২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

ব্যবসায়ী নেতাদের সমর্থন ও বাস্তবতা

-

দেশের গণমানুষ যাতে পছন্দমতো নেতৃত্ব বেছে নিতে পারে সেজন্য দরকার সুষ্ঠু নির্বাচন। গত ১৫ বছরে দেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। ভোটের অধিকার ছিনতাই হওয়ায় মানুষ নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়েছে। গত সোমবার অনুষ্ঠিত ঢাকা-১৭ আসনের প্রায় ভোটারশূন্য নির্বাচন এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত। দেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রয়োজন আছে। এ নিয়ে কারো দ্বিমত নেই। বাংলাদেশের যারা উন্নয়ন সহযোগী সেসব দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিষয়ে সক্রিয়। তারা বিদ্যমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে সাহায্য করতে চায়। এজন্য বেশ কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যেমন ভিসানীতি। এর ফলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে বড় ধরনের চাপে পড়েছে ক্ষমসতাসীন সরকার। তারা ক্ষমতায় থেকে, সব রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বহাল রেখে, তাদেরই সাজানো প্রশাসন দিয়ে পাতানো নির্বাচন করে ক্ষমতায় থাকতে চান। আর বিরোধী দলগুলো তাতে আপত্তি জানিয়ে সবার আগে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন করছে। তারা একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে।

বিরোধীদের আন্দোলন এবং বিদেশীদের চাপের মুখে সরকার নানাভাবে নিজের অবস্থান দেখানোর চেষ্টা করছে। শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছে। ‘সেন্টমার্টিন বিক্রি করলে ক্ষমতায় থাকতে পারতাম’ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন মন্তব্য জনগণের সহানুভূতি আকর্ষণের বড় কাতর প্রয়াস। চীন, রাশিয়া থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলাও একই চেষ্টার অংশ। তবে সরকারি দল সবচেয়ে মজার ঘটনা ঘটিয়েছে ব্যবসায়ী নেতাদের সমর্থন আদায়ের নাটক মঞ্চায়ন করে। গত শনিবার ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্যবসায়ীদের করণীয়’ শীর্ষক সম্মেলন করে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। তাতে শীর্ষ বণিক নেতারা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও ক্ষমতায় দেখতে চান বলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, ‘উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে রাষ্ট্রক্ষমতায় শেখ হাসিনাকে বারবার দরকার।’ ব্যবসায়ী নেতারা সবাই একযোগে দাঁড়িয়ে পতাকা নেড়ে প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন দেন।

সুশাসনের অভাবে দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাত যখন ধ্বংসের পথে, গত ৫২ বছরের মধ্যে দেশের অর্থনীতি সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে ঠিক তখন শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা কেন এই সরকারকেই আবার চান সেটি কিন্তু রহস্যজনক নয়। ব্যাপারটা স্পষ্ট ব্যবসায়ী নেতাদের বক্তব্যে। বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান আহমেদ আকবর সোবহান দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনার ষড়যন্ত্র রুখতে হবে মন্তব্য করে বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে কী হয়েছে, তা আমরা দেখেছি। ১/১১ সরকারের সময়ে নামীদামি সব ব্যবসায়ীকে জেলে ঢোকানো হয়েছিল। আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য নেয়া হয়। যদি এসবের পুনরাবৃত্তি চান, তাহলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনেন।’

ব্যাপারটা স্পষ্ট। তারা সব আইনের ঊর্ধ্বে থাকতে চান। সরকারের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ব্যাংকঋণ পাওয়া, সিন্ডিকেট করে পণ্যের দাম বাড়িয়ে রাতারাতি বাজার থেকে শত শত কোটি টাকা পকেটে পুরে নেয়া, নির্বিচারে লুটপাট, মানিলন্ডারিং, বিদেশের বেগম বাজারে বাড়ি, সুইস ব্যাংকে বেশুমার অর্থ সঞ্চয়সহ এত সুযোগ সুবিধা যে সরকারের সময় পাওয়া যাচ্ছে সে সরকারকে কে না চাইবে? ব্যবসায়ী নেতাদের তো সাত খুন মাফ এই সরকারের আমলে।
আমরা একটি জাতীয় দৈনিকের অনলাইন সংস্করণে ব্যবসায়ীদের ওই খবর প্রসঙ্গে পাঠকের দু-একটি মন্তব্য উল্লেখ করছি। আন্দালিব নামে এক পাঠক বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অধিকাংশ ব্যবসায়ী নেতাই ঋণখেলাপি। বিদেশে অর্থ পাচারকারী তারাই। এগুলো সম্ভব হয়েছে এই সরকারের আনুকূল্যে। তাদের এই স্বর্গরাজ্যে বসবাস দীর্ঘ করতে চায় বলেই আওয়ামী লীগকে আবার ক্ষমতায় দেখতে চায়।’

জনৈক ড. মো: জিয়াউল হক মন্তব্য করেন, ‘ইতিহাস বলছে, রাজনীতি-ব্যবসা-রাজনীতির আন্তঃযোগাযোগ বা নেক্সাস আরো জোরদার করার জন্য রাজনীতি-ব্যবসায়ীরা ফ্যাসিবাদের সমর্থক শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। জনগণকে শোষণের এ হচ্ছে ইস্পাত-কঠিন মহাসড়ক। দেশের জাতীয় সংসদের বেশির ভাগ সদস্যপদ যাদের কব্জায়, ব্যবসাও তাদের কব্জায়। জনগণকে আরো শোষণের ব্রহ্মাস্ত্র হচ্ছে আইনপ্রণেতা হিসাবে টিকে থাকা যা একমাত্র ফ্যাসিবাদে সম্ভব।’
আমিন নামে এক পাঠক বলেন, শেখ হাসিনাকে ফের প্রধানমন্ত্রী দেখতে চান ব্যবসায়ীরা, কারণ, ব্যাংক লোন নিলে শোধ করা লাগে না, কর পরিশোধ করা লাগে না, ওভার এবং আন্ডার ইনভয়েসিং করা যায়, বাংলাদেশে কোনো ব্যবসায়ী নেই, এরা মুনাফিক।’

সুতরাং, এফবিসিসিআই সভাপতি মো: জসিম উদ্দিন যখন প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি যেভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে আসছেন ও আমাদের (ব্যবসায়ীদের) যে অবস্থান সৃষ্টি হয়েছে, সেটি ধরে রাখার জন্য আপনাকে প্রয়োজন’ তখন আর এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের দরকার থাকে না। সত্যি কথা, সাংবাদিক না হয়ে যদি তাদের মতো ব্যবসায়ী নেতা হতাম তাহলে প্রতি পাঁচ বেলাই দু’হাত তুলে মোনাজাত করতাম- আয় পরওয়ারদেগার, তুমি এই সরকারকেই অনন্তকাল ক্ষমতায় রেখো, আমরা একটু ‘দুধেভাতে’ বাঁচি।

কবি রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতায় বলেছিলেন, ‘বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী, দেখা দিলো রাজদণ্ডরূপে’- সেটি ছিল এ দেশে বাণিজ্য করতে এসে ইংরেজের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশে বণিকেরা রাজনীতির অঙ্গন দখল করে নিয়েছেন অনেক আগে। আইন সভায় ৬০ শতাংশের বেশি সদস্য বণিক শ্রেণীর। গত ১৫ বছরে দেশের যে তিন লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে এবং ঋণখেলাপিদের পেটে হজম হয়ে গেছে তার বৃহদংশ এই বণিকদের মাধ্যমেই হয়েছে। তারাই সংসদ সদস্য, অর্থমন্ত্রী, বাণিজ্যমন্ত্রী, তারাই আইন বানান, তারাই ব্যাংকের মালিক, তারাই ঋণগ্রহীতা, তারাই সরকার বসানো ও সরানোর মালিক। সংবিধানে যা কিছুই লেখা থাক, নেতা নির্বাচনে, রাষ্ট্র পরিচালনায় এখন জনগণের কোনো ভূমিকা নেই।

কিন্তু ওইসব ব্যবসায়ী নেতার কোনও রাজনৈতিক চরিত্র নেই। সুবিধাবাদই তাদের চরিত্র। এজন্যই বিরোধী নেতারা বলছেন, রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের রাজনৈতিক গুরুত্ব নেই। কারণ এফবিসিসিআইতেই নির্বাচন হয় না। সরকার যাদের নাম বলে দেয় তাদের নিয়েই কমিটি গঠন করা হয়। এই তথ্য সত্যি।
দেশে যে ব্যবসায়-বাণিজ্যের পরিবেশের অবনতি হয়েছে সেটিও মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ এর বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিএক্স) ২০২২-২৩ জরিপে স্পষ্ট হয় এক বছর আগে। ২৬ জানুয়ারি জরিপের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘পদে পদে যদি সমস্যা থাকে, তাহলে আমরা যতই প্রচার-প্রচারণা চালাই না কেন, বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হবে না। আমরা মুখে যা বলছি, বাস্তবচিত্র কিন্তু ভিন্ন। আমরা কথায় অনেক স্মার্ট, কাজে তেমনটা নই।’
তো, বাস্তবতা এটাই যে, এসব সমর্থন আদায় সরকারকে কতটা শক্তিশালী করবে বলা মুশকিল। যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চ পর্যায়ের দল ঢাকা সফর করে গেছে। ঢাকায় এসে আগামী নির্বাচন বিষয়ে আলোচনা করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দল। এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন হবে বললেও বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো হাসিনা সরকারের পদত্যাগ ও নির্বাচনের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে এক দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সরকারের ওপর কারো ন্যূনতম আস্থা নেই। নির্বাচনের বাকি আছে পাঁচ মাসের মত। এখন থেকেই সরকার, সারা দেশে প্রশাসন নিজের মতো করে গুছিয়ে নিচ্ছে। ডিসি, এসপিসহ গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজের লোক বসাচ্ছে। একের পর এক আইনগত সুবিধাও তৈরি করে নিচ্ছে নিজের অনুকূলে। নির্বাচন কমিশনের জনপ্রতিনিধিত্ব আইন সংশোধন করে নির্বাচনের সময় সরকারের জন্য সুবিধা হবে এমন বিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হচ্ছে এটি প্রমাণ করার জন্য এজেন্সির মাধ্যমে কিছু দল গঠন করা হয়েছে। এরা নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধনও পাচ্ছে কোনো যোগ্যতা ছাড়াই।

সুতরাং আগামী নির্বাচন এই সরকারের অধীনে হলে সেটি একতরফা হবে এবং ২০১৮ সালের নৈশভোটের নির্বাচনের চেয়েও হতে পারে আরেক কাঠি সরেস। কোনো রাজনৈতিক দল কি সব জেনেশুনে আওয়ামী লীগের করাত কলে গলা বাড়িয়ে দেবে?

অতএব সমাধানটা হতে হবে ভিন্ন কিছু। সেই ভিন্ন কিছুটা কী? সেটাই দেখার অপেক্ষা।
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement