উচ্ছিষ্টভোগী আঁতেলরা রেডি হয়ে যান
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ১৮ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:০১
কিছু কাল আগে থেকেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে মাঝারি পর্যায় পর্যন্ত মন্ত্রীরা বলছিলেন, এই যে দুর্গাপূজা আসছে, বিএনপি-জামায়াত নানা উছিলায় এসব স্থানে হামলা করতে পারে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে পারে।
বাংলাদেশ বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যদিও এখানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান। কিন্তু প্রধানত হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে তারা পাশাপাশি অবস্থান করে এই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
আমরা স্কুল-কলেজে এক সাথে বেড়ে উঠেছি। কিন্তু নামগুলো ছাড়া কে হিন্দু কে মুসলমান এ নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো দিন বিরোধ হয়নি। পূজা উপলক্ষে আমাদের গ্রামে মেলার আয়োজন হতো। সেখানে আমরা হইচই করেছি। এক মাঠে খেলেছি। এক কলের পানি খেয়েছি। হোস্টেলে পাশাপাশি ঘুমিয়েছি। সাম্প্রদায়িকতা কী জিনিস সেটা বুঝতে পারিনি। আমরা স্কুলজীবনে উপরের ক্লাসে উঠে অনেকেই ছোটদের রাজনীতি, ছোটদের অর্থনীতি বই পড়ে বড় বড় বামপন্থী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু বামপন্থী আসলে কাকে বলে সেটা বুঝতে আরো বহু দিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমরা বামপন্থী মুরব্বিদের কাছে শুনতাম যে, ধর্মের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ইন্ডিয়া রাষ্ট্রের সৃষ্টি সঠিক হয়নি। এই বিভক্তির সময় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল। সন্দেহ নেই সেটা আমাদের সমাজজীবনে ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতি মাওলানা আবুল কালাম আজাদ লিখে গিয়েছেন যে, জিন্নাহ ভারতের বিভক্তি চাননি। চেয়েছিলেন নেহরু ও করম চাঁদ গান্ধী। জয়া চ্যাটার্জি তার ‘বাংলা ভাগ হলে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা’ বইতে দেখিয়েছেন কিভাবে বনেদি হিন্দুরা ভারত এবং বাংলা ভাগ করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন।
এদিকে হিন্দু শিল্পপতিরাও বাংলা ভাগ করার জন্য সাম্প্রদায়িক শক্তিকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। সেই অর্থ দিয়ে ব্রিটেন থেকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি করেছিল মুসলমানদের শায়েস্তা করার জন্য। এর মধ্যে প্রধান অর্থদাতা ছিল বিরলা গ্রুপ। তাদের ভয় ছিল বাংলায় যেহেতু তখনই সত্তর ভাগ মানুষ মুসলমান ছিল এবং তখন ইস্পাহানিসহ আরো কিছু শিল্পগোষ্ঠী বিকশিত হতে শুরু করেছে- তাতে বাংলা যদি একটি রাজ্য হিসাবে থাকে তাহলে সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা ইস্পাহানির পণ্যই কিনবে, বিরলাদের পণ্য কিনবে না। অতএব বাংলা ভাগ করো। তাতে রক্তগঙ্গা বয়ে গেলে যাক।
সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে কিছু সাম্প্রদায়িক হিন্দু এখানে সবসময় একটা টেনশন তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। এদের আবার সংগঠনও আছে। যেমন, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। এরা আগে থেকেই নানারকম হইচই করতে থাকে এবং আওয়ামী লীগকে ধোয়া তুলসীপাতা সাজিয়ে বিএনপি-জামায়াতকে হিন্দু মুসলমান দ্বন্দ্বের জন্য অভিযুক্ত করতে থাকে। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেখেছি, হিন্দুর জমিজমা ঘরবাড়ি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দখল করে আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি কুমিল্লায় ঘটেছে এমনি একটি ঘটনা। কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে পূজা উদযাপন নিয়ে সম্প্রতি একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় কুমিল্লা সদর আসনের এমপি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার মদমুক্ত পূজা করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ অক্টোবর বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে এমপির বক্তব্যকে সাম্প্রদায়িক উক্তি আখ্যা দিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। এই প্রতিবাদের প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার কুমিল্লার টাউন হল মিলনায়তনে মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের ব্যানারে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরিষদের সভাপতি শিব প্রসাদ রায় অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন। প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এমপি। তিনি বলেন, তার এই বক্তব্যকে রাজনৈতিক কারণে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ। পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতাদের এমন বিবৃতিতে তিনি হতবাক। তবে কুমিল্লা মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শিব প্রসাদ রায়, সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু, কান্তি রাহা, পাপড়ি বসুসহ নেতারা তাদের বক্তব্যে এমপির মদমুক্ত পূজা উদযাপনের আহ্বানকে স্বাগত জানান। এমপির বক্তব্য বিকৃত করে বিবৃতি দেয়ার প্রতিবাদে ১০১ জন হিন্দু নেতার স্বাক্ষর সংবলিত একটি প্রতিবাদলিপি পড়ে শোনানো হয়। সভায় ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী শুক্রবার মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ব্যানারে নগরীর কান্দিরপাড় এলাকায় মিছিল বের করে। এদিন সকালে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদ ও ছাত্র ঐক্য পরিষদ, কুমিল্লা জেলা ও মহানগর শাখার ব্যানারে নগরীর নজরুল এভিনিউ এলাকার বিভিন্ন জায়গায় পূজার প্রাক্কালে মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরের অভিযোগে প্রতিবাদ, মানববন্ধন ও মিছিল করে। এ সময় যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের ধাওয়া করে। এতে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
বিকালে নগর পাড়ার শ্মশান কালীবাড়ি মন্দির প্রাঙ্গণে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলন করে। এর জন্য এমপি বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী নেতাকর্মীদের দায়ী করে পরিষদের কুমিল্লা শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ তাপস বকসী বলেন, মহানগর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে হামলা চালায়। এ ঘটনায় অন্তত তিনজন আহত হয়েছে। তিনি এই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানান। এ সময় পরিষদের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আহমদ মঞ্জুর মোর্শেদ জানান, আহতদের বাসায় গিয়ে তাদের খোঁজখবর নেয়া হয়েছে। ঘটনায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনাসহ সব ধরনের আইনি সহায়তার আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
কুমিল্লায় হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের কর্মসূচিতে হামলার প্রতিবাদ ও জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন পরিষদের নেতাকর্মীরা। এদিকে বিভিন্ন দাবিতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় কর্মসূচি পালন করেছে ঐক্য পরিষদ। ঐক্য পরিষদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে হচ্ছিল। তখন কেন্দ্রীয় নেতারা কুমিল্লায় হামলার খবর পান এবং জানতে পারেন যে, কুমিল্লার সংসদ সদস্য বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারীরাই হামলা চালিয়েছে। তখন পরিষদ নেতারা মিছিল নিয়ে শাহবাগে যান। সেখানে তারা বিভিন্ন স্লোগান ও বক্তব্য দেন।
পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক রানা দাশ গুপ্ত বলেন, কয়েক দিন আগে মুন্সীগঞ্জের পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লব আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাশকে সাম্প্রদায়িক গালি দেন। মৃণাল কান্তির বিরুদ্ধে জনসমক্ষে আরো নানা সাম্প্রদায়িক কটূক্তি করেন। সে ঘটনায় তারা নিন্দা প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলেন। ফয়সালের বিরুদ্ধে অবিলম্বে সাংগঠনিক ও আইনগত প্রশাসনিক ব্যবস্থার দাবি জানান তারা।
৪ অক্টোবর কুমিল্লা জেলা পরিষদ কার্যালয়ে আসন্ন শারদীয় দুর্গাপূজা নিয়ে একটি সভা হয়। সেখানে স্থানীয় সংসদ সদস্য নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের লাখ লাখ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছেন। উক্ত পরিষদ প্রতিবাদ জানালে তিনি প্রতিহতের ঘোষণা দেন।
রানা দাশ গুপ্ত আরো বলেন, তাদের ভোটে যারা সংসদ সদস্য হন, গাড়ি পান আজকে তারাই তাদের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। দুর্গাপূজা সামনে রেখে তারা বলে আসছিলেন এ উৎসব যাতে শান্তিপূর্ণভাবে না হতে পারে সে জন্য মহল বিশেষ চেষ্টা করছে। সাম্প্রদায়িক গালাগাল ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, দুর্গাপূজার প্রাক্কালে মন্দিরে হামলা ভাঙচুর প্রভৃতি ঘটনার প্রতিবাদে পরিষদ সারা দেশে শান্তিপূর্ণ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিল। কুমিল্লার হামলার ঘটনায় তারা যন্ত্রণায় কাতর। তাদের অন্তর জ্বলছে।
এই পরিস্থিতিতে কুমিল্লার ঘটনার জন্য কিভাবে বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা যায় নিশ্চয়ই তার কোশেশ চলছে।
ওবায়দুল কাদের বলতে পারেন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগে কাউয়া ঢুকে গেছে। জামায়াত-বিএনপি ছদ্মবেশে এই কাণ্ড করেছে। কিছু উচ্ছিষ্টভোগী আঁতেল বলতে পারেন এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনাশে পাকিস্তানপন্থীদের ষড়যন্ত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি বলতে পারে, জামায়াত-বিএনপিকে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে নিষিদ্ধ করা হোক।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা