২৮ অক্টোবর : নরহত্যার উৎসব ষড়যন্ত্র ও সহযোগীরা
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৬:৪৬
ভয়াল ২৮ অক্টোবর তথা ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগ যে নরহত্যা উৎসবের আয়োজন করেছিল ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর, তার বার্ষিকী সমাসন্ন। লগি-বৈঠা নিয়ে সেদিন ঢাকায় এসে বঙ্গভবন ঘেরাও করতে বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। তার কর্মীরা সে আহ্বান মেনে হাজার হাজার কাঁচাবাঁশের লাঠি ও কাঠের নতুন বৈঠা নিয়ে ঢাকায় সমবেত হয়েছিলেন। সেদিন সদ্য বিদায়ী বিএনপি জনসমাবেশ ডেকে ছিল নয়াপল্টন, দলীয় কার্যালয়ের সামনে। জামায়াত সমাবেশ ডেকেছিল বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে। আর আওয়ামী লীগ সমাবেশ ডেকেছিল দলীয় কার্যালয়ের সামনে।
বিএনপি ও জামায়াতের লোকদের হাতে এমনকি কোনো লাঠিসোটাও ছিল না। তারা মনে করেছিলেন প্রত্যেকে যার যার মতো সমাবেশ করে, বক্তব্য রেখে চলে যাবেন। কিন্তু সে রকমটা হয়নি। একসময় আওয়ামী লীগের কর্মীরা লগি-বৈঠা হাতে ডাকাত দলের মতো ছুটে আসে জামায়াতের সমাবেশের দিকে। তারপর যাকে সামনে পায় তাকেই পিশাচের উন্মত্ততায় পেটাতে শুরু করে। এই দৃশ্য টেলিভিশন ক্যামেরায় লাইভ দেখানো হচ্ছিল। টিভির সামনে বসে বারবার শিউরে উঠছিলাম। আওয়ামী ঘাতকরা যাদের ওপর দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলে পড়েছিল, ধারণা করি তারা কেউ পরস্পরের পূর্ব পরিচিত নয়। কিন্তু আক্রমণকারীদের সে কি জিজ্ঞাসা!
দেখলাম পাঞ্জাবি পায়জামা পরা এক তরুণের ওপর কিভাবে হামলা চালাচ্ছে আওয়ামী লীগের অমানুষ কর্মীরা। মারের চোটে সে তরুণ রাস্তার ওপর পড়ে গেল। সে অর্ধমৃত শরীরের ওপরই আওয়ামী ঘাতকরা পেটাতে থাকল। আক্রান্ত তরুণ শেষবারের মতো উঠে দাঁড়াল। সম্ভবত সে পানি খেতে চাইছিল। তার সারা শরীর থেকে ঝরছিল রক্ত। ভিজে গিয়েছিল রাজপথ। এ ঘটনা ঘটেছিল পুরানা পল্টন মোড়ে। আমি দু’হাতে চোখ ঢেকে ফেলেছিলাম। কিন্তু চোখ খুলে দেখলাম ছেলেটি আবারও পড়ে গেছে সড়কে। ধারণা করি ততক্ষণে ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে। সেই মৃত লাশের ওপর লগি-বৈঠার পিটুনি চলছে। কেউ কেউ গিয়ে লাশের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ভি (া) চিহ্ন দেখাচ্ছে। আমি এই ভি চিহ্নওয়ালাদের মায়ের কথা চিন্তা করলাম। তিনিও নিশ্চয়ই চাননি তার সন্তান এমন বর্বর ঘাতক হোক। কিন্তু আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ এমন এক মেশিন যার ভেতরে একটি ভদ্র ছেলেকে ঢুকিয়ে দিলেও সে পিশাচ হয়ে বের হয়ে আসে। প্রায় ১০-১৫ মিনিট ধরে এই তাণ্ডব চলল। কোথায়ও পুলিশের একটি বাঁশির আওয়াজও শুনতে পেলাম না। সেদিন এই বীভৎস্য আওয়ামী হামলায় প্রাণ হারিয়েছিল ১১ জন তরুণ। যাদের কোনো বিচার হয়নি। কোনো মামলা দায়েরেরও খবর শুনিনি।
ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে সে সময় এবং পরেও অনেক নিবন্ধাদি প্রকাশিত হয়েছে। তখন একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব ড. মো: আওলাদ হোসেন। তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক। তিনি এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যা পরে ঢাকা টাইমসে প্রকাশিত হয়।
আওলাদ হোসেন লেখেন, ‘স্মৃতি রোমন্থন করলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ভয়াল দিনের ঘটনাগুলো। আরো মনে পড়ে সেদিনের আওয়ামী লীগ নেতাদের জীবন বাজি রাখা ভূমিকাসমূহ। তৎকালীন ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, আওয়ামী যুবলীগ চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির নানক, সিনিয়র সহ-সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক মীর্জা আজম, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ কৃষিবিধ বাহাউদ্দিন নাছিম, সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি লিয়াকত সিকদার, সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বাবু, যুব মহিলা লীগ সভাপতি নাজমা বেগম ও সাধারণ সম্পাদক অপু উকিল এবং শ্রমিক লীগ নেতাদের ভূমিকার কথা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
আওলাদ হোসেন লেখেন, ‘উল্লিখিত নেতাদের নেতৃত্বে নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মীরা পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ‘লগি-বৈঠা’ নিয়ে সকাল থেকেই ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে জমায়েত হতে থাকে। মাননীয় নেত্রী সুধাসদন থেকেই নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলেন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকসমাগম বাড়তে থাকে। লোকসমাগম বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ছাড়িয়ে পল্টন ময়দান পর্যন্ত ছড়িয়ে গেল। মতিঝিল, ডেমরা, শ্যামপুর এলাকার নেতাকর্মীরা দৈনিক বাংলার মোড় হয়ে শাপলা চত্বর পর্যন্ত জমায়েত হতে থাকে। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা নানারকম মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে অবস্থান নিয়েছিল। ফলে দুই গ্রুপ মুখোমুখি হয়ে যায়। জোহর নামাজের একটু আগে, ১২টা-সাড়ে ১২টা নাগাদ টেলিফোনে জানতে পারলাম একটি অ্যাম্বুলেন্স বেশ কয়েকজন লোকসহ রোগী নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে যাবে বলে দৈনিক বাংলা মোড়ে অবস্থানরত মানুষের ভিড় ঠেলে পল্টন মোড়ের দিকে যাচ্ছিল। সেখানে উপস্থিত নেতাদের সহায়তায় মানবিক কারণে সমাগত নেতাকর্মীরা অ্যাম্বুলেন্সটিকে এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেন। তখন কেউই বুঝতে পারেনি, অ্যাম্বুলেন্সের লোকগুলো নানা অস্ত্রে সজ্জিত বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসী। ওরা এসেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের খুন করার জন্য।’
আওলাদ লিখেছেন, ‘মাননীয় নেত্রী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনার সহকারী একান্ত সচিব হিসাবে আমি তখন কর্মরত ছিলাম। পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলার মোড়, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী কার্যালয়ের সামনে সমবেত নেতাকর্মীদের অবস্থান, সার্বিক পরিস্থিতি জানার জন্য নেতাকর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখছিলাম এবং মাননীয় নেত্রীকে পরিস্থিতি সম্পর্কে আপগ্রেড দিচ্ছিলাম। নেতাকর্মীরা যে যার মতো করে ফোন করে পরিস্থিতি জানাচ্ছিলেন। হঠাৎ সংবাদ পেলাম, পূর্বের ওই অ্যাম্বুলেন্সের কিছু লোক হাউজ বিল্ডিং করপোরেশনের দোতলায় এবং অপর কিছু লোক বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটের একটি বিল্ডিংয়ের দোতলায় অবস্থান নিয়েছে। কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে অনুরোধ করলাম তাদের অনুসরণ করার জন্য এবং লোকগুলো সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য দেওয়ার জন্য। অল্পক্ষণ পরই অনুসরণকারীরা জানাল, উক্ত লোকগুলো নানা ধরনের মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের দোতলায় অবস্থানরত লোকগুলো পল্টন মোড়ে অবস্থানরত আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর এবং ভিন্ন গ্রুপটি দৈনিক বাংলা মোড়ে অবস্থানরত নেতাকর্মীদের ওপর গুলিবর্ষণের পরিকল্পনা করছে। এ খবর জানার পর কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করে দুই মোড়ে অবস্থানরত আওয়ামী লীগ নেতাদের অবহিত করলাম। আমার স্পষ্ট মনে আছে, তৎকালীন ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ মন্নাকে আমি ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম, হারুন, তোমার অবস্থান কোথায়? সাথে কে কে আছে? লোকজন কত হবে? সে উত্তরে জানাল হাবিবুর রহমান মোল্লাসহ (মরহুম) হাজার খানেক লোক দৈনিক বাংলার মোড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছি। আমি বললাম, দ্রুত দৈনিক বাংলার মোড়ে সবাই অবস্থান নাও। ওরা দৈনিক বাংলার মোড় দখলে নিয়ে নেবে। হামলা হতে পারে। প্রতিরোধের ব্যবস্থা করো।’
আওলাদ হোসেন লিখেছেন, ‘সত্য বলতে কি, হারুন-অর রশিদের সেদিনের ভূমিকা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। ডেমরা থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি হাবিবুর রহমান মোল্লাসহ বিশাল মিছিল নিয়ে তারা দ্রুত দৈনিক বাংলার মোড়ে অবস্থান নেয় এবং শেষ পর্যন্ত সেই এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখবে বলে মাননীয় নেত্রীকে আশ্বস্ত করেছে।
এদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও মহিলা লীগ নেতাকর্মীরা আগে থেকেই পল্টন মোড় নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।
আওলাদ লিখেছেন, সর্বত্রই এক ভীতিকর ও থমথমে অবস্থা বিরাজমান। এক পর্যায়ে দু’পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলো। এভাবে দুপুর পেরিয়ে বিকাল হয়ে গেল। দু’পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। সাথে গুলিবর্ষণ, বোমাবর্ষণ ও জ্বালাও-পোড়াও। তিনি লিখেছেন, এক পর্যায়ে পুলিশ এসে দু’পক্ষের মাঝখানে অবস্থান নেয়। ‘হঠাৎ জাহাঙ্গীর কবির নানক ভাইয়ের ফোন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন, আমাদের ‘খাবার’ শেষ। পিছু হটতে বাধ্য হচ্ছি। জরুরি ভিত্তিতে ‘খাবার’ লাগবে। ভাবলাম লোকজন বেশি, খাবার শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু এখন খাবার কেন? বুঝতে সামান্য সময় নিলাম। আদিষ্ট হলাম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।
কিভাবে খাবার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি পাঠাব? মূল ফটকের সামনে একটি টিভি চ্যানেলের গাড়ি। রিপোর্টারের খোঁজ নিয়ে জানলাম, শামিম আহমদ। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ কর্মী ছিলেন। আমাদের সাথে খুবই আন্তরিক সম্পর্ক। তাকে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললাম ও সহযোগিতা চাইলাম। পরিস্থিতি বিবেচনা করে তিনি রাজি হলেন। তার গাড়িতে পানির বোতল তুললাম। শত্রু মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ‘খাবার’ পানির নিচে দিলাম। শামিম আহমেদ গাড়ি নিয়ে নানক ভাইয়ের নিকট খাবারের সরঞ্জামাদি হস্তান্তর করলেন। নেতাদের মনোবল বেড়ে গেল। নেতাকর্মীরা বিপুল মনোবল নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ যেন একাত্তরের আরেক রণাঙ্গন।
আওলাদ হোসেনের লেখাটি অনেকাংশে উদ্ধৃত করা হলো সেদিনের ঘটনার আরো খানিকটা সত্য উন্মোচিত করার জন্য। আশা করি পাঠক উপলব্ধি করবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা