২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
তৃতীয় নয়ন

মাসিক ‘নির্ঝর’

মাসিক ‘নির্ঝর’ - নয়া দিগন্ত

নির্ঝর। ফেনীর একটি বিলুপ্ত সাহিত্য মাসিকের নাম। এখন মফস্বল শহরের নাম শুনলে মনে করা হয়, সেখানকার পত্রিকার নাম কে মনে রাখে? কিন্তু ফেনীর এই সাহিত্য মাসিকটি সারা দেশেই আলোড়ন তুলেছিল। এর সম্পাদক ছিলেন মরহুম গিয়াসউদ্দিন হায়দার, যিনি আমাদের কাছে ‘হুমায়ুন কাকা’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরে গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন এবং ২০১৩ সালের মাঝামাঝি মৃত্যুবরণ করেন। মিরপুর ১১ নম্বরে তার কবর রয়েছে।

ফেনীতে আমার মরহুম বড় ভাই আনোয়ারুল করীম শিশু-কিশোর মাসিক ‘টাপুর টুপুর’ আনতেন আমার জন্য। ‘টাপুর টুপুরে’ যাদের লেখা দেখতাম, তাদের লেখা সাধারণত কচিকাঁচার মেলার পরিচালক দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান সম্পাদিত মাসিক ‘কচি ও কাঁচা’য় দেখা যেত না। তেমনি যারা (কবি ফররুখ আহমদসহ) ‘কচি ও কাঁচা’য় লিখতেন, তারা ‘টাপুরটুপুরে’ সাধারণত লিখতেন না। ফেনীর ‘নির্ঝরে’ও লিখতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের লেখকরা; যেমন- সিলেটের দিলওয়ার, শামসুল করিম কয়েস, চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দিন হায়দার চৌধুরী প্রমুখ। সম্ভবত সিলেটের ‘কয়সর’ নামের কেউ এবং মঈনুল ইসলাম চৌধুরীও লিখতেন মাসিক ‘নির্ঝরে’। এই সাহিত্য মাসিকটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত।

এত বছর আগের কথা মনে নেই সব। আমি তখন স্কুলে নিচের দিকের ক্লাসে পড়ি। কয়েক বছর আগে সিলেটের সাংবাদিক ইকবাল কবিরের সাথে পরিচয় হয় ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে। তিনি জানান, চট্টগ্রামের গিয়াসউদ্দীন চৌধুরীর বাড়ি ভোলায় হলেও তারা চট্টগ্রাম ও সিলেটে থাকেন এবং মরহুম গিয়াসউদ্দীন চৌধুরী তার চাচা। গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রামের একটি কলেজের প্রিন্সিপাল হয়েছিলেন। তিনি কয়েক বছর আগে ইন্তেকাল করেছেন।

এখনো আমার চোখে ভাসে, ফেনীতে আমাদের বাসার পাশ দিয়ে গীতিকবি জাহিদুল হক, সাংবাদিক ও অনুবাদক আখতার-উন-নবী এবং অভিনেতা মুজিব বিন হক (স্বাধীনতার পরে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’ ছায়াছবির নায়ক) এক সঙ্গে হেঁটে যাচ্ছেন মাসিক ‘নির্ঝর’র সম্পাদকের বাড়ির উদ্দেশে। জাহিদুল হক মাত্র দিন কয়েক আগে মারা গেলেন।

আমার সাথে মাসিক ‘নির্ঝর’ পত্রিকার সম্পর্ক সরাসরি থাকার কথা নয়। এই পত্রিকার নিয়মিত লেখক মরহুম মির্জা আবদুল হাইয়ের মাধ্যমেই আমার যোগাযোগ। তিনি তার লেখাটি প্রত্যেক মাসে ছিঁড়ে নিতেন এবং বাকি গোটা পত্রিকা আমাকে দিয়ে দিতেন। তিনি পরে কমিউনিস্ট পার্টির জেলা প্রধান, ‘দৈনিক সংবাদে’র প্রতিনিধি হয়েছিলেন। সেই সুবাদে সোভিয়েত ইউনিয়নেও সফর করে এসেছেন। তিনি থাকতেন আমাদের বাসার কম্পাউন্ডে, মামার বাসায়, যেখানে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ১৯৯০ সালে মাত্র ৫০ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তখন তিনি নাট্য আন্দোলনেও জড়িয়ে পড়েছিলেন। মাসিক ‘নির্ঝরে’ তিনি ধারাবাহিকভাবে উপন্যাস বা নাটক, কিছু একটা লিখতেন।

মাসিক ‘নির্ঝর’ ছাপা হতো নিউজপ্রিন্টে। ৬৪ পৃষ্ঠার ডাবল ডিমাই পত্রিকাটির দাম ছিল ৮ বা ১০ আনা, অর্থাৎ ৫০ পয়সা বা ৬২ পয়সা। এই পত্রিকার কপিগুলো এখন আমার কাছেও নেই। পত্রিকার কপি থাকলে ফেনীর সাহিত্য ইতিহাসের উপরে অনেক কিছু লেখা যেত। কবি দিলওয়ার এবং শামসুল করিম কয়েস তখনো মূলত কবিতাই লিখতেন মাসিক ‘নির্ঝরে’। দিলওয়ার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার ছেলে সাহিত্যিক কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার এবং শাহীন ইবনে দিলওয়ার- এদের একজন মারা গেছেন। তাদের বাড়ি সিলেট শহরের কাছে।

এখনো ভাবি, ফেনীর মতো ছোট শহর থেকে সাহিত্য পত্রিকা বের করার সাহস করেছিলেন এর সম্পাদক। পত্রিকাটি কিন্তু আহামরি গোছের ছিল না। সম্পাদক মরহুম গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী পরে ঢাকা এসে স্থায়ী হন। তার একটি স্টিলের ফার্নিচারের দোকান ছিল ফেনীর ইসলামপুর রোডে। মাসিক ‘নির্ঝর’ সেসময় সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। ফেনী থেকে আর কোনো সাহিত্য মাসিক বর্তমানে নেই। অথচ এই শহরের সমৃদ্ধি ঘটেছে অনেক। সিনেমা হল দু’টির জায়গায় চারটি হয়েছে। কিন্তু গণপাঠাগার দু’টির জায়গায় অর্ধেক হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, মরহুম কবি জাহিদুল হকের বাড়ি ফেনীর কাছাকাছি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের গুণবতীতে এবং তিনি মাসিক ‘নির্ঝর’ পত্রিকায় লেখার সময় ফেনী কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তেন। পরে ‘বাংলাদেশ বেতারে’ যোগ দিয়ে তিনি উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন।


আরো সংবাদ



premium cement