ক্রসফায়ারে পড়ছে না তো বাংলাদেশ
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ২০ জুন ২০২৩, ১৯:৪৫
দেশে ক্রসফায়ারের কালচার যখন শুরু হয়, তখন এ গল্পের শুরু। গল্পটা হলো, আসামিকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশনে বেরিয়েছিল পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তখন ওই আসামির সহযোগী দুর্বৃত্তরা হামলা করে, গুলি চালায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাল্টা গুলি চালালে মাঝখানে পড়ে অথবা পালাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ভিকটিম। ক্রসফায়ারে তথা বিনাবিচারে মানুষ খুনের এই প্রায় অবিকৃত ভাষ্যে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কোনো প্রশ্ন নেই। গল্পটা শুনতে শুনতে যতই কান ঝালাপালা এবং মনপ্রাণ ত্যক্ত-বিরক্ত হোক আম পাবলিকের কিছুই বলার বা করার ছিল না; অন্তত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমেরিকার স্যাঙ্কশন জারির আগ পর্যন্ত। কিন্তু নিজেরই তৈরি অসত্য গল্প অদৃশ্যের পরোক্ষ ইঙ্গিতে কিভাবে আত্মবিনাশী অমোঘ সত্য হয়ে দাঁড়ায় সেই দৃষ্টান্ত আমরা জেনেছি ঈশপের মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পে।
ক্রসফায়ার নিয়ে আমরা জনগণকে গল্প শুনিয়েছিলাম। এখন দেখছি একটু ভিন্নভাবে পুরো বাংলাদেশই কখন যেন দুই বা তিন বৃহৎ শক্তির ক্রসফায়ারের শিকারে পরিণত হবার হুমকির মুখে পড়ার উপক্রম হয়েছে। বিষয়টি আকস্মিক নয় অভাবিতও নয়। বেশ কিছু দিন আগে থেকেই এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বলে এক ধরনের খুশি খুশি আবহও দেখা যাচ্ছিল বিশেষ মহলের কথাবার্তায়। বিশ্বের একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র যখন থেকে তার মনোযোগ এশিয়ার দিকে নিবদ্ধ করতে শুরু করে তখন এটি স্পষ্ট হতে থাকে। বলা বাহুল্য, যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়ামুখী দৃষ্টির মূল কারণ চীনের উত্থান প্রতিহত করা। এ জন্য দেশটি কোয়াড, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল ইত্যাদি নানামুখী কার্যক্রম নিয়েছে। দেশটি বাংলাদেশকেও এসব উদ্যোগে পাশে পেতে চায়। অন্য দিকে চীনেরও লক্ষ্য বাংলাদেশের সমর্থন আদায়। আর সীমান্তের সবদিক ঘিরে থাকা ভারত তো আছেই।
বাংলাদেশে ভারত, চীন, আমেরিকা সবারই স্বার্থ আছে। তবে এই স্বার্থের প্রকৃতি ও আদায়ের প্রক্রিয়া ভিন্ন। ভারত নিজেকে প্রভু হিসাবে বিবেচনা করে (যেটি আমাদের সরকারের ভাষায় স্বামী) এবং প্রভুর মতোই কৌশলে এবং বলপ্রয়োগে সেই স্বার্থ আদায়ে সচেষ্ট থাকে। অবশ্য, গত ১৫ বছরে দেশটিকে বাংলাদেশে কোনো বিনিয়োগ করতে হয়নি। শুধু আওয়ামী লীগের সরকারকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা ছাড়া। এই সরকারের যেহেতু বৈধতার সঙ্কট রয়েছে সেহেতু এরা ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতের সহায়তার বিনিময়ে সে দেশের সব চাওয়া বিনা শর্তে দিয়ে দিতে কুণ্ঠা বোধ করেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দেশের অর্থনীতিকে চরম নাজুক অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ভারত ন্যূনতম সহায়তাও করতে সক্ষম নয়। স্বাভাবিকভাবেই চীনের ওপর নির্ভর করার কোনো বিকল্প বাংলাদেশ সরকারের সামনে নেই। বাংলাদেশে গত বছর কয়েক আগে যখন ভারতকে হঠিয়ে চীন বড় বড় আর্থিক প্রকল্প বাগিয়ে নিতে শুরু করে তখন থেকেই এই ভূখণ্ডে চীন-ভারত দুই বৃহৎ শক্তির মল্লযুদ্ধ বেধে যাবার একটা কানাঘুষা চলছিল। চীনা ঋণ ও অন্যান্য বিনিয়োগ বাংলাদেশে এখন অন্য সব দেশের চেয়ে সর্বোচ্চ। এই সুবিধাটি তারা রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসাবেও কাজে লাগতে পারছে।
বাংলাদেশে আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ করার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্ররা যে চাপ দিচ্ছে তা সহজ করতে ভূমিকা রাখছে চীন-রাশিয়া অক্ষশক্তি। তারা প্রকাশ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ তার গোটা অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের ওপর নির্ভরশীল। যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বৃহত্তম অংশ আমদানি করে। শুধু এই একটি পণ্য রফতানি বন্ধ হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে খানখান হয়ে যাবে।
বিপদটা এই জায়গায়। আর গণতান্ত্রিক বিশ্বের অংশ হিসাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকার বাক-স্বাধীনতা, জনগণের নেতৃত্ব বেছে নেবার অবাধ সুযোগ বিদ্যমান থাকবে এটা এ দেশের উন্নয়ন সহযোগীরা চাইতেই পারে। সে হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র যে ভূমিকা নিচ্ছে তা আপাতদৃষ্টিতে চাপ বলে মনে হলেও তা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। নয় বলেই বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল বিষয়ে বিশেষ রূপরেখা প্রকাশ করতে হয়, নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে বলে মৌখিকভাবে হলেও ঘোষণা দিতে হয়। তবে আগাম বলে দেয়া সম্ভব, এ ধরনের মৌখিক ঘোষণায় এবার আর নৈশভোটের মঞ্চায়ন সম্ভব হবে না। এজন্য অন্য কারিকুরি উদ্ভাবনের দরকার হবে। ছয়জন মার্কিন কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়ে তাদের ভাষায় ‘বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা বন্ধে এবং দেশটির জনগণকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে অংশ নেয়ার সর্বোত্তম সুযোগ করে দিতে জরুরি উদ্যোগ’ নেয়ার আহ্বান জানান।
চিঠিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকার ক্ষমতা দখলে রাখতে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের বিচারবহির্ভূত হত্যা, অপহরণ, নির্যাতন ও কারাবন্দি করছে। মিথ্যা মামলা দিচ্ছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন পার্লামেন্ট সদস্যদের বিবৃতি বা চিঠি আরো জোরালো।
যাই হোক, যুক্তরাষ্ট্র, চীনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব এ দেশের কৌশলগত অবস্থানের কারণে। বঙ্গোপসাগরের এমন একটি জায়গায় বাংলাদেশের অবস্থান যেটি ভারত মহাসাগর হয়ে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের রুট হিসাবে বিশ্ব অর্থনীতির জীবনরেখা। ভারত মহাসাগর এবং এর বিভিন্ন উপসাগর দিয়ে আফ্রিকার সাথে চীনের বেশির ভাগ বাণিজ্য হয়ে থাকে। এ ছাড়াও বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মাধ্যমে এই অঞ্চলে উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টাও করছে চীন। এর অগ্রগতি ইদানীং চোখে পড়ার মতো। কারণ বিশ্বের বহু দেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে এবং হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতির কোনো কোনো বিশ্লেষক অনেক আগেই বলেছেন, ভারত মহাসাগর হতে পারে বিশ্বব্যাপী সঙ্ঘাতের কেন্দ্রবিন্দু। ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া এবং ভারত মহাসাগরে পরাশক্তিগুলোর নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। আবার এই অঞ্চলে চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের কথাও সারা বিশ্ব জানে। সুতরাং বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় পরাশক্তিগুলো মরিয়া হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক এবং সেটাই ঘটছে। গত এক বছরে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের উপর্যুপরি সফর যেমন দেখা গেছে তেমনই সব ইতিহাস ভেঙে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গভীর রাতের সফরও নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, নতুন ভিসানীতি জারি, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে কংগ্রেস সদস্যদের চিঠি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পার্লামেন্ট সদস্যদের চিঠি ইত্যাদি সেই সূত্রে গাঁথা। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের তৎপরতা থেকে অনেকের অনুমান, তাদের মূল লক্ষ্য একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ছয় সদস্য তাদের চিঠিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি খোলাখুলিই বলেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, বাংলাদেশের বর্তমান সরকার বিগত বছরগুলোতে চীনের দিকে ঝুঁকে থাকার নীতি অবলম্বন করেছে। সে কারণে নিজেদের প্রভাব সুসংহত করতে যুক্তরাষ্ট্রকে এ দেশের আসন্ন নির্বাচনকে একটি সুযোগ হিসেবে নিতে হচ্ছে। কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র এই সুযোগ কাজে লাগাতে চায়। আর বাংলাদেশ এই চাপ অগ্রাহ্য করার নানা কৌশল খুঁজছে, বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশের সাথে গভীর এক প্রণয়ের সম্পর্কের সূত্রে। সেটি কতটা কার্যকরভাবে কাজে লাগানো যাবে এখনো স্পষ্ট নয়।
শক্তিমান দেশগুলোর দ্বন্দ্বের এই মঞ্চটি হয়তো শিগগির টালমাটাল হয়ে উঠবে। সেই প্রক্রিয়াই এখন দেখা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট পাস, আর চীনের হঠাৎ রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠার মধ্যে রেসলিং মঞ্চ সম্প্রসারণের ইঙ্গিতও স্পষ্ট। আর এই মঞ্চে বাংলাদেশ খেলুড়ে হিসাবে অংশ নিচ্ছে না। বাংলাদেশ থাকছে অন্য খেলুড়েদের সেবাইত হিসেবে। কথাটা খুব অমার্জিত শোনাতে পারে। তাই একটু মার্জিত ভাষায় যিনি বলেছেন তার একটা উদ্ধৃতি দিই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. শাফী মো. মোস্তফা কিছু দিন আগে ‘দ্য ডিপ্লোমেট’ পত্রিকায় লিখেছেন, পরাশক্তিগুলোর এই কাছে টানার প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাদেশ দৃঢ় ভূমিকা পালন করতে পারত। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক সঙ্কট, সরকারের বৈধতার সঙ্কট, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে দেশটির স্বাধীন ও যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। তার পরও যে বাংলাদেশ ‘কারো চাপের কাছে নতিস্বীকার না করার’ বিশাল আওয়াজ মাঝে মাঝেই তুলছে তার ব্যাখ্যা কী? একটি ব্যাখ্যা হতে পারে হারার আগেই হার না মানার কৌশল। দ্বিতীয়ত গভীর প্রণয়ের সম্পর্কের ওপর অত্যধিক ভরসা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা