২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`
সংবিধান ও রাজনীতি

৭ নভেম্বর : কী ও কেন

জিয়াউর রহমান - ফা

আজকের প্রসঙ্গ ৭ নভেম্বর, ১৯৭৫। প্রায় ৫০ বছর আগের ঘটনা, তরুণ পাঠকের মন অতটুকু পেছনে গিয়ে নোঙর করতে না-ও চাইতে পারে! তবু যারা দেশ ও জাতির ইতিহাস জানতে কিছুমাত্র আগ্রহী তাদের জন্য এই চেষ্টা। এ কলামে অনেক পাঠকের জন্য পরিচিত রাজনৈতিক দল ও নেতার নাম আসবে, অপরিচিত স্থানের নাম, সেনাবাহিনীর অনেক ইউনিট বা সংগঠনের কথা আসবে, সেনাবাহিনীর অনেক পরিচিত বা অপরিচিত অফিসারের নাম আসবে। সম্মানিত পাঠকের ধৈর্য কাম্য।

বঙ্গবন্ধুর সামনে প্রশ্ন উপস্থাপিত
১০ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় আসেন। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রধান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ২৫ মার্চ ১৯৭১, দিন শেষে মধ্যরাতে তিনি গ্রেফতার হন। তার প্রকাশ্য ভূমিকার সেখানেই ক্ষান্তি। এরপর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারিতেই মাত্র তিনি তার সাবেক সহকর্মীদের দেখেছেন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ তিনি দেখতে পাননি; অথবা দেশের বিরুদ্ধে বা দেশের বন্ধুদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্রও তিনি দেখতে পাননি। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত তরুণদের যুদ্ধে যাওয়ার আকুতি তিনি শুনতে পাননি। মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় সুবিধা-অসুবিধা কী ছিল, সেটা তার অনুভূতির বাইরে ছিল। তা সত্ত্বেও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নামে... এটাই বাস্তবতা। কারণ, বঙ্গবন্ধুর কোনো বিকল্প ছিল না। ১০ জানুয়ারির পর সেই বঙ্গবন্ধু একটি কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হন। প্রশ্ন হলো, নতুন বাংলাদেশের নতুন সরকার কি শুধু আওয়ামী লীগ দলীয় হবে, না মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে হবে? বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগদলীয় সরকারের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেন।

জাসদের জন্ম এবং নেতৃত্বের পরিচয়
বঙ্গবন্ধুর একদলীয় সরকার গঠনের সিদ্ধান্তে দ্বিমত পোষণকারীরা আরেকটি রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করলেন। এর নাম ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’-জাসদ। এখনো ওই একই নামের দলটি দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। এক ভাগের নেতৃত্বে আছেন হাসানুল হক ইনু (আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী) এবং আরেক ভাগের নেতৃত্বে আছেন ১৯৮৮-৯০ সালে এরশাদ সরকারের অধীনে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা এবং ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের পূর্ণমন্ত্রী আ স ম আবদুর রব।

বাংলাদেশ পরিচালনায় আওয়ামী লীগের চারটি নীতিমালার একটি ছিল ‘সমাজতন্ত্র’। জাসদ তাদের নীতিমালা ঘোষণা করল- ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সমাজতন্ত্র বুঝতেই কষ্ট পেত; বৈজ্ঞানিক অংশ বোঝা তো আরো কঠিন ছিল। জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে পথ চলা শুরু করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সদ্য অব্যাহতি পাওয়া মেজর এম এ জলিল। মেজর জলিলের কাহিনী, আজকের প্রজন্মের জন্য আরো চমকপ্রদ। চাকরির স্থান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। ছুটিতে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। ২৬ মার্চ এসে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত গেলেন না। নিজের উদ্যোগে সেক্টর সংগঠন করলেন, সুন্দরবনসহ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে। এই সেক্টরটি পরে ৯ নম্বর সেক্টর হিসেবে পরিচিত হয়।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর দুই-চার-ছয় দিন পরের কথা। যশোর-খুলনার ঘটনা। মেজর জলিল দেখলেন, বড় বড় ট্রাক বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে যাচ্ছে। জলিল ট্রাকগুলোকে আটকালেন এবং দেখলেন সেগুলোতে মূলত দুই ধরনের জিনিস আছে। এক হলো ওইসব অস্ত্র বা গোলাবারুদ, যেগুলো পাকিস্তান সেনাবাহিনী সমর্পণ করেছে (১৬ ডিসেম্বর বিকেলে)। আরেক ধরনের হলো বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মেশিন বা যন্ত্র। জলিল কিছু গাড়ি আটকালেন এবং বললেন এগুলো নিয়ে ভারতে যাওয়া যাবে না। কারণ, এগুলো বাংলাদেশের সম্পত্তি। কিন্তু বিধি বাম! এ বিষয় নিয়ে মেজর জলিল এবং তৎকালীন বাংলাদেশী উচ্চতর কর্তৃপক্ষের মধ্যে কঠোর মতবিরোধ দেখা দিলো। জলিলকে গ্রেফতার করা হলো। জলিলকে ঢাকা এনে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের পাহারায় রাখা হলো। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে উন্মুক্ত জায়গায় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাঁবু খাটিয়ে অবস্থানে ছিল। ওই সময় মাত্র দেড় বছর চাকরিসম্পন্ন লেফটেন্যান্ট সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমকে নিযুক্ত করা হয়েছিল জ্যেষ্ঠ মেজর জলিলের পাহারাদার অফিসার হিসেবে; উভয়ের মধ্যে অনেক গল্প হতো। কিছু দিন পর বিচার হয় এবং জলিল মুক্ত হন। এরপর তিনি হন জাসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং আ স ম আবদুর রব হন প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। আমি আর ব্যাখ্যা দিচ্ছি না যেন, সম্মানিত পাঠক নিজেই উপলব্ধি করতে পারেন, ১৯৭২-এর অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আত্মপ্রকাশ করা জাসদ নামে দলটির রাজনৈতিক-কেবলা কোন দিকে ছিল।

জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থা
১৯৭২-এর শেষ দিকে এবং ১৯৭৩ সালে জাসদ তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে ঢাকা মহানগরে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে লিপ্ত থাকে। অপর পক্ষে সরকারের পুলিশ এবং জাতীয় রক্ষীবাহিনী ব্যস্ত থাকে জাসদ কর্মীদের জেলে ভরা, গুম, আহত ও খুন করায়। এরূপ প্রেক্ষাপটে জাসদ আত্মসমালোচনায় লিপ্ত হয়েছিল। জাসদ চিন্তা করল সেনাবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে বা কিছুসংখ্যক সৈন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে জাসদকে সহযোগিতা না করলে, বঙ্গবন্ধু সরকারকে হটানো যাবে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হলো, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বন্ধু খোঁজ করো।

১৯৭২-৭৩-৭৪-এর কথা। নতুন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। পাকিস্তান থেকে যারা ফেরত এসেছেন তারা ও যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন তারা, একতাবদ্ধভাবে সেনাবাহিনী গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন এ কথা যেমন সত্য, তেমনি সত্য, উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড মতপার্থক্য ও মানসিক দমন নিপীড়নের প্রক্রিয়াও ছিল। কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও অমুক্তিযোদ্ধা সৈনিক, দেশ পরিচালনার নিয়ম, বিদ্যমান পরিস্থিতি বিশেষত দুর্র্নীতি ও স্বজনপ্রীতি প্রশ্নে খুবই ক্ষুব্ধ ছিল। এরা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তন চায়। সমাজতান্ত্রিক এবং মেহনতি মানুষের সরকার চায়। অফিসারবিহীন সামরিক বাহিনী চায় এবং শ্রেণীবিহীন সমাজ চায়। এরা নিজেদের গোপনে গোপনে সংগঠিত করল। নাম দিলো গোপন সৈনিক সংস্থা। সুবেদার-নায়েব সুবেদার-হাবিলদার-নায়েক-সৈনিক ইত্যাদি বিভিন্ন র্যাঙ্কের সাধারণ সৈনিক গোপনে নিজেদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে থাকল। অবসর নিয়েছে এমন সমমনা কিছু সৈনিক সাহায্য সহযোগিতা করত। বছর খানেক পর, গোপন সৈনিক সংস্থা ভাবল, এদের দিয়ে একা একা সরকার পরিবর্তনের কাজ সম্ভব নয়। তাদের রাজনৈতিক বন্ধু প্রয়োজন। অতএব ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বন্ধু খোঁজা শুরু হলো। এভাবেই জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন এবং বন্ধুত্ব সৃষ্টি হলো।

কর্নেল তাহের
অমিত সাহসে মুক্তিযুদ্ধ করা একজন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল আবু তাহের বীর উত্তম এবং একজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়াউদ্দিন বীর উত্তম। উভয়েই ব্যতিক্রমী চিন্তাধারার ব্যক্তি ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের সমালোচনা করেছিলেন প্রত্যক্ষভাবে বা পরোক্ষভাবে। চাকরি আগে চলে গেল জিয়াউদ্দিনের, পরে গেল তাহেরের। জিয়াউদ্দিন যোগদান করলেন গভীর অরণ্যে চলাচলকারী সর্বহারা পার্টিতে এবং তাহের যোগ দেন বাঘের মতো তেজোদীপ্ত জাসদে। আবু তাহের বীর উত্তমকে পেয়ে, জাসদের সংগ্রামী চিন্তায়, ব্যতিক্রমী চিন্তায় জোয়ার এলো। সিদ্ধান্ত হলো, গণবাহিনী সৃষ্টি করা হবে। সামরিক বাহিনী ও রক্ষীবাহিনীর বিকল্প বা সমান্তরাল। জাসদ ক্ষমতায় যাওয়ার পথে এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পরপরই যেন মাঠে ময়দানে শক্তি পায়, সে জন্যই গণবাহিনীর সৃষ্টি। সার্বিক জাসদের অতি ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি এবং গণবাহিনীর বিশেষ দায়িত্বে নিয়োজিত হন কর্নেল আবুতাহের বীর উত্তম। হাসানুল হক ইনু ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ও জ্যেষ্ঠ নেতা। গণবাহিনী এবং গোপন সৈনিক সংস্থার মধ্যে বন্ধুত্ব জোরদার হলো। লক্ষ্য মাত্র একটি, সরকার হটাও। পদ্ধতিও মাত্র একটি, রক্তাক্ত বিপ্লব।

১৫ আগস্ট এবং ৩ নভেম্বর
১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এর ঘটনার জন্য জাসদ প্রস্তুত ছিল না। ঘটনা ঘটাবার মূল নায়ক খোন্দকার মোশতাক এবং কয়েকজন মেজর বা লেফটেন্যান্ট কর্নেল। মেজরেরা ১৫ আগস্টের সাফল্যের পর, বঙ্গভবনে স্থান করে নিলেন এবং সেখান থেকে বের হয়ে সেনানিবাসে ফেরত এসে মূল দায়িত্বে যোগ দিতে চাইলেন না। এদের চেয়েও যারা জ্যেষ্ঠ অফিসার ছিলেন, তারা মনে করলেন এটা তো সাংঘাতিক বিশৃঙ্খলা। যেকোনো নিয়মেই হোক না কেন, বিদ্রোহী মেজরদের সেনানিবাসে ফেরত আনতে হবে। ২৫ আগস্ট ১৯৭৫ থেকে নতুন সেনাবাহিনী প্রধান ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান বীর উত্তম। জিয়ার কাছে এসব বক্তব্য যখন উপস্থাপিত হতো, তিনি ধৈর্য ধরে শুনতেন কিন্তু সমাধান দিতে সময় নিচ্ছিলেন। অন্যান্য জ্যেষ্ঠ অফিসার অস্থির এবং অধৈর্য হয়ে উঠলেন। অস্থির এবং অধৈর্য হয়ে তারা তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তমের নেতৃত্বে একজোট হলেন। তৎকালীন ৪৬ পদাতিক ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল বীর বিক্রম সহায়তায় এগিয়ে এলেন। জিয়াউর রহমানের মতোই, কিন্তু আলাদা, খালেদ মোশাররফের নিজস্ব একটি ক্যারিশমা ছিল। এরা ঠিক করলেন একটি ক্যু-দ্য-তা বা সেনাবিপ্লব ঘটাবেন।

৩ নভেম্বর ১৯৭৫-এ, ১৫ আগস্টের বিপরীতে প্রতি বিপ্লব বা কাউন্টার ক্যু ঘটে গেল। জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হলো সেনানিবাসের বাসায়, সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদচ্যুত করা হলো। খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম নিজে প্রমোশন নিয়ে মেজর জেনারেল হলেন এবং সেনাবাহিনী প্রধান হলেন। বঙ্গভবনে অবস্থানরত মোশতাক সরকার ও তার সহযোগী মেজরদের সাথে দেনদরবারে ব্যস্ত থাকলেন তিন দিন। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় নতুন প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আবু সায়েম। উল্লেখযোগ্য চারটি পয়েন্ট- প্রথম : খালেদ মোশাররফের ভাই এবং মা ঢাকা মহানগরে মিছিল করলেন এবং এমন কিছু কথাবার্তা বললেন যে, সবাই ধরে নিলেন ৩ তারিখের সেনাবিপ্লব ভারতপন্থী আওয়ামী লীগকে পুনরায় ক্ষমতায় স্থাপনের জন্য করা হয়েছে। দ্বিতীয় : ৩ তারিখেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ওই সময় বন্দী বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী স্তরের চারজন জাতীয় নেতা নিহত হলেন। তৃতীয় : সর্বস্তরের সাধারণ সৈনিকেরা বললেন, জিয়াউর রহমানকে পদচ্যুত করা, বন্দী করা অতি অন্যায় কাজ এবং এর বিহিত চাই। এরা বিক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকলেন। চতুর্থ: ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ তারিখের ঘটনায় জাসদ ও গোপন সৈনিক সংস্থা নিজেরাই রাজনৈতিকভাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। জাসদ দেখল যে, সরকার পরিবর্তন হচ্ছে ঠিকই কিন্তু বুর্জুয়া পুঁজিবাদী শক্তির প্রতিনিধিরাই ক্ষমতায় থাকছে। অতএব, আরো নতুন কিছু ঘটার আগে, কিছু একটা করতেই হবে।

দ্বিমুখী বিপ্লব শুরু
জাসদ এবং গোপন সৈনিক সংস্থা ত্বরিত বিপ্লবের সিদ্ধান্ত নিলো। প্রচার করল, অফিসার মারতে হবে; কারণ অফিসারেরা প্রথাগত শৃঙ্খলা ও নিয়মকানুনে বিশ্বাস করে। এ দিকে, বন্দী অবস্থায় জিয়াউর রহমান ভাবলেন, বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে, প্রথম কাজ হলো বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হওয়া। একই সময় জাসদ ভাবল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করতে হবে এবং জিয়াউর রহমানের ভাবমর্যাদাকে কাজে লাগাতে হবে। ৬ নভেম্বর ১৯৭৫ দিনের শেষে, তথা মধ্যরাত ১২:০১ মিনিটে বিপ্লব শুরু হলো। অফিসারদের বাসায় বাসায়, অফিসে অফিসে হামলা হলো। হত্যা করা হলো অনেককেই। নারী (ডাক্তার) অফিসারদের হত্যা বা অপদস্থ করা হলো। অফিসারদের অমান্য করার জন্য প্রকাশ্যে মাইকে ঘোষণা দেয়া হলো। অফিসারদের মধ্যে বেশির ভাগই যে যেদিক পারে, সেদিকে পালিয়ে নিরাপত্তা খুঁজলেন। ঢাকা সেনানিবাসের অনেক ইউনিট বা রেজিমেন্ট বা ব্যাটালিয়ন যেখানে যেখানে গোপন সৈনিক সংস্থা সক্রিয় ছিল, তারা অন্ধকার রাতে সেনানিবাসের রাজপথে নেমে এলো। হাজার হাজার অস্ত্র থেকে বের হওয়া গুলির আওয়াজ কত প্রকট ছিল সেটা বাংলায় কোনো শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারব না। আমি নিজে, বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেই ব্যাটালিয়নে ১৯৭০ সালে জন্ম নিয়েছিলাম এবং যাদের সাথে ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম সেই দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দিলাম রাত সাড়ে ১২টায়। নেতৃত্ব দিলাম সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত।

জিয়া মুক্ত হলেন
জাসদপন্থী সৈনিকদের সঙ্গে হাজার হাজার সাধারণ সৈনিকও বের হয়ে পড়ল। অনেক সৈনিক জেনারেল জিয়ার বাসায় গিয়ে তাকে মুক্ত করলেন। মুক্ত জিয়া পড়লেন এক বিপদে। জাসদপন্থী সৈনিকেরা চাইলেন জিয়াকে নিয়ে যেতে ঢাকা মহানগরীর এলিফ্যান্ট রোডে। সাধারণ সৈনিকেরা চাইলেন জিয়াকে সেনানিবাসে নিরাপদ জায়গায় রাখতে। জিয়া এলিফ্যান্ট রোডে গেলেন না। জাসদের পরিকল্পনা বড় হোঁচট খেল। জাসদ চেয়েছিল, সম্ভবত, জিয়াকে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঘোষণা দেয়াতে, যথা সরকারের সমাজতান্ত্রিক কাঠামো, সরকারের বৈদেশিক নীতি পুনরায় রুশ-ভারতমুখী করা, অফিসারবিহীন সৈনিকের কাঠামো ইত্যাদি। সাধারণ সৈনিকেরা, ব্যক্তিগতভাবে বন্ধুত্ব আছে এমন গোপন সৈনিক সংস্থার সদস্যদের কাছ থেকে অনেক কথাই জানতে পেরেছিল। জিয়া পুনরায় দায়িত্ব নিলেন সেনাবাহিনীর। জাসদপন্থী সৈনিকেরা এবং সাধারণ সৈনিকেরা সেনানিবাসের বিভিন্ন জায়গায় মুখোমুখি হয়ে গেলেন। বিদ্যুৎবিহীন সেনানিবাসে অকল্পনীয় ভীতিকর পরিস্থিতি ছিল।

বঙ্গভবন ঘেরাও ও পরিণতি
সাধারণ সৈনিকদের একটি বড় দল বঙ্গভবন ঘেরাও করল। এতদিন বঙ্গভবন যারা পাহারা দিয়েছিল, তারাও আনুগত্য বদলিয়ে ফেলল সাধারণ সৈনিকদের অনুকূলে। বঙ্গভবনে অবস্থানকারী খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম এবং তার জ্যেষ্ঠ সঙ্গীরা, গোপনে বা ছদ্মবেশে বঙ্গভবন ছাড়েন, জীবন বাঁচানোর জন্য। শোনা গিয়েছিল, জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার তিনজন এক গাড়িতে মিরপুর গাবতলী-আমিন বাজার ব্রিজ পার হয়ে আরিচা হয়ে দুই-তিন শ’ কিলোমিটার পশ্চিমে যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। মিরপুর ব্রিজে বাধাপ্রাপ্ত হন। বিদ্যুৎগতিতে গাড়ি ঘুরিয়ে, দ্রুতগতিতে এসে, ঢাকা মহানগরের শেরেবাংলা নগরে অবস্থিত মুক্তিযোদ্ধা দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে আশ্রয় নেন। এই তিনজন অফিসার এবং দশম বেঙ্গলের মধ্যে আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু ব্যাটালিয়নে সৈনিক মহলে রটে গিয়েছিল যে, এরা ভারতপন্থী, সে জন্য জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেছিলেন এবং এখন পরাজিত হয়ে পলায়নরত আছেন। কিছুক্ষণ পর এরা তিনজন নিহত হন। ৭ নভেম্বর সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টায় তিনজন অফিসারের লাশবাহী একটি হিনো ট্রাক ঢাকা সেনানিবাসে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির অফিসের সামনে আসে। শত শত সৈনিক, কাঁধে অনেকেরই র্যাঙ্ক নেই এরকম ডজন ডজন অফিসার ওখানে উপস্থিত ছিলেন। আমিও উপস্থিত ছিলাম। অফিসের ভেতরে জিয়াউর রহমান উপস্থিত ছিলেন কিছু জ্যেষ্ঠ অফিসার পরিবেষ্টিত।

অভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং সফল জিয়া
ঢাকা সেনানিবাসের সীমিত পরিসর থেকে সৈনিকেরা ভোর ৩-৪টার মধ্যেই ঢাকা মহানগরীর রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্য ওঠার আগে-পরে হাজার হাজার সাধারণ নাগরিক বাংলাদেশের অনুকূলে স্লোগান দিতে দিতে, জিয়াউর রহমান ও সৈনিকদের অনুকূলে স্লোগান দিতে দিতে সৈনিকদের গাড়িতে উঠে তাদের নিয়ে একেক জায়গায় ব্যস্ত হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং জিয়াউর রহমানের অনুকূলে তাদের ভালোবাসা ও আনুগত্য উজাড় করে দিয়ে ঢাকা মহানগরের রাজপথ দখল করে রাখে। জাসদ ওই বিপ্লবের জন্য, প্রধান অস্ত্র বিবেচনা করেছিল জিয়াউর রহমানকে। জিয়াউর রহমানকে নিজেদের আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে না পেয়ে, জাসদ হতবিহ্বল হয়ে পড়ে, কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। কিন্তু ইতোমধ্যেই জাসদপন্থী সৈনিকেরা, যারা এতদিন গোপন ছিলেন, তারা চিহ্নিত হয়ে পড়েছেন সাধারণ সৈনিকদের দৃষ্টিতে। বহুসংখ্যক অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে, অফিস আদালত তছনছ হয়েছে, গোলাগুলির আঘাতে প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে... এর দায়দায়িত্ব জাসদপন্থী সৈনিকদের ওপরই বর্তে গেল। অপর পক্ষে জাসদপন্থী সৈনিকেরা, রাজনৈতিক দল জাসদের ব্যর্থতার জন্য যুগপৎ হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। যেসব সাবেক সেনাকর্মকর্তা জাসদে জড়িত ছিলেন বা যেসব চাকরিরত সেনাকর্মকর্তা জাসদের প্রতি সহমর্মী ছিলেন, তারা সাংঘাতিক বেকায়দায় পড়ে গেলেন। জাসদপন্থী, বামপন্থী বিপ্লব ব্যর্থ করেছে কারা? ব্যর্থ করে দিয়েছিল সাধারণ সৈনিক ও সাধারণ নাগরিকেরা। সৈনিক ও নাগরিকের মধ্যে স্থাপিত বন্ধুত্ব ও সংহতি অভূতপূর্ব ছিল, মুক্তিযুদ্ধকালেই এর একমাত্র উদাহরণ ছিল। তাই ৭ নভেম্বরের একটি নাম ‘জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা পেয়েছে। জিয়াউর রহমান পুনরায় সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ড ফিরিয়ে এনেছেন। জিয়ার নেতৃত্বে সরকারি কাঠামো এবং জনগণ দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করেছে। তাই জিয়া ৭ নভেম্বরের জাসদপন্থী বিপ্লবীদের চরম শত্রু। জিয়া আর পৃথিবীতে নেই, কিন্তু ৭ নভেম্বর বিপ্লবীদের অনেকেই আছেন।

৭ নভেম্বর জাসদের কর্মের কুপ্রভাব
৭ নভেম্বর যেসব অফিসার নিহত হয়েছেন, তাদের হত্যাকারী কে? বেশির ভাগের হত্যাকারী জাসদপন্থী সৈনিক সংস্থা বা জাসদের গণবাহিনী? হত্যাকারীদের নির্দেশদাতা কে? উত্তর, এই লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা গেল না। সৈনিকদের মধ্যে রাজনীতি ঢুকিয়েছিল তৎকালীন জাসদ। যার কুফল পরবর্তী পাঁচ বছর তো বটেই, তিরিশ-চল্লিশ বছর পর্যন্ত লক্ষণীয় ছিল। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আমলে যে ক’টি ব্যর্থ সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান বা বিমানবাহিনীর অভ্যুত্থান হয়, প্রত্যেকটির সাথে জাসদের দেয়া শিক্ষা শ্রেণীবিহীন সমাজব্যবস্থা ও অফিসারবিহীন সামরিক ব্যবস্থার মন্ত্র কাজ করেছে। অফিসারদের হত্যা করার যে রেওয়াজ ৭ নভেম্বর স্থাপিত হয়েছে, তার কুফল ২০০৯ সালের ফেব্র“য়ারিতে ঢাকা মহানগরের পিলখানা পর্যন্ত এসেছে। ১৯৭৭-এ বগুড়ায় ব্যর্থ বিদ্রোহে সেনাবাহিনীর অফিসার হত্যা করা হয়। ১৯৭৭-এ ঢাকায় ব্যর্থ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর সৈনিকদের বিদ্রোহে, অনেক বিমানবাহিনীর অফিসারকে হত্যা করা হয়। প্রত্যেকটি ব্যর্থ বিদ্রোহ দমন করার কাজে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়, আদেশপ্রাপ্ত হয়ে। ১৯৭৫-এর পর, পরবর্তী পাঁচ বছরের রক্তাক্ত ইতিহাসের পেছনে ইন্ধন জুগিয়েছে ১৯৭৫। পিলখানায় নিহত ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা করা হয়েছে, যার রহস্য সন্তোষজনকভাবে উদঘাটিত এখনো হয়নি। ৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর জাসদপন্থী বিপ্লবীরা, সৈনিক হোক বা সাধারণ নাগরিক হোক, যদি বিপ্লবে সফল হতেন, তা হলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কী হতো, বাংলাদেশ সরকারের কী হতো এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার কী হতো? পাঠক নিজেই বিবেচনা করুন।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
www.generalibrahim.com

 


আরো সংবাদ



premium cement