নতুন মধ্যপ্রাচ্যের বার্তা
- মো: বজলুর রশীদ
- ২৬ জানুয়ারি ২০২৪, ০৭:২৬
মধ্যপ্রাচ্য, আরব বিশ্ব ও এর বাইরে বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তনের ফলে একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য উত্থিত হচ্ছে। নতুন এই বাস্তবতা রূপ নিচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ও দেশটির সাথে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের অংশীদারিত্ব, বিশেষ করে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অবকাঠামো ক্ষেত্রে। এই অঞ্চলে মার্কিন প্রভাব ও স্বার্থ হ্রাস, পাশাপাশি রাশিয়া ও তুরস্কের চ্যালেঞ্জ, যা আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব ও বিষয়গুলোতে আরো দৃঢ় হয়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অর্থনীতির আধুনিকীকরণ ও বৈচিত্র্যকরণ এবং তেল ও গ্যাস রাজস্বের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে তাদের তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য আরো সুযোগ তৈরি করতে চাইছে। এই অঞ্চলের সমাজগুলোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রূপান্তর এখন আরো প্রগতিশীল, বাস্তববাদী ও সহনশীল হয়ে উঠছে। নারী অধিকার, ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং ধর্মীয় শিক্ষা সংস্কারের সমর্থনও এখানে এক ফ্যাক্টর। এই পরিবর্তনগুলো এ অঞ্চল এবং বিশ্বের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ তৈরি করছে। নতুন মধ্যপ্রাচ্য জলবায়ু পরিবর্তন, শান্তি ও সুরক্ষার মতো বৈশ্বিক ইস্যুতে আরো সক্রিয় এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছে। এসব কিছুতে ইসরাইল ও জিওনিজমের প্রসার একটি বড় ফ্যাক্টর। ইসরাইল তাদের মতাদর্শের প্রসার, রাজনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র ও চারটি আরব দেশ ২০২২ সালের মার্চে, নতুন নিরাপত্তা স্থাপত্য তৈরির জন্য শীর্ষ সম্মেলন করেছিল। সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যার পোশাকি নাম ছিল ‘নেজেভ সামিট’। ইয়ার ল্যাপিড, অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন, বাহরাইন, মিসর, মরক্কো ও আমিরাতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে ছিলেন। ২০২০ সালে ট্রাম্পের সময় তিনটি আরব দেশ দখলদার রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। মিসর ১৯৭৯ সালে প্রথম শান্তি চুক্তি করে। ইয়ার ল্যাপিড গোপনে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।
মি. ইয়ার ‘আমাদের অভিন্ন শত্রু’ বোঝাতে ইরান ও তার প্রক্সিগুলোর নাম উল্লেখ করেন। তিনি চেয়েছেন, এই সদস্য দেশগুলো একটি ফোরামের মতো নিয়মিত বসবে। সোজা কথায়, ইরানবিরোধী একটি জোট বোঝাতে চেয়েছেন। তবে কোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি।
ব্লিøঙ্কেন বলেছিলেন, ‘এমন একটি সম্মেলন কয়েক বছর আগে কল্পনা করা অসম্ভব ছিল’। তবে তিনি এটিও বলেছিলেন, এটি ফিলিস্তিনি ইস্যুর কোনো বিকল্প নয়। এ কথায় পরিষ্কার যে, নেজেভ সামিটের ইসরাইল-মার্কিন উদ্দেশ্য হলো ফিলিস্তিন। তবে আরব রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তিনি ইস্যু তুলে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ও পূর্ব জেরুসালেমকে ফিলিস্তিনিদের রাজধানী করার কথা তুলেছিলেন।
দক্ষিণ ইসরাইলের ছোট্ট মরুভূমির শহর বোকারে গোপন সম্মেলনটি হয়েছিল, যে বাড়িতে হয় সেটি ছিল বেন-গুরিয়নের বাড়ি। বাইরে কিছু লোক ব্যানার ধরেছিল যেখানে লেখা ‘কেউ নিখোঁজ নয়’। ফিলিস্তিনিরা এই সম্মেলনের নাম দেয় ‘নেজেভে লজ্জার সম্মেলন’ ‘ফিলিস্তিনিদের পিঠে ছুরিকাঘাত’ ‘ইহুদিরা বর্বর’ ইত্যাদি।
সম্মেলনের আরো একটি উদ্দেশ্য ছিল, ‘আরব-জায়োনিস্ট জোট’ গঠন। যার ফলে ন্যাটো সম্প্রসারিত হবে, ইসরাইল ও আরব রাষ্ট্রগুলো ন্যাটোর আগ্রাসনে অর্থ ও সামরিক শক্তি দিয়ে অংশগ্রহণ করবে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে প্রয়োজনের মুহূর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যাবে, প্রয়োজনে চীনের বিরুদ্ধেও। এই উদ্যেগ পুরো সফল হলে বর্তমান অবস্থা কী দাঁড়াত তা শুধু কল্পনা করা যায়। তাই হামাসের ৭ অক্টোবরের আক্রমণ কৌশলগত দিক দিয়ে যথাযথ ছিল যা ইহুদি ষড়যন্ত্র নস্যাত করতে সক্ষম হয়েছে। সামরিক বিজয়- ভিন্ন ইস্যু।
জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮ নম্বর অধিবেশনে নতুন মধ্যপ্রাচ্যের ধারণার বিষয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু একটি ‘নতুন মধ্যপ্রাচ্যের’ ম্যাপ প্রদর্শন করেছিলেন। জার্মানি তার সমালোচনা করে। নেতানিয়াহু যে মানচিত্র উপস্থাপন করেছেন, সেখানে অধিকৃত পশ্চিমতীর, পূর্ব জেরুসালেম বা গাজা দেখানো হয়নি।
সেই মানচিত্রে ইসরাইলি বন্দর থেকে লোহিত সাগর পথটি বিশেষভাবে চিহ্নিত ছিল। যাতে হাইফা বন্দর থেকে সবধরনের জাহাজ আরব সাগর বা ভারত মহাসাগরে যাতায়াত করতে পারে। হুথিরা যে বর্তমানে জাহাজে আক্রমণ করছে সেগুলোর শিক্ষা তারা এসব উপস্থাপনা থেকেই পেয়েছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।
নেতানিয়াহু চান ইসরাইলের সমালোচনা যেন বন্ধ করা হয়। তিনি মনে করেন, স্বাভাবিকীকরণ চুক্তিগুলো আরব দেশগুলোকে সহযোগিতামূলকভাবে ইসরাইলের কাছাকাছি নিয়ে আসবে। নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘ইসরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে শান্তি একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি করবে’। এসব বিষয় প্রতিষ্ঠা করতে নেতানিয়াহু ও ইসরাইলি কূটনীতিকরা নিয়মিতভাবে জাতিসঙ্ঘের বিরুদ্ধে ইসরাইলবিরোধী এবং ইহুদিবিরোধী পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করে আসছে। ইসরাইল ইহুদিবিদ্বেষকে অপরাধ বলে আইন তৈরি করে তা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে বহুদিন ধরে। নেতানিয়াহু তাদের সব কাজকামের জন্য জাতিসঙ্ঘে দায়মুক্তি চান। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এসব সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
ইসরাইলি সব প্রচেষ্টায় আমেরিকা কিছু অংশে দায়িত্ব পালন করে। মুসলিম বিশ্বকে কাছে টানার ইতিহাস বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেটি বারাক ওবামা প্রসারিত করতে চেষ্টা করেছিলেন। ওবামার ২০০৯ সালের ‘কায়রো ভাষণের’ লক্ষ ছিল আরব দেশ, মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বের সাথে মার্কিন পররাষ্ট্র সম্পর্কের পুনর্গঠন। ওবামার জন্য, মধ্যপ্রাচ্যের সাথে মার্কিন সম্পর্ক পুনর্গঠনের প্রয়োজন ছিল শুধু তার পূর্বসূরিদের ইরাকে বিপর্যয়কর আক্রমণের কারণেই নয়; বরং এই অঞ্চলে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে ক্ষুণœ করার আমেরিকার লজ্জাজনক রেকর্ডের কারণেও। যুক্তরাষ্ট্র তেলআবিবকে বার্ষিক ৩.৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দেয়, এটি রুটিন কাজ। ওবামা জোর দিয়ে বলেছেন, তিনি ফিলিস্তিনকে বহু বছর উপেক্ষা করার পরে মার্কিন অ্যাজেন্ডায় ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার লিখিত ৯০০ পৃষ্ঠার বই ‘এ প্রমিজড ল্যান্ড’ স্মৃতিচারণে এসব কথা লিখেছেন।
এখন ২০২৩-২৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন আঞ্চলিক ব্যবস্থার গঠন এবং অগ্রগতি দৃশ্যত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে ঘটতে শুরু করেছে। হুথিবিরোধী আমিরাত ও রিয়াদ এখন আগের মতো ভোকাল নয়। হুথিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণে সৌদি আরব সমর্থন দিচ্ছে না। তা ছাড়া ইরানপন্থী হামাস, হিজবুল্লাহ এদের বিরুদ্ধেও দু’টি দেশ কোনো কূটনৈতিক বা সামরিক কার্যক্রম নিচ্ছে না। এভাবে মধ্যপ্রাচ্যে আরো যেসব গোষ্ঠী রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কেউ সোচ্চার নয়। তবে তুরস্ক-কুর্দি সমস্যাটি রয়েই গেছে। কুর্দি সমস্যা পুঁজি করে ইরাকের ইরবিলে বিশ্বের বৃহৎ দূতাবাস তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর সেখানেই মোসাদের বড় ঘাঁটি কাজ করছে যেখানে কয়েক দিন আগে মিসাইল আক্রমণ করেছে ইরান। এসব কার্যক্রম মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, কূটনীতি ও যুদ্ধনীতিকে বদলে দিয়েছে বিশেষ করে ৭ অক্টোবর-২০২৩ হামাসের ইসরাইল আক্রমণের পর।
সৌদি আরব দীর্ঘকাল ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে একটি বিশাল ক্ষেত্র দখল করে আছে। রিয়াদ পাকিস্তান এবং পশ্চিমের স্কুল ও প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থায়ন করে থেকে, সেই সাথে সুদান এবং পূর্ব আফ্রিকার অবকাঠামো তৈরিতেও রিয়াদ প্রধান অংশীদার, যার ওপর মুসলিম বিশ্ব এবং অনেক তৃতীয় বিশ্বের দেশ বিভিন্নভাবে নির্ভর করে। দক্ষিণ এশিয়া থেকে উত্তর আফ্রিকার নেতারা সবসময় সঙ্কট ও উন্নয়নে সৌদির দ্বারস্থ হন। এই কাজে কাতার ও আমিরাতের উদ্যোগও কম নয়।
সংযুক্ত আরব আমিরাত আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে খেলোয়াড় হিসেবে জাহির হয়েছে। এ জন্য একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসেবে তার শক্তি সম্পদ এবং মর্যাদা ব্যবহার করছে। আফ্রিকায় প্রচুর বিনিয়োগ করেছে এবং পূর্ব আফ্রিকার বন্দরগুলোতে তার প্রভাব বিস্তার করছে। হাফতার, মোহাম্মদ হামদান দাগালো ও বাশার আল আসাদের মতো ব্যক্তিদের সমর্থন করছে। আবুধাবি বিদেশে প্রক্সিদের অর্থায়নের ক্ষমতা ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য প্রভাব বিস্তার করে থাকে। সৌদি আরব চলমান সিরিয়া সঙ্ঘাত থেকে সরে এসেছে এবং আসাদ সরকারের সাথে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান মধ্যপ্রাচ্যের পুনর্নির্মাণ বিষয়ে ‘যুদ্ধ’ সম্পর্কে পাঁচ বছর আগে বক্তৃতা দিয়ে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মধ্যপ্রাচ্য ‘নতুন ইউরোপ’ হতে পারে। তিনি মূলত অর্থনীতি ও উন্নয়নের বিষয়ে স্মার্ট মেগাসিটি এবং গ্র্যান্ড এন্টারটেইনমেন্ট প্রজেক্ট নিউমের কথা বলছিলেন। কাতার, ওমান, বাহরাইনের বিশেষ করে আমিরাতের নান্দনিক উন্নয়নকে টেক্কা দিয়ে আরো প্রসারিত ও আধুনিক টেক নগর বানানোর মতও প্রকাশ করেছিলেন। তিনি যুদ্ধ ও ধ্বংসের পরিবর্তে শান্তি ও উন্নয়নের মডেল বানানোর মহাসড়কে সফর শুরু করেছেন। তিনি বলেছিলেন কিংডম এবং আশপাশের অঞ্চল ‘পাঁচ বছরে সম্পূর্ণ আলাদা হবে’ এখন দেখা যাচ্ছে, তিনি সঠিক ছিলেন।
রিয়াদ ও আবুধাবি নতুন মধ্যপ্রাচ্যে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সামাজিক উদারীকরণে নেতৃত্ব দিতে চায় এবং একই সাথে শক্তিশালী চীন ও রাশিয়ার সাথে বাস্তবসম্মত ভারসাম্য রাখতে চায়।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা