০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

ফজলুল্লাহ রহ:-র জ্ঞানসাধনা

লেখক : ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন - ফাইল ছবি

আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ: বহুমাত্রিক প্রতিভা, সৃষ্টিশীল মেধা ও ধীশক্তির অপূর্ব বিস্ময়। সাধারণত দেখা যায় মানুষ জ্ঞানের যেকোনো একটি বা দু’টি শাখায় নিরন্তর সাধনার মাধ্যমে বিশেষায়িত পণ্ডিতে পরিণত হয়; কিন্তু এক সাথে বহুবিধ বিষয়ে মৌলিক প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন এমন মনীষীর সংখ্যা হতে গোনা। তিনি উঁচু মাপের আলিমে দ্বীন, মুফতি, মুহাদ্দিস, গ্রন্থকার, অনুবাদক, ভাষাবিদ, ফারায়েজ (উত্তরাধিকার আইন) বিশেষজ্ঞ। বাংলা, আরবি, উর্দু, হিন্দি ও ফার্সি ভাষায় তার অসাধারণ পারদর্শিতা ও কাব্য প্রতিভা তাকে সমসাময়িককালে অন্যান্য পণ্ডিত-গবেষকদের তুলনায় অনন্য বিশিষ্টতা দিয়েছে। গোটা জীবন তিনি শিক্ষকতায় কাটিয়েছেন। এরই মাঝে ১৯টি গ্রন্থ প্রণয়ন, অনুবাদ ও সঙ্কলন করেন।


১৮৯৮ সালে তিনি চট্টগ্রাম জেলার মাদার্শা ইউনিয়নের বাবুনগর গ্রামে ঐতিহ্যবাহী ‘মক্কার বাড়ি’তে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা নুরুল হুদা ছিলেন সমসাময়িককালে বড় আলিম। মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম মুহসেনিয়া মাদরাসায় পড়ালেখা শেষ করে ১৯২০ সালে উত্তর ভারতের সাহারানপুর মাযাহিরুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। প্রতিটি ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করার কারণে মাদরাসা কর্র্তৃপক্ষ তাকে স্কলারশিপ প্রদান করেন। শিক্ষা শেষে তিনি কলকাতা আকাড়া সিনিয়র মাদরাসায় মুহাদ্দিস ও পরে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। দেশে ফিরে এসে তিনি পদুয়া হেমায়তুল ইসলাম, সাতকানিয়া আলিয়া ও চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে খিদমত আঞ্জাম দেন। চুনতি হাকিমিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপালও ছিলেন। ১৯৭৯ সালে এই মনীষী ইন্তেকাল করেন।

মাদরাসার মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের জন্য তিনি ‘মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার রূপরেখা’ শীর্ষক ৩৪ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। তার রচনাসমগ্রের মধ্যে রয়েছে, শামায়েলে তিরমিজির অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (বাংলা), জামে তিরমিজির অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (উর্দু), যুক্তির কষ্টিপাথরে ইসলাম (বাংলা), জালালাইন শরিফের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা (উর্দু), শরহে ঈসাগুজি (উর্দু), আদ দুরুসুস সারফিয়্যাহ, ১-৩ খণ্ড (উর্দু), আল-দুরুসুন নাহভিয়্যাহ, ১-২ খণ্ড (উর্দু), কাসিদা আল বুরদাহ লিল বুসিরির অনুবাদ (বাংলা), ইসলাম-কা ইকতেসাদি নিযাম, (মাওলানা হিফযুর রহমান সিওহারভি)-এর অনুবাদ (বাংলা), গুলজারে সুন্নাত (মাওলানা আসগর হোসাইন মিয়া সাহেব)-এর অনুবাদ, আসান উর্দু তালীম, ১২. উর্দু পাক গ্রামার (উর্দু), শিকওয়া ওয়া জওয়াবে শিকওয়া (ড. মুহাম্মদ ইকবাল)-এর অনুবাদ, (বাংলা), আল-ইনসাফ, (বাংলা), কুল্লিয়াতে ফযল (কাব্য গ্রন্থ) (উর্দু, ফার্সি, আরবি ও বাংলা), মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার রূপরেখা (উর্দু), মাজমুয়া লিল ফাতাওয়া আল ফিকহিয়্যা (ইসলামী ফতোয়াসমগ্র), ইয়াদ-ই-মুহসিন (উর্দু),কাদিয়ানিবাদ (বাংলা)।

আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ: যে যুগে বাংলা চর্চা করেন; আরবি ও উর্দু গ্রন্থের বাংলা ভাষান্তর করেন সে যুগে এ দেশের উলামায়ে কেরাম ছিলেন অবিশ্বাস্যভাবে পিছিয়ে। সে যুগে আরবি-বাংলা ও বাংলা-আরবি কোনো নির্ভরযোগ্য অভিধানই বের হয়নি। ১৯৫২ সালে সিরাজ রব্বানী রচিত ফরহাঙ্গে রব্বানী (উর্দু-বাংলা অভিধান) ছিল অনুবাদকদের একমাত্র ভরসা। অনুবাদ কঠিন ও দুরূহ কাজ; দুই ভাষার ওপর সমান দক্ষতা, শব্দভাণ্ডার, পরিভাষা, বাকরীতি, বাগধারা ও প্রবচন সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকলে সার্থক অনুবাদ করা যায় না। শামায়েলে তিরমিজি, ইসলাম কা ইকতেসাদি নিয়াম, গুলজারে সুন্নাত, কাসিদা বুরদাহ, শিকওয়া ওয়া জওয়াবে শিকওয়াহ, শরহে ঈসাগুজি, অনুবাদ করতে গিয়ে মূল লেখকের ভাষাশৈলী, গতি-স্বাচ্ছন্দ্য অরিজিনাল ভাবধারা ও ধ্বনিগাম্ভীর্য বাংলায় রূপান্তরে তিনি পাণ্ডিত্যের স্বাক্ষর রেখেছেন।

মুহাম্মদ ইবন ঈসা তিরমিজি রহ: রচিত শামায়েলে তিরমিজির অনুবাদ আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহর রহ: অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। ৩৩৮ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ব্যক্তিজীবনের ৫৮টি বিষয় অনুচ্ছেদ আকারে সাজিয়েছেন। মূল আরবির পাশাপাশি অনুবাদ সন্নিবেশিত হওয়ায় মাদরাসার ছাত্র এবং সিরিয়াস পাঠকদের প্রভূত উপকার হয়েছে।

মুহাম্মদ ইবন হাছান বুসিরি রহ: কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সা:-এর শানে লিখিত প্রশংসাগীতি ‘আল-কাছিদাতুল বুরদাহ-এর সার্থক বঙ্গানুবাদ করেছেন আল্লামা ফজলুল্লাহ রহ:। ১৩২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থটিতে কাছিদা গাউছিয়া, দু’আয়ে ছুরয়ানি ও হিজবুল বাহারের বাংলা তরজমাও রয়েছে। অনুবাদ গ্রন্থটি এত পাঠকপ্রিয়তা লাভ করে যে, ১৯৬৫, ১৯৭৭ ও ১৯৯৩ সালে এর তিনটি সংস্করণ বের হয়।

দারুল উলুম দেওবন্দের মুহাদ্দিস মাওলানা আসগর হোসাইন মিয়া সাহেবের রহ. উর্দু ভাষায় লিখিত ‘গুলজারে সুন্নাত’-এর বাংলা অনুবাদ করেন আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ:। ড. আল্লামা ইকবালের ‘শিকওয়াহ ওয়া জওয়াবে শিকওয়াহ’-এর বাংলায় অনুবাদ করেছেন অনেকে কাব্যাকারে। বিশেষত চট্টগ্রাম দারুল উলুম মাদরাসার প্রাক্তন প্রিন্সিপাল মাওলানা তমিজুর রহমানের কাব্যানুবাদে ইকবালের কবিতার ঝংকার, ছন্দ, অন্তঃমিল, দ্যোতনা স্পষ্টত লক্ষণীয়। মরহুম ইকবালের অনুমতিক্রমে তিনি এটার অনুবাদ করেন। ড. ইকবালের 'শিকওয়াহ ওয়া জওয়াবে শিকওয়াহর প্রতিটি ছত্রের সাথে ইতিহাসের ঘটনা জড়িত। ব্যাখ্যা ছাড়া কেবল কাব্যানুবাদ করলে শিকওয়াহর নির্গলিতার্থ পাঠক যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন না। আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ:-এর গদ্যানুবাদ ব্যাখ্যাসংবলিত হওয়ায় ‘শিকওয়াহ ওয়া অওয়াবে শিকওয়াহ’র মর্মার্থ পাঠকের মর্মে অনায়াসে স্থান করে নিতে পারে। সিহাহ সিত্তার অন্যতম হাদিসগ্রন্থ ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবন ঈসা আত-তিরমিজির ‘আল-জামে’-এর উর্দু ভাষায় অনুবাদ ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ: দক্ষতার পরিচয় দেন। তাহারত থেকে ফাওয়াইদে মিসওয়াক পর্যন্ত ৮০০ পৃষ্ঠার এই পাণ্ডুলিপি পড়লে অনুবাদকের ইলমের গভীরতা, অনন্য পাণ্ডিত্য ও হাদিসশাস্ত্রে অগাধ প্রজ্ঞা ধরা পড়ে।

‘যুক্তির কষ্টিপাথরে ইসলাম’ আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ:-এর এক অনবদ্য সৃষ্টি। প্রায় ২৫০ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থে তিনি যুক্তি ও বুদ্ধির নিরিখে ইসলামের বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। আধুনিক শিক্ষিতদের মনে পাশ্চাত্য চিন্তাচেতনার প্রভাবে ইসলাম সম্পর্কে নানা প্রশ্নের উদ্রেক ঘটে, যা অনেক সময় মানুষকে বিভ্রান্ত ও ধর্মবিমুখ করে তোলে। যুগে যুগে বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম উদ্ভূত এসব প্রশ্নের যৌক্তিক জবাব নিয়ে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করেছেন। তিনি মাদ্রাসার ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীর উপযোগী আরবি ব্যাকরণ রচনা করেন ‘আদদুরুসুস সারফীয়্যাহ’ এবং ‘আদদুরুসুস নাহভিয়্যাহ’ নামে দু’টি।

মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ রহ: ছিলেন স্বভাব কবি। উর্দু, ফার্সি ও আরবি ভাষায় প্রচুর কবিতা লিখেছেন। কবিতাসমগ্রের পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ২৫৫। তার উর্দু কবিতাসমগ্র ইকবাল, গালিব, আকবর এলাহাবাদী ও জোশ মলিহাবাদীর সমপর্যায়ের। মুহাম্মদ ফজুলুল্লাহ রহ: গ্রন্থিত ও অগ্রন্থিত রচনাসমগ্র মুসলিম জাতির সম্পদ।

মুহাম্মদ ফজুলুল্লাহ রহ:-এর জীবন ও কর্মসাধনা নিয়ে আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম ও আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশনের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ২০২২ সালে ৭৪৪ পৃষ্ঠার একটি স্মারকগ্রন্থ বের হয়। প্রফেসর ড. আবু রেজা নদভীর তত্ত্বাবধানে ড. মুহাম্মদ হুছামুদ্দিনের সম্পাদনায় প্রকাশিত গ্রন্থটি ইতিহাসের একটি আকর গ্রন্থ। আল্লামা মুহাম্মদ ফজুলুল্লাহ রহ:র সমসাময়িক আলিম-ওলামা, বিশ্বপরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিক ঘটনা পরম্পরাও এতে স্থান পেয়েছে। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ, এমফিল ও পিএইচডি গবেষকদের জন্য তথ্যসমৃদ্ধ রেফারেন্স হতে পারে।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement