২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

লুটেরা গোষ্ঠীর কালো থাবা-৩

লুটেরা গোষ্ঠীর কালো থাবা-৩ - নয়া দিগন্ত

(শেষ কিস্তি)
মুদ্রার বিনিময় হার-নব্য প্রস্তরযুগীয় সিন্ডিকেট
বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের তত্ত্বাবধানে এক ধরনের নব্য প্রস্তরযুগীয় সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। এই সিন্ডিকেটের কাজ হলো; ‘ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার নির্ধারিত করা।’ সদস্য হলো এবিবি (অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস-ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন)। এই সংগঠনের দীর্ঘদিনের সভাপতিকে বলা যেতে পারে একজন তোষামোদকারী ও চাটুকার। তবে মানসম্পন্ন বলা যাবে না। ২০২৩ সালে ব্যাংকগুলোর সিএসআর খাতের ব্যয়ের হিসাব অনুযায়ী এবিবি-এর সদস্য ব্যাংকগুলো ৫৩১ কোটি টাকা দান করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ত্রাণতহবিলে। অথচ এই ব্যাংকগুলোর অনেকগুলো লোকসানে। অন্য সদস্যরা হলো- ব্যাংকার অ্যাসোসিয়েশন (ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সংগঠন) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশন (বিএফইডিএ), যেসব কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা করে তাদের সংগঠন। মোট কথা, বিনিময় হার নির্ধারণ করার দায়িত্ব, বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই এই সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দিয়েছে।

মুদ্রার বিনিময় হারে দেশে যে অরাজকতা চলছে এরকম পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে কোনোকালে ছিল কিনা আমার জানা নেই। আলু বা পেঁয়াজের মূল্য সাধারণ মানুষের জীবনমানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে কথাটা খাঁটি সত্য। তবে এর থেকে খাঁটি সত্য হলো; এই ধরনের সিন্ডিকেট পুরো দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে এবং সবকিছুর দাম বেড়ে যাওয়ার সহায়ক।

ব্যবসায়ী গোষ্ঠী না লুটেরাদের সিন্ডিকেট
আজকাল এই লুটেরা গোষ্ঠীর সাথে যোগ দিয়েছেন দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা। ২০২৩ সালের ১৫ জুলাই তারিখে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ব্যবসায়ী সম্মেলন হয়তো অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ওই সম্মেলনে তাদের স্লোগান ছিল ‘যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়, তাদেরকে রুখে দাঁড়াতে আমরা ব্যবসায়ীরাই যথেষ্ট।’ তা ছাড়া এমন স্লোগানও তাদের মুখ থেকে শোনা গেছে যে ‘শেখ হাসিনার সরকার-বারবার দরকার।’ রাজনৈতিক মিটিং-মিছিলে এগুলো শোনা যায়। ব্যবসায়ী সমাজের জন্য এটা ছিল এক লজ্জাকর পরিস্থিতি ও কলঙ্কজনক অধ্যায়।

শ্যাম রাখি না কুল রাখি : ত্রিশঙ্কু অবস্থা
বাংলাদেশ ব্যাংকের অবস্থাও এখন ব্যবসায়ী সংগঠন বা বিচারব্যবস্থার মতো ত্রিশঙ্কু-‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’। নির্বাচনের নামে প্রহসনের মাধ্যমে অনির্বাচিত দলীয় সরকারের চাটুকারিতা করবে, না আইএমএফ-কে বোঝাবে, না মুদ্রাস্ফীতি সামলাবে। গত কয়েক বছর ধরে মাত্রাতিরিক্ত কাগজের মুদ্রা ছাপিয়ে সরকারকে মাত্রাতিরিক্ত ঋণ দেয়া, ব্যাংকগুলোর সাথে সিন্ডিকেটের সদস্য হয়ে মুদ্রার বিনিময় হারকে কৌশলে বাজারমূল্য থেকে কমিয়ে রাখা, বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা দখল, অনেক বড় অঙ্কের ঋণের নামে ব্যাংক লুট করা, এসবই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্বিক সহযোগিতায় সম্ভব হয়েছে।

মূল্যস্ফীতি দিন দিন বাড়ছে। ডলারের অভাবে দিন দিন আমদানি কমছে। অথচ মাঝে মাঝে এই সিন্ডিকেট টাকার মূল্য ০.২৫ টাকা করে বাড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজেদের আর কত হাসির পাত্র বানাবে? অর্থনীতি না পড়লেও এটা বোঝা সহজ, যে বাজার ব্যবস্থাপনায় এসব অসৎ উদ্দেশ্যমূলক ও অযাচিত কর্মকাণ্ড বা হস্তক্ষেপ, কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের জন্য সামান্য চটক দেখাতে পারলেও, এসবই অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে বা সামষ্টিক অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে।

বিভিন্ন গবেষণার ভিত্তিতে বলা যায়, আউশ ও আমনে কম বৃষ্টি অথবা যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে এই দুই ঋতুতে ধানের ফলন ১০ থেকে ১৫ শতাংশ কমেছে। ফলে চাল আমদানি বাড়াতে হবে। চাল রফতানির ওপর ভারতের শুল্ক আরোপ ও বিদেশে চালের দাম বেড়ে যাওয়াতে এবং একই সাথে ডলার-সঙ্কটের কারণে চাল আমদানি দুরূহ হয়ে পড়বে।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, বাজার ব্যবস্থাপনায় অযাচিত হস্তক্ষেপ, টাকার বিনিময় হারে দ্বিচারিতা, সমাজে নীতিনৈতিকতার অবক্ষয় ইত্যাদি একত্রে মিলেমিশে বিদেশী বিনিয়োগ শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে। তাতে বিদেশের সাথে দায়স্থিতিতে মূলধন হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে; অন্য দিকে রফতানি ও প্রবাসী আয় আশানুরূপ প্রবৃদ্ধি না হওয়া, বিদেশী ঋণের ছাড় কমে যাওয়া এবং সরকারি ও বেসরকারি বিদেশী ঋণ ও সুদ পরিশোধের চাপ বেড়ে যাওয়ায় দায়স্থিতির আর্থিক হিসাবেও ঘাটতি দেখা দিয়েছে।

সবমিলে বাজারে ডলার-সঙ্কট বেড়ে গেছে। বিদেশের সাথে দায়স্থিতিতে (ইধষধহপব ড়ভ চধুসবহঃ), এই তিন হিসাবের একত্রে ও সমানতালে ঘাটতি বাংলাদেশে নিকট অতীতে কখনো দেখা যায়নি।

পরিসংখ্যান নিয়ে ভেল্কিবাজি
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৪৫ বিলিয়ন ডলার। অথচ ডিসেম্বর, ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ২০-২২ বিলিয়ন ডলারে। মেগা প্রকল্প, গরিবের জন্য অতিমাত্রায় দরদ ও বিভিন্ন সুরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গান গাইতে গাইতে অর্থনীতিতে যে আরো বিষয় আছে, যেমন মূল্যস্ফীতি, আমদানি, রফতানি, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য হ্রাস, রাজস্ব ঘাটতি, বাজেট ঘাটতি, অতিমাত্রায় দেশী-বিদেশী ঋণ, বিদেশের সাথে দায়স্থিতির চলতি মূলধন ও আর্থিক হিসাবে ঘাটতি, এসবের কথা ভুলেই গেছেন। প্রতিটি বিষয়ে জনগণকে মিথ্যা পরিসংখ্যান দেয়া এখন আমাদের জাতিগত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তবে ধরা খেয়েছে রিজার্ভের বেলায়।
আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী, দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে। এ দিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে যেই পরিমাণ ডলার প্রয়োজন সেটি মেটানোর জন্য প্রতি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে আনুমানিক এক বিলিয়ন ডলার করে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। অন্য দিকে বর্তমান অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি মিলে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের সুদে-আসলে সাত থেকে ৯ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এর শেষ কোথায়?

অর্থনীতি ও সুশাসন-আইএমএফের পর্যবেক্ষণ
আইএমএফের সাথে চুক্তির আর্টিকেল-৪-এর আওতায় প্রতি বছর আইএমএফ প্রতিটি দেশের সাথে ওই দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও শাসনব্যবস্থা নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা একটা বাধ্যবাধকতা। ২০২২ সালে আলোচনা ও পর্যালোচনাপূর্বক প্রতিবেদন অনুযায়ী আইএমএফ বলেছে যে, ক) বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার জন্য বর্তমানে সহায়ক পরিবেশ নেই। উন্নতি প্রয়োজন; খ) দেশের রফতানিতে উল্লেখযোগ্য কোনো বৈচিত্র্য নেই। বৈচিত্র্য আনতে হবে- গ) বিদেশের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য বাড়াতে হবে। সে জন্য শুল্ক ও অশুল্ক অন্তরায়গুলো কমাতে হবে; ঘ) বাণিজ্যকেন্দ্রিক অবকাঠামোর উন্নয়ন করতে হবে; ঙ) শিল্পকেন্দ্রিক দক্ষতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে; চ) মামলার জট কমাতে হবে; ছ) সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষাজনিত বিধিবিধান ও বাস্তবায়ন, চুক্তির বাস্তবায়ন পদ্ধতি খুব দুর্বল; এগুলোর বাস্তবায়ন জোরদার করতে হবে; জ) বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা বাড়াতে হবে; ঝ) বাণিজ্যিক খাতের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ খুবই দুর্বল; উপরোক্ত সুপারিশগুলো পর্যালোচনা করে দ্রুতগতিতে যথাযথ প্রতিকারের ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানগুলো উল্টো দিকে হাঁটছে। তাই বর্তমান বাস্তবতায় নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, বর্তমান সরকার কর্তৃক এগুলোর কোনোটাই প্রতিকার করা সম্ভব নয়।

শাসনের সূচকে নিম্নগামিতা
একই প্রতিবেদনে সরকার বা প্রশাসনের বেশ কয়েকটি শাখা-প্রশাখার কার্যকারিতার মান নির্ণয় করেছে যেমন- ক) সরকারের কার্যকারিতা; খ) আইনের শাসন; গ) দুর্নীতি দমন; ঘ) বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; ঙ) আইনশৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মান; চ) সম্পত্তির অধিকার সুরক্ষা ইত্যাদির অবস্থা পর্যালোচনা করে বলা হয় যে, আইএমএফের প্রাক্কলন অনুযায়ী সুশাসনের সূচকের ক্ষেত্রে ‘০’ থেকে ‘২.৫’ স্কোরকে ‘ভালো’ বলে নির্ধারণ করা হয়। অন্য দিকে ‘০’ বা শূন্যের নিচে ঋণাত্মক বা মাইনাস ২.৫ পর্যন্ত স্কোরকে দুর্বলতার নির্দেশক হিসেবে গণ্য করা হয়।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, উপরোক্ত সব সূচকেই ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ঋণাত্মক বা মাইনাস ছিল। অর্থাৎ সবগুলো শূন্যেরও নিচে।

সূচকের এই মান, নিম্ন আয়ের দেশ অথবা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকেও খারাপ। অথচ দেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য নেতা, মধ্য আয়ের দেশে উন্নীত হচ্ছে বলে চিৎকার দিচ্ছেন। যতই চিৎকার দেয়া হোক, সত্য হলো- ‘সমাজ ও দেশের অর্থনীতিকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নেয়ার জন্য যে দক্ষতা, সামর্থ্য এবং যে আন্তরিকতা ও অকপটতা প্রয়োজন, তা বর্তমান অকার্যকর সরকার ও দুর্নীতিবাজদের দ্বারা পরিচালিত কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাদের সেই আগ্রহ বা সামর্থ্য কোনোটাই নেই।’

লেখক : সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই


আরো সংবাদ



premium cement