তাইওয়ানের গণতান্ত্রিক নির্বাচন
- মো: বজলুর রশীদ
- ১৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৪২
দক্ষিণ চীন সাগরকে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে সংযোগকারী গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক প্রবেশপথে অবস্থিত তাইওয়ান একটি পাওয়ার হাউজ। এটি সেমিকন্ডাক্টর শিল্পের আবাসস্থল যা মূল্যবান মাইক্রোচিপ তৈরি করে। বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণশক্তি স্মার্টফোন এবং গাড়ি থেকে শুরু করে ক্ষেপণাস্ত্র পর্যন্ত অনেক উচ্চ প্রযুক্তির ডিভাইসে এই চিপ শক্তি জোগায়। তাইওয়ান বিশ্ব অর্থনীতি ও ভূরাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাইওয়ান ও চীন ১৮০ কিলোমিটার বা ১১০ মাইল প্রশস্ত প্রণালী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। প্রণালীটি ভূকৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
১৩ জানুয়ারি তাইওয়ানে রাষ্ট্রপতি এবং আইনসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। ইউয়ানে ৭৩ আসন, আদিবাসী এলাকায় ছয় আসন, দলীয় ৩৪ আসন নিয়ে আইনসভার ১১৩টি আসন।
প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন ডিপিপি, ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টির প্রার্থী উইলিয়াম লাই। তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করছেন এবং ব্যাপক রাজনৈতিক প্রজ্ঞাসম্পন্ন। তিনি নিজেকে ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার কর্মী’ বলে অভিহিত করেন। তিনি দেশের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেননি, তার মতে- তাইওয়ান ইতোমধ্যে এক সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র, আনুষ্ঠানিক ঘোষণা অপ্রয়োজনীয়। তার দল ডিপিপি চীনের ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’ মডেল প্রত্যাখ্যান করেছে।
বেশির ভাগ জনগণ চীনের সাথে সামরিক সংঘর্ষ এড়িয়ে প্রকৃত স্বাধীনতার রাজনৈতিক স্থিতি বজায় রাখা পছন্দ করেন। যারা তাইওয়ানকে চীনের অংশ হিসেবে দেখেন এবং নামমাত্র একত্রীকরণ সমর্থন করেন তারা প্রার্থীদের জানিয়েছেন, চীন আক্রমণ করবে না এমন কথা তাদের দিতে হবে। চীনাপন্থী ও চীনবিরোধী উভয় শিবিরকে তাদের কড়া বার্তা দেয়া হয়েছে। বাণিজ্য ও বিনিয়োগ যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং অর্থনীতির কোনো ক্ষতি না হয় তারা সেটি নিশ্চিত হতে চেয়েছেন। বাইরের কোনো শক্তি তাইওয়ান প্রণালীতে ঘাঁটি করে কোনো ইউক্রেন, সিরিয়া বা লেবাননে পরিণত না করুক জনগণ তাও প্রত্যাশা করেন।
তাইওয়ানের রাজনীতি ও নির্বাচনে পার্টি এফিলিয়েশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাইওয়ান একটি কর্তৃত্ববাদী একদলীয় রাষ্ট্র থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিকশিত হয়েছে।
ভোটের আগে চেংচি বিশ্ববিদ্যালয় এক জরিপ চালিয়ে দেখেছিল, ডিপিপি প্রায় ৩০ শতাংশ, কেএমটি প্রায় ২০ শতাংশ এবং টিপিপি ১২ শতাংশ ভোটার সমর্থক রয়েছেন। ৪০ শতাংশ ভোটার কোনো পক্ষেই মত দিতে অস্বীকার করেন। এরকম দু’টি জরিপে অর্ধ শতাংশ নিরপেক্ষ দেখানো হয়েছে। ডিপিপি ও কেএমটি স্বতন্ত্র ভোটারদের কাছে আবেদন না করে পার্টি লাইন ব্যবহার করেছেন এবং জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সমর্থক ছিল না।
নির্বাচনী ভোট গণনায় জরিপের অনেক দিক প্রতিফলিত হয়েছে। ডিপিপির লাই ৫.৫ মিলিয়ন বা ৪০.০৫ শতাংশ, কেএমটির হাউ ৪.৬ মিলিয়ন বা ৩৩. ৪৯ শতাংশ, টিপিপির কো ৩.৬ মিলিয়ন বা ২৬.৪৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ২০২০ সালে ডিপিপি ৮.১৭ মিলিয়ন ভোট পেয়েছিল, যা ৫৭.১৩ শতাংশ। কেএমটি ৩৮.১৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। সে তুলনায় এবারের ভোট অনেক কম। নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করে কেএমটির হাই এবং টিপিপির কো ওয়েন উইলিয়াম লাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ডিপিপির জন্য যেটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো আইন সভায় সংখ্যগরিষ্ঠতা হারানো। তাইওয়ানের এক সাংবাদিক বলেছেন, ‘ডিপিপির উইলিয়াম লাই যখন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিচ্ছেন তখন তার পিঠের পেছনে একটি হাত বাঁধা থাকছে।’ জনাব লাই তার ভাষণে সবাইকে দেশের জন্য আইনসভায় এক সাথে কাজ করার আহ্বান জানান।
কেএমটি এবং টিপিপি উভয়ের যৌথ ভোট ৮.২ শতাংশ, যা ডিপিপি অর্জনের চেয়ে ২.৭ শতাংশ বেশি। তাই ডিপিপির আইনসভায় টিকে থাকা কঠিন হবে যদি উভয় দল মিলে যায়। উভয় দলের রাজনৈতিক মতাদর্শে অনেক মিল রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল কেএমটি তো তাইওয়ানের স্বাধীনতারই বিরোধী। এটি চীনের জন্য একটি বড় বিজয়। তবে চীন মনে করেছিল কেএমটি এবার ডিপিপিকে পরাজিত করবে তা না হওয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে তাইওয়ানকে চীনের সাথে সংযুক্তকরণ প্রক্রিয়া অনেক কঠিন হয়ে গেল।
অনেকেই বিশ্লেষণ করেছেন, সামগ্রিকভাবে তাইওয়ানের সামনে কয়েকটি বড় সমস্যা রয়েছে যেমন- চীনের সাথে রাজনৈতিক ও সামরিক ইস্যুগুলো মোকাবেলা, প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা, ২৩ মিলিয়ন জনসংখ্যার স্বাস্থ্যসেবা, পেনশন ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ, কর কমানো। ডিপিপির কর্মদক্ষতা কতটুকু এসব সমস্যা দূরীভূত করতে সক্ষম হবে সে বিষয়ে জনগণের বিরাট অংশ এখন সন্দিহান। ডিপিপির সাই ইং ওয়েনের ১০ বছরের আমলেই এ বিষয়গুলো কঠিন থেকে জটিল হয়ে ওঠে।
পিপলস পার্টি পুরোপুরি চীনপন্থী। তাদের মতে, চীনের ছায়া তাইওয়ানের জন্য মঙ্গল আর কেএমটি বা কুওমিনটাংয়ের নীতি ‘ভারসাম্যে’ নিজের স্বাধীনতা অটুট রেখে চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখায় বিশ্বাসী।
মঙ্গলবার, ৯ জানুয়ারি ২০২৩, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং নির্বাচন লক্ষ্য করে এক ভাষণে বলেন, ‘পুনরেকত্রীকরণ অনিবার্য’। তিনি বলেন, ‘মাতৃভূমি চীন ও তাইওয়ান অবশ্যই একীভূত হবে।’ ইংরেজি বর্ষের শুরুতেও প্রেসিডেন্ট শি অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছিলেন। চীন নিশ্চিত যে, আলোচনায় ‘শান্তির সাথে’ অথবা ‘যুদ্ধের মাধ্যমে’ তাইওয়ানকে যুক্ত করতে হবে। এর মধ্যে যদি কখনো তাইওয়ান স্বাধীনতার ঘোষণা দেয় তবে সাথে সাথেই প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হবে। চীনের সামরিক দফতর বলেছে, এমন কোনো যুদ্ধে আধা ঘণ্টার মধ্যে তাইওয়ান দখল হবে এবং ব্যাপক ধ্বংসলীলার মুখোমুখি হবে দেশটি, যা চীন চায় না।
তাইওয়ানের স্বায়ত্তশাসনের স্টেটাসকে পুঁজি করে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন সময়ে সমরযান, সমরাস্ত্রের জোগান দিচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে এটি চীনকে এক দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে ফেলে আর্থিক ও সামরিকভাবে দুর্বল করার প্রচেষ্টা। যেমনটি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে ব্যবহার। চীনকে দুর্বল করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ান ও ভারতকে ব্যবহার করতে চায়। নির্বাচনের পরপরই বাইডেন, ১৪ জানুয়ারি বলেছেন, ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে না।’ তথাপি বাইডেন ইতোমধ্যে ৮০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কেনার একটি গ্র্যান্ট স্বাক্ষর করেছেন। চীন বলেছে, আমেরিকা স্বাধীন তাইওয়ান ধারণায় বিশ্বাসী নয় এবং এক চীননীতির সমর্থক অথচ সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করছে। তাইওয়ান এরই মধ্যে ১৪ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের আদেশ দিয়েছে। গত ৪০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র এই কাজ করে চলেছে। আমেরিকার করদাতাদের অর্থ দিয়ে ফরেন মিলিটারি ফাইন্যান্স কর্মসূচির আওতায় অর্থ দিয়ে বিভিন্ন দেশকে সহায়তা করছে। যার মধ্যে ইসরাইল ও মিসর রয়েছে।
তাইওয়ানের প্রধান সামরিক অংশীদার বেইজিং এবং ওয়াশিংটন উভয়ই নির্বাচনটি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিল, কারণ দু’টি পরাশক্তি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাবের জন্য লড়াই করছে। এখন তাইওয়ান ইস্যুতে বেইজিং চাপ বাড়াবে এবং আন্তঃরাষ্ট্র উত্তেজনা বাড়তে থাকবে। তেমন পরিস্থিতিতে লাই হয়তো ১৯৯২ সালের ঐকমত্য বা বিকল্প কিছু নিয়ে আন্তঃরাষ্ট্র সংলাপ স্থগিত করবেন, ফলে তাইওয়ান প্রণালীতে উত্তেজনা বাড়বে। তা ছাড়া মি. লাই প্রতিরক্ষা ব্যয় এবং অস্ত্র ক্রয় বাড়ানোর জন্য ডিপিপির প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ভয়ানক চাপের সম্মুখীন হবেন, অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবেন। তাইওয়ানের রিজার্ভ বাহিনী পুনর্গঠিত করার প্রচেষ্টাও বিরোধিতার মুখে পড়বে।
প্রেসিডেন্ট লাই দ্বীপটিকে চীনের ‘ভীতি প্রদর্শন’ থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। নির্বাচনের আগে বেইজিং উইলিয়াম লাইকে ‘গুরুতর বিপদ’ বলে অভিহিত করেছিল। তিনি বিজয় বক্তৃতায় বলেছিলেন, তিনি তাইওয়ান প্রণালীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখবেন এবং চীনা যুদ্ধের হাত থেকে দ্বীপকে রক্ষা করবেন। তিনি বলেন, ‘আমরা তাইওয়ানকে চীনের ক্রমাগত হুমকি ও ভীতি থেকে রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাইওয়ানের ওপর সামরিক চাপ বাড়িয়েছে। চীনা যুদ্ধবিমান এবং নৌজাহাজগুলো তাইওয়ানের প্রতিরক্ষা কাঠামো প্রায় প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করে। চীনের সামরিক বাহিনী নির্বাচনের আগের রাতেই বলেছিল যে তারা ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতার সব প্রচেষ্টা দৃঢ়ভাবে চূর্ণ করার প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা প্রস্তুত করে রেখেছে।’
জনাব লাই নির্বাচনের পর বলেন, ‘নির্বাচন প্রভাবিত করার বহিরাগত শক্তির প্রচেষ্টা সফলভাবে প্রতিহত করা হয়েছে।’ ফলাফল প্রকাশের পরপরই তাইওয়ানে বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ সহ্য করা হবে না মর্মে বেইজিং শনিবার রাতে (১৩ জানুয়ারি) এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে। বেইজিং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তাইওয়ান ডেস্কের কর্মকর্তা চেন বিনহুয়া বলেন, ‘আমরা ১৯৯২ সালের ঐকমত্য মেনে চলব যা এক চীন নীতিকে মূর্ত করে এবং ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা’ এবং বিদেশী হস্তক্ষেপসহ সব বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপের দৃঢ় বিরোধিতা করব।’ তিনি আরো বলেন, ‘এই নির্বাচন আন্তঃপ্রণালী সম্পর্কের মৌলিক ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তন করবে না।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করে যে, ডিপিপি মূলধারার জনমতের প্রতিনিধিত্ব করছে না।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা