মায়ের ডাক শুনি লিঞ্চের ‘প্রফেট সং’-এ
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২০ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:২৭
ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে দীর্ঘ সময় ধরে। একটি বিষণ্ন, ভারাক্রান্ত সন্ধ্যা উৎরে গেছে অনেকক্ষণ। মিসেস এইলিশ স্ট্যাক সারা দিন অফিস করে ঘরে ফিরেছেন। মাইক্রোবায়োলজিস্ট এইলিশ একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ম্যানেজার। গবেষণার কাজ করেন। ঘরে ফিরেও তার অনেক কাজ। স্বামী ও চারটি ছেলেমেয়ে নিয়ে তার সুখের সংসার। বৃদ্ধ বাবার দেখাশোনাও করতে হয়। কিন্তু বাইরের দরজায় কাঙ্ক্ষিত ডোরবেলের আওয়াজ তিনি এখনো পাননি। স্বামী ল্যারি স্ট্যাক ফেরেননি এখনো। বাইরের দরজায় কান পেতে এইলিশ রান্নাঘরের নিভৃতে দাঁড়িয়ে রাতের খাবারের আয়োজন ভাবছেন। ঠিক তখন ডোরবেল বেজে ওঠে। এইলিশ বাইরের ঘরে এসে দরজা খোলেন।
ল্যারি নয়, দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাকের দুই পুলিশ।
এইলিশ জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে সিক্রেট পুলিশের দুই সদস্য হাসিমুখে বলেন, আপনার স্বামী মি. ল্যারিকে একটু ডেকে দেবেন? কথা আছে।
ল্যারি এখনো ফেরেনি, জানান এইলিশ। জিজ্ঞাসা করেন, কোনো সমস্যা? না না, জাস্ট একটু থানায় আসতে হবে তাকে। কিছু আলোচনা আছে। সেরেই চলে আসবেন। ভয় পাবেন না, ভয়ের কিছু নেই।
পুলিশ দুজন ল্যারিকে থানায় পাঠানোর জন্য এইলিশকে অনুরোধ জানিয়ে বিদায় নেয়। এইলিশের শরীর কাঁপছে। পুলিশ চলে গেলেও মনে হচ্ছে, একটি অশরীরী দানবকে তারা রেখে গেছে এই ফ্লাটে। দানব দৃশ্যমান নয়, কিন্তু তার চাপা নিঃশ্বাসের গুমোট চাপ এসে লাগছে এইলিশের বুকে, তার সমস্ত অস্তিত্বে। তার স্বামী ল্যারি বিশিষ্ট ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। এই মুহূর্তে শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া নিয়ে শহরে বড় ধরনের মিছিল সমাবেশের আয়োজনে ব্যস্ত ল্যারি। শিগগিরই সেই কর্মসূচি পালিত হবে দেশজুড়ে। এ সময় পুলিশের তলব স্বাভাবিক ঠেকছে না। পুলিশ তাকে ‘বিরোধ ও অশান্তি উসকে দেয়ার’ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চায়। বিশ^জুড়ে সব স্বৈরাচারই যে যুক্তিতে বিরোধীদের নির্মূল করে। এখানেও সেই একই যুক্তি। তোমরা অধিকারের নামে অশান্তি সৃষ্টিকারী, তোমরা সমাজে বিভেদ তৈরি করছ, তোমরা উগ্রপন্থার সহায়ক, তোমরা দুষ্কৃতি।
এইলিশ রাতে স্বামীকে জানান, বাড়িতে পুলিশ আসা এবং তাকে থানায় তলব করার কথা। উৎকণ্ঠার সঙ্গে জানতে চান, থানায় যাবে, যদি অ্যারেস্ট করে বা অন্যকিছু! ল্যারি হাসেন। যেতে তো হবেই, ডেকেছে যখন! ভয় পাচ্ছ কেন, সরকার জরুরি ক্ষমতা আইন জারি করলেও দেশে এখনো তো সংবিধান স্থগিত করেনি। মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা রদ করেনি। গণতন্ত্র আছে। মিছিল সমাবেশ করলে তা অপরাধ হবে না নিশ্চয়ই!
এটা যুক্তির কথা। বাস্তবতা ভিন্ন। পরদিন থানায় গিয়ে ল্যারি আর ফেরেন না। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, নাকি জেলে পোরা হয়েছে, কিছুই জানতে পারেন না এইলিশ। উল্টো পুলিশ তাকে পরামর্শ দেয়, চুপ থাকুন। অনেক দিন প্রশাসনের দুয়ারে নিষ্ফল ঘোরাঘুরির পর এইলিশ জানতে পারেন, তার স্বামীকে কোনো বন্দী শিবিরে রাখা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশ তাকে পরামর্শ দেয়, এসব নিয়ে মাথা গরম করবেন না। বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করতে যাবেন না। আর নিজেদের প্রতি মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করবেন না। অর্থাৎ সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা-বিবৃতি, মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন করা চলবে না।
স্বামী গুম হওয়ায় এইলিশের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। শুরু হয় তার ভিন্নতর সংগ্রাম। একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর দেশে জরুরি ক্ষমতা আইন জারি করেছে। গোপন পুলিশ বাহিনী গঠন করেছে। কথা বলার, সভা-সমাবেশ করার, প্রতিবাদ করার সব অধিকার কেড়ে নিচ্ছে কোনো আইনি ভিত্তি ছাড়াই। যখন তখন নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে পাড়া-প্রতিবেশী পুরুষরা, ভাইরা, বোনেরা। একের পর এক গুম হয়ে যাচ্ছে ভিন্নমতের মানুষ, গায়েব হয়ে যাচ্ছে চিরতরে। কারো আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ এক ভয়ঙ্কর অন্ধকার নেমে এসেছে দেশে। এইলিশ এখন কী করবেন? কীভাবে ধরে রাখবেন নিজের পরিবারকে, নিজের স্বজন, প্রিয়জনদের?
এভাবে শুরু হয় এক অসহায় স্ত্রী ও মায়ের অসম্ভব এক সংগ্রাম। শুরু হয় প্রবল ক্ষমতাধর এক স্বৈরাচারী রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর দুঃসাহসী সংগ্রামের শ্বাসরুদ্ধকর অভিযাত্রা।
দুই.
এতক্ষণ যে বিবরণ দেয়া হলো, তাতে দুটি প্রধান চরিত্রের নাম আছে। মিসেস এইলিশ স্ট্যাক এবং মি. ল্যারি স্ট্যাক। নাম থেকে স্পষ্ট, এটি বিদেশের পটভূমিতে ঘটমান কাহিনীর চিত্র। হ্যাঁ, ঘটনা বিদেশেরই, আয়ারল্যান্ডের। আর সেই কাহিনী একজন লেখক বিবৃত করেছেন তার উপন্যাসে। ‘প্রফেট সং’ নামের বইটির কথা এরই মধ্যে অনেকে জানেন। কারণ, এটি সদ্যই ব্রিটেনের সবচেয়ে সম্মানজনক বুকার পুরস্কার জিতেছে। লেখক পল লিঞ্চ আইরিশ। থাকেন রাজধানী ডাবলিনে। বুকার জেতার আগেই তিনি পেয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি।
কী আছে লিঞ্চের এই বইয়ে? একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে একটি নির্বাচিত সরকারের ক্রমেই স্বৈরাচারী হয়ে ওঠা এবং ফলশ্রুতিতে নাগরিকদের জীবনে নেমে আসা নিপীড়নের গল্প আছে এতে। আছে তাদের অসহায়ত্ব, স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ ও স্বজন হারানোর বেদনার গল্প। আর সেটি মূর্ত হয়েছে একজন অসহায় নারীর হাত-পা ছোঁড়ার নিষ্ফল আস্ফালনের মধ্য দিয়ে।
লিঞ্চের উপন্যাসটির যেসব রিভিউ বিশ্বের নামীদামি মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে সেগুলো অকুণ্ঠ প্রশংসায় ভরা। বলা হয়েছে, উত্তেজনাপূর্ণ, ভীতিকর এবং প্ররোচনাদায়ক এই উপন্যাস একটি শ্বাসরুদ্ধকর মৌলিক কাজ, যা যুদ্ধরত একটি দেশের ধ্বংসের পথে যাত্রা এবং নিজ পরিবারকে বাঁচানোর জন্য একজন মায়ের লড়াইয়ের একটি গভীর মানবিক অবয়ব নির্মাণ করেছে।
আয়ারল্যান্ড ভেঙে পড়ছে। দেশটি ক্রমেই অত্যাচারী হয়ে উঠতে থাকা সরকারের খপ্পরে পড়েছে। আর বিজ্ঞানী এইলিশ কেবল অসহায়ভাবে দেখছেন, তার চেনা সেই বিশ্বটি কখন যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। যখন প্রথমে তার স্বামী গুম হলেন এবং তারপর তার বড় ছেলে ১৬ বছরের কিশোর নিখোঁজ হয়ে গেছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য। এইলিশ নিজেকে আবিষ্কার করেন একটি ধসে পড়া সমাজের দুঃস্বপ্নের মধ্যে বন্দী অবস্থায়। যেখানে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে প্রতিরোধ, চলছে দস্তুরমতো মরণপণ গৃহযুদ্ধ।
প্রফেট সং একটি ‘ডিস্টোপিয়ান’ উপন্যাস। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত রাষ্ট্রে একনায়কতন্ত্রের উদ্ভবের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বে মানবিক মূল্যবোধের পতনের শঙ্কা থেকে যে উদ্বেগের সঞ্চার হয়েছিল তার ওপর বেশ কিছু ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস লেখা হয়। ১৯২১-২২ সালে রুশ লেখক ইয়েভগেনি জামিয়াতিন লিখেন ‘উই’ (আমরা)। এটি লেখার কারণে তাকে নির্বাসনে যেতে হয়। নির্বাসনেই তার মৃত্যু হয় প্যারিসে। বইটি নিজের দেশে কখনো প্রকাশও পায়নি। গোপনে এটি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বলা হয়, এটি ছিল ওই শতাব্দীর সেরা উপন্যাস।
এরপর জামিয়াতিনের পথ ধরে অলডাস হাক্সলি ১৯৩২ সালে লেখেন ‘ব্রেভ নিউ ওয়ার্ল্ড’। ১৯৪৫ সালে জর্জ অরওয়েল লেখেন বিখ্যাত উপন্যাস ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ (১৯৪৫) এবং ১৯৪৮-৪৯ সালে ‘১৯৮৪’। অ্যানিমেল ফার্ম প্রহসনধর্মী উপন্যাস হলেও অন্য সবগুলোই স্বৈরাচারী শাসনের বিপদ, ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কট এবং মুক্ত স্বাধীন ও উদার মানবিক সমাজের বিলীন হওয়ার শঙ্কা তুলে ধরে।
পল লিঞ্চের উপন্যাসের বুকার পাওয়া অস্বাভাবিক না। এর সঙ্গে বিশ^ রাজনীতির চলমান ঘটনাবলির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। বর্তমানে গণতান্ত্রিক বিশ^ বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে। সোভিয়েতের পতন হলেও রাশিয়া এখনো প্রায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি, যেখানে একনায়কতান্ত্রিক শাসন কায়েমি রূপ নিয়েছে। এর পাশাপাশি উঠে এসেছে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন, যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। উঠে আসছে তুরস্ক, ইরান, সৌদি আরব। শেষের তিনটি দেশের পরাশক্তি হয়ে ওঠার আপাতত কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও, রুশ-চীন বলয়ের সাথে জোগসাজশে বিশে^ ক্ষমতার ভারসাম্য যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে এমন সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ কম। এর পাশাপাশি আছে গণতন্ত্রের পুরোনো লেবাস ছেড়ে ক্রমেই স্বৈরতন্ত্রী হয়ে উঠতে থাকা ভারত। এই দেশটির পরাশক্তি হওয়ার খায়েশ গোপন বিষয় নয়। আর যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠলে, দেশটি যে যুক্তরাষ্ট্রের তাঁবে থাকবে না এমন অনেক আলামত স্পষ্ট।
সুতরাং বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ কথিত একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলোর হাতে চলে যেতে পারে এমন শঙ্কা আছে পাশ্চাত্যে। এই শঙ্কা থেকেই তারা বাংলাদেশে যেমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য চাপ দেয় তেমনই একনায়কতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী ও টোটালিটারিয়ান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রচারণাও জোরেশোরে চালিয়ে যাচ্ছে। পল লিঞ্চের উপন্যাস বা এর মতো আরো যেসব ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস সাম্প্রতিক সময়ে লেখা হচ্ছে সেগুলোকে প্রমোট করা হচ্ছে পাশ্চাত্যের নিজেরই আদর্শিক প্রয়োজনে। আর সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই স্বৈরতন্ত্রবিরোধিতা গণতান্ত্রিক বিশ্বের লেখকদের লেখার প্রধান উপকরণ ও উপজীব্য হয়ে উঠেছে, উঠতে থাকবে। পুরষ্কৃতও হবে এই ধারার বইগুলো, যেখানে স্বৈরশাসনের নিষ্পেষণে মানবতার অসহায় আর্তনাদ ও আর্তি তুলে ধরা হয়েছে।
একসময়ের সিনে সাংবাদিক এবং বর্তমানে সার্বক্ষণিক লেখক পল লিঞ্চ বলেছেন, তার অনুপ্রেরণা এসেছে সিরিয়া, ফিলিস্তিনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলের মানুষের দুর্বিষহ উদ্বাস্তু জীবনের বিপর্যয় দেখে, যারা নিজ দেশের স্বৈরাচারী সরকারের নিষ্পেষণ থেকে বাঁচার জন্য দেশান্তরী হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটারস’ আন্দোলনের অনুষঙ্গও মনে পড়ে তার লেখা থেকে।
আজকের বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চেতনা যখন ক্রমেই ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং অগণতান্ত্রিক শক্তি কোথাও কোথাও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে তখন প্রফেট সং বা ‘নবীর গানে’ আমাদের কান পাততেই হবে। নবীরা তো সবসময়ই বিশ্বের মানুষকে শান্তি, সাম্য, সহনশীলতা, ধৈর্য ও সহমর্মিতার গানই শুনিয়েছেন। পল লিঞ্চ সেই গানের কথাই বলেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা