সমাবেশ করতে পুলিশের অনুমতি
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ১১ আগস্ট ২০২৩, ১৯:৩১
পুলিশের অনুমতি মেলেনি এজন্য রাজনৈতিক দল শিডিউল ও পছন্দমতো স্থানে সভা সমাবেশ করতে পারছে না, এমন ঘটনা এখন হামেশা ঘটছে। রাজনৈতিক দলের নেতারাও সভা সমাবেশের অনুমতির জন্য পুলিশের কাছে দরখাস্ত নিয়ে যাওয়ার ছবি মিডিয়ায় প্রকাশ করেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সভার অনুমতি চাইতে গিয়ে চার আইনজীবীর বন্দী হওয়ার সংবাদ মিডিয়ায় এসেছে। তাদের টেনেহিঁচড়ে ডিবি অফিসে নেয়ার সচিত্র সংবাদ দেশবাসী দেখেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক সভা সমাবেশ করার অধিকার যেখানে সংবিধানে দেয়া আছে, সেখানে পুলিশের অনুমতি লাগবে কেন এই প্রশ্ন কেউ তুলছেন না। অন্যদিকে আস্থার প্রশ্নে বিচার বিভাগ প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় বিরোধী দলও এ বিষয়ে আইনগত ব্যাখ্যা চাইতে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে না।
সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে :
তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার কিংবা উহার সদস্য হইবার অধিকার থাকিবে না, যদি
(ক) উহা নাগরিকের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;
(খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করিবার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়;
(গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা
(ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য এই সংবিধানের পরিপন্থী হয়।
সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, ‘চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
(১) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে
(ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং
(খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’
বাংলাদেশ সৃষ্টিতে গণমানুষ পেয়েছিল কাক্সিক্ষত একটি সংবিধান। জনগণের করের টাকায় রাষ্ট্র চলে এবং সংবিধানের মাধ্যমে রাষ্ট্র জনগণের অধিকার নিশ্চিত করে। সংবিধান বাধাগ্রস্ত হয় রাষ্ট্রযন্ত্রের হাতে যাদের ওপর জনগণের অধিকার নিশ্চিত ও সংরক্ষিত রাখার দায়িত্ব, যথা: প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সংবিধান, নানাবিধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। এর ব্যত্যয় হলে জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের নিবর্তনমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের দায়িত্ব সংবিধান বিচার বিভাগের ওপর অর্পণ করেছে, যে কারণে প্রধান বিচারপতিকে সংবিধানের অভিভাবক বলা হয়। সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সুপ্রিম কোর্টের উপদেষ্টামূলক এখতিয়ার রয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রপতি যে কোনো জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলায় আপিল বিভাগের পরামর্শ চাইতে পারেন।
২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কাল থেকে ‘গায়েবি মামলা’ নামে দু’টি শব্দ বাংলাদেশের আইনাঙ্গনে জন্ম নিয়েছে যার প্রণেতা স্বয়ং রাষ্ট্রযন্ত্র। বিচারপতি (অব:) আব্দুল মতিন বলেছেন, গায়েবি মামলা অসাংবিধানিক। অথচ দায়িত্বরত কোনো আদালত বা দেশের সর্বোচ্চ আদালত এ ধরনের কথা বলেননি। অথচ এ গায়েবি মামলায় অনেকেই জেল খেটেছে, অনেক রাজনৈতিক নেতাকর্মী রিমান্ড খেটেছে।
মূল কথায় আসা যাক। পুলিশ পশ্চিমা বিশ্বের সৃষ্ট একটি আদি প্রতিষ্ঠান যা পৃথিবীব্যাপী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনী হিসাবে স্বীকৃত। ১৮৬১ সালে ব্রিটিশ ভারতে ঞযব চড়ষরপব অপঃ, ১৮৬১ প্রণয়নের মাধ্যমে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হিসাবে আনুষ্ঠানিকতা লাভ করে। অপরাধ প্রতিরোধ ও অপরাধী শনাক্ত করতে পুলিশের সৃষ্টি। কিন্তু বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নৈতিক/অনৈতিক সব কাজই করানো হচ্ছে পুলিশ দিয়ে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের শনাক্ত করার জন্য সরকারি দল কমিশন গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন একদিন আসবে যখন গায়েবি মামলা কাদের পরিকল্পনা ও ইন্ধনে করা হয়েছে এ মর্মে কমিশন গঠনের দাবি উঠবে। এ দাবি বাস্তবায়ন হলে আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিসমাপ্তির দ্বার উন্মোচিত হবে। নেতামন্ত্রীরা অহরহ অনায়াসে অসত্য কথা বলে যাচ্ছে, এসব শুনতে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্র কিভাবে মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়?
১৯৮১ সালে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েল্স পুলিশ কমিশনার জন অ্যাভারি বলেছিলেন, পুলিশ ফোর্স এবং পুলিশ সার্ভিসের মধ্যে তারতম্য নির্ধারণ করা দরকার। কর্তৃপক্ষ থেকে বলা হয় যে, পুলিশ সেবামূলক প্রতিষ্ঠান এবং পুলিশ জনগণের বন্ধু এবং এ কথা প্রতিষ্ঠিত করতে কর্তাব্যক্তিরা চেষ্টা কম করেনি। কিন্তু পুলিশ তাদের কর্মের মাধ্যমে জনগণকে বন্ধু বানাতে পারে নাই। মিথ্যা মামলা, বানোয়াট চার্জশিট দাখিলে পারদর্শিতা প্রমাণ করেছে পুলিশ। জনগণের বন্ধু হওয়ার পদক্ষেপ না নিয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে জনগণের অধিকার আদায়ের কণ্ঠকে স্তব্ধ করার।
বাংলাদেশের রাজনীতি অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। এ দেশে একদল ক্ষমতায় এলে অন্য দলকে কারাগারে পাঠায়। এতে সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে দুর্নীতি দমন কমিশন ও পুলিশ বাহিনী। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের তল্পিবাহক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যখন ক্ষমতা চলে যায় তখন ওই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদায়ি শাসকরা বলে বেড়ায় যে, ‘আমাদের কিছু করার ছিল না।’ যেমন ১/১১ সরকার কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া দুদকের দুজন কমিশনার বিদায় বেলায় বলেছিলেন, ‘আমরা স্বাধীনভাবে কোনো কাজ করতে পারিনি।’
দেশে এখন পুলিশি শাসন চলছে। দেশ পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এমন বক্তব্যসহ পত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে। আইন আদালত প্রসিকিউশননির্ভর হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে যে ধরনের প্রসিকিউশন হয়, একই অপরাধে সরকারি দলের বিরুদ্ধে একই বিচারিক সিদ্ধান্ত দেয়া হয় না মর্মে অসন্তোষ সর্বত্র বিরাজমান। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ১/১১ সরকার দায়েরকৃত কোনো মামলায় সরকার আদালতের উপর কোনো প্রভাব বিস্তার করেনি। তবে কেন আওয়ামী লীগ নেতারা খালাস পেয়েছেন আর বিএনপি নেতারা কারাবরণ অথবা সাজার বোঝা বহন করছেন?
রাষ্ট্রযন্ত্র যখন গণমানুষের অধিকার হরণ করে তখন অভিযোগ করে কোনো প্রতিকার পাওয়া যায় না, বরং প্রতিকার প্রার্থীকে পড়তে হয় আইনি গ্যাঁড়াকলে। অন্য দিকে বিচারপ্রার্থী সাধারণ জনগণ মামলা পরিচালনার জন্য প্রফেশনাল ভালো আইনজীবী তালাশ করে না, এখন খোঁজা হয় সরকারি দলের আইনজীবীদের যারা আইন আদালতের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। শুধু এ কারণেই এখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিসহ সব জেলা আইনজীবী সমিতিগুলো সরকার ঘরানার আইনজীবীরা দখল করে নিচ্ছে। আইনজীবী সমিতিগুলো এখন আর সেবামূলক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের সংবিধানবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতে ০৯/৪/১৯৮০ তারিখে দ্য অমবুডসম্যান অ্যাক্ট, ১৯৮০ (ন্যায়পাল) আইন প্রণয়ন করা হলেও কোনো সরকারই আইনটি কার্যকর করেনি। সংবিধানের ৭৭ ধারায় উল্লেখ রয়েছে যে :
১. সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন। ২. সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোন মন্ত্রণালয়, সরকারী কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারী কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন। ৩. ন্যায়পাল তাহার দায়িত্ব পালন সম্পর্কে বার্ষিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।
ন্যায়পাল পদটি সৃজন করা হলে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্র কর্তৃক সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে জনগণ একটি প্লাটফর্ম পেত; যেখানে তাদের অসহায়ত্বের প্রতিকার চাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হতো। কিন্তু সে সুযোগ নেই, কারণ এখন স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের স্বার্থ দেখে না, বরং সরকারের তল্পিবাহক হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
ই-মেল: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা