ইসির এখতিয়ার এবং অসার তর্জন-গর্জন
- ড. আবদুল লতিফ মাসুম
- ২৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৫:২৫
মানুষ জন্মগতভাবেই কিছু অধিকার ধারণ করে। মানুষ হিসেবে জীবন ধারণ, লালন-পালন ও বিকাশ, এসব অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এসব অধিকারকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রথমত, মৌলিক অধিকার। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক অধিকার। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক অধিকার ও চতুর্থত, সামাজিক অধিকার। এ ছাড়াও মানুষের অধিকারের পরিসর অনেক বিস্তৃত। যে সমাজ যত উন্নত, সে সমাজে অধিকার ততই ব্যাপক। তবে উন্নত অনুন্নত ব্যতিরেকে কিছু অধিকারকে রাষ্ট্র, সমাজ ও বিশে^ অপরিহার্য, আবশ্যিক ও প্রাকৃতিক বলে বর্ণনা করা হয়। এগুলোকেই মৌলিক অধিকার বলে বিবেচনা করা হয়।
এই মৌলিক অধিকার সংবিধান, রাষ্ট্র ও আইন দ্বারা স্বীকৃত, অনুমোদিত ও সংরক্ষিত। জীবনের জন্য অপরিহার্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা যেমন মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত, তেমনি স্বীকৃত মানবাধিকার। মানুষ হিসেবে যে অধিকারগুলো জন্ম থেকেই মানুষ স্বাভাবিকভাবেই ধারণ করে সেগুলোই মানবাধিকার। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বলেছে, ‘ব্যক্তি মানবজীবনে যেসব সুবিধা ভোগের দাবিদার হয় এবং যা ছাড়া তার ব্যক্তিত্ব বিকশিত হয় না সেগুলোই মানবাধিকার।’ রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানী এস পি হান্টিংটনের মতে- ‘The human rights are inherent, producing equal opportunity, makes the humanity a perfect one that never feels dissatisfy at their achievement.’এ সংজ্ঞার মর্মার্থ হলো- মানবাধিকার সহজাত, সমতা নিশ্চিতকরণ ও মানবিকতা পূরণের প্রতিশ্রুতি। জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার সনদে বলা হয়েছে- ‘সকল মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন, সমঅধিকার ও সমমর্যাদাসম্পন্ন।’ ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসঙ্ঘ ঘোষণাপত্রে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা দেয়া হয়। এই অধিকার বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব রাষ্ট্র অনুমোদন করে। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করা রাষ্ট্র ও সরকারের জন্য বাধ্যতামূলক। পৃথিবীর সব সংবিধানে মানবাধিকার সংরক্ষিত আছে। তাই সরকার এসব অধিকারে বাধা দিতে পারে না।
বাংলাদেশের সংবিধানে মানবাধিকারের ব্যাপক স্বীকৃতি রয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগ ‘মৌলিক অধিকার’ অনুসারে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেক বাংলাদেশী স্বতঃসিদ্ধভাবে কিছু মৌলিক অধিকারের মালিক। মৌলিক অধিকারের শুরুতেই ২৬ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী পূর্বেকার সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। মৌলিক অধিকার শারীরিক ও মানসিক সীমানা সঙ্কোচনকারী কৃত্রিম বাধা অতিক্রম করে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ নিশ্চিত করে নাগরিকদের জীবন মর্যাদাপূর্ণ করে। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম রক্ষাকবচ। সংবিধানের চতুর্থ পরিচ্ছেদের ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে মৌলিক অধিকার বলবৎ করার এখতিয়ার দিয়েছে।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে প্রত্যেক বাংলাদেশীর মৌলিক অধিকার ১৮টি। ৩৬ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, আইন মোতাবেক বাংলাদেশের সর্বত্র অবাধ চলাফেরা, এর যেকোনো স্থানে বসবাস ও বসতি স্থাপন এবং বাংলাদেশ ত্যাগ ও বাংলাদেশে পুনঃপ্রবেশ করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। ৩৭ নং অনুচ্ছেদ মোতাবেক, আইনসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হওয়ার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। ৩৮ নং অনুচ্ছেদ বলে যে, আইনসাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। ৩৯ নং অনুচ্ছেদ অনুসারে, বাংলাদেশের নাগরিকদের চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছে। প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার পাশাপাশি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিয়েছে। যদি কোনো কারণে মৌলিক অধিকার থেকে কেউ বঞ্চিত হয়, তাহলে এ ক্ষেত্রে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংবিধানের ১০২ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করার অধিকার রয়েছে।
মানবাধিকারের এই স্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্ত বৈশি^ক ও রাষ্ট্রিক স্বীকৃতির পরও বাংলাদেশের মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত হয়নি। বিগত ৫০ বছরের রাজনৈতিক ইতিহাস ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, কোনো সরকারই নিরঙ্কুশভাবে মানুষের অধিকারকে অনিবার্য ভাবেনি। বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকারের হাতে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে বারবার। ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন, একই সালে প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রাথমিক উদাহরণ। ২০০৯ থেকে আজকের ২০২৩ সাল পর্যন্ত যে সরকারটি গায়ের জোরে ক্ষমতাসীন রয়েছে তারা মানবাধিকার দলনে এমন কোনো হীন কাজ- হামলা, মামলা, গুম ও খুন বাকি রাখেনি যা মানবাধিকারকে বাংলাদেশে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থায় নিক্ষেপ করেছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং তাবৎ বৈশি^ক ও দেশজ মানবাধিকার সংগঠনগুলো মানবাধিকারের মাত্রায় বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিচুতে স্থান দিয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার এই, ক্ষমতা ও শুধু ক্ষমতার স্বার্থে এই সরকার কোনো মানবিক আবেদনকেই গ্রাহ্য করেনি। বিশেষত সমাগত নির্বাচন ও মানবাধিকার নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য তথা উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলো যে আবেদন রেখেছে তা সরকার বেপরোয়াভাবে নাকচ করেছে।
আন্তর্জাতিক আইন ও দেশজ আইন-কানুন, রীতি-রেওয়াজ ও ভদ্রতা-সভ্যতার তোয়াক্কা না করে বিরোধী নির্মূলে নেমেছে সরকার। শীর্ষ বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা জেলে রয়েছেন। ৫০ লাখ মানুষ আজব গজব গায়েবি মামলায় ঘরছাড়া হয়েছে। প্রতিদিন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জেল-জরিমানা হচ্ছে। সুপারসনিক গতিতে বিচার ব্যবস্থা এসব অন্যায় করে যাচ্ছে। নির্বাচনের আগ মুহূর্তে যেখানে অবারিত মাঠ ও অনিয়ন্ত্রিত অধিকার থাকার কথা সেখানে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা দিয়ে নির্বাচনকে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণের অপচেষ্টা চলছে। সেই সময়ে নির্বাচন কমিশন যেখানে ওইসব লঙ্ঘিত অধিকারকে নিশ্চিত করার কথা তখন তারা মৌলিক অধিকারের অবশিষ্ট অংশটুকু মুছে দেয়ার জন্য তৎপর হয়েছে। কমিশন প্রধান কাজী হাবিবুল আউয়ালের শিক্ষাজীবন ও কর্মজীবন প্রশংসিত হয়েছে। তিনি যখন এই গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করেন তখন মরহুম ডাক্তার জাফরুল্লাহর মতো অনেকেই আশাবাদী ছিলেন। তবে এটিও সত্য যে, কমিশন মানে ব্যক্তি নয়- সমষ্টি। সেখানে আওয়ামী লীগের চেয়েও বড় আওয়ামী লীগার রয়েছে। তারা সেখানে একটি মিশন নিয়ে গেছে, এটি স্পষ্ট। আরো গুজব এখন বন্দুকের নলই ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ছে। তফসিল ঘোষণার পরপর একজন রাজনৈতিক নেতা অভিযোগ করেছিলেন, সম্মতি নয়- শক্তি প্রয়োগেই তফসিল ঘোষিত হয়েছে। নইলে সেখানে এজেন্সি প্রধানদের বৈঠক কিভাবে হয়?
যেকোনো সাধারণ নাগরিক জানেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর নৈতিকভাবে সরকারের কোনো দাপট থাকার কথা নয়। সংবিধানে নির্বাচন নিয়ন্ত্রণে নির্বাচন কমিশনকে নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশনের ‘স্বাধীন’ প্রতিষ্ঠান হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। একই অনুচ্ছেদের (৫) দফায় ‘আইনের বিধানাবলি ও রাষ্ট্রপতির আদেশ’ অনুযায়ী নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে বলা হয়েছে। এই জাতির দুর্ভাগ্য এই যে, সংবিধান নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করলেও এরা সবসময়ই অধীন থেকেছে। অধীন থাকার বিষয় ব্যক্তি ও ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্যক্তি যদি দাসানুদাস হয় সংবিধান বা ব্যবস্থা তাকে সাহসী ও ব্যক্তিত্ববান করতে পারে না। অপর দিকে, ব্যক্তি যদি হয় সাহসী তাহলে কোনো না কোনোভাবেই সে অধীন অবস্থাকে অতিক্রম করতে পারে।
বাংলাদেশের মানুষজন সম্পর্কে আবারো সেই নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে ফিরে যেতে হয়। বঙ্গ নামক দেশের লোকদের সম্পর্কে পরিব্রাজকদের ধারণা ভালো ছিল না। অধীনতা, সুবিধাবাদ ও বিশ^াসঘাতকতা যেন আমাদের জনচরিত্রের অংশ। আকবর আলি খান তার ‘ছলনাময়ের রাজনীতি’র আলেখ্য রচনায় এসব কথা বলেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দীন ও এম এ সাইদের মতো বিরল উদাহরণও আছে। স্বাধীন থাকার পথে সাংবিধানিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক ও সরকারি দলের বাধা-বিপত্তি আছে। তারপরও মেরুদণ্ড সোজা রেখে কাজ করার মাইন্ডসেটও দরকার। এসব সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে বলা যায়, নির্বাচন কমিশন মানবাধিকার তথা ভোট দেয়া না দেয়ার অধিকারকে সমুন্নত না করে অধীনস্থ করতে পারে না।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন থেকে যখন নাগরিক সাধারণ অধিকতর স্বাধীনতা ও অধিকারের আশা করছিল, তখন তারা নিজেদের অধীনতাকে নাগরিক সাধারণের উপরও চাপিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসি ভালো করেই জানে, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে বিরোধিতা করছে। তারা হরতাল ও অবরোধ অবশেষে অসহযোগ আন্দোলনের মতো কঠিন কর্মসূচি নিয়েছে। কারণ এই নির্বাচনটি আদৌ কোনো নির্বাচন নয়। সরকারি দলের সেক্রেটারি জেনারেল ওবায়দুল কাদেরের ভাষায়- এটি হচ্ছে খেলা। যে খেলায় খেলোয়াড়কে হাত-পা বেঁধে বলছে খেলতে। বিএনপি এবং তার সহযোগীরা যাতে নির্বাচনে না আসে বা আসতে না পারে সে জন্য যাবতীয় নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। বিএনপির অফিস এখনো অবরুদ্ধ রয়েছে। বিএনপির নেতারা রাষ্ট্রিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। জামায়াতে ইসলামীর একই অবস্থা। তাদের নিবন্ধন কেড়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচন করার মতো নেতাদেরকে প্রতিদিন জেলে ঢুকানো হচ্ছে। হাস্যকরভাবে ডামি প্রার্থী দিয়ে নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার অবৈধ চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব তো নির্বাচন কমিশনের চোখের সামনেই ঘটছে।
যেখানে এসব ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের সোচ্চার হওয়ার কথা, তারা উল্টো সরকারের শিখণ্ডী হিসেবে ভোটের আগে রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ করতে চান। যাদের ভোটের কর্মসূচি স্বচ্ছ, সুন্দর ও জবাবদিহি করানোর মুরোদ নেই- বিরোধীদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদ করার নৈতিক সাহস নেই, কোন অধিকারে তারা রাজনীতি বন্ধ করতে চায়? কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক এই কমিশনকে আওয়ামী নির্বাচনী কমিশন বলছেন। তারা তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে সেটিই কি প্রমাণ করছেন না! নির্বাচন একটি রাজনৈতিক অধিকার। ইচ্ছা করলে যে কেউ নির্বাচন করতে পারে। আবার নাও করতে পারে। নির্বাচন করার যেমন অধিকার আছে, তেমনি নির্বাচন বর্জন করার অধিকারও নাগরিকদের আছে। নির্বাচন প্রতিহত করার অধিকার বিরোধীদের রয়েছে- যখন দেখা যাচ্ছে, সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে নির্বাচনের বশংবদ করছে। নির্বাহী বিভাগকে নিরঙ্কুশভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। পুলিশ বিরোধীদের গ্রেফতার ও নির্যাতনকেই তাদের কাজ মনে করছে। পুলিশের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তারা আওয়ামী রাজনীতিকদের ভাষায় কথা বলছেন। বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করছে। ব্যক্তি ও সমষ্টির কথা বলার সব অধিকার কেড়ে নিয়ে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে। এসব কি ইসির বিবেচ্য নয়?
নির্বাচনী কাজে বাধা হতে পারে এমন সভা-সমাবেশ বা রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ রাখতে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অসাংবিধানিক চিঠি দিয়েছে সাংবিধানিক নির্বাচন কমিশন। ইসির এই চিঠিতে ১৮ ডিসেম্বর থেকে জাতীয় নির্বাচনের ভোট গ্রহণের আগ পর্যন্ত সময়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন থেকে সবাইকে বিরত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ বন্ধের পদক্ষেপ চেয়ে এ ধরনের চিঠি দেয়ার নজির বাংলাদেশের বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে নেই। এটি সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার হরণের শামিল। ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে একই ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি কমবেশি পালিত হয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো বাধা-বিপত্তি আসেনি। ইসির চিঠিকে ‘অবৈধ নির্দেশনা’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন ফ্যাসিস্ট সরকারের মনোনীত কমিশন। তারা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী এই ফরমান জারি করেছে। তারা মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার এই পদক্ষেপকে ‘অবিশ্বাস্য’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, সভা-সমাবেশের অধিকার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার। আইন করেও এসব অধিকার রহিত করার সুযোগ নেই। মানবাধিকার যে দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে এটি তার আরেকটি দৃষ্টান্ত। জরুরি অবস্থা ছাড়া এ ধরনের নির্দেশ অন্যায়, অনৈতিক, অনুচিত ও ইসির ক্ষমতা বহির্ভূত। যেখানে মানবাধিকার ও ভোটাধিকার নিশ্চিত করা ইসির সাংবিধানিক দায়িত্ব সেখানে তারা তাদের এখতিয়ার বহির্ভূত অবৈধ আদেশ দিয়েছে। এটি সংবিধান লঙ্ঘনের শামিল। যেকোনো বিবেচনায় এটি প্রত্যাহারযোগ্য।
বাংলা ভাষায় প্রবাদ বাক্যটি এরকম যে- ‘ভাত দেয়ার মুরোদ নেই কিলের গোঁসাই’। ইসি সেই কাজই করেছে। আরো মজার বিষয়- প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ব্যতীত খোলা মাঠে নির্বাচনে এখন ইসি আস্ফালন করছে। ‘অসারের যেমন তর্জন গর্জন সার’ তেমনি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন, প্রতিযোগিতাহীন এই ডামি নির্বাচনে তারা দৃশ্যমানভাবে আইনের কঠোর প্রয়োগ দেখাচ্ছে। যেমন তারা একজন আওয়ামী জ্যেষ্ঠ নেতাকে কমিশনে ডেকে পাঠিয়েছে। এমন অনেককে কঠোর সতর্ক করেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অভিযোগ আমলে নিয়েছে। দলপ্রীতির অভিযোগে দু’জন ডিসিকে অদলবদল করেছে। বদলির জন্য অনেক পুঁটি পুলিশের নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
রাঘববোয়ালদের ধরার সাহস নেই, তাই পুঁটি পুলিশের শাস্তি দিয়ে কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছে ইসি। এরকম নিরুত্তাপ নির্বাচনকে অপ্রয়োজনীয় উত্তাপ দেয়ার জন্য সেনা মোতায়েনের ব্যবস্থা করেছে ইসি। যেখানে নির্বাচন নিয়ে খেলছে ‘আমরা আর মামুরা’ সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হাস্যকর। এই কলামের প্রারম্ভে সংবিধানকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, মৌলিক অধিকারের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ কোনো আইন করা যাবে না। আর যদি করা হয়, তবে তা স্বতঃসিদ্ধভাবে বাতিল হয়ে যাবে। এই অনুচ্ছেদ অনুসারে, মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী আগেকার সব আইন সাংবিধানিকভাবে অবৈধ। সুতরাং ইসির আরোপিত আদেশ স্বাভাবিকভাবেই বাতিল হয়ে আছে।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা