২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ড. ইউনূসের সাজা ও জাতির দুর্ভাগ্য

ড. ইউনূসের সাজা ও জাতির দুর্ভাগ্য - নয়া দিগন্ত

১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে ধাবিত। সদ্য স্বাধীন দেশের আর্থসামাজিক গতিপ্রকৃতি কী হবে তা নিয়ে ছিল না কোনো সুস্পষ্ট পথরেখা। এমন একটি সঙ্কটের স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ও সরকারের অভ্যন্তরে অনেকেই সচেষ্ট ছিলেন। বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদও এগিয়ে এসেছিলেন একটি সুস্পষ্ট গতিশীল ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টায়। তবে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তাদেরকে অর্থনীতির মূল স্র্রোতে সাধারণ জনগণকে অংশীজনরূপে হাজির করার কর্মসূচি কারো ধারণায় তেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি।

এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত ব্যতিক্রম হিসেবে আবির্ভূত হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে প্রত্যন্ত গ্রামীণ সমাজে ছড়িয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা নেয়ার সাথে সাথে অর্থনীতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইলেন- বাংলার নারীদের ক্ষমতায়নের অবরুদ্ধ দুয়ার খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে প্রথম ও প্রধান নায়করূপে।

এটি সর্বজনীন সত্য যে, ক্ষমতায়নের সাথে আর্থিক সক্ষমতা ও মালিকানার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূস ক্ষমতায়নের তাত্ত্বিক ধারণাকে ব্যবহারিক প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নারীর আর্থসামাজিক অবস্থানকে স্বাধীন করেছেন, স্বতন্ত্র করেছেন ও অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকে নারীর অবস্থান চিহ্নিত করেছেন। গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ছিল তার বর্ণিত পরিকল্পনার এক মূর্ত প্রকাশ।
অস্বীকার করার প্রশ্নই ওঠে না যে, গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মহিলাদের মধ্যে বিতরণের ফলে আর্থসামাজিক চিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। নারী আবির্ভূত হয়েছে অগ্রগতির চালিকাশক্তি রূপে। প্রায় পাঁচ দশক ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণদান কর্মসূচি দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে গুণগত উন্নয়ন ঘটিয়েছে। নারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের সম্পৃক্ত করেছে। এ প্রক্রিয়ার চূড়ান্ত পর্যায়ে তাদের ক্ষুদ্রঋণ দিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করেছে।

আমি এখানে গ্রামীণ ব্যাংক গড়ে তোলার একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরতে চাই। গত শতকের সাত দশকের মাঝামাঝি ড. মুহাম্মদ ইউনূস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন। পাহাড়ের কোলে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়টির চারপাশে সমতল গ্রামাঞ্চল। এসব গ্রাম প্রধানত কৃষিভিত্তিক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে এমনই একটি গ্রাম জোবরা। ওই জোবরা গ্রামে অধ্যাপক ইউনূস একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প গ্রহণ করেন। প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য ছিল- কী উপায়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধি করে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সূচনা করা যায় এবং কিভাবে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটানো যায়। বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এর আগে সাধারণত গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রাতিষ্ঠানিক ঋণলাভের সুযোগ পায়নি। কোনো কোনো ব্যাংক যেমন- কৃষি ব্যাংক বা কোনো কোনো বাণিজ্যিক ব্যাংক কৃষিঋণ কিংবা অন্য ধরনের ঋণ দিলেও ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষিদের জন্য এমন কোনো ঋণদান ব্যবস্থা কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ছিল না। ব্যাংকের প্রচলিত নিয়মনীতির মধ্যে এমন কোনো ব্যবস্থাও ছিল না যাতে করে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ঋণ গ্রহণ করতে পারে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হলে ব্যাংকে জামানত দিতে হয়। কোনো ধরনের জামানত দেয়ার সাধ্য ভূমিহীন, প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের ছিল না।

অধ্যাপক ইউনূসের আগে কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বা পরার্থপর চিন্তককারীরা গ্রামীণ অধস্তন, হতদরিদ্র, কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রায় নিঃস্ব জনগণের উন্নতির কথা চিন্তা করলেও আমরা কোনো ফলপ্রসূ ধারণা বা উদ্যোগ দেখিনি। বলা প্রয়োজন, গণমুখী গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তোলার বাধা অতিক্রম করা সহজসাধ্য নয়; কেননা বাংলাদেশের শ্রেণিবিভক্ত সমাজে প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে থাকে গ্রামীণ ধনিক শ্রেণী। আর্থিক ও অপরাপর ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ ও কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করে এই শ্রেণী। অপর দিকে, শোষণ ও বঞ্চনার স্থবির শৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে গ্রামীণ অধস্তন শ্রেণী তথা দরিদ্র জনগোষ্ঠী।

বিদ্যমান এই আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ড. ইউনূস জোবরা গ্রামে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখলেন, গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করলে সেই ঋণ বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতায় ব্যবহৃত হয়। গ্রামীণ দরিদ্রদের আয় বৃদ্ধি পায়। সবচেয়ে বড় কথা, গ্রামের ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধ করতে পারে। অর্থাৎ, এ পর্যন্ত প্রচলিত ঋণ প্রদান কর্মসূচির বিপরীতে তিনি এক যুগান্তকারী ঋণ প্রদান পদ্ধতির পরিকল্পনা করলেন। ড. ইউনূস জোবরা গ্রামে পরিচালিত তার পরীক্ষামূলক কর্মসূচিতে প্রমাণ করলেন, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শর্তহীন ঋণ প্রদানে কোনো ঝুঁকি নেই। তিনি আরো দেখতে পেলেন, আর্থিক সহায়তা পেলে গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সৃষ্টি করতে পার।
জোবরা গ্রামের পরীক্ষামূলক গবেষণা দারিদ্র্যবিমোচনে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে। এখানে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন। অধ্যাপক ইউনূস এর আগে স্থানীয় সরকারের গ্রামপর্যায়ে গ্রাম-সরকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র শ্রেণী ও পেশার মানুষের উন্নয়নের একটি মডেল প্রণয়ন করেছিলেন। ওই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য ছিল গ্রামের অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাভোগী ও বঞ্চিত বিভিন্ন শ্রেণী ও জনগোষ্ঠীকে সংগঠিত করে সমবায় পদ্ধতিতে গ্রামসরকার গঠন করা। এই পরিকল্পনায় সমবায়-ভাবনা এবং তৃণমূল পর্যায়ে পরিকল্পনা প্রণয়নের নীতি প্রাধান্য পেয়েছিল। পরিকল্পিত গ্রামসরকার ধারণা তিনি জোবরা গ্রামে তেভাগা প্রকল্পের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন এবং ওই পরীক্ষণের ভিত্তিতে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

শুরুতে অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রকল্প হিসেবে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্রমেই গ্রামীণ ব্যাংকের কার্যক্রম সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঋণ দেয়ার পাশাপাশি ঋণগ্রহীতাদের প্রশিক্ষণ ও তাদের উদ্বুদ্ধকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে গ্রামীণ ব্যাংক। এ উদ্যোগ অভূতপূর্ব সাফল্যের সূচনা করে। নারীর ক্ষমতায়নে গ্রামীণ ব্যাংক হয়ে ওঠে প্রধান চালিকাশক্তি। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ড. ইউনূস। তিনি বঞ্চিত নারীদের কেবল মর্যাদা ও শান্তি প্রদান করেননি, আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার দুয়ার অবারিত করে দিয়েছেন।

অধ্যাপক ইউনূস আজ বিশ্বনন্দিত। নোবেল কমিটি শান্তি পুরস্কার দিয়ে তার অবদানের প্রতি শ্রদ্ধাবনত সম্মান দেখিয়েছে। এ জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে এ দেশের একজন নাগরিক হিসেবে অহঙ্কার বোধ করি।

ড. ইউনূস একটি দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মহতী অভিযাত্রাকে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছেন। তার কর্মপ্রয়াসের ফল হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে সামাজিক প্রগতি ও স্থিতিশীলতার ধারা। আমি বিশ^াস করি, ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ- এ দু’টি অর্জন আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ।

একবার আমার সুযোগ হয়েছিল তার গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মসূচি প্রত্যক্ষ করার। আমার সাথে ছিলেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান মিয়া ও ড. ইব্রাহিম। সেটি ছিল একটি সমাবেশ। অধ্যাপক ইউনূস সেই বিশাল বড় সমাবেশে যে ভাষণ দেন তা আমি আজো গভীরভাবে স্মরণ করি। সেই ভাষণ ছিল নিপীড়িত, বঞ্চিত, ভাগ্যাহত দরিদ্র মানুষকে জাগিয়ে তোলার, অনুপ্রাণিত ও উদ্বুদ্ধ করার এক আশ্চর্য জাদুমন্ত্র।

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আট ও নয় দশকে অধ্যাপক ড. ইউনূসের সাথে একটি কমিটিতে একসাথে কাজ করার। এটি ছিল বিজ্ঞান ‘গণশিক্ষাকেন্দ্র’ নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। ড. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ওই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক। এ ছাড়াও ১৯৯১ সালে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গঠিত কয়েকটি টাস্কফোর্সের মধ্যে একটিতে আমি সদস্য ছিলাম। টাস্কফোর্সটি ছিল গ্রাম উন্নয়ন-সম্পর্কিত এবং অধ্যাপক ইউনূস ছিলেন এর প্রধান।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস চিন্তা-চেতনা, আদর্শ এবং জীবনভাবনার ক্ষেত্রে ছিলেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ও দ্বিধাহীন। একবার কোনো লক্ষ্য স্থির করলে তিনি সেই লক্ষ্যের প্রতি অবিচল থাকেন। তিনি সন্দেহাতীতভাবে এক মহান দেশপ্রেমিক। এখানেই তার সাহস ও শক্তি পুঞ্জীভূত।
তার উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসায় আজ বিশ্বের বহু দেশে বহু প্রতিষ্ঠানে চালু হয়েছে। এর সুফল লাভ করছে বিশ্বের বিপুল সংখ্যক মেহনতী মানুষ। গ্রামীণ ব্যাংক মডেল যেমন অনেক দেশে দারিদ্র্যবিমোচনে ভূমিকা রাখছে, তেমনি সামাজিক ব্যবসায় ও অধস্তন শ্রেণীর সামাজিক উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখছে। তার ‘তিন শূন্যের’ ধারণা বাস্তবায়িত হলে, বিশ্ব হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত এবং সুন্দর পৃথিবী হবে দূষণমুক্ত ও বাসযোগ্য।

তবে সাম্প্রতিককালে ড. ইউনূস তার স্বদেশ ভূমিতে অপমানিত, লাঞ্ছিত ও বিভিন্ন চক্রান্তের শিকার। এক অশুভ শক্তি তাকে নিগৃহীত করার ঘৃণ্য চক্রান্তে মত্ত। এই স্বার্থান্বেষী মহল গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তাকে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তা ও উৎপীড়ন করছে। তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বারবার তাকে আঘাত করেছে। বিশ্বাসী অবাক বিস্ময়ে এটি লক্ষ করেছে এবং এর থেকে বিরত থাকতে স্বার্থান্বেষী মহলকে অনুরোধ জানিয়েছে। বিশ্ববরেণ্য অনেক ব্যক্তি এর নিন্দা করেছেন। কিন্তু বিশ^বিবেককে উপেক্ষা করে সর্বশেষ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে এক হাস্যকর মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। তিনি নিজেই বলেছেন, যে অপরাধ আমি করিনি, তার জন্য শাস্তি পেলাম। এটিকে কি বিচার বলতে পারেন? আদালতের এই রায়ে সারা দেশ ও জাতি বিস্মিত, বিস্মিত বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ।

এই ঘটনায় আমি অত্যন্ত বিচলিত ও মর্মাহত। দেশের কোটি কোটি নাগরিক একই বেদনা অনুভব করছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, বিনাদোষে যে শাস্তি হয় তা কখনো চিরস্থায়ী হতে পারে না। ন্যায় ও সত্যের বিজয় অনিবার্য। ড. মুহাম্মদ ইউনূস আবার স্বমহিমায় দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর কাছে আরো নন্দিত হয়ে উঠবেন- এ কামনাই করি।


আরো সংবাদ



premium cement