ই-কমার্সের আইনি কাঠামো জরুরি
- রিন্টু আনোয়ার
- ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:১৫
ভালো তথা সম্ভাবনাময় জিনিসও আমাদের দেশে বরবাদ হয়ে যায় প্রতারণা, জালিয়াতি, ঠগবাজির কারণে। জনপ্রিয়তার বদলে পায় জনধিক্কার। উদাহরণের জায়গায় সেখানে উল্লেখ করতে হয় ই-কমার্সের কথা। ই-কমার্সের অর্থ ইলেকট্রনিক বাণিজ্য। জনগণকে বোঝানো বা সচেতন করার আগেই অনেকটা হুট করে দেশে শুরু হয় ব্যবসায়টি। ফলে এ নিয়ে দেখা দেয় মিথস্ক্রিয়া। কারো কাছে মনে হতে থাকে, বিভিন্ন সময় হঠাৎ গজানো অন্য সব ঠগবাজ ব্যবসার মতো। আবার কেউ কেউ এ নিয়ে যথারীতি ঠগবাজিই করেছে। অথচ দেশব্যাপী সচেতনতা তৈরি করলে ই-কমার্স হতে পারে নতুন যুগের বাণিজ্যপদ্ধতি।
দেশে দেশে সব ধরনের পণ্য ঘরে বসে অনলাইনে পাওয়া নিয়ে নিয়মিত চেষ্টা হচ্ছে। বাড়ছে প্রতিযোগিতাও। আমাদের এখানে এ নিয়ে শুরু থেকেই চলছে দ্বন্দ্ব-অবিশ্বাসের দোটানা। এতদিন দেশের একটি বড় সমস্যা ছিল অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক এ পেমেন্ট সিস্টেমের সমাধান করছে। এখন জরুরি দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য কিছুর সহজলভ্যতার জন্য ই-কমার্সের প্রাতিষ্ঠানিকরণ। সবার বোধগম্য করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় আনা। মুখে মুখে বোল না দিয়ে বাংলাদেশকে কার্যকরভাবে ডিজিটাল ও স্মার্ট করতে হলে ই-কমার্সে গুরুত্ব দিতেই হবে। আয়ত্তেও আনতে হবে। আস্থায় তো আনতে হবেই।
ধারণা হিসেবে ই-কমার্স একেবারেই নতুন। জানার-বোঝার ঘাটতির কারণে এ নিয়ে কিছু গোলমাল ঘটছে। বিশেষ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা, স্পেস দেয়ার নামে লুটপাটের সুযোগ করে দেয়া, কোনো ধরনের আইন কিংবা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না আনায় এ অবস্থা হয়েছে। প্রতারিত গ্রাহকদের অভিযোগে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। বেশ কয়েকজন শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে। অনেকেই আবার বাড়তি আয়ের জন্য চাকরির পাশাপাশি অনলাইন ব্যবসায়ও চালিয়ে যাচ্ছেন। না বুঝে এ ব্যবসায় ঢুকে পড়ায় তাদের হাতে মানুষ ঠকছে। কখনো তারা নিজেরাও ঠকছেন। আর মোটামুটি বুঝজ্ঞান নিয়ে শুরু করা অনেকে ভালো আছেন। বর্তমানে বড় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সাথে নতুন উদ্যোক্তারা ওয়েবসাইট খুলে অনলাইনে সেবা ও পণ্য বিক্রির ব্যবসায় শুরু করছেন। অনেকের আবার সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসায় আছে। সব ধরনের পণ্যই এখন অনলাইনে কেনাবেচা হয়। এর মধ্যে পচনশীল ফলমূল-শাকসবজি থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড় ইলেকট্রনিক জিনিসও আছে। সফল অনলাইন উদ্যোক্তা হতে হলে সংশ্লিষ্টদের কিছু বিষয় জানতেই হবে।
পরিকল্পনা নেয়ার সময়ই ভাবতে হবে কী পণ্য বা সেবার ব্যবসায় করবেন। সেটি কোথা থেকে সংগ্রহ করা হবে, কতদিন সেটি চালিয়ে যেতে পারবেন। পরবর্তী ধাপগুলো কী হবে, সে পরিকল্পনা করতে হবে। ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টাও থাকতে হবে। অনলাইনে এখন হাজার হাজার উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে টিকে থাকতে হলে, প্রতিযোগিতায় সফল হতে হলে, ব্যতিক্রমী কিছু করার চেষ্টা করতে হবে। কোনো পণ্য সংগ্রহ করে ছবি তুলেই বিক্রি শুরু না করে বরং সেগুলোয় নতুনত্ব যোগ করতে হবে। ব্যতিক্রমী কিছু নিয়ে আসতে হবে। ই-কমার্স বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেসবুক হোক আর ওয়েবসাইট হোক- ই-কমার্সের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের নাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ অনলাইন জগতে আকর্ষণীয় নাম না হলে মনে রাখতে চায় না। এ ব্যবসায় ফেসবুক একটি বড় মাধ্যম। ফেসবুকে একটি পেজ খুলে ব্যবসায় শুরু করা খুবই সহজ। উদ্যোক্তারা বলছেন, একেবারে শুরুতে ফেসবুকে পাতা খুলে ব্যবসায় শুরু করা যেতে পারে। কারণ এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ খুব কম লাগে। তা ছাড়া অনলাইন ব্যবহারকারীদের প্রায় সবাই ফেসবুক ব্যবহার করায় এখান থেকে গ্রাহক পাওয়া, গ্রাহকদের কাছে নিজের পরিচিতি তুলে ধরা সহজ। ফলে ওয়েবসাইট থাকলেও প্রায় সবারই ফেসবুক পাতা থাকে। ফেসবুকে বুস্টিং, অর্থাৎ নিজের প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দেয়ার মাধ্যমে অপরিচিত মানুষদের কাছে প্রতিষ্ঠানের সংবাদ পৌঁছে দেয়া যায়। বাংলাদেশে প্রায় তিন কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করেন। এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পণ্য বা সেবার তথ্য তুলে ধরা সম্ভব।
এরপর গ্রাহকদের সাড়া পেলে আস্তে আস্তে ওয়েবসাইট নির্মাণ করা যায়। বাংলাদেশে ১৫ হাজার থেকে পাঁচ লাখ টাকার মধ্যে ওয়েবসাইট নির্মাণ সম্ভব। এখানে আইনি বিষয়ও রয়েছে। নিবন্ধনসহ ব্যবসার বৈধতা লাগবেই। বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে যারা পণ্য বা সেবা বিক্রির ব্যবসায় করছেন, তাদের বেশির ভাগেরই কোনো আইনগত নিবন্ধন বা বৈধতা নেই। এমনকি ওয়েবসাইট খোলা, ওয়েবসাইটে ব্যবসায় করা বা ই-কমার্সের ক্ষেত্রে দেশে এখনো কোনো আইন নেই। তবে ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও যারা ই-কমার্স ব্যবসায় স্থায়ী হতে চান, তাদের উচিত অন্তত একটি ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসায় শুরু করা। তাহলে সেই ব্যবসার অন্তত একটি আইনগত বৈধতা তৈরি হয়। এ ছাড়া ব্যাংক অ্যাকাউন্টও জরুরি। ব্যবসায় বড় হলে, অন্য প্রতিষ্ঠানের সাথে লেনদেন করতে হলে ব্যাংক হিসাবের দরকার হবে।
মনে রাখতে হবে, গ্রাহকের কাছে শুধু পণ্যটি বিক্রি করাই শেষ কথা নয়, সেটি প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। পণ্য পৌঁছাতে বিলম্ব হলে গ্রাহক বিরূপ হতে পারেন। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অনেকেই অন্য স্থান থেকে পণ্য সরবরাহ করে সেটি গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দেন। এ ক্ষেত্রে তাদেরও এমন একটি চেইন তৈরি করতে হবে যাতে, তারাও পণ্যটি সঠিক সময়ে হাতে পান। পণ্য সরবরাহের পরে গ্রাহক সন্তুষ্টির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। সরবরাহ করা পণ্য নিয়ে কারো আপত্তি থাকলে তাৎক্ষণিকভাবে ফেরত নেয়া, বিকল্প পণ্য সরবরাহ বা মূল্য ফেরতের ব্যবস্থা থাকতে হবে। নতুন বাজার তৈরির চেষ্টাও থাকতে হবে। পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিত যেটিই হোক দেশ-বিদেশে সব পণ্যেরই বাজার বাড়ছে। তারওপর বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির সম্প্রসারণে গত কয়েক বছরে এমনিতেই ই-কমার্সের বাজার একটি সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছিল, করোনা মহামারীর কারণে এর গতি আরো ত্বরান্বিত হয়। মানুষের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছে চাহিদামাফিক পণ্য। ভোক্তা ও বিক্রেতা উভয়ের প্রয়োজনের তাগিদ এই ক্ষেত্রকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। ই-কমার্স নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনের ঘাটতির সুযোগ নিচ্ছে অনেকে। যে যেভাবে পারছে লুটপাট করছে। এত কিছুর পর এখন পর্যন্ত আইন করা তো দূরের কথা, অনলাইন মার্কেটের সংজ্ঞাই ঠিক করতে পারেনি সরকার। যদিও গত বছর আইন করার কথা জানানো হয়েছিল।
বাস্তবতা হচ্ছে, নানা প্রশ্ন, অবিশ্বাস, অনাস্থার মধ্যেও ই-কমার্সের আওতায় এসেছে প্রায় সব ধরনের পণ্যই। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান শুধু ই-কমার্সের কারণেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রচুর সংখ্যক তরুণ-তরুণী কাজ করছে প্রতিষ্ঠানগুলোতে। পাশাপাশি তৈরি করছে নতুন উদ্যোক্তা। ই-কমার্সের পুরোটাই প্রযুক্তিনির্ভর। এর মধ্যে নানা মন্দ ও বাজে খবরের মধ্যে ভালো খবর হচ্ছে, সরকার ই-কমার্সকে একটি আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছে। বর্তমানে দেশে ই-কমার্স মার্কেট ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৬ সাল নাগাদ ই-মার্কেটের আকার এক লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছবে এমন একটি হিসাব সামনে নিয়ে আইনের খসড়াও প্রায় পাকা করা হয়েছে। এত উদীয়মান এ খাতটির ব্যবসায়িক স্বীকৃতির পাশাপাশি সামাজিক স্বীকৃতি আসবে। মোটকথা, বৈধতার পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণও আসবে- সেই আশা করাই যায়।
সচেতন যেকোনো ব্যক্তিই চাইবে না ব্যবসাটি কেবল শখের বা ঠুনকো ব্যবসায় হিসেবে থাকুক। কিছু মহলের প্রতারণার কারণে এতে অনাস্থা থাকতে পারে। তবে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্যমতে, দেশে ওয়েবভিত্তিক অনলাইন শপ আছে আড়াই থেকে তিন হাজার, আর ফেসবুকভিত্তিক পেজ আছে ৫০ সহ্রাধিক। ফেসবুকভিত্তিক পেজগুলোর বাইরে শুধু ওয়েবসাইটভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গত এক বছরে এক লক্ষাধিক মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। এখন আইনি কাঠামোতে এলে ই-কমার্স নিয়ে ভালো কিছু একটা আশা করাই যায়। বাস্তবতা কখনো অস্বীকার করা যায় না। এখন পাড়ার মুদি দোকান থেকে শুরু করে দেশের বড় শপিংমলগুলোর দোকানদারও অনলাইনে পণ্য বিক্রি করছেন। শহরের ধনী-শিক্ষিত মানুষ থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামের কৃষক-চাষিরাও শিখেছেন এই মাধ্যমে কেনাবেচা। এটি অবশ্যই সময়ের চাহিদা।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা