‘বাবা হুজুর’
- ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন
- ০৪ জুলাই ২০২৩, ১৯:৩৮, আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২৩, ১৩:০৩
‘বাবা হুজুর’ নামে সমধিক পরিচিত মাওলানা মুমতাজুল কারিম ৮০ বছর বয়সে নশ্বর পৃথিবী ত্যাগ করেন ২০২৩ সালের ২৭ মার্চ। তার ইন্তেকালে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। ছাত্রজীবন শেষ করে তিনি শিক্ষকতায় যুক্ত হন ১৯৬৫ সালে। সুদীর্ঘ ৫৮ বছর বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি ইলমে দ্বীনের খিদমতে রত ছিলেন। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাখ লাখ ছাত্রের তিনি উস্তাদ। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া, চট্টগ্রাম থেকে কৃতিত্বের সাথে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করে তিনি লাহোর গমন করেন ১৯৬৩ সালে। উপমহাদেশের খ্যাতনামা মাদরাসা জামিয়া আশরাফিয়ায় দু’বছর পড়ালেখা করে তাফসির, প্রাচীন দর্শন ও আরবি সাহিত্য বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করতে সক্ষম হন।
‘বাবা হুজুর’ বিশ্ববিখ্যাত আলিমদের কাছে ইলমে দ্বীন হাসিলের গৌরব অর্জন করেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন পটিয়া মাদরাসার প্রবীণ মুহাদ্দিস মাওলানা আমীর হোসাইন ‘মীর সাহেব’ (রহ.), আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.), মাওলানা আনওয়ারুল আজীম (রহ.), শায়খুত তাফসির ওয়াল ফুনুন আল্লামা ইদরীস কান্ধলভী (রহ.), শায়খুল হাদিস আল্লামা মুহাম্মদ সরফরাজ খান (রহ.), শায়খুল মাশায়েখ আল্লামা রাসূল খান (রহ.) ও শায়খুল ফালসাফা মাওলানা গোলাম গাওছ হাজরাভী (রহ.)।
ময়মনসিংহের ত্রিশালের কাতলাসেন কাদেরিয়া কামিল মাদরাসা, বরিশালের চরমোনাই মাদরাসা, ঢাকা আশরাফুল উলুম বড়কাটারা মাদরাসা, জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়া ও দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারীতে হাদিসের উস্তাদ হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। জামিয়া ইসলামিয়া পটিয়ায় সাত বছর ও হাটহাজারী দারুল উলুমে ৩৫ বছর হাদিসের দরস দেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি তার অতুলনীয় স্নেহছায়া, অন্তরের দরদ ও ছাত্র গড়ার প্রতি তার মেহনত থেকে ছাত্ররা তাকে ‘বাবা হুজুর’ বলে সম্বোধন করতে থাকে। তিনিও দেশব্যাপী ‘বাবা হুজুর’ নামে পরিচিতি পান। ‘বাবা হুজুর’-এর আড়ালে তার আসল নাম চাপা পড়ে যায়। ছাত্রদের তিনি নিজ সন্তানের মতো লালন করতেন এবং অনেকের খরচও বহন করতেন। কোনো বিচ্যুতি দেখলে শাসন করতেও তিনি দ্বিধা করতেন না।
দিলখোলা এ মনীষী স্বল্পবাক হলেও সত্য উচ্চারণে ছিলেন নির্ভীক। হক কথা বলার ক্ষেত্রে তিনি কারো পরোয়া করতেন না। তার অন্তর ছিল পরিচ্ছন্ন, ভাষা ছিল পরিশীলিত এবং ব্যবহার ছিল অমায়িক। বিভিন্ন মাদরাসায় গেলে তিনি মাদরাসার তহবিলে কম বেশি দান করতেন। ইবাদতের প্রতি ছিল তার গভীর নিবিষ্টতা। ফরজের পাশাপাশি তিনি সুন্নত ও নফলের প্রতি ছিলেন যত্নবান। সর্বদা জুব্বা ও সাদা পাগড়ি পরতে পছন্দ করতেন। পোশাক পরিচ্ছদ ছিল সাদামাটা। তাকওয়া, লেনদেনে সততা, পরোপকার, প্রতিশ্রুতি রক্ষায় দৃঢ়তা তার জীবনের আলোকিত দিক।
ইসলামের প্রচার-প্রসার, কুরআনের তাফসির, ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদসহ নানা দ্বীনি কাজে তিনি দেশের আনাচে-কানাচে ছুটে বেড়িয়েছেন। অংশ নিয়েছেন সভা-সমিতি, ওয়াজ মাহফিল, জনসভা ও ইসলামী সম্মেলনে। দাওয়াতি কাজে একাধিক দেশও ভ্রমণ করেছেন। তন্মধ্যে তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, আমেরিকা, চীন, হংকং, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, সৌদি আরব, পাকিস্তান ও ভারত অন্যতম। শুধু হাদিসের খেদমত ও ওয়াজ মাহফিল নয় লেখালেখিতেও মাওলানা মুমতাজুল কারিমের অবদান রয়েছে। সুলুক ও তাসাউফের মেহনতও তিনি করেছেন। হাকিমুল ইসলাম মাওলানা কারি তৈয়ব রহমাতুল্লাহি আলাইহির নিকট বাইয়াত হন। পরবর্তীতে শায়খ মাওলানা মুহাম্মাদ কামরুজ্জামান এলাহাবাদী (বখশিবাজারী) তাকে চিঠির মাধ্যমে চার তরিকায় খেলাফত প্রদান এবং বাইয়াত করার অনুমতি দেন। এছাড়া দারুল মাআরিফ চট্টগ্রামের শায়খুল হাদিস সন্দ্বীপের পীর সাহেব হজরত মাওলানা এহসানুল হক রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাকে লিখিতভাবে খেলাফত প্রদান করেন এবং খানকায়ে এহসানিয়া প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেন। ২০১৭ সালে মাহবুবুল উলামা হজরত মাওলানা পীর জুলফিকার আহমদ নকশবন্দী মুজাদ্দেদির হাতে তিনি বাইয়াত গ্রহণ করেন। ‘বাবা হুজুর’ মালয়েশিয়ার হলুলাংগাত মিফতাহুল উলুম মাদরাসা মিলনায়তনে আয়োজিত শায়খ নকশবন্দীর আন্তর্জাতিক ইসলাহি মুলতাকায় যোগ দিয়ে বক্তব্য রাখেন (মাওলানা মুনির আহমদ, উম্মাহ ডটকম)।
তার রচিত গ্রন্থাবলির অন্যতম হলো- আরবি বোখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ বাদয়ুল কারি ইলা দিরাসাতিল বোখারি, বোখারি শরিফের উর্দু ব্যাখ্যাগ্রন্থ হাবিবুল বারী শরহিল বোখারি, আরবি কাওয়ায়েদে ফিকহিল হানাফি, তারিখুত তাফসির, কোরআন-হাদিসের অমূল্য রত্ন, পরকালে মুক্তি কিসে (অনুবাদ), উলুমুল কোরআন, এসো কোরআনের অর্থ শিখি, আকিদায়ে খতমে নবুওয়ত, রাইবেন্ডের দশ দিন (অনুবাদ) ও আল্লাহকে পাওয়ার রাস্তা। এছাড়া বিভিন্ন মাসিক পত্রিকা, স্মরণিকা ও স্মারকগ্রন্থে তার অনেক লেখা প্রকাশ পেয়েছে (প্রাগুক্ত)।
বাংলাদেশের বিখ্যাত আলিম ও রাজনীতিক খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-এর সাথে বাবা হুজুরের সম্পর্ক ছিল আন্তরিক ও হৃদ্যতাপূর্ণ। তারা দু’জনই স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা উত্তরকালে পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ায় একসাথে শিক্ষকতা করেছেন। থাকতেনও পাশাপাশি কক্ষে। খতিবে আজমের স্মারকগ্রন্থে প্রদত্ত এক নিবন্ধে তিনি নিম্নোক্ত অভিমত প্রকাশ করেন।‘খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) হাটহাজারী মাদরাসার অন্যতম মুহাদ্দিস ছিলেন। তার উস্তাদ হজরত হাকিমুল উম্মতের জামাতা মুফতি জামিল আহমদ থানভী (রহ.) বলেন, সাহারানপুর মাদরাসায় পড়ার সময় খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.) অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। সেখানে তিনি ছাত্রদের তাকরার করাতেন। ঢাকা বায়তুল মোকাররম মসজিদে মে’রাজুন্নবী সা: সম্বন্ধে তথ্যপূর্ণ বয়ান রাখেন। সেখানে যারা ওয়াজ শুনেছেন তারা তাকে খতিবে আজম না বলে ‘খতিবে আলম’ বলে সম্বোধন করেছেন। কুমিল্লার মন্ত্রী চৌধুরী আশরাফ উদ্দীনের বাড়িতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মরহুম লিয়াকত আলী খানের সাথে খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (রহ.)-কেও দেখেছি। মরহুম মাওলানা আতাহার আলী সাহেবের সাথে তিনি নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য ছিলেন। তিনি ছিলেন হাটহাজারীর বড় মুফতি সাহেব আল্লামা মুফতি ফয়জুল্লাহ (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলিফা ও বুযুর্গ ব্যক্তি। ইসলামী রাজনীতিবিদ ও এবং পটিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদিস হিসেবে তিনি খ্যাতি লাভ করেন (ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন সম্পাদিত খতিবে আজম স্মারকগ্রন্থ)।
বাবা হুজুর ১৯৪২ সালের ২৭ ডিসেম্বর কুমিল্লা জেলার সদর থানার ডুলিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জনক ‘বাবা হুজুর’। তিনি ছিলেন চরমোনাইর দাদাপীর হজরত মাওলানা ইসহাক সাহেব (রহ.)-এর জামাতা। ‘বাবা হুজুর’-এর বড় ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান মুমতাজী বড়মাপের আলিম ও বক্তা। তিনি ঢাকা তেজগাঁও রহিম মেটাল জামে মসজিদের খতিব, ইন্টারন্যাশনাল খতমে নবুওয়ত মুভমেন্ট বাংলাদেশের আমির ও ইসলামিক কালচারাল ফোরামের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
হাটহাজারী দারুল উলুম মাঠে অনুষ্ঠিত তার নামাজে জানাজায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেন। জানাজার নামাজে ইমামতি করেন ‘বাবা হুজুরের’ ছেলে মাওলানা মাহমুদুল হাসান মুমতাজি।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা