২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কামাল মজুমদারের মন্তব্য সত্যের সাক্ষ্য

কামাল মজুমদার - ছবি : সংগৃহীত

‘মানুষ বাজারে গিয়ে কাঁদে, কারণ বাজারের যে অবস্থা, তার পকেটে টাকা নেই। এর একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ এটি শিল্প প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য। এই মন্তব্য সবাই পত্রপত্রিকায় পড়েছেন। এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হয়েছে সামাজিক মাধ্যমে, ক্ষমতাসীন দলে এবং অবশ্যই মিডিয়া জগতে। কিন্তু চেনাজানা একাধিক মানুষকে, যাদের মধ্যে সাংবাদিকও ছিলেন, যখন জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা শিল্প প্রতিমন্ত্রী কি শুধু ওই দু’টি বাক্যই বলেছেন নাকি আরো কিছু বলেছিলেন সেদিন? তারা স্পষ্ট করে বলতে পারলেন না। কেউ বললেন, পুরো রিপোর্ট পড়িনি। কেউ বললেন, খেয়াল করিনি। শুধু মূল কথাটাই মনে রেখেছি।

আসলে এমনটাই হয়। সবার সব কথা সবাই গুরুত্ব দিয়ে শোনে না অথবা মনে রাখে না। আর কামাল আহমেদ মজুমদার মন্ত্রী হলেও জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত নন। তার মতো অনেক মন্ত্রী আছেন যাদের নামও মানুষ শোনেনি। সেসব মন্ত্রীর কেউ কোনো কারণে আলোচিত হয়ে উঠলে মানুষ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, আরে, এই নামে কেউ মন্ত্রী আছে? জানতাম না তো! একজন মন্ত্রীর যে মান থাকা দরকার বলে মানুষ মনে করে সেই শিক্ষাদীক্ষা, সেই জ্ঞানগরিমা, প্রজ্ঞা অথবা দক্ষতা আমাদের ক’জন মন্ত্রীর আছে সেটি তর্কসাপেক্ষ। তবে মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পান, প্রতিদিনের খবরে যাদের চেহারা দেখে মানুষ অভ্যস্ত তাদের নানা সরস তির্যক ও ধারালো বাণী শুনে অনেকেই যে নির্মল বিনোদন লাভ করেন সে তো প্রতিদিনের সত্যি। সেসব বাণীর কতটুকু সত্য বা বাস্তবসম্মত সে নিয়ে যেহেতু কেউ কোনো প্রশ্ন তোলে না তাই আমরাও তুলতে চাই না। তবে এটা সত্য, ওইসব বাণী শুনে জনগণ খুব সহজেই মন্ত্রীর মান বা ওজন পরিমাপ করে নেয়।

শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার বড় নেতা নন। আবার নেহায়েত ছোটও নন। তিনি আওয়ামী লীগের এমপি, ১৯৯৬ সালে ও ২০০৮ সালে মিরপুর থেকে এমপি নির্বাচিত হন। ছিলেন অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। এখন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা। সক্রিয় রাজনৈতিক জীবন ৫০ বছরের বেশি। মিরপুরে তার শক্ত অবস্থান আছে। মন্ত্রী হিসাবে তার সাফল্য-অসাফল্য যা-ই থাকুক না কেন নিজ দফতর অথবা সরকার কিভাবে চলছে, দেশের কী অবস্থা সেটা তার ভালোই জানার কথা। সেজন্যে আমরা প্রতিমন্ত্রীর উল্লিখিত বক্তৃতার কিছু প্রধান দিকগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব। কারণ তার বক্তব্যে বাস্তবের ছোঁয়া আছে, চলমান সময়ের চালচিত্র ধরা আছে।
১১ মে ইআরএফ-এর কর্মশালার আলোচ্য বিষয় ছিল, ‘কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতিতে এসএমই খাতের উন্নয়নে গণমাধ্যমের ভূমিকা।’ শিল্প প্রতিমন্ত্রী সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন। বক্তৃতায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, দেশের অর্থনীতি ও বাজার দুই জায়গাতেই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ঝরে পড়ছেন এবং পণ্যের মূল্য বেড়ে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। দেশে আজ যে ‘অরাজকতা ও নৈরাজ্য’ সৃষ্টি হয়েছে, ব্যবসার নামে যে লুটপাট হচ্ছে, মানুষের পকেট কাটা হচ্ছে এগুলো সাংবাদিকদের আরো জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। তিনি বলেন, আমরা যখন বাজারে যাই, দেখি দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। কেন ঊর্ধ্বগতি? আমাদের তো কোনো কিছুর অভাব নেই। আমরা প্রতিটা ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তারপরও সিন্ডিকেটের কারণে দেশের এই অবস্থা।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, অবাক লাগে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে লাখ লাখ বেকার, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তার ঋণ কিন্তু মওকুফ করা হয় না। যারা ব্যাংক থেকে লাখ-কোটি টাকা নিয়ে খেলাপি হয়েছে তাদেরই বারবার মওকুফ করা হচ্ছে। তারা মওকুফ পেয়ে আবার ঋণ নিচ্ছে। বড় খেলাপিদের এই ঋণগুলো যদি এসএমই ফাউন্ডেশনসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের দেয়া হতো, তবে তাদের ব্যবসা আরো সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু সেটা করা হচ্ছে না।
কামাল আহমেদ মজুমদার বলেন, আমি দেখেছি অনেকে ব্রিফকেস নিয়ে ঘুরত, অনেকের কাছে টাকা ছিল না, অন্যের কাছে সিগারেট চেয়ে খেত। আজকে তারা ব্যাংকের মালিক। তারা সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হয়েছে। যারা সরকারি ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বেসরকারি ব্যাংকের মালিক হয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের উচিত তাদের নাম প্রকাশ করা।

এসএমই খাতের যেসব ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা মুড়ি-চানাচুর বিক্রি করে চলত, সেখানেও দেশের বড় বড় কোম্পানি হাত বাড়িয়েছে। যার কারণে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।

এই যে কথাগুলো শিল্প প্রতিমন্ত্রী বললেন, এর মধ্যে কোনো একটাও কি অসত্য, অথবা অতিরঞ্জিত?
হ্যাঁ, যদি প্রতিপক্ষের কেউ বলত তাহলে এরই মধ্যে অনেক হেস্তনেস্ত হয়ে যেতে পারত। যেমনটা হচ্ছে রাজশাহীতে বিএনপির কোন নেতা কাকে কবরে পাঠাতে চেয়ে রাজনৈতিক বক্তৃতাবাজি করেছেন সেটি নিয়ে। কিন্তু স্বপক্ষের লোক বললে হজম করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এই জমানায় স্বজনের সাত খুন মাফ। এ ক্ষেত্রে সেটাই ঘটেছে। ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর মন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ১৩ মে মিরপুরে দলের এক সমাবেশে কামাল আহমেদ মজুমদারের উপস্থিতিতে তাকে উদ্দেশ করে শুধু বলেছেন, ‘আপনি তো নিজে মন্ত্রী, সিন্ডিকেট নিজে থামান। এগুলো বললে নিজের গায়ে আসে।’ ব্যস, এটুকুই। জানা গেছে, প্রতিমন্ত্রীর বিস্ফোরক বক্তব্য নিয়ে মন্ত্রিসভায় টুঁ শব্দ হয়নি। দলীয় কোনো ফোরামে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ কিছু বলেনি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে অনেকে ক্ষোভ ঝেড়েছেন, কেউ কেউ কামাল মজুমদারকে একহাত নিয়েছেন। দলের প্রেসিডিয়ামের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি দৈনিককে বলেছেন, ‘কামাল আহমেদ মজুমদার এসব বলেছেন নিজেকে বাঁচানোর জন্য। বিসিআইসিতে সারের হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। নিজের মন্ত্রণালয়ের ঘটনা থেকে বাঁচার জন্য তিনি আগেভাগে সমালোচনা শুরু করেছেন বলে মনে হচ্ছে।’

বিসিআইসিতে সারের হিসাব মিলছে না এটা সত্যি। তবে সেটি কোনো গোপন বিষয় না। কোন ঠিকাদার চট্টগ্রাম থেকে সার পরিবহনের নামে মাঝপথে ট্রাকশুদ্ধ গায়েব করে দিয়েছে, সেই ঠিকাদারের দলীয় অবস্থান কী, সেসব খবর অনেকেরই জানা। সেই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না সেটাও তো মনে হয় গোপন নেই। আর কামাল মজুমদার তো আজীবন আওয়ামী লীগই করেছেন। তার চরিত্র বিএনপির কোনো নেতার মতো নয় যে, এক শ’ একটা মিথ্যা অভিযোগেও রা কাড়বেন না। দলের কোন নেতা কোথায় ধরা, তিনি বেশ ভালো জানেন। আর জানেন বলেই তাকে কেউ সহজে ঘাঁটাবে না।

তবে দেশ-বিদেশের নানামুখী চাপে সরকারের অবস্থা খুব একটা স্বস্তিকর নয়। সামনে জটিল একটি নির্বাচন। ব্রিটিশ স্টাইলের একটি মানসম্মত সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি বেকায়দায় দিয়ে ফেলেছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। আমেরিকাকে খুশি করতে ইন্দো-প্যাসিফিক রূপরেখায় চীনকে নাখোশ করার মতো ঝুঁকি নিয়েছেন। তার পরও খুশি না বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তিটি। নতুন করে স্যাঙ্কশন জারির হুমকির কথা শোনা যাচ্ছে। এদিকে কোষাগারে টাকা পয়সা বেজায় বাড়ন্ত। গ্যাস নিয়ে একটা তালগোল বোধ হয় পাকিয়ে উঠছে। নগদ অর্থে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। শেভরনের পাঁচ মাসের বিল বকেয়া। ছয় মাসের বিল বাকি পড়লে চুক্তিমতে ওরা গ্যাস উত্তোলন বন্ধ করে দিতে পারে। খোদা না করুন! সেটা হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কঠিন হয়ে পড়বে। জাদুঘরে পাঠানো লোডশেডিং এরই মধ্যে কালামুখ নিয়ে ঘরে ফিরে এসেছে। মানুষ কতদিন মানবে যদি দিনে ১২/১৪ ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয়? এমনিতেই আছে সবদিক ম্যানেজ করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসার কৌশল বের করার কঠিন চাপ, এর মধ্যে যদি মানুষ ক্ষেপে ওঠে, দলে দলে রাজপথে নেমে আসে তাহলে বেকায়দা হয়ে যাবে, সন্দেহ নেই। চিন্তায় শীর্ষ নেতাদের রাতের ঘুম বরবাদ হবার জোগাড়। এই অবস্থায় একজন পাতিমন্ত্রী কী বললেন আর তাতে দলের বা সরকারের কতটুকু ক্ষতি হলো সেসব দেখার সময় কোথায়?
আওয়ামী লীগ সরকার দলের, দেশের বা নিজেদেরও ভাবমর্যাদা রক্ষার বিষয়টি কখনো ভাবেন কিনা কে জানে। ভাব দেখে মনে হয়, তারা নিজেদের সব সময়ই প্রভুর আসনে দেখেন। তাই যে কোনো বিষয়ে নিজেরা যেটা বলেন সেটাকেই চূড়ান্তভাবে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেন। অন্য কারো কোনো ভিন্নমত বা আপত্তির কোনো সুযোগ রাখেন না। তাই গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন চাপিয়ে দেন, মানুষের কণ্ঠরোধ করে ভাবেন এটাই গণতন্ত্র। নির্বিচারে ক্রসফায়ার চালিয়ে বলতে পারেন দুষ্কৃতকারী মরেছে।

একই ধাঁচে গড়া আওয়ামী প্রতিমন্ত্রী কামাল মজুমদারও তাই অদম্য। ওবায়দুল কাদেরের ঠাণ্ডা সতর্কীকরণের পর দুদিন না যেতেই গত ১৬ মে তিনি জাতীয় দৈনিক যুগান্তরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে আরো বড় ও বিধ্বংসী তোপ দাগলেন। যেন তোরাবোরায় মাদার বোমা ফেললেন। বললেন, খোদ সরকারের মন্ত্রীদের ভেতরেই সিন্ডিকেট আছে। শেয়ার কেলেঙ্কারিতে জড়িতরা এখন মন্ত্রী। যারা এক সময় খালি ব্রিফকেস নিয়ে ঘুরত, এর ওর কাছে সিগারেট চেয়ে খেত তারা এখন ব্যাংকের মালিক।

সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার ওইসব সিন্ডিকেটের হোতাদের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমি যদি সব কথা বলতে যাই, দেখবেন আমার লাশটা রাস্তায় পড়ে আছে।’

এই ভয়ঙ্কর সত্য উচ্চারণের পর আর কিছু কি বলার দরকার থাকে? দেশ কেমন চলছে, কারা, কতভাবে জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করছে, মানুষের কথা বলার, সত্য প্রকাশের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত তা বুঝতে কি কেবল পরিসংখ্যানই যথেষ্ট? মনে হয় না। কামাল মজুমদারের মুখে উচ্চারিত এই শেষ বাক্যটি ইতিহাসে জায়গা নেবে। অনাগত ভবিষ্যতের সব প্রজন্মের মানুষকে জানিয়ে দেবে কেমন ছিল বর্তমানের এই সময় পরিসরে আওয়ামী লীগের শাসনকাল।

[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement