জজ অরওয়েল
- মীযানুল করীম
- ২৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:৪৭
জর্জ অরওয়েল (১৯০৩-১৯৪৯)। অবিভক্ত ভারতের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা প্রদেশের মতিহারিতে জন্ম নিয়েছিলেন এরিক আর্থার ব্লেয়ার। বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি ‘জর্জ অরওয়েল’ ছদ্ম নামে কালোত্তীর্ণ ইংরেজ লেখক হয়ে ওঠেন। তিনি ঔপন্যাসিক এবং রাজনৈতিক লেখক। তার স্বল্প আয়ু জীবনের একটি অংশ ‘মারাকেশ’। ফরাসি ভাষায় ‘স’কে ‘চ’ লেখা হয়। এজন্য অনেকে ‘মারাকেচ’ লিখে থাকেন। মরক্কো নামে মুসলিম দেশটির সাবেক রাজধানী ‘মারাকেশ’। অতীতের মোয়াহিদ ও মোরাবিদ আমলের প্রধান শহর ‘মারাকেশ’। মারাকেশের লাইব্রেরি বিশ্ববিখ্যাত। মরক্কো একটি মুসলিম দেশ। এটি মুসলিম জাহানের সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত বলে ‘আল মাগরিব’ নামে পরিচিত। মরক্কোর প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে রয়েছে বর্তমান রাজধানী রাবাত, বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার জীবনের সাথে জড়িত তানজিয়ার ছাড়াও মারাকেশ, ক্যাসাব্লাঙ্কা, ফেজ ও আগাদির। জর্জ অরওয়েল ১৯৩৬ সালের ৯ জুন এলিন শাওনেসিকে বিয়ে করেন। কিছু দিন পরই স্পেনে রাজনৈতিক সঙ্কট শুরু। রাজতন্ত্রের দুর্বলতা স্পেনকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের কুরুক্ষেত্রে পরিণত করে।
রাজার ক্ষমতাচ্যুতি, একনায়কতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের নির্বাচনী জাতীয় রাজনীতিতে তুমুল অস্থিরতার সৃষ্টি করে। সেনাপ্রধান ফ্রাঙ্কোর অংশগ্রহণ গৃহযুদ্ধের সূচনা করে (১৯৩৬-৩৯ সালে)।
প্রজাতন্ত্রকে উৎখাত করে পুরোনো ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে ১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে ফ্রাঙ্কো ‘মরক্কোর সেনাবাহিনী’ নিয়ে স্পেনে পৌঁছেন। স্পেনের কৃষক ও শ্রমিকরা অধিকারকে রক্ষা করার জন্য একজোট হয়েছিলেন। আশা করা হয়েছিল, পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স কিছুতেই মুখ বুঁজে ফ্রাঙ্কোর স্পর্ধাকে প্রশ্রয় দেবে না। উত্তেজনা কেটে যেতেই দেখা গেল, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ফ্রাঙ্কোকেই মূলত সাহায্য করেছে। ইতালি ও জার্মানি সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়েছে। বোঝা গেল, স্পেনের গৃহযুদ্ধ আদতে বিশ্বযুদ্ধের মহড়া।
স্প্যানিশ সাহিত্যের বিখ্যাত কবি, নাট্যকার ও মঞ্চনির্দেশক ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকাসহ কবিদের সম্মিলনের সংগঠন ‘প্রজন্ম ২৭’-এর সদস্যরা সাহিত্যে ‘ইউরোপিয়ান বিপ্লব’ আনার চেষ্টা করেন। লোরকার রচনা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীতে। তার কাব্য-সাহিত্য লাভ করে স্বতন্ত্র এক ধারা। তাকে ‘জনগণের কবি’ বলে ডাকা হয়। লোরকা ১৯৩৬ সালে স্পেনে গৃহযুদ্ধের সময়ে নিজগৃহে অবস্থান করছিলেন। ফ্রাঙ্কোর সেনারা লোরকাকে তুলে নিয়ে যায় এবং বন্দী করে রাখে। ১৯ আগস্ট ঘাতকরা তাকে হত্যা করার পর তার মৃতদেহ গুম করে ফেলে। স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করার জন্য তিনি রোষানলে পতিত হন। লোরকার মৃত্যু হৃদয়বিদারক। লোরকাকে হত্যা করা হয়েছিল তার স্বাধীনতাকামী কবিতার জন্য, মৃত্যুর পর তার সব রচনা পুড়িয়ে দেয়া হয়।
প্রজাতন্ত্রের পক্ষের হয়ে যুদ্ধে অংশ নিতে স্পেনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অরওয়েল ১৯৩৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর প্যারিসে আমেরিকান ঔপন্যাসিক হেনরি মিলারের সাথে দেখা করেন। নিউইয়র্ক এবং প্যারিসে বসবাসের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে লেখা মিলারের ট্রপিক অব ক্যান্সার, ব্ল্যাকস্প্রিং, ট্রপিক অব ক্যাপ্রিকর্ন প্রভৃতির কারণে তিনি বিখ্যাত। মিলার অরওয়েলকে বলেন, কিছু বাধ্যবাধকতা বা অপরাধবোধ থেকে লড়াই করা হলো ‘নিছক মূর্খতা’। ‘ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা, গণতন্ত্র রক্ষা করা ইত্যাদি সম্পর্কে ইংরেজদের ধারণাগুলো একধরনের বেহায়াপনা।’ মিলারের সাথে খাবার খেয়ে অরওয়েল স্পেনে যাত্রা করেন। কয়েক দিন পর বার্সেলোনা শহরে ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি (আইএলপি) অফিসের ম্যাকনায়ারের সাথে দেখা করেন। অরওয়েল কাতালোনিয়ার জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পা রাখেন। কয়েকটি উপদল রিপাবলিকান সরকারকে সমর্থন করেছিল। সোভিয়েত ইউনিয়ন এদের সমরাস্ত্র ও সাহায্য দিয়ে সমর্থন করেছিল। অরওয়েল একটি উপদল POUM-এ যোগ দেন। বার্সোলোনার লেনিন ব্যারাকে কিছু দিন থাকার পর তাকে আরাগন ফ্রন্টে পাঠানো হয়। তিনি এক রাতেই লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেন। তিনি শত্রু সেনাকে তাড়া করেন এবং শত্রুর ঘাঁটিতে বোমাবর্ষণ করেন। এপ্রিল মাসে অরওয়েল বার্সেলোনায় ফিরে আসেন। তার ইচ্ছা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক ব্রিগেডে যোগ দেয়ার পরিবর্তে আরাগন ফ্রন্টে ফেরার সিদ্ধান্ত নেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার পর তিনি আহত হন। স্নাইপারের একটি বুলেট গলায় বিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হন। ছয় ফুট দুই ইঞ্চি দীর্ঘ শরীরের অরওয়েল স্প্যানিশ যোদ্ধাদের চেয়ে লম্বা। তাই ট্রেঞ্চের সামনের আত্মরক্ষামূলক দেয়ালের উল্টোদিকে না দাঁড়াতে সতর্ক করা হয়েছিল। গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর কথা বলতে অক্ষম অরওয়েলের মুখ থেকে অনবরত রক্ত ঝরতে থাকে। স্ট্রেচারে করে সিয়েটামোতে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি অস্বস্তিকর পথ পাড়ি দিয়ে অ্যাম্বুলেন্স তাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে। সুস্থ হয়ে ওঠার পর ১৯৩৭ সালের ২৭ মে তাকে টারবাগোনায় এবং এর দু’দিন পর বার্সেলোনার শহরতলির একটি স্যানাট্যারিয়ামে পাঠানো হয়। বুলেটটি তার প্রধান ধমনীর কাছাকাছি হয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। কণ্ঠস্বর অস্ফুট শোনা যাচ্ছিল। সংক্রমণরোধে অবিলম্বে ক্ষার জাতীয় পদার্থের দ্বারা স্থানটি পুড়িয়ে দেয়ার মতো জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ইলেকট্রোথেরাপি চিকিৎসা দেয়ার পর তাকে চিকিৎসার জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল।
জর্জ অরওয়েল এই অভিজ্ঞতার আলোকে ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ গ্রন্থটি লেখেন। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লেখেন ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। তিনি ১৯৪৬-৫০ সালের মধ্যে লেখেন ‘১৯৮৪’। তিনি ‘হোমেজ টু কাতালোনিয়া’ লেখার পর যেমন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে, ঠিক তেমনি ‘১৯৮৪’ লেখার পরে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। স্বৈরতন্ত্রের কর্তৃত্ববাদী তাণ্ডবের তিনি পূর্বাভাস দিয়ে গেছেন। উদারতার অবসান ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের বিলুপ্তির তিনি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। আভাস দিয়ে গেছেন। অরওয়েলের জন্মস্থান বিহারের মতিহার ছিল তামাকের জন্য প্রসিদ্ধ। তিনি তার চেয়েও খ্যাতিমান হয়ে ওঠেন সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক হিসেবে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন পুলিশ অফিসার এবং বার্মার (মিয়ানমার) নিম্নাঞ্চলে কাজ করেন। তার একটি বিখ্যাত রচনার নাম ‘শুটিং অ্যান এলিফ্যান্ট’।
তার বিখ্যাত বই ‘অ্যানিমেল ফার্ম’-এর সার সংক্ষেপ হলো, ম্যানর ফার্মের বয়স্ক শূকর ওল্ড মেজর সব পশুকে ডেকে এক সভায় বলল, মানুষ পরাশ্রয়ী জীব। সেসব পশুকে ‘বিস্টস অব ইংল্যান্ড’ নামে বিপ্লবী সঙ্গীত শেখায়। ওর মৃত্যুর পরে ওর দুই তরুণ সন্তান স্নোবল ও নেপোলিয়ন অন্যদের ঠিক করার কাজ নেয়। তারা বিদ্রোহ করে মাতাল ও অবিবেচক চাষি জোনসকে তাড়ায়। তারা সাতটি মূলনীতি মেনে চলে, যার একটি হচ্ছে ‘All animals are equal, but some are more equal than others’ এই কথাটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো পশুর অধিকার বেশি, এর প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, উইন্ডমিল (windmill) তাদের আয় বাড়িয়ে দেয়। তারা ফার্মের নাম রাখে মেজর ফার্ম এবং বলে যে, তারা ও মানুষ অভিন্ন।
জর্জ অরওয়েল এই বইটি লিখেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়ার পূর্বসূরি) কমিউনিস্ট ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে। সোভিয়েত ইউনিয়নে বা সাবেক রাশিয়ার পূর্বসূরি রাষ্ট্রে সমাজতন্ত্রের নামে কমিউনিস্ট পার্টির ক্যাডাররা সব কিছু দখল করে নেয়। সেখানে আমলাতন্ত্র আগের মতোই বহাল থাকে। ঠিক তেমনি ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, স্নোবল ও নেপোলিয়ন ভ্রাতৃদ্বয় দু’পেয়েরা শত্রু ও চারপেয়েরা পরস্পরের বন্ধু বলে মত প্রচার করে। ‘সব পশু সমান’-এটি প্রচার করার পর দেখা যায়, শূকরের প্রাধান্য বেড়ে গেছে, কিন্তু তারা কোনো কাজ করে না। তারা কেবল খায়দায়, ঘুমায় আর ফন্দি আঁটে। পশুদের নেতা নেপোলিয়ন মানুষের সাথে সখ্য করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করে। পশুরা শুধু অসহায়ের মতো সব কিছুতে সায় দেয় এবং উদয়াস্ত খাটে।
জর্জ অরওয়েলের মূল নামটি হারিয়ে গেছে, কিন্তু হারায়নি তার ‘১৯৮৪’ ও ‘অ্যানিমেল ফার্ম’। যতদিন মানুষ বেঁচে থাকবে, ততদিন তাকে স্মরণ করবে ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ ও ‘১৯৮৪’ এর জন্য। জর্জ অরওয়েল বেঁচে থাকলেও ১৯৮৪ সালে তিনি অবাক হতেন যে, তার কথা সত্য হয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নে পার্টি ক্যাডাররা কর্তৃত্ব করে। জর্জ অরওয়েল দেখতেন, তার কথিত সাম্রাজ্যবাদ সর্বশ্রেষ্ঠ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। অরওয়েল মরক্কোর মতো দেশের মাধ্যমে প্রধানত মুসলমানদের দুর্দশা তুলে ধরেছেন। দেশটির প্রাচীন রাজধানী মারাকেশ শহরে তার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এ জন্য। তিনি দেখেছেন, মুসলমানদের ধর্ম মেনে দাফন করা পর্যন্ত কঠিন। তাদের জীবনের নিশ্চয়তা পর্যন্ত নেই। মৃত্যুর পরও তারা অবহেলিত থাকে। মুসলমানরা সামান্য পয়সার জন্য লালায়িত। তারা বোঝা বহনকারী প্রাণী হিসেবে সামান্য পয়সার জন্য নিজের অবস্থানকে মেনে নেয়।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা