০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সঙ্কটের একমাত্র সমাধান

লেখক : ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন - ফাইল ছবি

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের নিজভূমে ফিরিয়ে নেয়ার একটি পাইলট পরিকল্পনার অধীনে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যে রাখাইন থেকে একটি প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গাদের সাথে ক্যাম্পের নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আলাপ করেছেন। গত ৫ মে জেলা শহর মংডু ঘুরে এসেছেন ২০ জনের রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদলও। প্রত্যাবাসনের এই কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে।

পরিকল্পনার অধীনে রোহিঙ্গারা আরাকানে ফিরে গেলে প্রাথমিকভাবে তাদের ‘মডেল ভিলেজ’-এ রাখা হবে। প্রয়োজনীয় রেশন তারা পাবেন। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারবে। প্রত্যেক পরিবারকে চাষাবাদের জন্য এক একর করে জমি দেয়া হবে। স্কুলে রোহিঙ্গা ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, চাকরি ও স্বাধীনভাবে ব্যবসায়-বাণিজ্য করার সুযোগ থাকবে। মডেল ভিলেজে হাসপাতাল, মসজিদ ও খেলার মাঠ থাকবে। রাখাইনে অনেক রোহিঙ্গা নিজ নিজ বাজারে ব্যবসায়-বাণিজ্য করছেন এমন চিত্র বাংলাদেশ থেকে যাওয়া রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলকে দেখানো হয়েছে। মংডু শহরের অনতিদূরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের জন্য তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের গুচ্ছগ্রাম আদলের মডেল ভিলেজ। কয়েক শ’ একর জমিতে তৈরি হচ্ছে প্রায় চার হাজার রোহিঙ্গা ধারণক্ষমতার ১৫টি পৃথক ‘মডেল ভিলেজ’। ইতোমধ্যে নির্মিত হয়েছে পৃথক দু’টি ভিলেজ। একটি ভিলেজে ২১৫ পরিবার এবং আরেকটিতে ৯৯ পরিবার থাকতে পারবে।

রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বদানকারী শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (যুগ্মসচিব) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘মংডু শহরে আমরা ঘুরেছি, গ্রামেও গিয়েছি। সেখানকার রোহিঙ্গাদের সাথে কথা হয়েছে, পরিবেশ অনেক ভালো। মংডু শহরে রোহিঙ্গারা অবাধে ঘুরছে-কাজকর্ম করছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আমরা আশাবাদী।’ স্মর্তব্য, মংডুতে ৮০ শতাংশ রোহিঙ্গা মুসলমান বাস করে।

প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মংডু শহরের আশপাশের অন্তত ১৫টি গ্রাম ঘুরে দেখানো হয়। শহরের মার্কেট ও বিপণিকেন্দ্রে মগ সম্প্রদায়ের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকেও দোকানপাট, ব্যবসায়-বাণিজ্য পরিচালনা করতে দেখেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। মংডু ট্রানজিট কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা প্রতিনিধিদলের সাথে বৈঠকে মংডু জেলা প্রশাসক বলেন, বাংলাদেশ থেকে ফিরে আসা রোহিঙ্গাদের মংডু ট্রানজিট কেন্দ্রে মাত্র তিন দিন রাখা হবে। তারপর সরাসরি মডেল ভিলেজে স্থানান্তর করা হবে। তখন মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতিস্বরূপ রোহিঙ্গাদের ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন সার্টিফেকেট দেয়া হবে। পরে ওই কার্ডের ভিত্তিতে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব আইন-১৯৮২ অনুযায়ী নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবে।

কিন্তু রোহিঙ্গাদের একটি গ্রুপ স্বদেশে ফিরে যেতে আগ্রহী নয় এবং তারা ফিরে না যাওয়ার জন্য সতীর্থদের উদ্বুদ্ধ করছে। উখিয়া-টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে তৎপর রয়েছে প্রত্যাবাসনবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠী। প্রায় প্রতিদিন একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। তাতে সাধারণ রোহিঙ্গারা আতঙ্কিত। এর বহুবিধ কারণ রয়েছে।

প্রথমত, তারা প্রথমে নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা চায়। এই দাবি যৌক্তিক। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক লবির মাধ্যমে নাগরিকত্ব বিষয়টি আগেভাগে ফয়সালা করতে পারে। রোহিঙ্গারা নিজ বসতবাটিতে পুনর্বাসিত হতে চায় কিন্তু এর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা গ্রামে ইতোমধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নানা অবকাঠামো, সামরিক স্থাপনা, সেনা ব্যারাক ও পুলিশ ফাঁড়ি। রাখাইন রাজ্যের নাকফুরা থেকে মংডু শহর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের দুই পাশ প্রতিনিধিদলকে দেখানো হয়েছে। দুই পাশে আগে যেসব রোহিঙ্গা গ্রাম ছিল, এখন তার কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই।

দ্বিতীয়ত, ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা জাতিসঙ্ঘ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও এনজিওদের মাধ্যমে খাবার, বিশুদ্ধ পানীয়জল, ওষুধ, চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা, বইপুস্তক, তাঁবু, ত্রিপল, মাদুরসহ গৃহস্থালি সামগ্রী বিনামূল্যে পাচ্ছে। বিনাশ্রমে জীবন ধারণের এই সুযোগ অনেকে হাতছাড়া করতে চায় না। স্বদেশে ফিরে গেলে তো পরিশ্রম করে সংসার চালাতে হবে।

তৃতীয়ত, এক শ্রেণীর এনজিও নানা অজুহাত দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরে না যেতে প্ররোচিত করছে- এমন অভিযোগ রয়েছে। কারণ ক্যাম্প না থাকলে দেশী-বিদেশী অনেক এনজিওকর্মী ও কর্মকর্তার চাকরি এবং সুযোগ-সুবিধা শেষ হয়ে যাবে।

চতুর্থত, রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ইয়াবা, ক্রিস্টাল ম্যাথ ও গাঁজাসহ কোটি কোটি টাকার মাদক পাচার এবং অস্ত্রব্যবসায় জড়িত। প্রায় প্রতিদিন চালান আসছে ও যাচ্ছে। সীমান্তের ওপারে-এপারে কোথায় কোথায় বখরা দিতে হয় তারা তা বিলক্ষণ জানে। কদাচিৎ আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে এমন চালান ধরা পড়ে যা দেখলে চোখ ছানাবড়া হয়ে ওঠে। এই স্বর্গরাজ্য ছেড়ে তারা আরাকানে ফিরে যাবে কোন দুঃখে।

পঞ্চমত, রোহিঙ্গাদের আরেকটি অংশ স্থানীয় দুর্বৃত্তদের সহায়তায় ডাকাতি, গুম ও অপহরণ বাণিজ্যের সাথে জড়িত। রাস্তা, দোকান ও জমিতে কর্মরত কৃষক, রাখাল ও পথিকদের ধরে হ্নীলা ও টেকনাফের গহিন পাহাড়ে বন্দী করে রাখে। তারপর লাখ লাখ টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়। টাকা দিতে ব্যর্থ হলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে ফেলে অথবা গুলি করে হত্যা করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রোহিঙ্গা ডাকাতচক্রের টিকিটিও স্পর্শ করতে পারে না। ‘কাঁড়িকাঁড়ি’ কাঁচা টাকা ছেড়ে এসব রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহ দেখাবে কেন?

ষষ্ঠত, রোহিঙ্গা যুবকরা দিনের বেলা ক্যাম্প থেকে বের হয়ে আশপাশে ক্ষেত খামারে দিনমজুরের কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। একদিকে ক্যাম্পের সুযোগ-সুবিধা, অন্যদিকে বাড়তি আয়। বাংলাদেশে ক্যাম্পজীবন তাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

এমন কোনো সপ্তাহ বা এমন কোনো মাস নেই- টেকনাফ, কুতুপালং, বালুখালি ও হ্নীলা রোহিঙ্গাশিবিরে মানুষ খুন হচ্ছে না। চলছে আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। রাতে রোহিঙ্গাশিবিরগুলো থাকে অরক্ষিত। শুরু হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি ও স্বজন হারানোর আর্তনাদ। সূর্যাস্তের সাথে সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ব্যারাকে ফিরে যান। এক শ্রেণীর রোহিঙ্গা দুর্বৃত্তের নানাবিধ উৎপাতে পুরো দক্ষিণ জনপদের মানুষ আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে। শিশুরা স্কুল ও মাদরাসায় যেতে ভয় পাচ্ছে।

বর্তমানে সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর রাখাইন রাজ্য থেকে এসেছে আট লাখ। বিগত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও রাখাইনে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। যদিও এর আগে দু’বার প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু রোহিঙ্গাদের অনীহার কারণে তা ব্যর্থ হয়।

মিয়ানমার জান্তার নিপীড়নের শিকার আট লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে উখিয়া-টেকনাফে ঢুকেছে। বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। এলাকার জনগণও দেখিয়েছে সহমর্মিতা। সারা বাংলাদেশের মানুষ ট্রাকে ট্রাকে ত্রাণসামগ্রী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে বিতরণ করে মানবিক ঔদার্যের পরিচয় দিয়েছে। তৈরি করে দিয়েছে ঘর, মসজিদ, মাদরাসা ও স্কুল। রোহিঙ্গাদের কারণে উজাড় হয়ে গেছে শত শত একর পাহাড় ও সংরক্ষিত বনভূমি। বদলে গেছে এলাকার ডেমোগ্রাফিক চিত্র। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আশ্রিত রোহিঙ্গারা কালক্রমে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। তারা এখন স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য হয়ে উঠেছে গলার কাঁটা। নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। রাতের অন্ধকারে যেকোনো সময় হানা দিয়ে স্থানীয়দের ধরে নিয়ে যেতে পারে দুর্বৃত্তের দল। শিক্ষা ও পরিবেশের অভাবে অধিকাংশ রোহিঙ্গার মধ্যে জন্ম নিয়েছে কৃতঘ্নতা ও জিঘাংসার মনোবৃত্তি। সুতরাং দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠাতে হবে। এটিই রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement