায়। স্নেহ কাউকে ঢেলে দেয়ার তৃষ্ণায় সে কাতর। হাইয়ের কান্না শুনে সে তাকে স্তন্য দান করল। মায়ের মতোই সে বাচ্চাটিকে রক্ষা করল দ্বীপের অন্য পশুর হামলা হতে।
শিশুটি বড় হলো। বয়স তার সাত। একদিন সে দেখল মা হরিণী মারা গেছেন। হাই ইতোমধ্যে বন্য পশুদের ভাষা শিখে ফেলেছে। নিজের নগ্নতা উপলব্ধি করে দেহের কিছু অংশ গাছের পাতা দিয়ে ঢাকল। তারপর সে মায়ের মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে বের হবে। এক পর্যায়ে ধারালো পাথর ও শুকনো গাছের ডাল দিয়ে হরিণীর দেহ কাটবে। প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ বিশ্লেষণ করবে।

আবিষ্কার করবে হৃৎপিণ্ডের শূন্য হয়ে যাওয়া বাম কক্ষটি। যেখানে প্রাণ ছিল, যে চলে গেছে। প্রাণের ধর্ম সে খুঁজবে। আগুন দেখবে, উপরে উঠছে। আগুনের প্রকৃতি ও প্রতিক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করবে। একে একে নিরীক্ষণ করবে প্রকৃতির অন্যান্য অংশ। পশু, উদ্ভিদ ও অন্যান্য জড়বস্তুর স্বভাব ও ধর্ম। সে আবিষ্কার করবে পদার্থ ও তার সামগ্রিক বিন্যাস। কারণ, প্রতিক্রিয়া, একক, সংখ্যাধিক্য এবং পৃথিবী, চন্দ্র - সূর্য, গ্রহ- নক্ষত্র সংক্রান্ত জগতের গ্রন্থিসমূহ সে মূলত থাকবে ঐন্দ্রজালিক জন্মতায়। বিশ্বব্যবস্থার খুঁটি-নাটি সে অগম্য থাকতে দেবে না।

এক সময় সে ইন্দ্রিয়গত উপলব্ধির স্তর অতিক্রম করল। ব্যাখ্যার অতীত সত্যকে সব অস্তিত্বের মর্মমূলে ক্রিয়াশীল হিসেবে প্রত্যক্ষ করেন হাই। হাইয়ের এ সফর দর্শন ও বিজ্ঞানচেতনার সূচনাবিন্দু থেকে চরম ঔৎকর্ষ পর্যন্ত মানবতাকে দেয় বোধের আলো। এ আলো নির্মাণ করেছে এক অখণ্ড ভাববলয়। যেখানে প্রতিটি পর্যায়ে উত্তরণের দরজা শেষ পর্যন্ত উন্মুক্ত। এই দরজা দিয়ে পার হলো নতুন বোধ ও জীবনচিন্তার নিরবচ্ছিন্ন পরিব্রাজক। সে যাত্রা করল আরো বেশি মুক্তির দিকে। তার সঙ্গে চলতে লাগল ইউরোপীয় জীবনদৃষ্টি ও সাহিত্য। মধ্যযুগীয় গুহা থেকে আধুনিক, উন্মুক্ত আবহাওয়ায়।

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement