অনৈক্যের বেড়াজালে বঙ্গীয় মুসলমানদের রাজনীতি
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ২৬ মে ২০২৩, ১৯:৫২
ভৌগোলিক সীমারেখার এক ভূখণ্ড থেকে আরেক ভূখণ্ড পর্যন্ত ১২৪৯ মাইল দূরত্বের ব্যবধানে পৃথিবীর এক নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তান ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ ব্রিটিশ থেকে স্বাধীন হয়, পরের দিনই স্বাধীনতার সনদ লাভ করে ভারত। এই রাষ্ট্রের পূর্ব ও পশ্চিম অঙ্গের দূরত্ব দুই হাজার ১২ কিলোমিটার তথা- এক হাজার ২৪৯ মাইল। অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ১২ শতাধিক মাইল দূরত্ব রেখে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনীয়তা কী ছিল? যে রাষ্ট্রটি জন্মের পর মাত্র ২৪ বছর সমাপ্ত না হতেই একটি অংশ তথা পূর্বপাকিস্তান স্বাধীন হতে হয়েছে, যা ছিল সময়ের দাবি, মূলত যে দাবি উপলব্ধি ও উপস্থাপিত হতে হয়েছে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর বৈষম্যের কারণে। জনসংখ্যা ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে পূর্বপাকিস্তানের আধিক্য ছিল অনেক কিন্তু বৈষম্য ছিল অত্যন্ত বেশি, যা পূর্বপাকিস্তানীদের জন্য ছিল অত্যন্ত পীড়াদায়ক এবং স্বাধীনতার স্বাদ ছিল বঞ্চনামূলক।
পাক-ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব ইতিহাস অর্থাৎ ১৭৫৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ঘটনাবলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯০ বছরের ইতিহাস ছিল ষড়যন্ত্র ও বেঈমানিতে ভরপুর। ব্রিটিশরা ভারত দখল করে কূটকৌশলের মাধ্যমে, প্রথমে ফিরিঙ্গিরা তাদের সংস্কৃতির প্রতি ভারতীয়দের আকৃষ্ট করে, যা উচ্চ বর্ণের বণিক হিন্দু সমাজ লুফে নেয়, ফলে ব্যবসায় বাণিজ্যের মাধ্যমে ব্রিটিশদের সাথেই উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের সখ্য গড়ে ওঠে এবং তখন থেকেই পর্যায়ক্রমে রোপিত হয় ষড়যন্ত্র ও বেঈমানির বীজ, যা দিনে দিনে মহীরুহতে পরিণত হতে থাকে। পক্ষান্তরে মুসলিম সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাস ও অনুশাসনিক বাধ্যবাধকতার কারণে ব্রিটিশদের সাথে ছিল দূরত্ব, ফলে মুসলিমের সাথে ব্রিটিশদের বৈরিতার কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন যারা সংঘটিত করেছিল তাদের মধ্যে মুসলমানরাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তৎকালীন মুসলমানদের অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য উদাহরণস্বরূপ ফকির মজনু শাহের ব্রিটিশবিরোধী ভূমিকা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-
‘ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তাদের এ দেশীয় দালাল, মহাজনদের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, চরম ধ্বংসযজ্ঞ এবং একচেটিয়া লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে বাংলা তথা ভারতের নিপীড়িত মজলুম মানুষের মুক্তি সংগ্রামে যিনি নেতৃত্ব দেন তিনি হলেন ফকির মজনু শাহ। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের তিনি প্রথম সৈনিক। মজনু শাহ বর্তমান ভারতের গোয়ালিয়র রাজ্যের নেওয়াত এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মাদারি বোরহানা তরিকার ফকির বা দরবেশ ছিলেন।
আবু সাঈদ মুহম্মদ ওমর আলী বলেন, ১৬৫৯ সালে তৎকালীন সুবে বাংলার মুঘল সুবাদার শাহ সুজা এই তরিকার দরবেশ পুরুষ ফকির শাহ সুলতান হাসান মোরিয়া বোরহানকে বাংলা অঞ্চলে বসবাস অবাধে চলাফেরা এবং ভূসম্পত্তি ভোগদখলের অধিকার দেয়াসহ সনদ দান করেন। কালক্রমে এই তরিকার অনুসারীরা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ও বাংলায় খাস এবং দানসূত্রে প্রাপ্ত জমিতে বসবাস, চাষাবাদ করে স্থায়ী কৃষক সম্প্রদায়ে পরিণত হন। পলাশী যুদ্ধ-পরবর্তীকালে ভূমির ওপর অতিরিক্ত করারোপ, মুসলমান সমাজের ওপর নির্যাতন, খ্রিষ্টান মিশনারিদের ইসলামবিরোধী তৎপরতা, মুসলমানদের অবাধ চলাফেরার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয় গোটা মুসলিম সমাজকে জীবন-জীবিকা প্রশ্নে এক চরম অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেয়।
এ পরিস্থিতিতে ফকির মজুন শাহ ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে ১৭৬৩ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। মজনু শাহের বাহিনী সর্বপ্রথম কোম্পানির ঢাকাকুঠি আক্রমণ করে তছনছ করে দেয়। এটিই ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণ এবং এখান থেকেই প্রতিরোধযুদ্ধের সূচনা ঘটে। মজনু বাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল ইংরেজ কোম্পানির কাছারি, কুঠি, ইংরেজ শক্তির সহযোগী হিন্দু দালাল, মহাজন, ফড়িয়াদের বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ। ফকির মজনু শাহের সহযোদ্ধা ও সাগরেদদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- মুসা শাহ, পরাগল শাহ, সোবহান শাহ, করিম শাহ, চেরাগ আলী শাহ প্রমুখ। মজনুর পরে এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন মুসা শাহ। এই ফকির বিদ্রোহের বিস্তৃতি ছিল বিহারের পূর্ণিয়া, কুচবিহার অঞ্চল, বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, পাবনা, বগুড়া, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, সিলেট, বরিশাল, ঢাকা, কুমিল্লা এবং বর্তমান পশ্চিম বাংলার মালদহ, জলপাইগুড়ি প্রভৃতি জেলায়। ইংরেজ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এবং হিন্দু দালাল, মহাজন ও বেনিয়া শ্রেণী ফকির বিদ্রোহকে দস্যু আর তস্করদের কাজ হিসেবে অভিহিত করত। যামিনী মোহন ঘোষ এই ফকির বিদ্রোহকে বিহার ও বাংলার বাইরে থেকে আগত, যাযাবর প্রকৃতির নাগা সন্ন্যাসী ও ভোজপুরী দস্যু ডাকাতদের উৎপাত হিসেবে অভিহিত করেছেন।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এই ফকির বিদ্রোহকে যাযাবর প্রকৃতির দস্যু, ডাকাত ও লুটকারীদের কাজ হিসেবে দেখেছেন। অন্যদিকে ইংরেজ শাসকদেরই একজন ডবিøউ ডবিøউ হান্টার এই বিদ্রোহকে মুঘল সাম্রাজ্যের ধ্বংসপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর বুভুক্ষু সৈন্য, জমিহারা কৃষক জনসাধারণের কাজ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন সময়ের বাস্তবতায় জীবন ধারণের সব পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়েছিল। আঠারো শতকের বাংলা ও ভারতের ইতিহাসের আলোকে ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে পরিচালিত এই আন্দোলন সম্পর্কে সামগ্রিক পর্যালোচনায় যে বিষয়টি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় তা হলো-এটি ছিল বাংলা ও ভারতে ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত প্রথম সশস্ত্র লড়াই।
যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে এই বিদ্রোহ ছিল অনেকটা অসংগঠিত। কিন্তু আন্দোলনকারীদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, প্রত্যয়, প্রতিজ্ঞা ছিল দৃঢ় ও সাহসী। আঠারো শতকের শেষ তিন দশক এই বিদ্রোহ ইংরেজ কোম্পানি শাসন এবং তাদের দেশীয় দালালদের কম্পিত করে রাখে। উনিশ শতকের একটানা, ব্রিটিশ সাম্র্রাজ্যবাদ এবং তাদের দেশীয় দালালদের বিরুদ্ধে পরিচালিত কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অফুরন্ত প্রেরণা জুগিয়েছিল ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে পরিচালিত এই বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র লড়াই। (সূত্র : ড. নুরুল ইসলাম মনজুর প্রণীত ‘শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস’)
উপরোক্ত কারণে মুসলমানদের জন্য আলাদা আবাসভূমির নিমিত্তে তৎকালীন মুসলিম নেতাদের দাবিতে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান সমন্বয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল। মুসলমানদের জন্য পৃথক স্বাধীন আবাসভূমির দাবির প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল ফিরিঙ্গিদের দোসর উচ্চ বর্ণের হিন্দু বণিক গোষ্ঠীর নিপীড়ন ও নির্যাতনের কারণে, তথা তাদের সৃষ্ট জমিদার শ্রেণী কর্তৃক মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন। এ গোষ্ঠী নিম্নবর্ণের হিন্দুদের প্রতি নির্যাতন করতে ছাড় দেয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যের কারণে। স্বাধীনতা-পূর্ব বিভিন্ন জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন ভাষণে বলে ছিলেন, তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক দেশ পরিচালনা করবেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলতেন, ‘আমি মানুষ, আমি মুসলমান ও আমি বাঙালি।’ পক্ষান্তরে স্বাধীনতার পর ৪ নভেম্বর ১৯৭২ বাংলাদেশ পার্লামেন্টে অনুমোদিত সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সাথে সংযোজিত হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। ধর্মনিরপেক্ষতা সমস্যা হওয়ার কথা নয় কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয় ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যার আড়ালে যখন ধর্মহীনতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়, যখন নাস্তিকরা ধর্মহীনতার আড়ালে আবডালে বাংলাদেশের ৯২ শতাংশ মুসলমানের সেন্টিমেন্ট বা মনমানসিকতার ওপর আঘাত হানে। ইসলাম ধর্ম নিজেই একটি শান্তির ধর্ম হিসেবে বিবেচিত, যা অন্য কোনো ধর্মের প্রতি আঘাত হানে না।
বিদায় হজের ভাষণে হজরত মুহাম্মদ সা: বলেছেন, ‘তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ইতঃপূর্বে অনেক জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে।’ কিন্তু বর্তমানে মুসলমানদের সন্তান অথচ নাস্তিক, তারাই ইসলাম ধর্মের আইন অনুশাসনকে কটাক্ষ ও আঘাত করে কথা বলে, তাদের ধারণা ইসলামিক অনুশাসনকে হেয় প্রতিপন্ন করলে ‘প্রগতিশীল’ লেবাস গায়ে দেয়া যায় এবং এটিই তাদের স্বাধীনতা। পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সাম্প্রদায়িকতার একটি অভয়ারণ্য। ভারতে উচ্চবর্ণের হিন্দু বণিক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িক মানসিকতার কারণেই মুসলমানদের পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু ভারতে বসবাসরত মুসলমানরা আজ সরকারের সাম্প্রদায়িকতার টার্গেট চরমভাবে। ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারের সাম্প্রদায়িক রূপ প্রকাশ্যে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। তারা ভারতীয় মুসলমানদের নাগরিকত্ব বাতিল করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের মতে, সেখানকার মুসলমানরা ভারতীয় নয়।
বাংলাদেশের মাটি, মানুষ ও পরিবেশ অসাম্প্রদায়িক হলেও অত্যন্ত ধর্মভীরু। দেশে অনেক স্বনামধন্য পীর সাহেব রয়েছেন যাদের মধ্যে অনেকেরই নিজস্ব রাজনৈতিক দল রয়েছে এবং যেকোনো রাজনৈতিক দলের চেয়ে তাদের সমর্থক সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু ইসলামিক দলগুলো নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে বলে, ক্ষেত্রমতে তাদের প্রজেক্ট বা মাদরাসায় অনুদান পেলে বিভিন্নভাবে সরকারকে মৌন সমর্থন দেয়। অথচ বাম দলগুলো যেকোনো জাতীয় ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে, একমঞ্চে মিটিং ও একসাথে মিছিল করতে পারে। নিজেদের মধ্যে কোনো কোনো বিষয়ে দ্বিমত থাকলেও ইসলাম ধর্মকে কণ্টকমুক্ত করার স্বার্থে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা:’ এই একটি মতাদর্শের ওপর ভিত্তি করে ইসলামিক দলগুলো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারত। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসা তাদের জন্য মোটেই অসম্ভব হতো না। কিন্তু নিজেরা নিজেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামিক দলগুলো অনৈক্যের বিষণ্ণতা রোগে ভুগছে। পীর সাহেবরা নিজেকে নিজে নেতা মান্য করা ছাড়া অন্য কাউকে নেতা মানতে চান না, ইসলামিক দলগুলোর অনৈক্যের পেছনে এটিই মূল কারণ। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইসলামিক অনুশাসন, সম্প্রসারিত হচ্ছে মুসলমান নামধারী নাস্তিকতা, উৎসাহিত হচ্ছে ভিন্ন ধর্মের উগ্রবাদী সংগঠন।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা