মাওলানার মৃত্যু ও শোকার্ত ছাত্রলীগকর্মীরা
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২৩ আগস্ট ২০২৩, ০৬:২৩
দেশের বিশিষ্ট আলেম, ওয়ায়েজ, সাবেক এমপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ইন্তেকাল করেছেন গত ১৪ আগস্ট। এ খবর প্রকাশের পর সামাজিকমাধ্যমে শোকবার্তার ঢল নামে। কতশত মানুষ শোক জানান, হিসাব রাখা অসম্ভব। সে চেষ্টাও করিনি। তবে বোঝার চেষ্টা করেছি, সমাজের কোন ধরনের মানুষ শোক জানাচ্ছেন। এরা কি সবাই কথিত স্বাধীনতাবিরোধী দল জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মী, সমর্থক? সবাই কি ইসলামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত? সবাই কি, কেবলই ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী? পুরো বিষয়টি অনুসরণ করা দুঃসাধ্য মনে হচ্ছিল। কারণ পরিচিতজন ছাড়া আর কারোই ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস জানার কোনো উপায় নেই। তার পরও দেখেশুনে নিশ্চিত হয়েছি, শুধু জামায়াত, শুধু ইসলামী রাজনীতি এবং শুধু ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরা নন, সর্বস্তরের মানুষই শোক প্রকাশ করছেন। মৃত্যুর খবর শুনে মুসলমানরা পবিত্র কুরআনের যে আয়াত পাঠ করেন সেটি, ‘ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন’ অর্থাৎ ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চিতই আমাদেরকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে’- লিখে শোক প্রকাশ করেছেন। এটি মৃতের জন্য কোনো দোয়া বা প্রার্থনা নয়, মৃতের রূহের মুক্তি বা কল্যাণের আকাক্সক্ষা জানানো নয়, বরং এটি হলো নিজেকেই মনে করিয়ে দেয়া যে, আমারও মৃত্যু হবে এবং সে কথা মাথায় রেখেই আমাকে জীবনযাপন করতে হবে। অনেকে এই আয়াত স্মরণ করার পাশাপাশি মাওলানার রূহের মাগফিরাত কামনা করেছেন। কেউ ছবি দিয়ে, কেউ ছবিসহ নানা ধরনের রঙিন কার্ড তৈরি করে। অনেকে তার বিষয়ে ছোট বড় নানা বর্ণনা, তার ওয়াজ শোনার অভিজ্ঞতা, তাঁর সঙ্গে পরিচয়ের বা তাঁকে দেখার আবেগপ্রবণ বিবরণ দিয়েছেন। এসবের মধ্য দিয়ে মাওলানার প্রতি পোস্টদাতার অনুভূতি, শ্রদ্ধা, আন্তরিকতার ভিন্ন মাত্রা বোঝা গেছে।
আমার পর্যবেক্ষণের বিষয়টি শিগগিরই সহজ করে দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। সেইসঙ্গে সুখরঞ্জন বালীর বক্তব্য। কথাটা শুনে যদি বিস্মিত হন, তাহলে আর একটু পড়ুন।
মাওলানা সাঈদীর নামাজে জানাজা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে পারেনি প্রশাসনের তথা সরকারের বাধার কারণে। এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নেই। কোন্ বিষয়েই বা থাকে? একজন দণ্ডিত আসামির মৃত্যু হলে তার স্বজনেরা তাদের পছন্দের জায়গায় জানাজা করতে পারবেন না, পৃথিবীর কোথাও আইন এতটা নিষ্ঠুর নয়। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারি দল নিষ্ঠুর। একজন মৃত ব্যক্তিকেও তাদের ভয় পাবার কারণ আছে। মাওলানা সাঈদীর একটি আদর্শ ছিল, সেই আদর্শ ইসলামের জন্যই তিনি আজীবন কাজ করেছেন। তার সংগ্রামের অন্যতম হাতিয়ার ছিল অপূর্ব বাগ্মিতা ও সুললিত কণ্ঠস্বর। ধর্মীয় বক্তৃতা বা ওয়াজের মাধ্যমে তিনি আদর্শের প্রচার চালিয়েছেন। সেসব বক্তৃতা ক্যাসেটবন্দী হয়ে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এমনকি বিশে^রও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু এই আদর্শ রুখে দেয়ার মতো কোনো জোরালো আদর্শ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেই। এমনকি দলটি যে গণতন্ত্রের জন্য নিবেদিত বলে দাবি করে সেই গণতন্ত্র তাদের শাসনামলের কোনো পর্বেই স্বস্তিতে ছিল না। স্বাধীনতার পর ক্ষমতা পেয়ে তথাকথিত দ্বিতীয় বিপ্লবের নামে তারা গণতন্ত্রের কবর রচনা করেন। বর্তমানে ঘোষণা দিয়ে একদলীয় ব্যবস্থা কায়েম না করলেও কেমন শাসনব্যবস্থা তারা অনুসরণ করছেন তা দেশের প্রতিটি মানুষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।
বিশেষ করে টের পেয়েছেন ছাত্রলীগের সেই সব তরুণ নেতাকর্মী যারা একজন বিশিষ্ট ওয়ায়েজের মৃত্যুতে ফেসবুকে শোক জানিয়েছিলেন। মুসলিম হিসাবে পবিত্র কালামের অংশবিশেষ স্মরণ করেছিলেন, ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চিতই আমাদেরকে তাঁর কাছে ফিরে যেতে হবে।’ কিন্তু পবিত্র কালাম সম্ভবত ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের পছন্দ না। মুসলিম সংস্কৃতির কোনো কিছুই তাদের পছন্দের না। ‘নারায়ে তাকবির/আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে তাদের আপত্তি, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিমে’ তাদের আপত্তি, ‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে আপত্তি, এমনকি ইসলামও তাদের পছন্দের কিনা, এমন সংশয় জাগে যখন দেখি ‘ইসলাম মানেই জঙ্গি’ বলে সরকারি দলের কোনো কোনো লোক ঘোষণা করছেন যদিও তাহাজ্জুদের নামাজে তাদের বেশ ভক্তি। আর কেউ তাদেরকে ‘হঠাৎ মুসলমান’ বলে বেফাঁস মন্তব্য করলে তারা এমনই রুষ্ট হয়ে ওঠেন যে, মাসের পর মাস জাতীয় সংসদ অচল করে দিতেও কুণ্ঠিত হন না। মোট কথা, নিজেদেরকে ইসলাম পছন্দ দল হিসাবে প্রমাণে তাদের প্রয়াস মরিয়া এবং প্রাণান্ত।
যাই হোক, মাওলানা সাঈদীর প্রতি শোক জ্ঞাপনের কারণে শুধু ছাত্রলীগের কয়েক শ’ নেতাকর্মী দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার হয়েছেন তা-ই নয়, মসজিদের ভেতরে লাঞ্ছিত ও পদচ্যুত হয়েছেন মসজিদের খতিব ও ইমাম, চাকরি হারিয়েছেন মাদ্রাসার শিক্ষক, এমনকি শাস্তির মুখে পড়েছেন সরকারি কর্মচারী এক পুলিশ সদস্যও।
ফেনী সদর উপজেলার ফকিরহাট বাজার মাদরাসা জামে মসজিদে জুমার নামাজের পর মাওলানা সাঈদীর রূহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া করার কারণে মসজিদের ভেতরেই ছাত্রলীগের নেতার হামলার শিকার হন মসজিদের খতিব ও ইমাম মাওলানা মো. সলিমুল্লাহ। তাকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।
ফেসবুকে ‘ইন্নালিল্লাহ’ লিখে মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানানোয় চাকরি খুইয়েছেন চট্টগ্রামের জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদরাসার ইবতেদায়ি শিক্ষক আবু সালেহ মো. যোবায়ের।
রাজশাহী মহানগর পুলিশের সদস্য খায়রুল ইসলাম মাওলানা সাঈদীর মৃত্যুতে শোক জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় এখন শাস্তির মুখে। গত ১৪ আগস্ট রাতে সাঈদীর মৃত্যুর পর শোক প্রকাশ করে পোস্ট দেন তিনি। মজার বিষয়, ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন আরএমপির কোর্ট ইন্সপেক্টর পদে কর্মরত খায়রুল ইসলাম।
১৫ আগস্ট কক্সবাজারের চকরিয়ায় মাওলানা সাঈদীর গায়েবানা জানাজার আয়োজনে এক জামায়াতকর্মী নিহত হয়েছেন। খোদ আওয়ামী লীগ দলীয় এমপির নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সশস্ত্র মিছিল থেকে গুলিবর্ষণে নিহত হন ফোরকানুর রহমান (৫০) বলে পত্রিকার খবর। ঘটনাস্থলে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগের সশস্ত্র মিছিলকারী ও গায়েবানা জানাজায় উপস্থিত মুসল্লিরা ছিলেন। পুলিশ বলেছে, তারা গুলি চালায়নি। এমপির মিছিলে কারা ভারী আগ্নেয়াস্ত্রসহ উপস্থিত ছিল এবং কার অস্ত্র থেকে গুলি করা হয়েছে সেসবের ভিডিওচিত্র এরই মধ্যে ফেসবুকে ভাইরাল। তথ্যপ্রমাণ ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। সুতরাং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ বা অন্য কেউ ঘটনার দায় অস্বীকার করলেও আমরা কোনো বিতর্কে যাবো না।
আমরা বরং শুরুতে যে পর্যবেক্ষণের কথা বলছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরি। প্রমাণ হয়েছে, দেশের সর্বস্তরের মানুষ মাওলানার মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তবে ছাত্রলীগ বা আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করায় আমাদের বিস্ময়ের অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। সেটি হলো, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলছেন, তাদের সংগঠনের আদর্শবিরোধী কেউ কেউ নাকি সংগঠনে জায়গা করে নিয়েছিল। তাদের মুখোশ উন্মোচন হয়েছে। তাহলে কি বুঝতে হবে, ছাত্রলীগে, তাদের ভাষায়, রাজাকারের ছেলেরা ঢুকে পড়েছে? কেবল তো সাধারণ কর্মী-সমর্থকই নন, ছাত্রলীগের অনেক নেতারও দলের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার অভাব বা ঈমানের দুর্বলতা আছে মনে হচ্ছে। কারণ, অনেক নেতাও শোক জানান। সংগঠনটিতে যদি মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকত তাহলে কী হতো অবস্থা? দেশে যদি বাক-স্বাধীনতা থাকত তাহলে সাঈদীর মৃত্যু ঘিরে, এমনকি মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে কী হতো জনমতের প্রতিফলন?
গত ১৫ আগস্ট নরসিংদীর রায়পুরায় স্থানীয় এমপির প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সঙ্গে জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ায় এক ছাত্রলীগ নেতাকে অব্যাহতি দেয়া হয় এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর ছেলে রাজিব আহম্মেদ পার্থর নির্দেশে। রায়পুরা পৌরসভার ১নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক তানভীর সংবাদ সম্মেলনে এমনই অভিযোগ করেন। ছাত্রলীগের এসব আচরণ অগণতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী না অন্যকিছু সে প্রসঙ্গ থাক। শুধু বলি, আওয়ামী প্রশ্রয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমাদের তরুণরা যেভাবে ফ্যাসিবাদী ভাবধারায় বেড়ে উঠছে সেটি দেখে আমরা শঙ্কিত। মাওলানা সাঈদীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
ই-মেইল : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা