২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

নির্বাচনে নিরপেক্ষ সরকার কেন দরকার

- ছবি : নয়া দিগন্ত

ইইউ প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চান। তবে বলেছেন, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কথা বলতে তারা আসেননি। সরকারি ঘরানার লোকেরা বলেন, সরকারের তরফে নাকি ইইউ প্রতিনিধিকে বলা হয়েছিল, আপনাদের দেশে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হয় না; আপনারা আমাদের দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেন কোন যুক্তিতে। কথাটি হয়তো হুবহু এমন না-ও হতে পারে। তবে এমনটিই বলছেন সরকারি দলের নেতারা।

২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারা বাতিল করে। অথচ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের পুরো ভাগে ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী এবং আমিরে জামায়াত মরহুম অধ্যাপক গোলাম আযম। সরকার থেকে জোর গলায় বলা হচ্ছে, ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের ক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হবে না। ওয়ান-ইলেভেন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন কর্তৃক সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শপথ অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘এটি আমাদের আন্দোলনের ফসল।’ বামপন্থী নেতারাও নিজস্ব দলীয় প্রতীক বিসর্জন দিয়ে চিরপ্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগের ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে সংসদে গিয়েছিলেন। অথচ মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পর আওয়ামী সরকারের রক্ষীবাহিনীর হাতে বামদের গণবাহিনীর লক্ষাধিক যুবক আত্মবিসর্জন দিয়েছে।

ভোট ও ভাতের অধিকার নিশ্চিত করতে স্বাধিকার, স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন শেষে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধমে ৫২ বছর আগে আমরা পেয়েছি মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু জাতির কাঙ্ক্ষিত ভোট ও ভাতের অধিকার কি সুনিশ্চিত হয়েছে? বরং রাজনীতিতে সৃষ্টি হয়েছে রাজতন্ত্র। মানুষ পায়নি তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, পায়নি ভাতের নিশ্চয়তা। বেড়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য।

সংবিধানের প্রস্তাবনার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ শাসক দল কথায় কথায় বিরোধী দলকে কটাক্ষ করে বলে যে, স্বাধীনতার চেতনা ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। বাস্তবে শাসক শ্রেণিই তা লুণ্ঠন করছে। এতে জড়িত আছে সরকারি ঘরানার ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ গোষ্ঠী, আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগও। সরকার থেকে বারবার অগ্নিসন্ত্রাসের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু মাতুয়াইলে যে বাসে আগুন দেয়া হয়েছে, সে বাসের ড্রাইভার মিডিয়াতে বলেছে, দুই পাশে পুলিশ মোতায়েন ছিল, সেখানে বিক্ষোভকারী ছিল না। মোটরসাইকেলযোগে আসা তিনজন বাসে আগুন দেয়। এই জবানবন্দিতে কি মনে হয় বিক্ষোভকারীরা অগ্নিসংযোগ করেছে?

আমি জ্বালাও-পোড়াও এবং প্রতিহিংসার রাজনীতি সমর্থন করি না। কিন্তু দুঃখজনক যে প্রতিহিংসার রাজনীতি ক্রমেই বাড়ছে। যে ক্ষমতায় থাকে সে আইন-কানুন এমনভাবে তৈরি করে এবং পদলেহনকারী এমন বলয় সৃষ্টি করে যাতে তাদের কোনো দিন ক্ষমতা হারাতে না হয়।
‘গণতন্ত্র’ এখন এক অসহায় শব্দ যার কোনো কার্যকারিতা নেই; বরং রূপকথায় পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের বক্তব্য এই যে, উন্নয়নের প্রশ্নে গণতন্ত্র অকার্যকর। তবে গণতন্ত্র না থাকলে জবাবদিহি থাকে না। আর জবাবদিহি না থাকলে বিচারব্যবস্থা স্বাধীনভাবে চলতে বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশে সেটিই হচ্ছে।

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন যদি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে না হয় তবে সঙ্ঘাত আরো বাড়বে এবং দিন যত গড়াবে তার প্রচণ্ডতা জ্যামিতিক হারে বাড়বে। এক দিকে বঞ্চিত মানুষের ক্ষোভ, অন্য দিকে সুবিধাভোগীদের সম্পদ ও প্রভাব টিকিয়ে রাখার প্রচণ্ড বাসনা। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখার জন্য ভোট চাইছেন। অন্যদিকে এমপিরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় একটি নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলেছেন এবং সংশ্লিষ্ট এলাকা এমপিদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিটি এলাকায় অলিখিত ওসির দায়িত্ব পালন করেন স্থানীয় এমপি, নতুবা ওসি বদলি হয়ে যান। এমনিভাবে এমপি বনাম নির্যাতিত জনগণের নীরব লড়াই চলছে। প্রধানমন্ত্রী কি এ সংবাদ রাখেন? নির্যাতিত জনগণ যদি সুযোগ পায় তবে তো এর প্রতিশোধ নেবে। এ ধারণা যদি শাসকগোষ্ঠী করে থাকে তবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন তারা কোনো দিনই মেনে নেবে না। অন্য দিকে বিএনপি যদি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যায় তবে আন্দোলনরত জনগণের কাছে তাদের কমিটমেন্ট ভঙ্গসহ সংসদে আসন পাওয়ার প্রশ্নে ২০১৮ সালের পুনরাবৃত্তি হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন-উর-রশিদের কাস্টডিতে আপ্যায়ন গ্রহণ করে মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলেননি। কিন্তু ভ‚রিভোজের ছবি গোপনে ধারণকরত তা ভাইরাল করে শিষ্টাচার ও নৈতিকতাবহির্ভুত কাজ করেছে পুলিশ। বাংলা প্রবাদে যাকে বলা যায় গরু মেরে জুতাদান।

গয়েশ্বর বাবুর সাথে ডিবি প্রধান যে আচরণ করেছেন তা অন্য কোনো রাজনীতিকের সাথে করেননি। তিনি বিএনপির চিপ হুইপ ও ছয়বারের নির্বাচিত এমপি জয়নাল আবেদীন ফারুককে রাজপথে গরুর মতো লাঠিপেটা করেছেন। এ আচরণ তিনি সরকারের নির্দেশেই করেছেন। সহজেই অনুমেয়, গয়েশ্বর বাবুকে সম্মানিত নয়; বরং আন্দোলন রত নেতাকর্মীদের কাছে বিতর্কিত ও হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যই ভ‚রিভোজের দৃশ্য সরকারের নির্দেশে চতুরতার সাথে রেকর্ড করে ভাইরাল করেছেন।

পুলিশ রাষ্ট্রের কর্মচারী হলেও সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি তার অন্যতম উদাহরণ। এ অবস্থায় নির্দলীয় সরকার ছাড়া বাংলাদেশে নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হওয়া সম্ভব নয়।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)

e-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement