০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

নেপথ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীচক্র টেকনাফজুড়ে খুন অপহরণ আতঙ্ক

নেপথ্যে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীচক্র টেকনাফজুড়ে খুন অপহরণ আতঙ্ক। - ছবি : সংগৃহীত

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা ইদানীং সশস্ত্র সন্ত্রাসী ও ডাকাতদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ মহাআতঙ্কে দিনাতিপাত করছেন। মেরিন ড্রাইভের শাপলাপুর থেকে সাবরাং ও রামু টেকনাফ সড়কের বালুখালী থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কে সন্ধ্যার পর চলাচল করা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পাহাড়ের পাদদেশে যেসব কৃষক চাষাবাদে জড়িত তারা সবচেয়ে বেশি আতঙ্কগ্রস্ত। পাহাড় সন্নিহিত এলাকায় মানুষ বাজার সওদা করতে এমনকি চায়ের দোকানে বসতেও ভয় পাচ্ছে। কোন সময় মুখোশপরা সন্ত্রাসীচক্র হানা দিয়ে ধরে নিয়ে যায়! স্কুল ও মাদরাসায় পড়তে যাওয়া শিশুদের নিরাপত্তাহীনতায় অভিভাবক মহল উৎকণ্ঠিত। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পুলিশ সূর্যাস্তের পরই ব্যারাকে ফিরে যায়। ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো রাতের বেলা থাকে অরক্ষিত। শুরু হয় অস্ত্রের মহড়া ও ঝনঝনানি।

কর্র্তৃপক্ষীয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার গোয়েন্দা ও বৃত্তিভোগী এজেন্ট হিসেবে কিছু রোহিঙ্গা টেকনাফে সক্রিয় রয়েছে। মিয়ানমারের সরকার গোপনে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গ্রুপ সৃষ্টিতে ইন্ধন দিচ্ছে। অস্ত্র আসছে ওপার থেকে। একটি গ্রুপের হাতে ৫০০ অস্ত্র মজুদ রয়েছে এমন তথ্যও পাওয়া গেছে। টেকনাফ এলাকায় মিয়ানমারের মোবাইল নেটওয়ার্ক সক্রিয়। ফলে যোগাযোগ ও তথ্য বিনিময়ে কোনো অসুবিধা হয় না। মিয়ানমার সরকার বিশ্বকে দেখাতে চায় রোহিঙ্গারা জাতিগতভাবেই ভালো মানুষ নয়, সন্ত্রাসী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী।

ক্যাম্পের অভ্যন্তরে বা বাইরে রোহিঙ্গার হাতে রোহিঙ্গা খুন হওয়ার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরাকানে থাকতে রোহিঙ্গার হাতে রোহিঙ্গা মারা যাওয়ার ঘটনা বিরল ছিল। সামরিক জান্তার নজিরবিহীন পাশবিকতা ও নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় পাওয়ার পর রোহিঙ্গারা হয়ে উঠেছে বেপরোয়া ও দুর্ধর্ষ। তাদের হাতে এখন অত্যাধুনিক অস্ত্র। নানা ধরনের কোটি কোটি টাকার মাদক ও অস্ত্রপাচারকে কেন্দ্র করে আধিপত্য বিস্তারই সহিংসতার অন্যতম কারণ। হত্যা, খুন, গুম, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায় করে এতদঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে তারা। অশিক্ষা, মিয়ানমার জান্তার অব্যাহত নিবর্তন, স্বাধীন জীবনযাত্রার অভাব, রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঐতিহ্যগতভাবে জন্ম নিয়েছে অপরাধপ্রবণতা, কৃতঘ্নতা, নিষ্ঠুরতা ও জিঘাংসার মনোবৃত্তি। উল্লেখ্য, সব রোহিঙ্গা খারাপ, অপরাধী বা অকৃতজ্ঞ এ কথা সমীচীন নয়। তাদের মধ্যে অনেক ভালো, ভদ্র, শালীন ও বিবেচনাবোধসম্পন্ন মানুষ আছেন। সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রশিক্ষণ না থাকায় বেশির ভাগ রোহিঙ্গার জীবনাচারে আইন না মানা ও ঔদ্ধত্যের প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দুনিয়ার খবরাখবর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। সংবাদপত্র পাঠ ও টিভির সংবাদ দেখারও ব্যবস্থা নেই। তাদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ ও একতার অভাব প্রকট। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা এখন গলার কাঁটা। ভ্রাতৃত্ব ও মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় ও আতিথ্য দিয়েছিল। কিন্তু আফসোস, তারা জাতিসঙ্ঘ ও এনজিওদের সহায়তায় ফ্রি থাকা-খাওয়ার সুযোগ পেয়ে স্থানীয় জনগণকে জিম্মি করে ফেলেছে। খাল কেটে কুমির আনার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের ডাকাতচক্র। এসব কারণে উখিয়া ও টেকনাফের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও ডেমোগ্রাফিক চিত্র বদলে যেতে বসেছে। আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

অপহরণের সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে উপজেলার হ্নীলা, হোয়াইক্যং, বাহারছড়া ও সদর ইউনিয়নের একাংশ। স্থানীয়, রোহিঙ্গা, শিশু, বৃদ্ধ, কৃষক কেউ বাদ পড়ছে না অপহরণের কবল থেকে। অপহরণ পরবর্তী অনেকে অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দিয়ে তাদের স্বজনদের ছাড়িয়ে নিয়েছে, অনেকে মুক্তিপণ দিতে ব্যর্থ হয়ে প্রাণ দিয়েছে, ব্যতিক্রম দুয়েকটি ঘটনায় পুলিশের ধাওয়ায় অপহৃতদের ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও রয়েছে। তবে প্রতিনিয়ত অপহরণের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় তেমন সন্তুষ্ট নয়। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, অপহরণকারীদের মূল আস্তানা পাহাড়ে। এসব পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের হাতে। সন্ত্রাসীরা পাহাড়ের আস্তানা থেকে পরিচালনা করছে এ সব অপহরণ কর্মকাণ্ড। এ ক্ষেত্রে তারা নিজেদের টার্গেট করা ব্যক্তি বা অন্য যে কাউকে সুযোগ পেলে অস্ত্র ধরে পাহাড়ের গহিনে নিয়ে যায়। পরে সেখান থেকে পরিবারের ফোন নম্বর নিয়ে যোগাযোগ করে মুক্তিপণের টাকা দাবি করে। টাকা দিলে ছেড়ে দেয়, না দিলে অপহৃত ব্যক্তিকে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়, মুক্তিপণ দিতে না পারায় প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তথ্যমতে, গত আট মাসে ৭০ জনকে অপহরণ করেছে সন্ত্রাসীরা। তবে এর বাইরেও আরো অপহরণের ঘটনা ঘটেছে যেগুলো অপহরণকারীদের সাথে দেনদরবার করে গোপনে ছাড়িয়ে নিয়েছে পরিবার। গত ২ জুন দিবাগত রাতে টেকনাফের ২৫ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পাঁচজনকে অপহরণ করে সন্ত্রাসীরা। পরে তাদের পরিবারের কাছে ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণ না পেয়ে অপহৃতদের একজনের হাতের কব্জি কেটে বিচ্ছিন্ন করে ছেড়ে দেয়। পরে আলীখালী নামক এলাকার পাহাড়ের পাশে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের সহায়তায় তাকে উদ্ধার করা হয়। একজনের হাত কেটে অপহরণকারীরা অপর চারজনের পরিবারে এক ধরনের হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৬ জুলাই-২০২৩)।

গত ৬ মে টেকনাফ উপজেলার দমদমিয়া পাহাড়ি এলাকা থেকে তিন বন্ধুর মরদেহ ২৫ দিন পর পাহাড়ি এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়। পাত্রী দেখতে এসে তারা অপহরণের শিকার হন। হতভাগারা হলেন- কক্সবাজারের ঈদগাঁও জালালাবাদ সওদাগরপাড়া এলাকার মোহাম্মদ ইউছুপ, চৌফলদণ্ডী ইউনিয়নের রুবেল ও কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়া এলাকার ইমরান। তিন বন্ধু ২৮ এপ্রিল টেকনাফে পাত্রী দেখতে আসেন। রাতে তারা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে ফিরে যাচ্ছিলেন। সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে অটোরিকশা থামিয়ে তাদের অপহরণ করে গহিন জঙ্গলের আস্তানায় নিয়ে যায়। তাদের ছেড়ে দিতে ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে নির্যাতনের ভিডিও পাঠায় অপহরণকারীরা। পরিবার দুর্বৃত্তদের চাহিদামতো অর্থ দিতে না পারায় তাদের নৃশংস কায়দায় হত্যা করা হয়। গত ২১ মে টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকার মৌলভীপাড়া থেকে আলী হোসেন (৫৫) নামে এক কৃষককে পাহাড়ি এলাকায় গরু চড়াতে গেলে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে টেকনাফের গহীন পাহাড়ে নিয়ে যায়। সন্ত্রাসীরা ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এসব পাহাড়ি এলাকায় বহু মানুষের কৃষিজমি রয়েছে। ওই জমিতে ধান ও সবজির চাষ করে তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। পাশাপাশি রাখাল বালকরা সেখানে গরু চড়াতে যায়। এখন কৃষকদের জীবন-জীবিকা হুমকির মুখে।

গত পাঁচ বছরে উখিয়া ও টেকনাফের আশ্রয়শিবিরগুলোতে ১২৩ জন খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৯১ জনকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা ৮১ মামলায় আসামি ৩৮৪ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী। অবশিষ্ট ৩২ জন খুন হয়েছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের একাধিক বাহিনীর গোলাগুলিতে এবং অপহরণের পর খুন-গুমের ঘটনায়। মুক্তিপণের জন্য গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে অপহরণ করা হয় ২০৭ রোহিঙ্গাকে। পুলিশের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় পাঁচ বছর তিন মাসে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন অপরাধে পাঁচ হাজার ২২৯ জন রোহিঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে দুই হাজার ৪২৫টি। সবচেয়ে বেশি মাদক মামলা এক হাজার ৫৬৪টিতে আসামি করা হয়েছে দুই হাজার ৩৮৫ রোহিঙ্গাকে। একই সময়ে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় ১৭৬টি অস্ত্র। গত ১৫ ফেব্রæয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে সংঘটিত অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ সময়ে হত্যাকাণ্ড বেড়েছে। ২০২১ সালে যেখানে ২২টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে, ২০২২ সালে তা বেড়ে হয় ৩২টি। জানুয়ারি ২০২১ থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত ২২২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৯৯টি দুর্ঘটনাজনিত। ৬০টি নাশকতামূলক ও ৬৩টির কারণ জানা যায়নি (বাংলা ট্রিবিউন, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ভোরের কাগজ, ২১ জানুয়ারি-২০২৩)।

বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় ৩৪টি ক্যাম্পে ১৮ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করে। প্রতি বছর ক্যাম্পে ৩০ হাজার শিশু জন্ম নেয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মতে, দিন যতই যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে তত বেশি অস্থিরতা ও নানা অপরাধ বাড়ছে। একই সাথে বাড়ছে হত্যা, গুম, মাদক চোরাচালান ও অপহরণসহ নানা অপরাধ। প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের হাতে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। সংঘটিত অপরাধের মধ্যে আছে- অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশের ওপর হামলা, ডাকাতি, হত্যা, খুন, মানবপাচার ও নৈরাজ্য সৃষ্টি। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবির। দুই উপজেলার বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ। অথচ দুই উপজেলায় মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে ১৮ লাখ রোহিঙ্গা; যা স্থানীয় জনসংখ্যার তিনগুণেরও বেশি। স্থানীয়রা নিজ দেশে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছে। দুই উপজেলায় ক্যাম্প গড়ে তোলায় আট হাজার একর বনভ‚মি ধ্বংস হয়ে গেছে। স্থানীয়দের প্রশ্ন, নিজ দেশে কবে ফিরে যাবে রোহিঙ্গারা। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া যত বিলম্বিত হচ্ছে, শঙ্কা ও উদ্বেগ তত বাড়ছে।

এহেন পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। ভাসানচরের মতো কোনো দ্বীপ বা জেগে ওটা চরাঞ্চলে রোহিঙ্গাদের অস্থায়ীভাবে রাখা যায় কি না, ভাবতে হবে। সেনাবাহিনী, বিজিবি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট সম্মিলিতভাবে চার দিকে থেকে পাহাড় ঘেরাও করে সাঁড়াশি অভিযান চালালে সন্ত্রাসীরা ধরা পড়তে বাধ্য। তীক্ষ্ম গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে সশস্ত্র দুর্বৃত্তদের পাকড়াও করাও কঠিন হবে না। এমন দক্ষতা ও অভিজ্ঞ দেশপ্রেমিক সেনা, বিজিবি সদস্য ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর রয়েছে।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement