২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সম্রাট আওরঙ্গজেব বনাম মনুবাদী প্রোপাগান্ডা

সম্রাট আওরঙ্গজেব বনাম মনুবাদী প্রোপাগান্ডা। - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার প্যাটেল। ১৯৫০ এর ১৫ ডিসেম্বরে মৃত্যু অবধি তিনি বসবাস করেন নয়াদিল্লির ১. আওরঙ্গজেব রোডের একটি ভবনে। এই রোডের নাম বা এখানে অবস্থান কারো মন বিক্ষুব্ধ করেনি। কিন্তু এখন করছে। সড়কটির নাম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। ২০১৪ সালে মনজিৎ সিং বলেছিলেন, ‘হিটলারের নামে পৃথিবীর কোথাও যেমন কোনো রাস্তা নেই, তেমনি আওরঙ্গজেবের নামে এই রাস্তাও দিল্লির একটি কলঙ্ক!’

সড়কটির নাম বদলানো হয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সিদ্ধান্তে। ২০১৫ সালে লুটিয়েন্স জোনের আওরঙ্গজেব সড়কটি হয়ে ওঠে এপিজে আবদুল কালাম রোড। পরিবর্তন কেবল এতটুকুই নয়। আগ্রা শহরের মেয়র আওরঙ্গজেবকে একজন ‘কসাই’ আখ্যা দিয়ে বলেন, সব জায়গা থেকে তার চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে। বিজেপি নেতারা তার কবর নিশ্চিহ্ন করার দাবি জানান। মহারাষ্ট্রে তার মাজার দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি মুঘলদের নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ এবং ভবন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলার আহবান জানানো হয়।

কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে কেন এমন প্রচারণা? যার মৃত্যু হয়েছে ৩০০ বছরেরও আগে! এ প্রশ্ন সঙ্গত। প্রশ্নটির জবাব তালাশ করেছেন ঐতিহাসিক অড্রে ট্রাশকি। তার মতে, এ ঘৃণা ও প্রচারণার মূলে আছে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের বিশ্বাস। তারা বিশ্বাস করে যে, ‘মুসলিমরা শত শত বছর ধরে হিন্দুদের পীড়িত করেছে এবং এ কারণে আজকের দিনে অতীতের উচিত শাস্তি হিসেবে তাদেরও পীড়িত হতে হবে।’

অড্রে ট্রাশকির মতে, ‘বর্তমানকালের মুসলিমদের ঘৃণা করা এবং তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতা গ্রহণযোগ্য, এই ইঙ্গিত দিতেই আওরঙ্গজেবের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে।’ (গীতা পাণ্ডে, বিবিসি নিউজ, দিল্লি, ২২ মে ২০২২)
অন্যায্য ও অনৈতিহাসিক ঘৃণার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই প্রকল্প। যার দাবি হলো নৃশংসতা ও সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন আওরঙ্গজেব। তরবারির মাধ্যমে সভ্যতা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। মুসলমান না হওয়ায় মানুষ হত্যা করেছেন। যেমনটি দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি; ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বারানসির এক অনুষ্ঠানে। (গীতা পাণ্ডে, বিবিসি নিউজ, দিল্লি, ২২ মে ২০২২)

কিন্তু আওরঙ্গজেব কিংবা কোনো মোগল শাসক তরবারির মাধ্যমে ইসলামের প্রচারে কোনো চেষ্টা করেননি। বহু শতাব্দী ধরে তারা ভারত শাসন করেছেন। তাদের গোটা শাসনকালে মুসলিমরা সংখ্যালঘু থেকে গেছেন। ১৮৭১-৭২ সালে ব্রিটিশরা প্রথম আদমশুমারি করে ভারতে। তাতে দেখা যায়, ভারতে শিখসহ হিন্দুদের সংখ্যা ৭৩ শতাংশ, আর মুসলিমদের সংখ্যা ২১ শতাংশ। এটি স্পষ্ট করে যে, হিন্দুদের নিপীড়ন এবং নির্মূল করা মুসলিম শাসকদের কর্মপন্থা ছিল না। এমনটা হলে ভারত থেকে হিন্দুরা বিলুপ্ত হয়ে যেতেন। কথিত ‘মুসলিম’ শাসনের শেষে ভারতে হিন্দু ছিল ৭৩.৫ শতাংশ, যা বেড়ে ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দাঁড়িয়েছে ৭৯.৮০ শতাংশ। বিপরীতে মুসলমানরা ছিল ২১.৫ শতাংশ, যা কমে ২০১১ এর শুমারিতে ১৪.২৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

কিন্তু আওরঙ্গজেব সেখানে মন্দির ধ্বংস ও তরবারি দিয়ে মুসলিম বানানোর প্রতীক। ফলে মহারাষ্ট্রের আহমেদ নগরে তার ও টিপু সুলতানের ছবি বহনের অভিযোগে তিন মুসলিম নাবালককে গ্রেফতার করে পুলিশ।

হোয়াটস অ্যাপের প্রোফাইলে আওরঙ্গজেবের ছবি ব্যবহার করেছিলেন ভারতের মুম্বাইয়ের এক বাসিন্দা। ফলে ধারা ২৯৮ (ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করার ইচ্ছাকৃত অভিপ্রায়) এবং ১৫৩-এ (বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে শত্রুতা প্রচার করা) এর অধীনে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে। ওই ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হলেও তার বিরুদ্ধে একটি নোটিশ জারি করা হয়েছে। কিন্তু এর পরেও মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে এ নিয়ে সহিংস বিক্ষোভ করে হিন্দুত্ববাদী বিভিন্ন সংগঠন। এতে অংশ নেন বিজেপি-আরএসএসের বিশিষ্ট নেতারা। রাজ্যটি বিজিপি শাসিত হলেও তারা সেখানে ‘আইনের শাসনকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়।’ (The Indian Express, Delhi, June 10, 2023)

এই সহিংসতার মধ্যে আগুন ঢালেন মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফডনবিস। তিনি বলেন, ‘ প্রশ্ন হলো এত এত আওরঙ্গজেবের আওলাদ কোথা থেকে পয়দা হলো? এর পেছনে কারা আছে? এদের আসল মালিক কারা? তাদের আমরা খুঁজে বের করব। মহারাষ্ট্রের সম্মান নষ্ট করার জন্য এসব করা হচ্ছে। এ সব বরদাশত করা হবে না।’ (gallinews.com, June 7, 2023)

মহারাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িক হুমকি মোকাবেলা যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব, তিনি হিন্দুত্ববাদী বাগাড়ম্বরের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী ঘৃণার বিস্তার ঘটালেন। ফলে গভীর সাম্প্রদায়িক কুসংস্কার ও উগ্রতা প্রশাসনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হলো। যা ভারতীয় মুসলিমদের ব্র্যান্ডিং করার জন্য বেছে নিয়েছে আওরঙ্গজেবের আওলাদ পরিভাষা।
ফডনবিস যখন মুসলিমদের আওরঙ্গজেবের আওলাদ বলে তাদের ওপর ঘৃণা, সহিংসতা এবং নিবর্তনকে বৈধতা দিতে চান, তখন তার জানা থাকার কথা যে, মুসলমানরা মোগল বা আওরঙ্গজেবের সরাসরি বংশধর নন। তিনি বরং আওরঙ্গজেবের ঐতিহ্যের বাহক হিসেবে মুসলিমদের চিহ্নিত করতে এই রূপকের আশ্রয় নিয়েছেন। যেন যে প্রতিশোধ আওরঙ্গজেবের ওপর নেবার কথা, সেটি তাদের ওপর নেয়া যায়।
কিন্তু আওরঙ্গজেব কিংবা মোগলদের শাসন প্রতিষ্ঠিত থেকেছে বিপুল সংখ্যক হিন্দু কর্মকর্তা ও সেনাদের সহায়তায়। সেখানে ছিল প্রবল মাত্রায় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের অংশগ্রহণ। সেই অংশগ্রহণ দীর্ঘ ও ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছিল। যার ব্যাপ্তি এত বেশি ছিল যে, আকবরের পরে আওরঙ্গজেবের পিতা অবধি কোনো মোগল সম্রাট মুসলিম মায়ের গর্ভে জন্মগ্রহণ করেননি। আওরঙ্গজেবের দাদী ছিলেন মানমতি, যোধাবাঈ বা জগৎ গোসাই। তিনি ছিলেন মাড়ওয়ারের রাজপুত শাসক উদয় সিং-এর কন্যা।

বস্তুত মোগল শাসকদের দরবারে সবচেয়ে প্রভাবশালী ভূমিকায় নিয়মিত দেখা গেছে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের। হিন্দুত্ববাদকে ভিত্তি প্রদানে প্রধান ভূমিকা রেখেছেন যে জাতীয়তাবাদী ইতিহাসকাররা, তাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব অরবিন্দ ঘোষ স্বীকার করেছেন, মোগলদের রাজ্যরক্ষায় ক্ষমতা ও দায়িত্বসম্পন্ন ক্ষেত্রে হিন্দুরা ভূমিকা রেখেছেন। তাদের মস্তিষ্ক এবং বাহু ব্যবহারের ফলে মোগল শাসন স্থায়িত্ব লাভ করেছে। (Chand, Tara: History of the Freedom Movement in India, vol. 3, Publication Division Government of India, Delhi, 1992, p. 162.)

১৬ শতক থেকে নিয়ে ১৯ শতকের মাঝামাঝি সময়কাল অবধি কেবল পশ্চিম পাঞ্জাব ছাড়া সমগ্র ভারতের ভূমিতে উচ্চতর অধিকার প্রধানত হিন্দুদের হাতে ন্যস্ত ছিল। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই সুবিধা ভোগ করতেন রাজপুতগণ। এটি ঐতিহাসিক তারা চাঁদের উপসংহার। ১৯৬১ সালে ভারত সরকারের প্রকাশনা বিভাগ থেকে প্রকাশিত হিস্টোরি অব দি ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া গ্রন্থে (খণ্ড-১, পৃ. ১২৪) এ সত্য তিনি স্বীকার করেছেন।

আমাদের হাতে আছে মোগল আমলের কর্মকর্তাদের তালিকা ও পরিচিতিমূলক অভিধান। গ্রন্থটির নাম মাসিরুল উমারা। গ্রন্থটি লেখেন শাহনওয়াজ খান এবং তার পুত্র আবদুল হাই। ১৭৪১ সালের আগস্ট থেকে ১৭৮০ সাল অবধি গ্রন্থটি রচনায় তারা নিয়োজিত ছিলেন। ২৭০০ পৃষ্ঠার ফার্সি গ্রন্থটিতে ১৫৫৬ থেকে ১৭৮০ সাল এর মধ্যবর্তী ৭৩৪ জন মোগল কর্মকর্তার বিবরণ রয়েছে। বইটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এবং এশিয়াটিক সোসাইটি এটি প্রকাশ করে তিন খণ্ডে, ১৮৯৬ সালে মির্জা আশরাফ আলীর সম্পাদনায়।
গ্রন্থটি দেখায় মোগল শাসকরা প্রায় ৩৬৫টি উচ্চপদে কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। যার মধ্যে ১০০টি প্রধানত রাজপুত। যারা মূলত ছিলেন রাজপুতানা, মধ্যভূমি, বুন্দেলখণ্ড এলাকার। রাজপুতদের প্রায় সমান কর্মকর্তারা ছিলেন ব্রাহ্মণবংশীয়। ফলে আওরঙ্গজেব বা অন্যান্য মোগল শাসকের শাসনের স্থানীয় প্রতিনিধি যারা ছিলেন, তারা মূলত উচ্চবংশীয় এমন হিন্দু, যাদের বংশধরদের অনেকেই এখন আওরঙ্গজেবদের অপরাধী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চায় এবং কল্পিত সেই অপরাধের প্রতিশোধ নিতে চায় মুসলমানদের ওপর!

কিন্তু আমরা দেখি, মোগলরা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ করেননি। তাদের নির্মম যে গল্পগুলো রয়েছে, সেটি প্রধানত নিজেদের মধ্যকার ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ফসল। যার শিকার হয়েছেন নিজেদের বাবা, ভাই, আনুগত্য ত্যাগকারী আত্মীয়, বিদ্রোহী আঞ্চলিক প্রতিনিধি কিংবা সেনাপতি। তাদের সময়কালে লিখিত বহুসংখ্যক ঐতিহাসিক বিবরণীতে তাদের প্রকৃত চিত্র উপস্থাপিত। সেখানে প্রজাকল্যাণ ও ন্যায়প্রতিষ্ঠায় তাদের অঙ্গীকার আর অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রনীতি সুস্পষ্ট। কিন্তু আওরঙ্গজেবকে অভিযুক্ত করা হয় হিন্দুদের ঘৃণা ও মন্দির ধ্বংসের জন্য। একে মিথ্যা বলে প্রতিপন্ন করেন মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা। ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইয়র্কে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসের এ অধ্যাপক তার বিখ্যাত ‘আওরঙ্গজেব- দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ’ বইয়ে দেখান আওরঙ্গজেবের হিন্দু ঘৃণা ও হাজার হাজার মন্দির ধ্বংসের যে মিথ তৈরি হয়েছে, তা ভিত্তিহীন।

ট্রাশকার মতে, ব্রিটিশদের শাসনের সময় তাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ জনগোষ্ঠীকে ‘বিভাজন আর শাসন করো’ নীতির আওতায় ভারতে হিন্দু বর্ণবাদী ধারণা উসকে দেয়ার কাজে নিয়োজিত ইতিহাসবিদরাই মূলত আওরঙ্গজেবের এমন একটি ইমেজ তৈরি করেন।

আওরঙ্গজেবের আদেশে বিনষ্ট হয়, এমন মন্দিরের সংখ্যা ট্রাশকার হিসেবে এক ডজন। ৩১ জুলাই ১৬৫৮ থেকে ৩ মার্চ ১৭০৭ অবধি ৪৯ বছর দীর্ঘ তার শাসনামল রাজনৈতিক গোলযোগ, বিদ্রোহ মোকাবেলা ও বিজয়াভিযানে ছিল কম্পমান। এ সময় দক্ষিণ ভারত জয়ের ফলে তার শাসিত সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল ৯ কোটি ১৩ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এ সময় সাম্রাজ্যের জনসংখ্যা ছিল ১৫০ মিলিয়নের বেশি। যা তৎকালীন পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় এক চতুর্থাংশ। যুদ্ধরত বিভিন্ন এলাকায় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠাসহ নানা কারণে মন্দিরগুলোকে যুদ্ধপরিস্থিতির ক্ষতির শিকার হতে হয়। ট্রাশকার হিসেবে ৪৯ বছরের শাসনে এই বিশাল, বিপুল সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক গোলযোগের মধ্যে যদি এক ডজন মন্দির ধ্বংসের কবলে পড়ে তার কারণে, সে পরিপ্রেক্ষিতে তাকে কসাই বলে আখ্যায়িত করার আগে চিন্তা করা উচিত বিগত ৫০ বছরে ভারতে করুণ ধ্বংসের কবলে পড়েছে, এমন মসজিদের সংখ্যা কত?

সত্য হলো, ধর্মীয় কারণে আওরঙ্গজেব কোনো মন্দিরের ক্ষতি করেননি। যদি হিন্দু ধর্ম ও মন্দিরের প্রতি তার বৈরিতা থাকবে, তাহলে কেন তিনি পৃষ্ঠপোষকতা করলেন অসংখ্য মন্দিরের, কেন সহায়তা করলেন মন্দির ও পুরোহিতদের? মন্দিরে তার সহায়তার বহু ঐতিহাসিক দলিল পাওয়া গেছে। হিন্দু ও জৈন ধর্মীয় স্থানগুলোর সমসাময়িক নথিতে পাওয়া যায় আওরঙ্গজেব তাদের সহায়তা করতেন। হিন্দু মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তিনি সর্বোচ্চ পরিমাণে অনুদান দিয়েছেন। রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে এর নমুনা যেমন আছে, তেমনি আছে দূর-দূরান্তের জনপদেও। দিল্লির লাল কেল্লার লাহোরি গেট থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত গৌরি শঙ্কর মন্দির এবং শাহজাহানের রাজত্বকালে নির্মিত লাল কেল্লার ঠিক বিপরীতে অবস্থিত জৈন লাল মন্দিরে আওরঙ্গজেবের সহায়তার ঐতিহাসিক নথি পাওয়া গেছে। বারানসির গোধূলিয়ার মোড় থেকে বানারসি হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাবার পথে বাঙালিটোলায় অবস্থিত জঙ্গমবাদী মঠে পাওয়া গেছে আওরঙ্গজেবের তিনটি ফরমান। ফরমানগুলোতে দেখা যায়, তিনি এই মঠের জন্য অর্থদান করেছেন, ভ‚মি বন্দোবস্ত করেছেন এবং আগের কোনো অনুদান পুনরায় বলবত করেছেন। এমনতরো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া গেছে গয়ার প্রাচীন এক মন্দিরে, আসামে ব্রহ্মপুত্র তীরের এক মন্দিরে। এতে দেখা যায়, মন্দিরে যেমন তিনি সহায়তা দিয়েছেন, তেমনি ভ‚মিদান করছেন পুরোহিতদেরও।

এসব দৃষ্টান্ত বিচার করে আওরঙ্গজেবকে নিয়ে তৈরি মন্দির বিনাশের মিথের উপর সংশয় প্রকাশ করেছেন রেখা যোশীর মতো গোঁড়া লেখকও। ‘আওরঙ্গজেব: অ্যাটিটুডস অ্যান্ড ইনকিনেশন্স’ গ্রন্থে যোশী স্বীকার করেন, ‘আওরঙ্গজেবের চরিত্র মূল্যায়ন করা অত্যন্ত কঠিন।’ সরল ও অনাড়ম্বর সাধারণ এক ধার্মিকের জীবন অতিবাহিত করেন তিনি। মাটিতে ঘুমাতেন। দরবারে কৃচ্ছ্রতার নীতি চালু করেন। নিষিদ্ধ করেন বহু পাপাচার। জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই তার কাছে লাভ করত ন্যায়বিচার। তার আমলে ভারতের জিডিপি বিশ্ব অর্থনীতির ২৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল, যা বিশ্বের বৃহত্তম সাম্রাজ্য চীন এবং পশ্চিম ইউরোপের মিলিত জিডিপির অধিক ছিল। বস্তুত ১৮ শতক পর্যন্ত মোগল সাম্রাজ্য গোটা বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ শিল্প উৎপাদন করত।

কিন্তু বিজেপির ভারতে আওরঙ্গজেবকে ঘৃণা করতেই হবে। মহিমান্বিত করতে হবে শিবাজিকে। ফডনবিস বলেছেন, মহারাষ্ট্র শিবাজির। আওরঙ্গজেবকে মহিমান্বিত করা হলে বরদাশত করা হবে না। কিন্তু শিবাজির নিষ্ঠুরতা কি ইতিহাস থেকে মোছা যাবে? নেহরু তার ‘Discovery of India’-তে শিবাজিকে ঠিকই ‘ডাকাত’ বলে উল্লেখ করেছেন। শিবাজি বিভিন্ন শহরে নির্মমতার প্লাবন বইয়ে দিয়েছেন, এটি তার অনুরাগীরাও স্বীকার না করে পারেননি। ১৬৬৪ সালে (জানুয়ারি) প্রথম সুরাট লুণ্ঠনের একটি বিবরণ শোনা যাক: যে তিন দিন শিবাজি সুরাট নগরে ছিলেন, সেই তিন দিন এমন কোনো পাশবিক কাজ নেই, যা তার দল করেনি। লুটপাট, ঘরে আগুন দেয়া, হাজার হাজার মানুষের হাত কেটে দেয়া, মাথা কেটে দেয়া, নারীদের ওপর চরম নির্যাতনে সুরাট অধিবাসীর কান্না যেকোনো মানুষকেই ব্যথিত করে তোলে। (জে সি দে, শিবাজিজ সুরাট এক্সপিডিশন অব ১৬৬৪, ইন্ডিয়ান কালচার’, এপ্রিল ১৯৪০।)

শিবাজির এমন নির্মমতার প্রমাণাদি ঐতিহাসিক। কিন্তু হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য শিবাজির ওপর দেবত্ব ও মাহাত্ম্য আরোপের মাধ্যমে ধর্মকে রাজনীতির ক্ষেত্রে অস্ত্ররূপে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সূচনা ঘটে বাল গঙ্গাধর তিলকের হাত ধরে। ১৯০২ সালে কলকাতায় শুরু হয় শিবাজি উৎসব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শিবাজি উৎসব’ (১৯০৪) কবিতা রচিত হয় অচিরেই। তারপর এই ধারা আজকের চরিত্র অবধি বিকশিত হয়েছে।

শিবাজিকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের মহানায়ক বিবেচনা করে তার শত্রু হিসেবে কথিত আওরঙ্গজেবের আওলাদ মুসলিমদের যখন চিহ্নিত করা হচ্ছে, তখনো ভুল করা হচ্ছে গুরুতর। মহারাষ্ট্রে শিবাজির বিরুদ্ধে কখনো মুখোমুখি হননি আওরঙ্গজেব। এখানে তাকে মোকাবেলার জন্য মূলত পাঠানো হয় রাজপুত সেনাপতি জয় সিংহকে (১৬১১-১৬৬৭)। তিনি শিবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার চাচা ছিলেন মহারাজা সওয়াই জয় সিংহ (১৬৮১-১৭৪৩)। আওরঙ্গজেবের দেয়া তার সম্মানজনক খেতাব ছিল মির্জা রাজা, ‘সারমাদে রাজাহায়ে হিন্দ’ (ভারতের শাশ্বত শাসক), ‘রাজ রাজেশ্বর’ (রাজাদের প্রভু) এবং ‘শ্রী শান্তনু জি’ (সুস্থ রাজা)।

শিবাজির মোকাবেলায় ভূমিকা রেখেছিলেন আরেক রাজা রঘুনাথ বাহাদুর। তিনি ছিলেন একজন কায়স্থ। সম্রাট শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেবের দেওয়ানে আলা বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কাজ করেন তিনি। আওরঙ্গজেব এই হিন্দু প্রধানমন্ত্রীকে খুব পছন্দ করতেন। রাজার মৃত্যুর পরে মন্ত্রী আসাদ খানকে লেখা আওরঙ্গজেবের চিঠিতে এর নিদর্শন স্পষ্ট। রাজা অনেক বেশি মনোযোগী ছিলেন কায়স্থদের উন্নয়নে। যা তার পারিবারিক নথিতে পরিষ্কার।

অন্যদিকে শিবাজির পক্ষে কাজ করেছিলেন বিপুল সংখ্যক মুসলমান। তার সেনাবাহিনী হিন্দু, মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের নিয়ে গঠিত ছিল। জয়সিংহ যখন শিবাজিকে চরম আঘাত করেন, তখন শিবাজিকে রক্ষা করেন প্রধানত পাঠান মুসলিমরা। বহু পাঠান তার প্রশাসনে উচ্চপদে সমাসীন ছিলেন। তার সেনাবাহিনীতে মুসলিম সমরনায়কদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দৌলত খান, ইব্রাহিম খান, সিদ্দি সম্বল ও সিদ্দি মিশরী প্রমুখ।

শিবাজির সচিবের নাম ছিল হায়দার খান। তার গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান ছিলেন ইব্রাহিম খান, নৌবাহিনীর প্রধান ছিলেন দৌলত খান, পদাতিক বাহিনীর প্রধান ছিলেন নূর খান বেগ। তার ব্যক্তিগত অন্যতম দেহরক্ষী ছিলেন মাদারি মেহতাব। তার আরেক সহযোগী ছিলেন সামা খান। আগ্রা থেকে তার পলায়নে সহায়তা করেন এক মুসলিম যুবক। দাক্ষিণাত্যে শিবাজির সাথে যখন আলোচনার জন্য আওরঙ্গজেবের তরফে আসেন এক হিন্দু ব্রাহ্মণ রাজদূত, তখন শিবাজির তরফে প্রতিনিধি ছিলেন মুসলিম জেনারেল হায়দার খান।

ইতিহাসের এই কৌতুককর বাস্তবতার প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা প্রদর্শন করছে হিন্দুত্ববাদ। যে দ্বন্দ্ব ও প্রেক্ষপটগুলোর ছিল বহুমাত্রিক রাজনৈতিক-আঞ্চলিক বাস্তবতা, তাকে তারা কেবল নিজেদের সাম্প্রদায়িক উগ্রতার পোশাক পরিয়ে মুসলিম ঘৃণার নতুন জোয়ার বইয়ে দিতে চায়।

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
যুক্তরাষ্ট্র ‘আগুন নিয়ে খেলছে’, চীনের কঠোর হুঁশিয়ারি ভোটের ‘নথি গোপন’ করতে চায় মোদি সরকার : খাড়গে চুয়াডাঙ্গায় জমিজমার জেরে কৃষককে কুপিয়ে হত্যা সড়ক দুর্ঘটনায় স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিহত রাজধানীতে পরিত্যক্ত অবস্থায় শটগানের ২৩ রাউন্ড কার্তুজ উদ্ধার যশোরে আ.লীগের ১৬৯ নেতাকর্মীর আদালতে আত্মসমর্পণ অন্তর্বর্তী সরকারকে আরো ২ বছর সময় দিতে হবে : ভিপি নুর সতর্ক থাকুন, দেশকে কেউ যেন বিভক্ত করতে না পারে : মির্জা ফখরুল নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪ দফা দাবি আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে রাবি অধ্যাপক আতাউরকে সাময়িক অব্যাহতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হলেন নাসিমুল গনি

সকল