উন্নয়নের শাক দিয়ে গণতন্ত্রের মাছ ঢাকা
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০৬:৪৪
গণতন্ত্রের প্র্যাকটিস করার স্টেকহোল্ডার হলো মূলত সরকার, রাজনৈতিক দল ও জনগণ। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনগণের সমর্থনে রাজনৈতিক দল সরকার গঠন করে রাষ্ট্রশাসন করে। জনগণের সমর্থন বা আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে, যদি সে নির্বাচন হয় প্রভাবমুক্ত, গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের বর্ণনামতে, জনগণের কাক্সিক্ষত নির্বাচন চলে গেছে এখন ‘নির্বাসনে’। জনগণের ভোটভিত্তিক নির্বাচন হয় না, টেলিভিশনের পর্দাই পাস-ফেল নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। রাষ্ট্রটির লিগ্যাল বা সাংবিধানিক নাম হচ্ছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ অধিকন্তু সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক, জনগণই হচ্ছে রাষ্ট্রের মালিক। অথচ রাষ্ট্রের মালিক তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনে অসহায়। এ জন্য ১. জনগণের অসচেতনতা অথবা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা বারবার ধোঁকা খাওয়ার হতাশা; ২. গণতন্ত্রের প্র্যাকটিসবিমুখ রাজনৈতিক দল ও ৩. উদ্দেশ্যবিহীন সংগঠিত রাজনৈতিক কর্মীবাহিনী।
বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় ১৮ কোটি। এর মধ্যে সচেতন মানুষ রয়েছে, কিন্তু সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের বেশিরভাগই অসচেতন। অন্য একটি শ্রেণী রয়েছে যারা সংখ্যায় কম হলেও কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে। এ জন্য দলের নমিনেশন বাণিজ্যের একতরফা মার্কেট দখল করেছে হাতেগোনা দু’-একটি দল। ফলে নমিনেশন বাণিজ্যে টাকার খেলায় সমাজের ভালো লোক, দলের নিবেদিতপ্রাণ, ক্লিন ইমেজের লোকেরা ব্যাংকলুটেরা ও মানিলন্ডারিং হোতাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেন না। নমিনেশন বাণিজ্যে ব্যাংকলুটেরা দিন দিন প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে বিধায় পার্লামেন্টে রাজপথের রাজনীতিবিদদের সংখ্যা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নমিনেশন বাণিজ্য সফল হওয়ার প্রধান কারণ- এ দেশের মানুষ প্রার্থী চেনে না, চেনে মার্কা এবং এ কারণেই ব্যাংকলুটেরা রাজনীতি না করেই জনগণের প্রতিনিধি বনে যাচ্ছেন টাকার বিনিময়ে। তারা নির্বাচনী মার্কা ক্রয় করেন, জনগণের সমর্থন প্রয়োজন হয় না।
বড় বড় রাজনৈতিক দল মেধার ক্রমবিকাশ ও রাজনীতি জ্ঞানসম্পন্ন একটি কর্মীবাহিনী তৈরির পরিবর্তে ক্ষমতা ভোগের আকাশচুম্বী প্রত্যাশায় তাদের বিভোর করে তোলা হয়। ফলে ক্ষমতার পরিবর্তন হলে দলের নীতি-আদর্শ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে হাট, ঘাট, বাজার, পরিবহন সেক্টর- প্রভৃতি দখল ও টেন্ডার বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে শুরু হয় অবিরাম লুটপাট। প্রতিযোগিতা শুরু হয় সম্পদ প্রাপ্তি-পাচার। একটি রাজনৈতিক মেধাসম্পন্ন কর্মী গড়ে তোলার জন্য নিম্নবর্ণিত বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হবে, যথা- ১. অব্যাহতভাবে জ্ঞানার্জন; ২. প্রশিক্ষণ; ৩. স্থানীয় ও জাতীয় সমস্যা নিরসন করার জন্য ক্রমাগত চিন্তাশীল হওয়া এবং ৪. গবেষণা।
এই চারটি বিষয়ে পারদর্শী না হলে কর্মীবাহিনী লুটপাটের প্রতিযোগিতায় নামা ছাড়া আর কোনো কাজেই আসে না। একটি রাষ্ট্রকে সমস্যামুক্ত করার জন্য প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভূমিকা থাকা অপরিহার্য। কিন্তু দল যখন ব্যক্তি মালিকানায় পরিণত হয় তখন দলীয় পরিচালনায় কর্মীদের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা থাকে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্টের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি করার সময় শিক্ষক পড়িয়েছেন যে, Great Organization is Run by it’s Rules, on the other hand Private organization is Run by the decision of the Owner-এ মতবাদ অনুযায়ী একটি বড় সংগঠন তার সংবিধানে নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা, কিন্তু ব্যক্তি মালিকানাধীন দলে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম সাধন হয় বলে কর্মীরা দল পরিচালনায় অংশগ্রহণমূলক অবদান দলে রাখার সুযোগ পান না, অন্য দিকে চাটুকারদের তোপের মুখে নিবেদিত কর্মীবাহিনী গড়ে উঠতে পারে না।
আমি মনে করি, ক্রমাগত সাংগঠনিক প্রক্রিয়ার নাম রাজনীতি এবং এর অপর নাম আন্দোলন। রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে নিম্নমুখী অর্থাৎ নিম্নস্তর পর্যন্ত সাংগঠনিক বিন্যাস থাকতে হবে, যারা নিজেরাই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা পাবে। বর্তমানে রাজনীতি হয়ে গেছে কেন্দ্রভিত্তিক তথা ঢাকাকেন্দ্রিক। একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী দেয়ার সিদ্ধান্ত স্থানীয় কর্মীরা নিতে পারেন না। ঢাকার নেতাদের যেভাবেই হোক বাগে এনে নমিনেশন নিয়ে এলাকায় পৌঁছতে পারলেই স্থানীয় সবার দায়িত্ব হয়ে পড়ে প্রার্থীকে খুশি রাখা। প্রার্থী হওয়ার জন্য স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পেছনে এখন আর ধরনা দিতে হয় না, টাকার বস্তা যা দরকার তা ঢাকাতেই বিলি-বণ্টন করলে মনোবাসনা পূর্ণ হয়। ক্ষমতাসীন সরকার স্থানীয় সরকার নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের নমিনেশন পদ্ধতি আইনগতভাবে প্রতিষ্ঠিত করে স্থানীয় জনগণকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে কেন্দ্রমুখী করে স্থানীয়দের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। দলীয় নমিনেশনে রাজনৈতিক মার্কায় স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোট প্রদানে এ দেশের জনগণ অভ্যস্ত নয় বিধায় সঙ্গত কারণেই জনগণ এ পদ্ধতি মেনে নেয়নি, যার অবসান হওয়া আবশ্যক।
রাজনীতিতে গুণগতমান বৃদ্ধি পেলে পাল্টা-পাল্টি অস্বচ্ছ ও অশোভন প্রতিযোগিতা কমে আসত, রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলা করা হতো কিন্তু বর্তমানে তা করা হয় পুলিশ দিয়ে, নতুবা হামলা-পাল্টা হামলা অথবা গায়েবি মামলায় অভিযুক্ত করার মাধ্যমে।
স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলের কর্মীবাহিনীর চেয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও সাংগঠনিক ভিত্তি অনেক শক্তিশালী। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আদলে গড়ে উঠেছে পাক-ভারত উপমহাদেশের প্রশাসনিক পদ্ধতি। এখানে প্রশাসন জনমুখী নয়; বরং জনগণকে প্রশাসনমুখী হতে হচ্ছে। প্রশাসনের কাছে জনপ্রতিনিধিরা অসহায়, এমন বক্তব্য পার্লামেন্টেই উপস্থাপিত হয়েছে অনেকবার।
যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবন। যে থাকে ক্ষমতায় সেই নির্বাচনী ব্যবস্থাকে করে কলুষিত। মানুষের অধিকারকে হরণ করা হয় উন্নয়নের দোহাই দিয়ে। উন্নয়নের ‘শাক’ দিয়ে গণতন্ত্রের ‘মাছ’ ঢেকে দেয়া ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। আমেরিকা ব্রিটেনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বা ক্ষমতা হস্তান্তরের পদ্ধতি যেভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে, অনুরূপ পাক-ভারত উপমহাদেশে তো বটেই, পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন- রাশিয়া, চীনসহ কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে গড়ে ওঠেনি, অধিকন্তু সম্প্রতি বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে।
ক্ষমতায় থাকতেই হবে, এ প্রবণতা তখনই একরোখা দাবিতে পরিণত হয় যখন ক্ষমতাসীনরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে, রাষ্ট্রের কর্মচারীরা পেশাগত দায়িত্ব ভুলে যখন দলীয় কর্মীর মতো আচরণ করে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। হালে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা চলছে একপেশে অর্থাৎ তাদের সেবা পাচ্ছে সরকারি ঘরানার লোক। অথচ সংবিধানের ২১(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল সময়ে জনগণের সেবা করিবার চেষ্টা করা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তির কর্তব্য।’
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা