সুসন্তান
- গোলাম মাওলা রনি
- ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০৬:৩৯
অমিতাভ বচ্চনপুত্র অভিষেক বচ্চনের একটি সাক্ষাৎকার দেখছিলাম কয়েকদিন আগে। আর সেই সাক্ষাৎকার দেখে অঝোরে কেঁদেছিলাম বহুক্ষণ ধরে। কান্না থামার পর নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম, কেন আমি কাঁদলাম! আমি কি আমার পিতার কথা স্মরণ করে কেঁদেছিলাম, নাকি আমার সন্তানদের কথা মনে পড়েছিল অথবা পৃথিবীর তাবৎ পিতা-মাতা ও সন্তানদের মধ্যে যে অনুপম প্রাকৃতিক রসায়ন রয়েছে সেটার কারণে আমার হৃদয়-মন বিগলিত হয়ে চোখে অশ্রুর বন্যা বয়েছিল!
উল্লিখিত প্রশ্নের কোনো জবাব আমি পাইনি; বরং সাক্ষাৎকারটি নিয়ে যখন আমি অধিকতর চিন্তা করতে থাকলাম তখন আবার নতুন করে কান্নার কবলে পড়ে গেলাম। এমনিতেই আমার মধ্যে ন্যাকামির শেষ নেই। মানবিক দোষগুণের কয়েকটি উপকরণ আমার মধ্যে বিধাতা একেবারে অধিক মাত্রায় ঢেলে দিয়েছেন। ফলে কথায় কথায় অভিমান এবং পান থেকে চুন খসলে রেগেমেগে একাকার হয়ে লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে আমি আমার প্রিয়জনদের জীবন যে কতটা দুর্বিষহ করে তুলেছি তা কেবল বিধাতাই বলতে পারবেন। অন্য দিকে, তুচ্ছ ঘটনায় হেসে গড়াগড়ি দেয়া কিংবা কেঁদেকেটে একাকার করার পর আমার যখন হুঁশ হয় তখন নিজের কাছে নিজের পরিচয় সঙ্কট প্রকট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ আমি কি অবোধ শিশু, নাকি ভবঘুরে বৃদ্ধ অথবা সর্বহারা বৈরাগী- তা নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আরেক দফা হাসি-কান্নার সাগরে ডুব দেয়ার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ি।
নিজের সম্পর্কে আপনাদেরকে এত কিছু বলার অর্থ হলো- অভিষেক বচ্চনের সাক্ষাৎকার দেখে কান্নার হেতু আমি আজো আবিষ্কার করতে পারিনি। তাই পুরো ঘটনা আপনাদের না বলা পর্যন্ত আমার পেটের দানাপানি হজম হচ্ছে না। অভিষেকের সাথে তার পিতার সম্পর্ক কেমন তা বোঝানোর জন্য তিনি বলছিলেন যে, ঘটনার সময় তিনি আমেরিকার একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছিলেন। তিনি যখন শৈশব ও কৈশোর পার করছিলেন তখন অমিতাভ বচ্চন খ্যাতি, জনপ্রিয়তা ও অর্থবিত্তের চূড়ান্ত শিখরে ছিলেন এবং নিজের সামর্থ্যরে শ্রেষ্ঠতা দিয়ে একমাত্র পুত্রের শখ-আহলাদ পূর্ণ করার পাশাপাশি তাকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার চেষ্টাও করেছিলেন। ফলে উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠতর শিক্ষার জন্য অভিষেককে আমেরিকায় পাঠানো হয়েছিল।
অমিতাভ বচ্চন-অভিষেক বচ্চনদের মতো পরিবারের সবচেয়ে বড় বিয়োগাত্মক ঘটনা হলো- ছেলেসন্তানদের সাথে পিতা-মাতার বিরাট দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। মিঠুন চক্রবর্তী, শাহরুখ, আমির খানের মতো মেগা-স্টারদের সন্তান-সন্ততি নিয়ে যেমন প্রচুর অভিযোগ রয়েছে, তদ্রƒপ অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস, বিল গেটস, ইলন মাস্ক থেকে শুরু করে ভারতের টাটা-বিড়লা-সিংসালিয়া পরিবারের সন্তান-সন্ততি ও পিতা-মাতার মধ্যকার তিক্ততা আমরা কমবেশি জানি। এসব পরিবারের সন্তান-সন্ততিরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মানোর পর পৃথিবীর যা কিছু কমনীয়, আকর্ষণীয় ও উপাদেয় তা খুব সহজে পেয়ে যান। ফলে সাংসারিক মায়া-দয়া-প্রেম-ভালোবাসা-দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে তারা ইন্দ্রিয় সুখ ও আকাশকুসুম কল্পনার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে পিতা-মাতাকে নিজেদের পথের কাঁটা মনে করতে থাকেন এবং সেটি যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ শেখ সাদী রহ: তার বিখ্যাত ঐতিহাসিক গ্রন্থ গুলিস্তানে বর্ণনা করেছেন।
শেখ সাদী বলেন, পারস্যের এক গ্রামে এক দম্পতি ছিল। বহু বছর ধরে তাদের কোনো সন্তান-সন্ততি হচ্ছিল না। পুরুষটি একটি সন্তান লাভের আশায় ডাক্তার-কবিরাজ-বৈদ্য থেকে শুরু করে ঝাড়-ফুঁক-তাবিজ-কবজ কোনো কিছুই বাদ রাখল না। তার আকুতি দেখে গ্রামের জনৈক প্রবীণ তাকে পরামর্শ দিলো যে, নদীর ধারে একটি তালগাছ রয়েছে। সেখানে গিয়ে যদি ১৭ বছর টানা ইবাদত-বন্দেগি করতে পারে তবে তার পক্ষে সন্তান লাভ সম্ভব। লোকটি সংসার ত্যাগ করে তালগাছ তলায় গিয়ে ১৭ বছর কাটিয়ে তারপর স্ত্রীর কাছে ফিরে এলো এবং কিছু দিন পর সত্যিই একটি পুত্রসন্তানের জনক হলো। ছেলেটি বড় হলো এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়েশাদী করল। তারপর গ্রামের লোকজনের কাছে সেই তালগাছটির সন্ধান জানতে চাইল। লোকজন যখন জানতে চাইল, কেন সে তালগাছের খোঁজ করছে- তখন সে জানাল, তালগাছের তলায় গিয়ে বলবে- তার পিতা যেন অবিলম্বে মারা যায়।
পিতা-পুত্রের সম্পর্কের মধ্যে ভালোবাসার নিম্নগামিতা, শ্রদ্ধা-বিনয় ও কৃতজ্ঞতার উল্টো স্রোত ও সর্বোপরি ধনীর দুলালদের মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির বিপরীতে অমিতাভ বচ্চনপুত্রের অনুভূতি ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। অভিষেক বচ্চন বলেন, আমেরিকা বসে জানতে পারলাম আমার বাবা মহামুসিবতে পড়েছেন। তার আয়-রোজগার বন্ধ। দেনার দায়ে তিনি দেউলিয়া হয়ে পড়েছেন। রাজনীতিতে ব্যর্থতা এবং ব্যবসায়-বাণিজ্যে ধস নামার পাশাপাশি অভিনয় জগত থেকেও তিনি ছিটকে পড়েছিলেন। ফলে এক সীমাহীন দুর্ভোগ-দুর্দশা, অপমান ও মানসিক পীড়ন বচ্চন পরিবারকে অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছিল। ঠিক সেই সময় অভিষেকের মনে হলো- পৃথিবীর অন্য সব কাজের চেয়ে এই মুহূর্তে তার উচিত পিতার পাশে থাকা। তিনি জানেন, পিতাকে কোনো সাহায্যই তিনি করতে পারবেন না। কিন্তু তার মনে হলো যে, বিপদের দিনে তিনি যদি পিতার হাতটি স্পর্শ করেন, একটু জড়িয়ে ধরেন, টুকটাক ফুটফরমায়েশের ওসিলায় তার পাশে ঘুর ঘুর করেন তবে পিতা হয়তো আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবেন এবং বেঁচে থাকার লড়াইয়ে সন্তানের শরীরের গন্ধ ও রক্তের টানকে মহৌষধ হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন।
অভিষেক বচ্চন কাউকে কিছু না বলে বাক্স-পেটরা গুছিয়ে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে আমেরিকার সুখস্বপ্ন পায়ে মাড়িয়ে দুর্দশাগ্রস্ত দেউলিয়া পিতার সামনে উপস্থিত হলেন। পিতা-পুত্রের কোনো কথা হলো না- কিন্তু উভয়ের দৃষ্টি বিনিময়ের মধ্যেই একে অপরের আকুতি টের পেয়ে গেলেন। অভিষেক দিন-রাত ছায়ার মতো পিতার সাথে লেগে থাকেন। রাতে পিতার কামরায় লাইট বন্ধ না হওয়া অবধি তিনি ঘুমান না। আবার সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে অপেক্ষা করেন কখন পিতার ঘুম ভাঙবে এবং তাকে কাছে ডাকবে। এভাবেই কেটে গেল কয়েকটি মাস।
এক রাতে অভিষেক দেখলেন তার পিতা লাইব্রেরিতে বসে গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন এবং মাঝে মধ্যে হাঁটাহাঁটি করে কিছু একটা চিন্তা করছেন। ঘড়িতে যখন রাত ২টা বাজল ঠিক তখন অমিতাভ ইন্টারকম করে অভিষেককে নিজের কামরায় আসতে বললেন। সন্তানের চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, অনেক চেষ্টা করলাম, অনেক ভাবলাম ও অনেক পড়াশোনা করে বিকল্প চেষ্টা করলাম। কিন্তু যতই চেষ্টা করছি ততই নিত্যনতুন ব্যর্থতার রেকর্ড বাড়ছে এবং নতুন করে ঋণভারে জর্জরিত হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছি। আমার জীবনের উপর্যুপরি ব্যর্থতা কিভাবে কাটানো সম্ভব তার একটি সূত্র এই মাত্র পেলাম এবং তা নিয়ে তোমার সাথে পরামর্শের জন্য তোমাকে এত রাতে ডেকেছি।
অমিতাভ বললেন, মানুষ যখন সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয় তখন তাকে শিকড়ের কাছে ফিরে আসতে হয়, যাকে ইংরেজিতে বলে ইধংরপ ঢ়ড়ংরঃরড়হ অথবা রুট অফ দ্য ক্যারিয়ার। আমার ক্যারিয়ারের রুট বা বেসিক হলো অভিনয়। সুতরাং একমাত্র অভিনয়ের মাধ্যমেই আর্থিক সঙ্কট কাটানো সম্ভব। পিতা-পুত্রের গভীর রাতের আলোচনা শেষ হলো। পরদিন তারা ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থা যশরাজ ফিল্মসের কর্ণধার ইয়াস চোপড়ার সাথে দেখা করেন যিনি অমিতাভের ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিলেন। পুরো ঘটনা শুনে ইয়াস চোপড়া তার মেধাবী সুপুত্র আদিত্য চোপড়াকে ডেকে পাঠান। আদিত্য ভারতীয় সিনেমার প্রধানতম সফল কাহিনীকার ও পরিচালক। তিনি আদিত্যকে অতি দ্রুত একটি চিত্রনাট্য রচনা করতে বলেন, যেখানে বয়স ও চরিত্রগত দিক থেকে অমিতাভ হবেন প্রধান ব্যক্তি এবং তাকে কেন্দ্র করেই সিনেমার গল্প আবর্তিত হবে। পিতার নির্দেশ পেয়ে আদিত্য অতি দ্রুত একটি চিত্রনাট্য দাঁড় করিয়ে ফেলেন ও পুরোদমে সিনেমার শুটিং শুরু করে দেন এবং ২০০০ সালে ভারতবর্ষকে উপহার দেন দুনিয়া কাঁপানো ব্লক বাস্টার সিনেমা মোহাব্বাতেন। ওই সিনেমায় সফলতার পর অমিতাভকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এবং সেই কাহিনী অমিতাভ বচ্চনপুত্র অভিষেকের মুখে শোনার পর আমি কেন অশ্রুসিক্ত হয়েছিলাম- সে বিষয়ে মন্তব্য করার ভার সম্মানিত পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা