কুরআন পোড়ানোর নিন্দা
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ০৯ জুলাই ২০২৩, ১৯:২৭, আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৩, ০৫:৩৬
গত ২৮ জুন ঈদের দিনে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমের কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে কুরআন শরিফ পোড়ানো হলো। এবার আদালতের অনুমতি নিয়ে দুর্বৃত্তরা পবিত্র কুরআনের পাতা ছিঁড়ে আগুন ধরিয়ে দিলো। প্রায় ২০০ মানুষ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে ইরাক থেকে আসা অভিবাসী সলমন মোমিকা মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে কুরআন পোড়ান। ওই ব্যক্তি কুরআন নিষিদ্ধের দাবি জানান। তিনি ওই কাজের জন্য আদালতে আবেদন জানিয়েছিলেন। আদালত তাকে অনুমতি দেন। এ দিকে ইরাকি ওই যুবক আবারো কুরআন পোড়ানোর হুমকি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘১০ দিনের মধ্যে আমি স্টকহোমে ইরাক দূতাবাসের সামনে ইরাকি পতাকা ও কুরআন পুড়িয়ে দেবো।’
২০২২ সালের ২১ জানুয়ারি সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তুরস্কের দূতাবাসের সামনে পবিত্র কুরআন পোড়ানোর মত ঘৃণ্য ঘটনা ঘটে। উগ্র ডানপন্থী রাজনৈতিক দল হার্ডলাইনের বিতর্কিত নেতা রাসমুস পালুদান পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে কুরআনের একটি কপিতে আগুন ধরিয়ে দেন। এর আগে প্রায় এক ঘণ্টা ইসলাম ধর্ম ও সুইডেনের অভিবাসন ব্যবস্থাকে আক্রমণ করে গালিগালাজপূর্ণ বক্তব্য রাখেন তিনি।
আমরা মনে করি ঘৃণা ও চরমপন্থাকে প্রত্যাখ্যান করে সংলাপ, সহনশীলতা ও সহাবস্থানের মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে বিশ্বের নানা জাতিগোষ্ঠীকে এগিয়ে আসতে হবে। পবিত্র কুরআন অবমাননা বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়ার পরিবর্তে বৈষম্য, অসহিষ্ণুতা ও সহিংসতা বৃদ্ধির আশঙ্কা তৈরি করবে।
সুইডিশ আদালত বলেছেন, ‘কুরআন পোড়ানো হলে নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। বর্তমান আইন অনুসারে এ কাজে বাধা দেয়া যায় না। আর নিরাপত্তার বিষয়টি এত বড় নয় যে, বাধা দেয়া ঠিক হবে। সে জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ যেন এই জমায়েতের অনুমতি দেয়।’ কুরআন পোড়ানোর ঘটনা সুইডেনে বারবার ঘটছে। উগ্র ডানপন্থীরা অতীতে এই কাজের নেতৃত্ব দিয়ে ঘৃণা ছড়িয়েছেন। এই ধারার রাজনীতিবিদ পালুদান সর্বদা কুরআন অবমাননা করে বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছেন।
সুইডেনে কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় ঢাকাস্থ সুইডেন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলা হয়- ‘বাকস্বাধীনতার নামে মুসলমানদের পবিত্র মূল্যবোধ ও ধর্মীয় প্রতীকের অবমাননার এ ধরনের জঘন্য কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বার্থে বাংলাদেশ আবারো সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ ধরনের অযৌক্তিক উসকানি বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে।’ সুইডেনে কুরআন অবমাননার ঘটনায় পোপ ফ্রান্সিস বলেন, ‘আমি এই কর্মকাণ্ডে রাগান্বিত ও বিরক্ত বোধ করছি। বাকস্বাধীনতা মানে এই নয় যে, অন্যদের মনে ঘৃণা সৃষ্টি হবে এমন কাজ করা যাবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড প্রত্যাখ্যান ও নিন্দা করা উচিত।’
ঘটনার পরপরই মুসলিম বিশ্বে নিন্দা ও ক্ষোভের ঝড় ওঠে। তুরস্ক, জর্দান, ফিলিস্তিন, সৌদি আরব, মরক্কো, ইরাক, ইরান, পাকিস্তান, সেনেগাল, মরক্কো ও মৌরিতানিয়াসহ বিভিন্ন ইসলামিক দেশে ব্যাপক ক্ষোভ ও নিন্দার জন্ম দেয়। এ ঘটনায় কিছু মুসলিম দেশ সুইডেনের রাষ্ট্রদূতকে প্রত্যাহার করেছে এবং সুইডিশ রাষ্ট্রদূতদের ডেকে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এ ঘটনার পর সুইডেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেল। এর আগেও সুইডেনে কুরআন অপবিত্র করার ঘটনা ঘটেছিল। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান তখন জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি এ ঘটনা বরদাশত করবেন না। তুরস্ক কোনোভাবেই সুইডেনকে ন্যাটোর সদস্য হওয়াকে সমর্থন করবে না। যদিও সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এখনো ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে আশাবাদী।
ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) সুইডেনের চরমপন্থী কর্তৃক কুরআনের কপি পোড়ানোর তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, চরমপন্থীদের দ্বারা সংঘটিত এ ধরনের কাজ অপন্দনীয় এবং বিশ্বব্যাপী সরকারগুলোকে এসব কাজের পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় বিদ্বেষ বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক আইন ব্যবহার করা উচিত বলে ওআইসি মনে করে। জাতিসঙ্ঘের সনদ মেনে চলার ওপর জোর দিয়ে ওআইসি বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব তুলে ধরে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ কাজটিকে গভীরভাবে অসম্মানজনক বলে বর্ণনা করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এর নিন্দা করেনি। একটি সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠী ইউরোপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইসলাম, নবী মুহাম্মদ সা:-কে অবমাননা ও কুরআন পোড়ানোর মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে। আসলে ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে ধর্মের অগ্রযাত্রা রোধ করা যায় না। এটা নিচু মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। এতে সমাজ ও রাষ্ট্রে অস্থিরতা তৈরি হয় এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে অসম্ভব করে তোলে। ২০১৭ সাল থেকে ডেনমার্কে কুরআনকে অপবিত্র করা বৈধ। হার্ডলাইন পার্টির (ড্যানিশ : স্ট্রাম কুর্স) একটি নিয়মিত ঘটনা হলো কুরআন পোড়ানো।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষক ড. হামদান আল-শেহরি বলেন, ‘সন্ত্রাসী ও অপরাধী যারা অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে সম্মান করে না এবং যারা মতবিরোধকে উসকে দিতে চায় এবং বিশ্বকে ধর্মীয় যুদ্ধে টেনে আনতে চায়, তাদের কর্মতৎপরতার পরিণতি যাই হোক, কোনোক্রমে ঘৃণা প্রকাশের অবারিত সুযোগ দেয়া উচিত নয়। অতীতে মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য প্রথাগত বা মিডিয়ার মাধ্যমে একটি ভয়ঙ্কর প্রচারণা দেখেছি; মুসলমানরা বিশ্বের জনসংখ্যার ২০০ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। এই প্রচারাভিযানগুলো প্রকাশ্যে প্রতিক‚লভাবে পরিচালিত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলে চালিয়ে দেয়া হয়।’ মুসলমানরা সবসময় সংস্কৃতি ও ধর্মকে সম্মান করতে আগ্রহী। (আরব নিউজ, জেদ্দা, ১৯ এপ্রিল-২০২২)
বারবার কুরআন পোড়ানোর পেছনে রয়েছে রাজনীতি। মূলত ২০২২ সালের জুনে সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দিতে তুরস্কের সাথে চুক্তি করে ফিনল্যান্ড-সুইডেন। ওই চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, কুর্দি সন্ত্রাসীদের কোনো প্রশ্রয় দিতে পারবে না এই দু’টি দেশ। একই সাথে ফিনল্যান্ড-সুইডেনে বসবাসরত পলাতক কুর্দি সন্ত্রাসীদের তুরস্কের হাতে তুলে দিতে হবে। তবে সুইডেন সেসব শর্ত ভঙ্গ করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত সামরিক জোট ন্যাটোতে তুরস্ক যোগ দেয় ১৯৫২ সালে। নিয়ম অনুযায়ী, মার্কিন নেতৃত্বাধীন এই জোটে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে প্রতিটি দেশের সম্মতির প্রয়োজন হয়। সে ক্ষেত্রে এই জোটে ফিনল্যান্ড ও সুইডেনের অন্তর্ভূক্তির বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ভেটোক্ষমতা প্রয়োগ করার সুযোগ রয়েছে তুরস্কের। স্টকহোমে কুরআন পোড়ানোর পরিপ্রেক্ষিতে সুইডেনের ন্যাটোভুক্তি অনুমোদন করবে না বলে তুরস্ক ইঙ্গিত দিয়েছে। (আল-জাজিরা ইংলিশ, দ্য গার্ডিয়ান, ২৩ জানুয়ারি-২০২৩)
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মুসলিমরা একত্র হয়ে সুইডিশ পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে মিসরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফতোয়া সেন্টার। এই ঘৃণ্য অপকর্মটি সহনশীলতা, মধ্যপন্থা ও চরমপন্থা প্রত্যাখ্যানের আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার বিপরীত। এতে কোনো সন্দেহ নেই। মুসলিম বিশ্বের কাছে সুইডেন সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে, নইলে দেশটির সব পণ্য বর্জন করতে হবে। কুরআনের অবমাননার মধ্য দিয়ে বিশ্বের ২০০ কোটি মুসলমানের হৃদয়ে চরম আঘাত হানা হয়েছে। এ জন্য দোষী ব্যক্তিকে অবশ্যই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।
অন্য ধর্মের মানুষের হৃদয়ে আঘাত দেয়া কোনোভাবেই মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হতে পারে না। মুসলমানদের পবিত্র মূল্যবোধ ও ধর্মীয় প্রতীককে অপমান একটি জঘন্য কাজ। যা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। সুইডেনের যে আদালত ওই বক্তিকে কুরআন অবমানার মতো ঘৃণ্য কাজের অনুমতি দিয়েছে তাদের কর্মকাণ্ডও অত্যন্ত নিন্দনীয়। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের স্বার্থে এ ধরনের উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড বন্ধে ব্যবস্থা নিতে ওআইসি ও জাতিসঙ্ঘকে এগিয়ে আসতে হবে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য সুইডেন সরকারের ওপর চাপ তৈরি করতে হবে। কেবল বিবৃতি যথেষ্ট নয়। ইউরোপীয় দেশে ইসলামোফোবিয়া ও ধর্মের অবমাননার অপরাধ বৃদ্ধির কারণে শান্তিকামী মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ জাতীয় কর্ম বিশ্বের নানা ধর্মীয় অনুসারীদের মধ্যে অধিকার ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠার অন্তরায়।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা