২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সঙ্কট আসলে কোথায়

- ফাইল ছবি

আমার মনে এই প্রশ্নটি জেগেছে এই কারণে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরাসরি বলেছেন যারা আমাদের ওপর স্যাঙ্কশন দেয় তাদের কাছে থেকে কিছু কিনব না। তিনি ইতোমধ্যেই কেনাকাটার মন্ত্রণালয়কে বলে দিয়েছেন এ-বিষয়টি। তার বলে দেয়া মানে নির্দেশ।

সন্দেহ নেই এটি একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। তার এই সিদ্ধান্ত অটুট থাক তাই আমরা চাই। কিন্তু আমাদের এই চাওয়ার পেছনেও আছে কিছু প্রশ্ন। তার একটি হলো, আমাদের ওপর স্যাঙ্কশন দিয়েছে কে? এর উত্তর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বাংলাদেশের মানবাধিকার বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করে দেখেছে যে এ দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ। বিশ্বের অনেক দেশেরই মানবাধিকার বিষয়টি তারা লক্ষ্য রেখে যাচাই করে, তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণা করে ওই বিষয়ে তাদের মতপ্রকাশ করে। সেই হিসেবেই দেশটি র‌্যাবের বেশ কয়েকজনের নামে এবং তৎকালীন পুলিশের আইজির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। ওই পাঁচ-সাতজনের ওপর নিষেধাজ্ঞাকে কেন ‘আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা’ বলে বিবেচনা করব আমরা? তাদের কর্মক্ষেত্রে যদি চরম কোনো অন্যায় অপরাধ হয়ে থাকে, যা মানবাধিকার হরণের আওতায় পড়ে, তাহলে সেই কথাটি তো তারা বলতেই পারেন। আর যদি তারা কিছু বলার অধিকারী না হয়, তা হলে এ-নিয়ে মাথা ঘামানোর কি প্রয়োজন? মাথা ঘামানোর প্রয়োজন আছে বলেই তো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন। কারণ দেশটি (যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের উন্নয়ন সহযোগীই কেবল নয়, তারা আমাদের রফতানি বাণিজ্যের শীর্ষে অবস্থান করছে। আরো নানা বিষয়েই সহায়তাকারী হিসেবে বন্ধু দেশ যুক্তরাষ্ট্র। সেই দেশ কেন ওই লোকদের ওপর স্যাঙ্কশন দিয়ে আমাদের মনে আঘাত হানল? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হবে আমাদের।

এর মধ্যেই পুলিশের আইজি বেনজীর আহমেদ অবসরে গেছেন। নতুন আইজি এখন দায়িত্ব পালন করছেন। অতএব বিষয়টি বেশ পুরোনো হয়ে গেছে। অনেকে ভুলেই গেছেন যে র‌্যাবের কয়েকজন অফিসারের ওপর মার্কিনি স্যাঙ্কশন বলবৎ আছে। প্রধানমন্ত্রী যদি বিষয়টি না তুলতেন, তাহলে আমাদের, মানে শিক্ষিত রাজনীতি সচেতন মানুষের মনেই পড়ত না এটি। কারণ, এই কসমোপলিটান জঙ্গমময় নগর জীবনে নানামাত্রিক চাপে পিষ্ট মানুষ, (তার মধ্যে পণ্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি একটি, সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না) বেঁচে থাকার লড়াই করে চলেছে। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্বেগজনক চাপে বিভ্রান্ত ভোটার জনগণ। (বিএনপির নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার কায়েমের গণআন্দোলন ও সরকারি দলের শক্তি দেখানোর পাল্টা শোডাউন, বিভিন্ন উপজেলার নির্বাচন, বিভিন্ন শহরের মেয়র নির্বাচন, সে সব নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক এবং আরো আরো বিষয়) ভোটার নন, এমন তরুণদের মধ্যেও মানবিক মানসিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে, যা নিয়তই আলোচনায় জায়গা পাচ্ছে। কিন্তু না সরকার না বিরোধী রাজনীতিক, কোনো পক্ষই ওই সদ্য তরুণ সম্প্রদায়ের সঙ্কট নিয়ে ভাবিত নন এবং তাদের উদ্দেশে কোনো বাক্য তারা খরচ করছেন না। এই রকম একটি পরিস্থিতির মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য সত্যই ভয়কে জয় করার মতোই একটি বাণী।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত নেবার ফলে প্রতিপক্ষ মার্কিনিরা এর জবার দেবে কি না, তা অনুমানও করতে পারছি না আমরা। আমাদের দেশটি ক্ষুদ্র হলেও ভূ-রাজনৈতিক প্রশ্নে পরাশক্তিদের চাহিদার কারণে আমাদের রয়েছে একটি অবস্থানগত মূল্য। বৈরী চীনকে সামরিক চাপে রাখতে হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশে তাদের উপস্থিতি বা প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি। এই চেতনা তাদের বহুবছরের। উদীয়মান চীন থেকে পরাশক্তির রূপ নেয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র এই অবস্থানেই আছে।

আমরা ‘কারো সঙ্গে বিরোধ নয়, বন্ধুত্ব’ এই পররাষ্ট্র বিষয়ক বোধে ও সংস্কৃতিতে উজ্জীবিত। সরকার সেই নীতিই বহন করেন। যখন স্যাঙ্কশন দাতার বিরুদ্ধে কথা বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তখন ওই আচরিত নীতি ও আদর্শ কি তিনি ভুলে যান?

বর্তমানে মার্কিনি প্রশাসন এখন মারাত্মক আর্থিক ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। তাদের অর্থনীতি এখন ৩১.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের যে চাঙ্কটি আইন করে নির্ধারণ করা হয়েছিল, সেই লিমিট ক্রস করতে যাচ্ছে। অর্থাৎ আরো ঋণ নিতে হলে সংসদে আইনটি সংশোধন করে ঋণ-মাত্রা বাড়াতে হবে। না পারলে দেশটির অবস্থা কাবু হয়ে যাবে। তারা তখন জনগণকে তাদের সেবা দিতে পারবে না। এই সঙ্কট থেকে উদ্ধারের আশা অবশ্যই আছে, এটা মনে করেন বিশ্বের বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদ। শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকানদের সাথে একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে পারবে ক্ষমতাসীন ডেমোক্র্যাটরা। আলোচনা চলছে। বিদেশ সফর সংক্ষেপ করে দেশে ফিরেছেন জো বাইডেন। ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ছাড় দিয়ে হলেও অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছিলেন। তখন ওবামার সঙ্গে ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন। অতএব তার অভিজ্ঞতার কমতি নেই।

আমাদের প্রধানমন্ত্রী কি এই নাজুক অবস্থার সুযোগ নিয়ে এ-কথা বলেছেন নাকি তার অন্য কোনো ভয় জয় করার দাওয়াই এটা? আমরা লক্ষ্য করলাম, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত এক বিবৃতিতে বলেছেন সরকার প্রধানের এই সিদ্ধান্তকে তারা সমর্থন করেন। তার মানে পশ্চাতে আছে চীনের ইশারা। সেটা ভালো একটি ইশারা বলতেই হবে। চীন পরাশক্তি হয়ে উঠলেও, তার মানবিক গুণ দিয়ে বাংলাদেশের হৃদয় না হোক, মন তো জয় করেছে- আপাতদৃষ্টিতে এমনটি মনে হতে পারে। কিন্তু এই উভয়পক্ষই জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক-ধরনের দেশ। তাদের প্রধান বিষয় স্বার্থ ও বাণিজ্য। স্বার্থের বিষয়টি মার্কিনিদের, আমাদের তেমন নয়, খোলা চোখে এটিই মনে হতে পারে। কিন্তু আমরাও যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করি, মানে আমাদের বিপুল গার্মেন্ট দেশটি আমদানি করে, সেই বিষয়টি কি তিনি মাথায় রাখেননি। তিনি কি মনে রাখেননি যে, তিনি যে বিশ্বব্যাংকের সাথে কথা বলে এলেন, সেই ব্যাংকের নিয়ন্তা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। আইএমএফ বলেন, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলেন, সবই পশ্চিমাদের দখলে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও তাদেরই স্নেহে লালিত পালিত, ইদানীং সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে সৌদি আরব ও অন্য মুসলিম দেশগুলো। একটি অর্থনৈতিক মেরুকরণ যে হচ্ছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। ডলারের বিশ্বব্যবস্থা এখন ভেঙে দিতে উদ্যত হয়েছে চীন ও রাশিয়া। কিন্তু সেই চাওয়া আর প্রকৃত বাস্তব এখনো মার্কিনি নিয়ন্ত্রণেই আছে। ঠিক এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর এই খোলামেলা কথা আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে তা বোঝা কঠিন।

২.
তথ্যনির্ভর একটি হিসাব পাওয়া গেল দৈনিক প্রথম আলোর খবরে। আমাদের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ-এর ২৭টি দেশ) যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের চেহারা কেমন তা দেখানো হয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, ইপিবির তথ্য-উপাত্ত সহযোগে। ওই সূত্রে দেখা যাচ্ছে, আমাদের গার্মেন্ট ও হোম টেক্সটাইলের পণ্য সব চেয়ে বেশি নেয় যুক্তরাষ্ট্র।

বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারই বাংলাদেশের রফতানি আয় বাঁচিয়ে রেখেছে। এর মধ্যে অবশ্য একক বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানই শীর্ষে।

অন্য দিকে, প্রবাসী আয়ে বরাবরই শীর্ষে থাকত সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)। তবে দুই অর্থবছর ধরে এখন আরব আমিরাতকে হটিয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। আর চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসের প্রবণতা বাকি সময়ে বজায় থাকলে শীর্ষস্থানও দখল করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। (প্রথম আলো ২১ মে, ২৩)

এখন আমরা এই ভেবে সত্যই চমকিত হচ্ছি যে, যে দেশটি আমাদের পণ্য বেশি কিনে নিচ্ছে, আর আমরা তাদের পণ্য আমদানি করছি অনেক কম, সেই দেশটি যদি মানবাধিকার প্রশ্নে স্যাঙ্কশন দেয়, তার দায় সরকারপ্রধানের ওপরই বর্তায়। তবে, তারও চেয়ে যাদের ওপর স্যাঙ্কশন দিয়েছে, তাদের অপকর্মের (মানবাধিকার হরণের দায়) জন্য তারাই এর দায় বহন করবে। একটি উন্নয়ন সহযোগী ও বাণিজ্যের প্রধান অংশীদারের অভিযোগ অস্বীকার করে তাদের দায় কেন প্রধানমন্ত্রী নিজের কাঁধে নিচ্ছেন? এটাও আরেক প্রশ্ন। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের একজন শক্তিশালী মানুষ ভাবতে চাই।

কিন্তু তিনি জনাকয়েক সরকারি কর্মকর্তার দায়, গোটা সরকারের দায় হিসেবে বহন করে যে পদক্ষেপ নিলেন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, তাতে আমাদের ক্ষতির আশঙ্কাই বেশি। যদি যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের এই ইশারা দেয় যে তারা যেন কমিয়ে আনে বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন, তাহলে আমাদের গার্মেন্ট পণ্য বাজার হারাবে। হারাবে জিএসপি সুবিধা ও সুযোগ। এমনিতেই আমরা শঙ্কার মধ্যে আছি এই ভেবে যে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় চলে যাওয়ার পর সেসব সুযোগ আর থাকবে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ যদি ঋণ ছাড়ে গড়িমসি করে, দীর্ঘসূত্রতার ব্যবস্থা করে, তাহলে তো আমাদের নেয়া প্রকল্পগুলো থমকে যাবে। ভারতের সামান্য ঋণসুবিধা আর চীনের উচ্চসুদের ঋণে তো দেশের অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন গতি ঠিক রাখা যাবে না। এ সবের সবই জানেন ও বোঝেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তারপরও মানবাধিকার হরণ করেছে যারা তাদের জন্য নিজের মর্যাদা ও সরকারের অবস্থান-নীতিকে বৈরী করে তুললেন!


আরো সংবাদ



premium cement