ভঙ্গুর রাজনীতির টানাপড়েন
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:০৪
বাংলাদেশের মানুষের আতঙ্কের শেষ নেই, সবাই উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। সংবিধান মোতাবেক চলতি ২০২৩ সালের অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা। সব কিছু ঠিক থাকলে নির্বাচনের মাঠ গরম হওয়ার এখনই সময়। কিন্তু দু’টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত এখনও চূড়ান্ত হতে বাকি। ক্ষমতাসীন সরকার বলছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্য দিকে, বিরোধী দল বলছে শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। বিরোধীদের যুক্তি ২০১৪ ও ২০১৮ সালে নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও প্রশাসনের কারসাজিতেই ভোট হয়েছে, গায়েবি মোকদ্দমা ছিল সরকারের হাতিয়ার।
প্রার্থী ও ভোটারবিহীন নির্বাচনকে বিশ্ব স্বীকৃতি না দেয়ায় আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশ্বসহ জাতিসঙ্ঘ কোনোরূপ রাখঢাক না করে স্পষ্টভাবেই গ্রহণযোগ্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলছে। এ মর্মে আমেরিকা অত্যন্ত জোর দিয়েই বলছে, নির্বাচন অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক হতে হবে, কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা আমেরিকা কখনও বলেনি। পক্ষান্তরে রাশিয়া ও চীন নির্বাচন নিয়ে সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আবার ভারতের ভূমিকা নিয়েও অনেক টানাপড়েন চলছে। প্রচার রয়েছে, ভারতের বিরোধিতার কারণে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী ব্রিকস সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। অন্য দিকে, রাষ্ট্রপ্রধান উপস্থিত না হয়েও ইউথিওপিয়া সদস্যপদ লাভ করেছে।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস রাজনৈতিক দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশ্যে রাজনৈতিক দলের মধ্যে বাক-বিতণ্ডা যা-ই হোক না কেন, তলে তলে আসন ভাগাভাগিসহ নমিনেশন পাবার তদবির শুরু হয়ে গেছে। পত্রিকার ভাষ্যমতে বিদেশেও অনুরূপ বৈঠক চলছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য হলো ক্ষমতা। ক্ষমতার জন্য যে কারো সাথে কারো নির্বাচনী ঐক্য করে রাজনৈতিক হাইপ্রোফাইল। রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ভোটাধিকার নেই। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও চলছে এক নায়কতন্ত্র, সেখানেও গণমানুষের কোনো স্বাধীনতা নেই, তবে জীবন ধারণ অর্থাৎ খেয়ে পরে বাঁচার রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রয়েছে। প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে ব্রিটেন ও আমেরিকায়। আমেরিকাতেও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোটের ফল পরিবর্তনের অভিযোগ, যার কারণে তিনি এখন জামানতে জামিনে আছেন। বাংলাদেশের নির্বাচনে শাসক দলের বিরুদ্ধে কারচুপির অনেক অভিযোগ করলেও কোনও আদালত তা আমলে নেয়নি। একটি মজবুত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য স্বাধীন বিচারব্যবস্থা দরকার।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৪৯টি যার মধ্যে ইতোমধ্যে চারটি দলের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে।
সবগুলো দলেরই নিজস্ব এজেন্ডা রয়েছে। জনগণ দল চেনে না, মার্কা চেনে এবং চিনতে ও জানতে চায় না। ভোটাধিকার প্রয়োগে এ দেশের মানুষ বিবেক দিয়ে চলে না; বরং হুজুগে চলে- এ প্রবাদ দীর্ঘদিনের। এ দেশের মানুষ ক্ষমতাপ্রিয়, এ দেশে ক্ষমতায় থাকাবস্থায় যে রাজনৈতিক দলের উৎপত্তি হয়েছে তারাই টিকতে পেরেছে, অন্যান্য দল টিকতে পারছে না, জোটবদ্ধ হয়েও নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে পারছে না। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো বড় দলকেও জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে হয়, যদিও জাতীয় পার্টির উৎপত্তি ক্ষমতার মসনদ থেকে। জোটে না থাকলে জেলখানা, থাকলে মন্ত্রিত্ব যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত জেনারেল এরশাদ। এ দেশের ভোটাররা প্রার্থীর মূল্যায়ন করে না, ভোট দেয়ার ক্ষেত্রে দু’টি বিষয় মূল্যায়িত হয়। তা হলো নির্বাচনী মার্কা এবং ক্ষেত্রবিশেষে টাকা। নমিনেশন মূল্যায়িত হয় লবিং অথবা টাকায়, জনসম্পৃক্ততা বিবেচনায় আসে না। স্বর্ণ চোরাচালান বা ব্যাংক লুট বা যেভাবেই হোক টাকা হলেই হলো, জনগণ টাকার উৎসের কথা বিবেচনায় নেয় না। ভালো-মন্দ জানতে চায় না।
রাজনৈতিক অঙ্গনে নমিনেশন প্রাপ্তির প্রক্রিয়াগত বিষয়টি খুব সম্মানজনক নয়। ত্যাগ বা যোগ্যতা নমিনেশন প্রশ্নে মূল্যায়িত হয় না। মূল্যায়িত হয় লবিং ও টাকা। অন্য দিকে, সবচেয়ে বেশি মূল্যায়িত হয় পরিবারতন্ত্রের আশীর্বাদ। পরিবারতন্ত্রের আশীর্বাদ পাওয়ার জন্য অনেক মশলা ও কাঠখড় পোড়াতে হয়। ফলে এ পদ্ধতিতে এমপি পদে যারা নির্বাচিত হন তখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে জনগণের ভাগ্যকে তাদের নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেন। এ জন্যই অনেকে জাতীয় সংসদকে জনগণের নয়; বরং বড় লোকদের একটি ক্লাব বলে মন্তব্য করে আসছেন। শুধু টাকার জোরে চলতি সংসদে স্বামী-স্ত্রী এক সাথে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, যদিও তাদের জনভিত্তি ছিল না।
জনতার স্বার্থ জনগণই বিচার-বিবেচনা করে না। তারা বিবেক খাটিয়ে কথা বলার প্রস্তুতি নেয় না। কারণ রাজনীতিতে বিবেকসম্পন্ন কথার কোনো মূল্য নেই; বরং মূল্য রয়েছে তেলবাজির।
কোনো রাজনৈতিক দলই জনসমর্থনে টইটম্বুর নয়, যতটুকু রয়েছে তাদের গলাবাজিতে, বিশেষ করে শাসকদলে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, স্থানীয় পর্যায়ে এমপিদের রামরাজত্ব, প্রজাতন্ত্রের একপেশে দলবাজি, সর্বক্ষেত্রে তথা চাকরি প্রমোশন প্রভৃতিতে দলীয়করণ- সব বিষয় একত্রিত হয়ে জনগণ ও সরকার মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু দেশের আইন-আদালত, পুলিশ, প্রশাসন এবং নিরপেক্ষ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি তাঁবেদারিতে ব্যস্ত। ফলে জনতার স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না। বাংলাদেশে প্রতিটি ডাবের মূল্য ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত ওঠানামা করে।
টাকা ছাড়া সরকারি সেবা পাওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী জোর গলায় বলছেন, তিনফসলি জমি ভরাট করা যাবে না। অথচ চিহ্নিত ভূমিদস্যুরা রাজধানীর আশপাশে তিনফসলি জমি ভরাট করে ফেলছে। সুপ্রিম কোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিলেও ভূমিদস্যুদের থামাতে পারছে না। সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছিলেন, ‘আমরা কনটেম্পট করতে করতে হয়রান।’ কারণ সুপ্রিম কোর্টের আদেশ যারা কার্যকর করার দায়িত্বপ্রাপ্ত অর্থাৎ ডিসি, এসপি ও পরিবেশ অধিদফতর তারা সবাই ভূমিদস্যুদের পকেটে।
রাজনীতিতে স্বচ্ছতা আনার প্রশ্নে জনগণের ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। সে সুযোগ রাজনৈতিক দলকে করে দিতে হবে। সময়ে সময়ে জনগণ সোচ্চার না হওয়ার কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদলে গড়ে ওঠা আমলাতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা জাতিকে শাসন শোষণ করছে। ব্রিটিশদের ফিরিঙ্গিবাহিনী বা সে আমলের জমিদারদের লাঠিয়ালবাহিনী জনগণকে যেভাবে শাসন শোষণ করছে তার ব্যতিক্রম করছে না বর্তমানের আমলা ও আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। পানির ধর্ম যেমন নিচের দিকে গড়ানো, তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আমলাদের অনুরূপ চরিত্র, তাদের শাসন শোষণ শুধু দুর্বলের প্রতি।
‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ এ প্রবাদটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত। এ থেকে উত্তরণ হওয়ার জন্য দেশটি দুবার (১৯৪৭ ও ১৯৭১) স্বাধীন হয়েছিল, এখন প্রয়োজন মানসিক দাসত্ব থেকে বাঁচার লড়াই, সে লড়াই হবে গণমানুষের মুক্তির লড়াই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নিশ্চয় একসময় এ মর্মে এগিয়ে আসবে। মানসিক দাসত্বের কারণেই গণমানুষ আজ ন্যায়বিচার, প্রভাবমুক্ত সমাজ ও সম্পদের সুষম বণ্টন থেকে বঞ্চিত। দেশে সম্পদের অভাব নেই, কিন্তু সে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে ১-৫ শতাংশ মানুষের হাতের মুঠোয়, যাদের জন্য বাংলাদেশ হয়ে গেছে স্বর্গরাজ্য, বাকিদের জন্য রয়ে গেছে ‘বাঁচা মরার লড়াই’, অর্থাৎ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা