০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ফিলিস্তিনিরা কেন সিনাই যাবে

ফিলিস্তিনিরা কেন সিনাই যাবে - ফাইল ছবি

ইসরাইল চায় হাজার হাজার ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুকে সিনাই মরুভূমিতে পাঠিয়ে দিতে। মিসর মনে করে, এত বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনিকে তাদের বাড়িঘর থেকে উৎখাত করাটা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং মিসরের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। সে জন্য গাজার রাফা সীমান্তে সামরিক শক্তি বাড়িয়েছে। ফিলিস্তিনিরা ও কিছু আরব দেশ আশঙ্কা করছে যে, গাজাবাসী সিনাই চলে গেলে আর কখনো তাদের বাড়িতে ফিরতে দেয়া হবে না। ইতোমধ্যে ছয় লাখ গাজাবাসী উত্তর থেকে ও গাজার বিভিন্ন বিধ্বস্ত এলাকা থেকে উত্তরে রাফা এলাকা ও মিসর সীমান্তে পৌঁছেছে।

হামাস গাজার তলদেশে জটিল টানেল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। মাকড়সার জালের মতো এই টানেল উত্তরে ইসরাইল ও দক্ষিণে মিসরীয় সীমান্তের সাথে সংযোগ স্থাপন করা যায়। এটিকে নামকরণ করা হয়েছে মেট্রো। ইসরাইল মেট্রো ধ্বংস করার জন্য আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নির্মূল করতে আমেরিকার সর্বাধুনিক অস্ত্র ব্যবহার করছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা টানেল ব্যবহার করেছে, ইসরাইলি সেনারা কিছু টানেল ধ্বংসও করেছে কিন্তু হামাস যে এত জটিল, বড় ও প্রশস্ত টানেল বানাবে সেটি ভাবতে পারেনি।

আজ এতদিন যুদ্ধের পর বিশ্লেষকরা একমত যে, যুদ্ধে ইতোমধ্যে হামাস বিজয়ী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র শুরুতেই রণতরী পাঠিয়েছে, সেনা পাঠিয়েছে, অস্ত্র পাঠিয়েছে হামাসের বিরুদ্ধে- তারপরও শক্ত প্রশিক্ষিত ইসরাইলি সেনারা স্বল্প প্রশিক্ষিত বা যুদ্ধ সম্পর্কে অজ্ঞ ফিলিস্তিনি যারা এতদিন শুধু পাথর মেরে যুদ্ধ করেছে তাদের সাথে কোনো মতেই কুলাতে পারছে না। আমেরিকার সহায়তা তা হলে কী হলো? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাকে একই ধরনের সামরিক কৌশল কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। আসলে নিজ দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত যোদ্ধা ও ভাড়াটে বা উদ্দেশ্যহীন যুদ্ধ এক কাতারে ফেলা যায় না।

এটি কোনো গোপন বিষয় নয় যে, অন্তত অর্ধশতাব্দী ধরে, ইসরাইল বলে আসছে যে, মিসর গাজা স্ট্রিপের দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এটি তেলআবিব ও কায়রোর মধ্যে একটি বোঝাপড়া বা সমঝোতা। পশ্চিমতীর নিয়েও জর্দানের সাথে বোঝাপড়া রয়েছে, চুক্তিও রয়েছে। এমনকি জেরুসালেমের আলআকসা নিয়েও সমঝোতা রয়েছে। জেরুসালেম,গাজা স্ট্রিপ ও ১৯৬৭ সালের সীমানা বরাবর একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের যে স্বপ্ন তা নির্বাপিত হয়ে গেছে। এগুলো এমন এক সময় হলো যখন মিসর বা জর্দানের মূলত কিছুই করার নেই। তারপরও উভয় দেশ ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে মধ্যস্থতা বা দূতিয়ালি করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে টিকে আছে।

ইসরাইল পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে গাজার জনসংখ্যার অর্ধেক বা ১০ লাখ গাজাবাসীকে উত্তর থেকে দক্ষিণে সরিয়ে নেয়ার কাজ চালু রেখেছে। মানে এতগুলো মানুষ মিসরের উপর অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চাপ সৃষ্টি করবে। মিসর চেয়েছে এদের গাজায় রাখতে ইসরাইল চায় সিনাই এলাকায় পাঠাতে। মিসরীয় সাধারণ লোকজনও পছন্দ করছে না গাজা থেকে লোকজন সিনাই আসুক। মিসরের অনেক বুদ্ধিজীবী প্রস্তাব করেছেন, ইসরাইল ইচ্ছা করলে দক্ষিণ ইসরাইলের পাহাড়ি খোলা এলাকা নেজেভে গাজাবাসীদের রাখতে পারে।
নেগেভ বা নেজেভ দক্ষিণ ইসরাইলের একটি বৃহৎ মরুভূমি অঞ্চল। এর প্রধান শহর তেল বিরশেভা। এখানে পুরোনো শহরটি নেজেভ মিউজিয়াম অব আর্ট, সমসাময়িক ইসরাইলি ও আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আবাসস্থল। কাছে রয়েছে আব্রাহামস ওয়েল, একটি সাংস্কৃতিককেন্দ্র যেখানে ইবরাহিম আ:-এর বিবিধ কাহিনীর ইন্টারেক্টিভ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা রয়েছে। শহরের পূর্বদিকে, বিরশেবার ধ্বংসাবশেষসহ একটি প্রাগৈতিহাসিক বসতি টিলা, পাশাপাশি মরুভূমির দৃশ্যসহ একটি লুকআউট টাওয়ার রয়েছে। নেজেভ আশদোদ থেকে ইলাত পর্যন্ত প্রায় ১৪ হাজার ৪৭৫ বর্গকিলোমিটার ইসরাইল রাষ্ট্রের ৬০ শতাংশ। নেজেভ ইসরাইলের অর্ধেকেরও বেশি ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত এবং দেশটির জনসংখ্যার মাত্র ১৩ শতাংশ সেখানে বাস করে। বিরশেবা দক্ষিণ ইসরাইলের নেজেভ মরুভূমির বৃহত্তম শহর।

তেল বিরশেবা প্রকৃতপক্ষে একটি খুব পুরোনো শহর ছয় হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদ্যমান। উসমানীয় তুর্কি শাসনের অধীনে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এটি নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানে প্রধান উৎপাদনের মধ্যে রয়েছে রাসায়নিক দ্রব্য, মূলত মৃতসাগরের খনিজ উপাদান প্রক্রিয়াকরণ, চীনামাটির ও টাইলসপণ্য এবং টেক্সটাইল। বিরশেবা বেনগুরিয়ন ইউনিভার্সিটি অব দ্য নেজেভ (১৯৬৫) এবং নেগেভ ইনস্টিটিউট ফর অ্যারিড জোন রিসার্চের সাইট। বিরশেবার সাথে শেভার রানীর সম্পর্ক রয়েছে।

শেবার রানী ছিলেন একজন ধনী রানী যিনি ইথিওপিয়া বা ইয়েমেনের কোথাও থাকতেন বলে মনে করা হয়। তিনি ইসলাম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি ধর্মের পবিত্র গ্রন্থগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তিনি অপরিসীম সম্পদ ও প্রজ্ঞার জন্য এবং রাজা সুলাইমান আ:-এর প্রজ্ঞাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য সর্বাধিক বিখ্যাত হন। রানী শেবাকে স্থানীয়ভাবে বিলকিস বা বিলিকিসু নামেও ডাকা হতো। বিশ্বাস করা হয় যে, বিলিকিসু নিঃসন্তান বিধবা ছিলেন, তার সাথে সবসময় প্রচুর ক্রীতদাসদাসী থাকত। সুলাইমান আ: তাকে বিয়ে করেছিলেন মর্মে বর্ণিত রয়েছে। রাজা সুলাইমান আ:-এর প্রথম স্ত্রী ছিলেন নামাহ। তার ৭০০ রাজকীয় স্ত্রী ও ৩০০ উপপত্নী ছিল বলে ইহুদিদের বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়।

প্রায় ৯২ লাখ ৪০ হাজার ১৫৬ জন ইহুদি নিয়ে, ইসরাইল একমাত্র ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং একমাত্র ইহুদি রাষ্ট্র। ইসরাইলের দক্ষিণ নেজেভ মরুভূমিতে ৭০ হাজার লোকের বসবাস, সম্মিলিত জনসংখ্যার বড় বড় ৪৫টি বেদুইন গ্রাম রয়েছে, তারা সবাই ইসরাইল রাষ্ট্রের নাগরিক। বিরশেবা, নেজেভ মরুভূমির রাজধানী। এখানে ১০ লাখ গাজাবাসীকে সাময়িক থাকার বন্দোবস্ত করা যেতে পারে। ব্লিঙ্কেন বলেছেন, গাজাবাসীদের জন্য একটি তাঁবুর শহর গড়ে তোলা দরকার। পরে তিনি অবশ্য বলেছেন পাকা বাড়ির কথা। পাকা বাড়ি বা তাঁবু বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বিদ্যুৎ, খাবার, চিকিৎসা ও ওষুধপত্র এবং রাতে ঘুমানোর মতো নিরাপত্তা। পঙ্গু ও অর্ধমৃত শিশুসহ সবার জরুরি চিকিৎসা।

গত নভেম্বরে আলজেরিয়ার পার্লামেন্ট সর্বসম্মতিক্রমে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে দখলদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট আবদেল মাজিদ তেবাউনকে ক্ষমতা দেয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবের একটি থিংক ট্যাংক গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি যুদ্ধ অবসানের পরিকল্পনা হিসেবে হামাসের নেতাদের আলজেরিয়ায় নির্বাসিত করার একটি রূপরেখা প্রকাশ করেছে। কাতার ও ইরানের সাথে আলজেরিয়ার সুসম্পর্ক এবং হামাস আন্দোলনের প্রধান সমর্থক ও হামাস নেতাদের কার্যকলাপ তদারক করার মতো নিরাপত্তা সক্ষমতা আলজেরিয়ার থাকায় দেশটির নাম সুপারিশ করা হয় বলে জানা যায়। রূপরেখায় গাজায় জাতিসঙ্ঘ ম্যান্ডেটের আওতায় আরব শান্তিরক্ষীবাহিনী মোতায়েনের কথাও বলা হয়েছে।

ইসরাইলের গোয়েন্দা মন্ত্রী গিলা গামালিয়ার নথি থেকে জানা যায়, গাজা বাসিন্দাদের মিসরের সিনাই উপত্যকায় স্থানান্তরের কথা রয়েছে এবং সেভাবেই ইসরাইল গাজাকে মানবশূন্য করার কাজ বা পোড়ামাটির নীতি গ্রহণ করেছে। এদিকে মিসরের নাজুক অর্থনীতি দিন দিন আরো নাজুক হচ্ছে। মিসর গম ও তেল আমদানি-নির্ভর এক দেশ। বিশ্বব্যাংক মিসর থেকে অনেক অর্থ পায়। বর্তমানে ঋণের পরিমাণ ১৬৪ বিলিয়ন ডলারের উপর। এর একটি বড় অংশ আরব আমিরাত থেকে বাকি অংশ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর। ইসরাইল এ সুযোগ নিয়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ ও অন্যান্য সংস্থা মিসর থেকে যে অর্থ পায় তার দায় নিতে ইচ্ছুক। এ বছরের মাত্র কয়েক দিন বাকি, এরই মধ্যে মিসরকে আইএমএফকে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। মিসর বা সিসি এই প্রস্তাবে রাজি হলে সিনাই গাজাবাসীদের জন্য খুলে দেয়া হবে। মিসর ১১ কোটি মানুষের দেশ, সিনাইয়ের বিরাট উপত্যকায় ১০ লাখ মানুষকে স্থানান্তরিত করতে জমির অভাব হচ্ছে না, তবে ব্লুমবার্গের মতে, মিসর ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, ঋণ শোধ করার মতো কোনো অবস্থা তার নেই। সেদিক দিয়ে ইউক্রেনের পরই মিসরের স্থান। তাই মিসরকে আন্তর্জাতিক চাপ সহ্য করতে হয়।

এদিকে ইসরাইল থেকেও অনেকে চলে গেছেন ও যাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র মার্কিন নাগরিক ও তাদের পরিবার সদস্যদের হাইফা বন্দর থেকে জাহাজে সাইপ্রাসে নিয়ে যাচ্ছে। সংবাদে আরো জানা যায়, তাদের সাথে হাজারো ইসরাইলি নাগরিকও একটি স্যুটকেস নিয়ে চলে যাচ্ছে। জাহাজে কত জন যাচ্ছে তার কোনো হিসাব মার্কিন দূতাবাস দেয়নি। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এর মধ্যে ১০ লাখের ওপর ইসরাইলি নাগরিক দেশ ছেড়েছে।
গাজাবাসীদের জন্য ভিটাভূমি ত্যাগ করা কোনো নতুন বিষয় নয়। গাজাবাসী তাদের পূর্বপুরুষদের বেদনাদায়ক নির্বাসনে আতঙ্কিত। গাজার অনেক বাসিন্দাই ১৯৪৮ সালে ইসরাইল সৃষ্টির পর তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা ফিলিস্তিনিদের বংশধর। গাজাবাসীরা বলে, উদ্বাস্তু হওয়ার চেয়ে নিজের বাড়িতে মৃত্যুবরণ করা শ্রেয়। বোমার আঘাতের চেয়েও নির্বাসন ভয়ঙ্কর।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার
নিউম টাওয়ার, বান্দরবান পার্বত্য জেলা


আরো সংবাদ



premium cement