২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

প্রত্যাশার জাতীয় নির্বাচন

-

‘বাঙালি রাজনীতিসচেতন,’ এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ‘হুজুগে বাঙালি’ এ কথাও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- সে কোন কালে, তার নির্দিষ্ট কোনো হদিস নেই। দেশবাসী মাথায় নিয়ে চলছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পরিবেশ বিপর্যয়, নদীভাঙন, মানি লন্ডারিং, মুদ্রাস্ফীতি, বৈষম্য, রাবনদের ধাপ্পাবাজি, ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ভয়ভীতি, হাভাতে, লোডশেডিং ও বেকারত্বে। পাশাপাশি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেল, প্রশস্ত মহাসড়ক প্রভৃতি দৃশ্যমান অগ্রগতি নীতিগতভাবে অস্বীকার করা যায় না। তবে অগ্রগতির সব কিছুই ম্লান হয়ে যাচ্ছে সরকারি দলের বৈষম্যমূলক একনায়কসুলভ শাসনের কারণে।

বিরোধী দল তো বটেই সরকারি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের গত ৪ জুন নরসিংদীতে জাতীয় পার্টির সম্মেলনে বলছেন, বাংলাদেশে এখন একদলীয় শাসনব্যবস্থা চলছে যার সদস্য পদে রয়েছে বিচার বিভাগ, দুদক, পিএসসি, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরের দিন একই কথা ঢাকা জেলা জাতীয় পার্টির সম্মেলনে পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, আগের ‘বাকশালই’ বর্তমান ‘আওয়ামী লীগ প্লাস’। সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদার জোরগলায় বলেছেন, মানুষ বাজারে গিয়ে কান্নাকাটি করে। সিন্ডিকেট দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করে লাগামহীন করছে এবং মন্ত্রীদেরও ব্যবসায় রয়েছে যারা সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। সরকারের অন্যতম শরিক দল সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ২০১৮ নির্বাচনের পরপরই বলেছিলেন, ৯ হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়েছে এবং তিনি নিজের ভোট নিজে দিতে পারেননি। অর্থাৎ বর্তমানে বাংলাদেশে চলছে ভোটারবিহীন নির্বাচন। এগুলো একদলীয় শাসনব্যবস্থারই আশীর্বাদ।

একদলীয় শাসনব্যবস্থা সেখানেই কার্যকর হয় যেখানে অবাধ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত। একটি দেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সবার আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন, থাকতে হবে জবাবদিহিতা, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতাসহ দৃঢ়তা। কিন্তু এর পরিবর্তে জন্ম নিয়েছে তেলবাজি, তোষামোদি, চামচাগিরি, ফলে মূলত জনমনে প্রতিবাদ যা হচ্ছে তা ধোপে টেকে না; বরং প্রতিবাদকারীর ভোগান্তি হচ্ছে নানাভাবে। চাটুকাররা তো প্রতিবাদকারীদের পেছনে লেগে থাকে অধিকতর চাটুকারি করে কর্ণধারদের মনোরঞ্জনের জন্য। দৃশত এখন মনে হচ্ছে শুধু বেঁচে থাকার জন্য চাটুকার এখন সবাই, ক্ষেত্র বিশেষে কিছু ভিন্নতা ছাড়া। সরকারি আমলাদের মেরুদণ্ড শক্ত থাকার কথা নয়, ফলে দিন দিন তারা চাটুকারিতাতে বাধ্য হয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কারণ সিনিয়র ডিঙিয়ে প্রমোশন এবং লোভনীয় পোস্টিং সব কিছুই তাদের নির্ভর করে সরকারপ্রধানের মনমর্জির ওপর। অযাচিত প্রমোশন ও লোভনীয় পোস্টিংয়ের মজাই আলাদা। কিন্তু যারা সাংবিধানিক পদে অলঙ্কৃত হয়েছেন তাদের এত পিছুটান কেন? তাদের দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষতার বিষয়টি কেন এত প্রশ্নবিদ্ধ? কথাগুলো এখন পাবলিক পারসেপশন বৈকি!

জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সরকারের অযাচিত প্রভাবমুক্ত একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার জন্য সংবিধান কতগুলো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেছে যার অন্যতম নির্বাচন কমিশন, দুদক, পিএসসি, মানবাধিকার কমিশন প্রভৃতি। বিচার বিভাগ পৃথিবীব্যাপী একটি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কার্যকর হওয়ার জন্যই জন্মলাভ করেছিল। স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কর্মকাণ্ডে আজ প্রশ্নবিদ্ধ। দুদক দায়েরকৃত মামলা বিরোধী দলের ওপর খড়গের মতো ঝুলে আছে, অথচ প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলায় খালাস। এ ধরনের বৈষম্য সর্বত্রই আজ দৃশ্যমান। এসব কারণেই জনগণ আজ সরকারের প্রতিপক্ষ এবং বিভিন্নভাবে সরকারই জনগণকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে।

যার ফলে গাজীপুর সিটি করপোরেশন মেয়র পদে সরকারি দলের স্বনামধন্য প্রার্থীকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে দল থেকে দ্বিতীয়বার বহিষ্কৃত জাহাঙ্গীরের ৬৭ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ মাতার কাছে যিনি কোনো দিনই রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিলেন না; বরং প্রতিবাদের দৃঢ়তাই ছিল তার জয়ের মুখ্য হাতিয়ার। ফলে প্রচারে বিভিন্নভাবে হামলার শিকার ও শত প্রতিকূলতার মধ্যেও তিনি নির্বাচিত হয়ে সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছেন। সরকারি দলের লোকেরা এখন বলছে, জাহাঙ্গীরের মা বিএনপি ও জামায়াতের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে কি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে জামায়াত-বিএনপি যাতে ভোট না দিতে পারে সে ফন্দিই সরকার আঁটছে? গ্রামে গঞ্জে, বাসে, স্টিমারে, চায়ের দোকানে বা অফিস আদালতে, পাড়ায়-মহল্লায় তখন সর্বত্রই একটি আলোচনা, তা হলো- আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে? সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে তো!

১. অনেকের ধারণা, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না হয় তবে আগামীতে শেখ হাসিনাই সরকার গঠন করবেন। কারণ তার আমলের নির্বাচন বিশ্বব্যাপী প্রশ্নবিদ্ধ। পুলিশের সহায়তায় দিনের ভোট রাতে হয়েছে বলে রাষ্ট্রদূতরাও প্রকাশ্যে বলে বেড়াচ্ছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের অনুষ্ঠিত নির্বাচনের অভিজ্ঞতা দেশবাসীর রয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সুরের সাথে যদি নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, র‌্যাব প্রশাসন, দুদক প্রভৃতি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সুর একই সূরে বাজে তবে ইতোপূর্বে যেমন ভোটারবিহীন ভোট হয়েছে এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না। নাজিমউদ্দিন নামে একজন জাতীয় সংসদ সদস্য ঘোষণা দিয়েছেন- তিনি আত্মহত্যা করবেন যদি আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসে।

২. অনেকের ধারণা, যেহেতু সরকার ও এমপি নেতৃত্বাধীন জেলায় জেলায় গড়ে উঠা সরকারের বেসরকারি বাহিনী বিভিন্নভাবে জনগণকে তাদের প্রতিপক্ষ বানিয়েছে, সেহেতু সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দলের সমন্বয়ে সরকার গঠিত হবে। তবে প্রশ্ন থাকে, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে তো?

৩. অনেকের ধারণা, আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপে তৃতীয় শক্তি ক্ষমতায় আসবে। যদিও রাষ্ট্রদূতরা প্রায়ই বলে আসছেন, তারা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ করবেন না। দৃঢ়তার সাথে এই কথাটাও প্রকাশ্যে বলছেন, তারা বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচন দেখতে চান। পৃথিবী এখন কোনো রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেকেই কারো না কারো ওপর বিভিন্নভাবে নির্ভরশীল। রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনাররা যা বলেন তা সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের অনুমোদনক্রমেই বলেন। ফলে মন্ত্রীরা গলা উঁচিয়ে যা-ই বলেন না কেন, ভেতরে ভেতরে বরফ গলা শুরু হয়েছে। এতদিন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকসহ বাকপটু মন্ত্রীরা দৃঢ়তার সাথে বলে আসছিলেন, জামায়াত-বিএনপির সাথে কোনো আলোচনা নেই। এখন সবচেয়ে সিনিয়র নেতা ও সরকারি ১৪ দলের সমন্বয়কারী প্রধানমন্ত্রী পরিবারের নেতৃস্থানীয় আমির হোসেন আমু বলছেন, তারা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে আলোচনায় বসতে রাজি আছেন।

এটি আর কিছু নয়; বরং মার্কিন ভিসানীতির প্রতিফলন। তবে আওয়ামী জুনিয়র এক মন্ত্রী (তথ্য) বলছেন, এটি আমুর নিজস্ব মতামত, দলের নয়। বিএনপি সঙ্গতভাবেই বলছে, আগে পদত্যাগ, পরে আলোচনা। তবে আমি মনে করি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি ১নং অ্যাজেন্ডাভুক্ত হওয়া জরুরি। কারণ খালেদা জিয়ার মুক্তিই হবে নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের পূর্বশর্ত। পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে তা এখনো আঁচ করা যাচ্ছে না। সম্মানজনক ও গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে তৃতীয়পক্ষের ক্ষমতা গ্রহণের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না, যেমনটি ঘটেছিল ওয়ান-ইলেভেনের সময়। তখন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ওয়ান-ইলেভেন তাদের আন্দোলনের ফসল। শুধু নিজেদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রাখার জন্য সরকারের সব কূটকৌশল এখন বিশ্ববাসীর কাছে ধরা খেয়েছে। ফলে সরকারের শত অর্জন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হচ্ছে হেয়প্রতিপন্ন। সরকার জাতিকে দ্বিখণ্ডিত করেছে। রক্তের বিনিময়ে দেশটি স্বাধীন হয়েছিল, কিন্তু সে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করছে সরকার ও সরকারি ঘরানার লোকেরা। রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবারতন্ত্রের কষাঘাতে জাতি সব সময়ই অধিকারবঞ্চিত। দৃশত মনে হচ্ছে, দেশটি সামগ্রিকভাবে যেন আপামর সবার জন্য স্বাধীন হয়নি। সবাইকে নিয়ে সার্বিক ও সমভাবে বাঁচাটাই সার্থকতা, নতুবা ইতিহাসের ডাস্টবিন। জাপানিরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তাদের মতবাদে একনিষ্ঠভাবে বিশ্বাসী হওয়ার কারণে। তারা বিশ্বাস করে, মানুষের সব কর্মজীবনের জন্য, জীবনের জন্য প্রয়োজন সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য।

তবে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য হতে হবে সামগ্রিক, একতরফা নয়। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এখন একতরফাভাবে সরকারি ঘরানায়। ফলে বর্তমানে সামগ্রিকভাবে এ জাতিকে সুখী সমৃদ্ধশালী স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ জাতি বলা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারি আগ্রাসন বন্ধ না করা যায়, যার জন্য প্রয়োজন একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও প্রতিযোগিতামূলক গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ জন্য একজন যোগ্য প্রার্থী বাছাই করতে দেশবাসীকে সচেতন হতে হবে। মহান করুণাময় আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি সে জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করি না, যারা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য নিজেরা সচেষ্ট না থাকে।’ জনগণকেও নির্বাচনে সঠিক যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, শুধু ব্যাংকলুটেরা টাকাওয়ালাদের পিছু হাঁটলে সার্বিক সুখ-সমৃদ্ধি অর্জন হবে না। উল্লেখ্য, সংবিধানের বয়স ৫০ অতিক্রম করেছে। সময়োপযোগী ও জনঅধিকারবান্ধব সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্য যথোপযুক্ত সংশোধনী এখন সময়ের দাবি।

লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
ডিজি-মার্ক সল্যুশন এবং জেটকেটেকোর ‘রোড টু এআই’ এবং পার্টনার মিট ২০২৪’ অনুষ্ঠিত দাগনভূঞা ও সোনাগাজীতে বিএনপির আহবায়ক কমিটি সাংবাদিক তুরাব ছিলেন সত্যের পক্ষে, মানবতার পক্ষে : সেলিম উদ্দিন নাটোরের সেই তরুণ দাস মন্দিরের পাহারাদার নয়, ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরে সারজিসের আশ্বাসে সড়ক ছাড়লেন চিকিৎসকরা নির্বাচনের জন্য যৌক্তিক সময় দিতে চায় জামায়াত : মোবারক হোসাইন নিজেদের যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করল যুক্তরাষ্ট্র! হাসিনা যত টাকা লুট করে নিয়ে গেছে তা দিয়ে ১০০টি পদ্মা সেতু তৈরি করা যেত : টুকু খুলনায় হত্যাসহ ৪ মামলায় সালাম মুর্শেদীর জামিন নামঞ্জুর কারো লুটপাটের দায়ভার আমি নেব না : মেজর হাফিজ ‘যারা চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করছে দেশের মানুষ তাদেরকেও বর্জন করবে’

সকল