০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও আইসিসি

ইসরাইলের যুদ্ধাপরাধ ও আইসিসি - ফাইল ছবি

হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) ফিলিস্তিনে নৃশংতার জন্য ইসরাইলের ৩০০ জন সামরিক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুদ্ধাপরাধের বিচারের মুখোমুখি হতে পারে এমন এক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছিল ইসরাইলের হারেজ পত্রিকায়। ২০১৪ সালে গাজা উপত্যকা ও পশ্চিম তীরে তেলআবিব যে অমানবিক যুদ্ধাপরাধ করে এর তদন্তের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি বিচারের টেবিলে ওঠে। তালিকায় প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেনি গ্যান্টজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন। সেটি সুরাহা হওয়ার আগেই ২০২৩-২৪ সালের গাজা যুদ্ধের গণহত্যা ও নির্যাতন আগের সব অপরাধকে ছাড়িয়ে যায়।

ইসরাইল আইসিসিকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং আইসিসির সদস্য দেশ না হওয়ায় তাদেরও ইসরাইলের কর্মকাণ্ডের তদন্তের কোনো এখতিয়ার নেই বলে অধিকাংশ জাতিসঙ্ঘের সদস্য দেশ বলে থাকে। ৩ মার্চ ২০১৪ সালের আইসিসির তদন্তের উদ্যোগে ইসরাইল নিন্দা জানিয়েছে। তারা জানায় যুদ্ধাপরাধের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করার আন্তর্জাতিক আদালতের সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। বিষয়টি ইহুদি বিদ্বেষের মধ্যে পড়ে, তা অগ্রহণীয়।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধের সময়কালসহ ফিলিস্তিনি অঞ্চলে কথিত যুদ্ধাপরাধের একটি আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে। তদন্তটি ২০১৪ সালের জুন থেকে ইসরাইল-অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুসালেম এবং গাজা স্ট্রিপের ঘটনাগুলোকে কভার করবে। আইসিসির প্রসিকিউটর, ফাতু বেনসুদা বলেছেন, এই সিদ্ধান্তটি প্রায় পাঁচ বছর স্থায়ী একটি ‘শ্রমসাধ্য প্রাথমিক পরীক্ষা’ অনুসরণ করে। তিনি বলেছিলেন, তদন্ত ‘স্বাধীনভাবে, নিরপেক্ষভাবে ও বস্তুনিষ্ঠভাবে, ভয় বা পক্ষপাত ছাড়াই’ পরিচালিত হবে। যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং গণহত্যার বিষয়ে আইসিসির এখতিয়ার রয়েছে।

ফিলিস্তিন ২০১৫ সালে এই সংস্থায় যোগ দেয়, কিন্তু ইসরাইল সদস্য না হয়ে আদালতের কর্তৃত্ব প্রত্যাখ্যান করে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তদন্তকে ‘ইহুদি বিরোধিতা ও ভণ্ডামির প্রতীক’ বলে নিন্দা করেছেন। অধিকন্তু আদালতকে ইরান ও সিরিয়ার দ্বারা সংঘটিত ‘প্রকৃত যুদ্ধাপরাধ’ উপেক্ষা করার জন্য অভিযুক্ত করে বলেছেন ‘আমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে ন্যায়বিচারের এই বিকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই হবে’। আদালত কর্তৃক তদন্ত করা সম্ভাব্য অপরাধগুলোর মধ্যে রয়েছে : ক. ২০১৮ সালে গাজায় ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ইসরাইলি বাহিনীর অসামঞ্জস্যপূর্ণ শক্তির ব্যবহার, যাতে ২০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা এবং হাজার হাজার লোককে আহত করা হয়। খ. ২০১৪ এবং ২০২১ সালে সশস্ত্র গোষ্ঠীর রকেট হামলায় বেসামরিক লোকদের হতাহত করা, গ. পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলি বসতি নির্মাণ, যা আন্তর্জাতিক আইনে অবৈধ বলে বিবেচিত। ঘ. পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ধ্বংস করা এবং ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের জোরপূর্বক স্থানান্তর। ঙ. ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনি উভয় কর্তৃপক্ষের দ্বারা বন্দীদের নির্যাতন ও দুর্ব্যবহার। ২০১৪, ২০১৮, ২০২১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও নির্যাতনের তদন্ত এখন শুরু হচ্ছে তাহলে চলতি ভয়াবহ গাজা যুদ্ধের তদন্ত বা বিচারপর্ব শুরু বা শেষ হতে কয় যুগের প্রয়োজন তা পাঠকরা অনুমান করতে পারেন। বিশ্বের অনেক বড় বড় বিশ্লেষক এই দু’টি আদালতের কার্যক্রমকে ‘ভণ্ডামি’ বলে অভিহিত করেন।

আইসিসির কিছু সমালোচক পক্ষপাতিত্ব ও অদক্ষতার জন্য এবং কিছু সমর্থক পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের হাতিয়ার হিসেবে অভিযুক্ত। আদালত দোষী সাব্যস্ত করতে এবং গ্রেফতারি পরোয়ানা কার্যকর করতেও হিমশিম খেয়েছে, বিশেষ করে শক্তিশালী বা সুরক্ষিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে। যাই হোক, আইসিসির তদন্তকে অনেক ফিলিস্তিনি ইসরাইলি দখলদারিত্বের অধীনে অধিকার লঙ্ঘনের জন্য ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহি চাওয়ার একটি বিরল সুযোগ হিসেবে দেখে। এটিকে কিছু মানবাধিকার কর্মী বিশ্বের অন্যতম জটিল দ্বন্দ্বে কয়েক দশক ধরে বিরাজমান দায়মুক্তিকে চ্যালেঞ্জ করার উপায় হিসেবেও দেখেন।
গাজা যুদ্ধের কারণে যুদ্ধাপরাধ এবং গণহত্যার অভিযোগ মোকাবেলা ও তদন্ত করার জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) মতো আন্তর্জাতিক আইনি সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততার আন্দোলন জোরদার হয়েছে।

দক্ষিণ আফ্রিকা গাজায় ‘গণহত্যা’ করার অভিযোগ এনে আইসিজেতে ইসরাইলের বিরুদ্ধে মামলা করেছে যা শুনানির জন্য নির্ধারিত। আমরা অনেকেই কনফিউজড, কেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত না হয়ে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এই বিচার না মানলে সংস্থার কতটুকুইবা করার আছে। পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হলে নেতানিয়াহু গংদের বিরুদ্ধে কেন পরোয়ানা নয়! দক্ষিণ আফ্রিকা ফিলিস্তিনিদের জন্য মামলা করলেও কোনো আরব দেশ এগিয়ে না আসায় লজ্জাও বিশ্লেষণ করার মতো ঘটনা। একটি দেশ মামলা করলে অন্য সদস্য দেশ মামলা করতে পারবে না এমন কোনো ধারাও বিধিবদ্ধ নেই। তবে কেন এই নীরবতা!

আইসিজে-কে বিশ্ব আদালতও বলা হয়, এটি জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ আদালত এবং এটিকে তার ‘প্রধান বিচারিক অঙ্গ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জাতিসঙ্ঘের সনদ দ্বারা ১৯৪৫ সালের জুনে এটি প্রতিষ্ঠিত এবং ১৯৪৬ সালের এপ্রিল থেকে কাজ শুরু করে। এটি একটি সিভিল কোর্ট যা ব্যক্তি ব্যতীত দেশগুলোর ভেতরকার বিরোধ নিষ্পত্তি করে।

ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগ শুরু হয় ১৪ মে, ১৯৪৮ ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে। এত দিন এই দু’টি আদালতের কী কাজ ছিল? ৭০ বছর নির্যাতনের জন্য এদের ভূমিকাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট অনেকবারে বলেছেন, জাতিসঙ্ঘ ছেড়ে আরেকটি বিশ্বসভা প্রতিষ্ঠা করা উচিত।

আইসিসি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত, বিশ্বের একমাত্র স্থায়ী আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত হিসেবে সংজ্ঞায়িত। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং আগ্রাসনের অপরাধের মতো চারটি অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও বিচার করতে পারে। এটি রোম সংবিধি নামে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। আইসিসি, তার ওয়েবসাইটে, এটিকে ‘শেষ অবলম্বনের আদালত’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ১৫ জন বিচারক নিয়ে গঠিত। একজন রাষ্ট্রপতি, একজন ভাইস প্রেসিডেন্ট, যারা জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদ দ্বারা নির্বাচিত। ৯ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়ে বিচারকরা পুনরায় নির্বাচনের যোগ্য। অন্য দিকে অপরাধ আদালতের (আইসিসি) বিচারক সংখ্যা ১৮ জন, যারা সদস্যরাষ্ট্র দ্বারা নির্বাচিত। আদালত প্রসিকিউটর অফিসের মাধ্যমে মামলাগুলোর তদন্ত পরিচালনা করে।

আইসিসির ১২৩ সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও ইসরাইল আইসিসির সদস্য নয়। আইসিসি ১ জুলাই ২০০২ বা তার পরে সংঘটিত অপরাধগুলো খতিয়ে দেখে, যেদিন এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আইসিজে তার দফতরের হিসাব অনুসারে ১৯০টির বেশি মামলা রয়েছে। ১৯৮৬ সালের নিকারাগুয়া বনাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি উল্লেখযোগ্য মামলায় রায় দেয় যে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করেছে এবং নিকারাগুয়া সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন করেছে। অনুরূপভাবে আইসিজে ২০২১ সালে সোমালিয়া এবং কেনিয়ার মধ্যে বিরোধীয় সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দেয়।

আইসিসির আদালতে ৩১টি মামলা রয়েছে, বিচারকরা ৪০টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অভিযুক্তরা বেশির ভাগ আফ্রিকান দেশের। ২১ জনকে আইসিসি ডিটেনশন সেন্টারে আটক করা হয়েছে। ১৫ জন পলাতক রয়েছে, সাত জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ বাদ দেয়া হয়েছে তাদের মৃত্যুর কারণে। ২০২৩ সালে পুতিনের বিরুদ্ধে একটি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। রাশিয়া এটি মানছে না; বরং বলেছে তারা আইসিসির এখতিয়ার স্বীকার করে না।

দক্ষিণ আফ্রিকার ২৯ ডিসেম্বরের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হেগে শুনানি শুরু হচ্ছে ১২ জানুয়ারি। বিচারকের আসনে অন্যান্যের মধ্যে একজন থাকবেন যিনি গাজা হামলার মুখ্য সমর্থক। ১১ বছর ধরে তিনি, আহারনবারাক (৮৭) ইসরাইলের পক্ষে কাজ করে আসছেন। নেতানিয়াহু এমন একজন পক্ষপাতদুষ্ট মানুষকে আদালতে পাঠালেন যিনি মনে করেন, শিশুরা যদি নিহত হয়- তা হতেই পারে। ২০০৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে নিজেই এটি অনুমোদন করেছিলেন! উল্লেখ্য, গত বছর ২০২৩ সালের ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ, বলিভিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কমোরোস ও জিবুতি ফিলিস্তিনের অবস্থা তদন্ত করার জন্য আইসিসিতে অনুরোধ জানিয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ, আইসিসির নিষ্ক্রিয়তা ও দ্বৈত মানদণ্ডের আলোকে আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা দায়ের বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন নেতৃত্বাধীন ইসরাইলকেন্দ্রিক ভণ্ডামি, জাতিসঙ্ঘ ও আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থাকে শুধু উপহাসই করে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ও অপরাধ আদালতের অর্জন খুবই সামান্য।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement