২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
অন্য দৃষ্টি

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করছে কে

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করছে কে - ফাইল ছবি

একটি দেশে কত মানুষ আকাঙ্ক্ষিত সেটি মানুষ নির্ধারণ করতে পারেনি। জাপান ও ইতালির মতো সবচেয়ে আধুনিক দেশগুলো এসব ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে। একসময়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের ওপর অত্যধিক জোর দিয়েছে তারা। মাত্র কয়েক যুগের ব্যবধানে ১৮০ ডিগ্রি উল্টো তাদের অধিক সন্তান নেয়ার জন্য জোর দিতে হচ্ছে। পরিবারে কতজন মানুষ হলে পরিবেশটি সবচেয়ে ভালো হবে তার সঠিক নির্ণয় এখনো নেই। এ ব্যাপারে যেই পাণ্ডিত্য কিছু বিশেষজ্ঞ দেখিয়েছেন অল্প কিছু সময়ের ব্যবধানে সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। খাদ্য উৎপাদনের বিষয়টি মাথায় নিয়ে জনসংখ্যার আকার নির্ধারণ করতে চেয়েছিল তারা। এ পর্যায়ে এসে খাদ্য উৎপাদন ও জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি সম্পর্কহীন মনে হচ্ছে। মানব বংশধারা টিকে থাকা ও এর বিকাশ কোনোভাবেই মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল নয়, এ বিষয়টিও সামনে এসেছে।

১৮০০ সালে বৈশ্বিক জনসংখ্যা প্রথম ১০০ কোটি ছাড়ায়। আরো ১২৭ বছর লেগেছে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হতে। আর মাত্র ৮৪ বছরের ব্যবধানে ২০১১ সালে তা সাড়ে তিনগুণ বেড়ে ৭০০ কোটি ছাড়িয়ে যায়। ১৯০০ সালের পর মানুষ নিজেদের বংশবিস্তার রোধে প্রথম আদাজল খেয়ে লেগে যায়। মানবেতিহাসের অন্য কোনো সময় সামষ্টিকভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণের এমন প্রবণতা দেখা যায়নি। এটি আসলে মানুষের চরম স্বার্থপরতাকে প্রকাশ করে দিয়েছে। একজন মানুষ কখনো জন্মের ব্যাপারে নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে না। পৃথিবীতে কোনো মানুষই কখন জন্মাবে সেটি নিজে ঠিক করতে পারেনি। কিন্তু বিগত শতাব্দীর মানুষরা প্রথম বাধা দিতে শুরু করল নতুন মানুষের আগমন। এটিকে হয়তো তারা একটি বোঝাই নৌকার সাথে তুলনা করতে চেয়েছে । তারা আশঙ্কা করেছে ওই নৌকায় উঠলে ঝড়ের কবলে সবাই ডুবে মরবে। কিংবা এমনিতেই অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাইয়ের কারণে ডুবে যাবে নৌকা। বিগত দুই শতাব্দীর মানুষের বংশ বিস্তারের বিষয়টি যাচাই করলে এমন আশঙ্কার ভিত্তি পাওয়া যাবে না।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কঠিন প্রবণতা সত্ত্বেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে। ২০২৪ সাল শুরু হওয়ার আগেই জনসংখ্যা আরো ১০০ কোটি বেড়ে পৃথিবীর বুকে এখন সর্বোচ্চ ৮০০ কোটির বেশি মানুষ বাস করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিষ্ঠান সেনসাস ব্যুরো ও জাতিসঙ্ঘের প্রণীত হিসাবের মধ্যে কিছুটা তফাত থাকলেও উভয় রিপোর্ট বলছে- বিশ্বজনসংখ্যা এখন ৮০০ কোটির বেশি। জাপান ও ইতালির মতো দেশগুলো জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে যতটা গলদঘর্ম হয়েছে এখন তারা একইভাবে জনসংখ্যা বাড়াতে উদ্যোগ নিচ্ছে। তাদের জন্য হাতশার বিষয় হচ্ছে- জন্ম নিয়ন্ত্রণে যতটা উৎসাহিত করতে পেরেছে নিজেদের জনগণকে সেভাবে শিশুসন্তান নিতে ততটা আগ্রহী করে তুলতে পারছে না।

জাপানের জনসংখ্যা টানা কমে ২০২৩ সালে ২০০০ সালের নিচে নেমেছে। এর প্রাথমিক অসুবিধা হচ্ছে তরুণদের সংখ্যা দ্রুত কমছে বিপরীতে বাড়ছে বৃদ্ধদের সংখ্যা। আনুপাতিক হারে জাপানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধরা বসবাস করেন। গত বছরের শুরুতে দেশটিতে ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৩০ লাখ। একই অবস্থা ইউরোপের ধনী দেশগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। যারা বিগত শতাব্দীর মাঝামাঝিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণে উৎসাহিত করেছিল। এখন তাদের সবাইকে শঙ্কায় ধরেছে প্রজন্ম বিলুপ্ত হওয়ার। এই প্রবণতা বাড়তে বাড়তে একটা সময় গিয়ে কেউ আর সন্তান নিতে চাইবে না। ধনী দেশগুলোতে জীবন অনেক কঠিন করা হয়েছে। তারা শুধু বৈষয়িক উন্নতিকে জীবন মাপার একমাত্র মানদণ্ড বানিয়েছে। ভালো খাওয়া, ভালো পরা ও সুন্দর বাড়িতে বসবাস তাদের জীবনের লক্ষ্য হয়ে গেছে। এর সাথে বিনোদনকে দিয়েছে সর্বাধিক প্রাধান্য। এ জন্য দরকার হয় পর্যাপ্ত আয়। জীবনের একটা মান বজায় রাখতে গিয়ে তাদের জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। সন্তান জন্মদানকে তারা ভীতিকর মনে করে। এর লালন-পালনের ঝক্কি-ঝামেলা ও খরচের দিকটিকে তারা সবচেয়ে বড় করে দেখছে।

গত কিছু দিন আগে জাপানে একটি প্রত্যন্ত গ্রামে এক শিশুর জন্মদান আন্তর্জাতিক মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কারণ হচ্ছে, ২৫ বছর ধরে ওই গ্রামে নতুন মানবশিশুর আগমন হয়নি। গ্রামশুদ্ধ মানুষ তাকে বরণ করতে তার বাড়িতে হাজির হয়। জনসংখ্যা বাড়ানোর জন্য জাপান এখন যারপরনাই চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিটি শিশুর জন্মের পর অভিভাবককে চার লাখ ২০ হাজার ইয়েন দেয়া হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে টানা চার বছর দেশটির জনসংখ্যা কমছে। এই প্রণোদনা এখন পাঁচ লাখ ইয়েন করা হয়েছে। এরপরও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দম্পতিরা সন্তান জন্ম দিতে আগ্রহী হবে না। তাদের প্রজন্ম রক্ষা করতে হলে বিদেশীদের জন্য অভিবাসনের দুয়ার খুলে দিতে হবে।

নতুন বিশ্বশক্তি চীনের প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে যাচ্ছে জনসংখ্যার কারণে। দেশটিতে দ্রুত প্রবীণের সংখ্যা বাড়ছে। বৈশ্বিক পরাশক্তি হওয়ার পথে চীনের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে জনসংখ্যার ঘাটতি । দেশটি তাদের আগের জনসংখ্যা নীতি থেকে সরে এসেছে। ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জনসংখ্যা-সংক্রান্ত ধারণা পাল্টে গেল। ১৮০০ সালের চেয়ে এখন পৃথিবীতে আটগুণ মানুষ বসবাস করে। মানুষ আশঙ্কা করেছিল, খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে মানবজাতি। বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন এই সময়ের মধ্যে নিশ্চয়ই আটগুণের বেশি বেড়েছে। ২০০ বছর আগের তুলনায় সব দিক দিয়ে মানুষের বস্তুগত উপায়-উপকরণ বেড়েছে। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, বস্তুগত জৌলুস বাড়লেও মানুষের মৌলিক মানবিক শক্তি ও গুণ কমে গেছে। জনসংখ্যা ভাবনা আরো একটি বিষয় সামনে আনে, পৃথিবীতে কত মানুষ থাকবে সেটি মানুষের চেয়ে অন্য কেউ একজন বেশি ভাবছেন। যিনি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ও সর্বাধিক বুদ্ধি-কৌশলের অধিকারী।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement