লুটেরা গোষ্ঠীর কালো থাবায় দেশ
- আবদুল আউয়াল মিন্টু
- ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:২৯
বাংলাদেশে আজকাল বহু কিছু ঘটে চলেছে, যা শুধু মূল্যবৃদ্ধি নয় বরং দেশ ও সমাজকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব বিষয়ে কাউকে তেমন কথা বলতে শোনা যায় না।
দেশের বর্তমান রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতির বিভিন্ন বিষয়াবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শাসকদলের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও এখন কোটিপতি। এমনকি ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ের ছাত্র ও যুব নেতারাও কোটিপতি হয়ে গেছে। অনেকের গাড়ি, বাড়ি হয়েছে। অথচ তারা এখনো কর্মজীবনে প্রবেশ করেননি। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে এ গোষ্ঠী শুধু যে নিজেরা সম্পদশালী বনে যাচ্ছে তাই নয়। এদের অনৈতিক কার্যক্রম ও কর্মকাণ্ড দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ ধ্বংস করে দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেও অজানা-অচেনা গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ছেলেবেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যে বাক্যটি প্রতিনিয়ত আমাদের শেখানো হতো, ‘লেখা-পড়া করে যে, গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে’, প্রবাদটি বাংলাদেশের বর্তমান সমাজে আর কার্যকর নেই। তাহলে স্বভাবত মনে প্রশ্ন জাগে; গত দশকে দেশে কি আরো বহুমাত্রিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এর সোজাসাপটা উত্তর অবশ্যই। বর্তমানে সবকিছু এখন বিভিন্ন সিন্ডিকেট সদস্যদের দখলে। তাহলে স্বভাবত প্রশ্ন উঠে, কারা এসব সিন্ডিকেটের সদস্য। কারা এসব সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। চিন্তা করে সময়ের অপচয় করার প্রয়োজন নেই। এদিক-সেদিক একটু তাকালে সহজে উত্তর পেয়ে যাবেন।
বর্তমানে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, জমি দখল, উন্নয়ন প্রকল্প ও সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় বিভিন্ন কার্যক্রম থেকে চুরি, অনৈতিক ও অবৈধ আয়, খাজনা খোঁজা বা হাটে-ঘাটে-মহল্লায় চাঁদাবাজি, অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে যারা লুটপাটের সাথে জড়িত, তাদের প্রায় সবাই শাসকদলের নেতা, সদস্য ও সমর্থক। সেই সাথে আজকাল যোগ হয়েছে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে, তথাকথিত নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং অনির্বাচিত দল ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী বা আমলারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্যও এদের অন্তর্ভুক্ত। গত দশকে বাংলাদেশের একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে রাজধানী শহর পর্যন্ত সর্বত্র এ ধরনের হাজারো গোষ্ঠী (সিন্ডিকেট) জন্মলাভ করেছে।
দুর্নীতি সব দেশে কম-বেশি আছে। বাংলাদেশেও সবসময়, সব সরকারের আমলে ছিল। কিন্তু এমন নির্লজ্জের মতো প্রকাশ্য দিবালোকে ডাকাতি এর আগে আমাদের সমাজে আর কখনো দেখা যায়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বর্তমানে দেশের কর্মকর্তারা (নির্বাচিত, অনির্বাচিত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য) লজ্জাশরমের মাথা খেয়েছেন। দুর্নীতির মাধ্যমে লুটপাটকে ব্যবসা-বাণিজ্যের রীতি ও প্রথা বানিয়ে ফেলেছেন। এসব গোষ্ঠী শুধু যে ব্যবসা-বাণিজ্য অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার করে আছেন তা নয়। তারা একই ধরনের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন দেশের প্রতিটি সাংবিধানিক ও আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অঙ্গনে। ফলে দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো আজ দেউলিয়া হয়ে গেছে। এসব ফাঁক-ফোকরে পড়ে প্রকৃত ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ জপ করতে করতে ব্যবসা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছেন। অনেকে ব্যবসা ছেড়ে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। অনেকে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে চাপা উত্তেজনার পীড়নে অকালে মৃত্যুবরণ করছেন।
এক কথায় বলতে হয়, দেশের অর্থনীতিতে এমন কোনো খাত নেই যেখানে নতুন নতুন সিন্ডিকেট সৃষ্টি হয়নি। উপার্জন অবৈধ, তাই ভ্যাট ও ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া যায়। দিলেও যৎসামান্য। এ গোষ্ঠী বাংলাদেশে বর্তমানে একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এ গোষ্ঠীকে যদি কেউ লুটপাটের সিন্ডিকেট হিসেবে চিহ্নিত করে তাহলে ভুল হবে না। অতএব কেবল তেল, ডিম, পেঁয়াজ ও আলু বিক্রেতাদের সিন্ডিকেটের দোষ দিয়ে কি মূল্যবৃদ্ধি থামানো যাবে? মানুষের দুর্ভোগ কমানো যাবে? আমাদের বিশ্বাস, প্রত্যেক পাঠক এ প্রশ্নের উত্তর জানেন।
রীতি-নীতি-প্রথার বনবাস
এ লুটপাট ও অসাধু প্রতিযোগিতায় কোনো নৈতিকতা, রীতিনীতি, প্রথা বা ব্যবসায়িক মান ও প্রমিতির কোনো বালাই নেই। তাদের কাছে আইন-কানুন কোনো বিষয় নয়। কেননা তাদের অবস্থান ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা ও আশ্রয়-প্রশ্রয়ে। তাদের প্রয়োজনে বা সুবিধার্থে সরকারের সরবরাহ ও সংগ্রহ বিধিমালা বদলানো হয়। পাশাপাশি প্রয়োজনমাফিক বিধিবিধান এড়িয়ে ব্যতিক্রমী কার্যপন্থা নির্ধারণ করতেও তাদের মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হয় না। এমনকি সরকার তাদের সমর্থকগোষ্ঠীকে ব্যবসা দেয়ার জন্য ও ভবিষ্যতে আইনি ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে, নতুন আইন পাস করতেও দ্বিধা করে না। এসব গোষ্ঠী যেসব সরকারি দফতরের সাথে ব্যবসা করে, ওইসব দফতরে বা নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোতে তাদের পছন্দমতো আমলা (কর্মকর্তা) নিয়োগ দিতে পারেন। আবার প্রয়োজন মতো বা চাপের মুখে তাদের বদলও করতে পারেন। একই প্রথা এখন উপজেলা, জেলা ও সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও রীতিনীতি হয়ে গেছে। সবই করা হয় সরকার সমর্থিত বায়বীয় ব্যবসায়ী এবং প্রহসনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও দলবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের অশুভ যোগসাজশে। অতএব বাংলাদেশে জনগণের বর্তমান দুঃখ-দুর্দশা বা দুর্ভোগের জন্য যদি কোনো সিন্ডিকেটকে দায়ী করতে হয়, তাহলে বাস্তবে দায়ী হলো এসব সিন্ডিকেট।
সিন্ডিকেটের থাবা-কোষাগার লুণ্ঠন
গত দশকে সরকারি কেনাকাটা বা সরবরাহের যেকোনো দরপত্র প্রকাশ্যে আসার আগে সরকার সমর্থক সিন্ডিকেটের সদস্যরা একে অপরের সাথে যোগসাজশে গোপন আঁতাত, ষড়যন্ত্র ও সমঝোতার মাধ্যমে ঠিক করে নেন, কোন কাজটি কে করবেন, কত টাকায় করবেন, কত টাকা আত্মসাৎ করবেন এবং কে কত ভাগ পাবেন। এভাবে এ গোষ্ঠী একে অপরের সাথে যোগসাজশের মাধ্যমে সেবা বা পণ্যের মূল্য বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। নির্মাণকাজ, সেবা বা সামাজিক বেষ্টনীর আওতায় সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমও তাদের লুটপাটের হাত থেকে রেহাই পায় না। এ কারণে টেন্ডারের মাধ্যমে হোক বা বিনা টেন্ডারে হোক, সরবরাহ করা পণ্য বা সেবা যা-ই হোক না কেন, এক দিকে এসবের দাম বেশি, আবার অন্য দিকে অত্যন্ত নিম্নমানের। ফ্লাইওভার নির্মাণ থেকে বড় বড় সড়কের কাজ, সেতু থেকে রেলপথ, তেল দ্বারা পরিচালিত ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, গ্রামের রাস্তার মেরামত, শহরগুলোর বর্জ্য অপসারণ, বন্যা ও নদীভাঙন থেকে শহর রক্ষায় নদীশাসন কোনো কিছুই এদের আয়ত্তের বাইরে নেই।
নদীর বাঁধ ও হাওরের বেড়িবাঁধগুলো প্রতি বছর ভেঙেপড়া ও রাস্তাঘাটের বেহাল চেহারা উদাহরণ হিসেবে নিয়ে পাঠক নিজে বর্তমান লুটপাটের প্রকৃত অবস্থা অনুমান করে নিতে পারেন। এগুলোর জন্য কি পেঁয়াজ ও আলু বিক্রেতাদের সিন্ডিকেট দায়ী। খাদ্যপণ্যের বেলায় কোনো একটা পণ্যের দাম বাড়লে, সব ভোক্তা টের পান। বাকি সব পণ্যের দাম বাড়লেও বুঝতে কিছুদিন লেগে যায়। কারো হয়তো বোঝার প্রয়োজন নেই। কারণ ওই পণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। তবে অর্থনীতির এক খাত, অন্য বহু খাতের সাথে জড়িত। তাই এর প্রভাব-প্রক্রিয়ায় তিনি যে ভুক্তভোগী তা কোনো দিন হয়তো বুঝবেনও না। দেশের অর্থনীতিকে কাঠঠোকরা পাখির মতো এ গোষ্ঠী ঠুকরে ঠুকরে গর্ত করে ফেলেছে। গর্ত যত বেশি হয়, গাছ তত দুর্বল হয়। দেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন একই অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
চোরে চোরে মাসতুতো ভাই
লুটপাটের মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্জিত এ অতিরিক্ত অর্থ সবাই মিলে ভাগবাটোয়ারা করে নেন। অন্য দিকে আবার টেন্ডারে প্রাপ্ত কাজের ওয়ার্ক অর্ডার দেখিয়ে এ লুটেরা (সিন্ডিকেট) গোষ্ঠীর সদস্যদের ব্যাংক থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে কোনো সমস্যা নেই। অনেক সময় কাজ শেষ হওয়ার আগে, অর্থাৎ কাজ শেষ না করেও সরকারি কোষাগার থেকে পুরো টাকা উঠিয়ে নিতে কোনো বাধা নেই। পুরো টাকা উঠিয়ে নিলেও এ গোষ্ঠীর সদস্যরা ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণ পরিশোধ করার প্রয়োজন মনে করেন না। অর্থাৎ একই কাজে চার দিকে লুট; প্রথম, বেশি টাকায় টেন্ডার পাওয়া। দ্বিতীয়, কম দামে নিম্নমানের উপাদান ব্যবহার করে নিম্নমানের কাজ। তৃতীয়, ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া। কাজ শেষ। টাকা উঠিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করার তাড়া নেই। অনেকে আবার ঋণ শোধ না করে বিদেশে পাচার করে দেন। পাচার করা টাকা দিয়ে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি কেনেন বা বিনিয়োগ করেন। মোট কথা হলো, এ লুটপাটের টাকা ব্যাংকে ফেরত না দিয়ে বা বিদেশে পাচার করে দেশের আর্থিক খাত ও অর্থনীতিকে ভয়াবহ সঙ্কটের মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
লেখক : সাবেক সভাপতি, এফবিসিসিআই
কৃষি অর্থনীতিবিদ
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা