০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

কর্নাটকে ‘হিজাবপন্থী’দের বিজয়

কর্নাটকে ‘হিজাবপন্থী’দের বিজয়। -

সম্প্রতি দক্ষিণ ভারতের কর্নাটকে বিধানসভার নির্বাচনে হিজাবের পক্ষে আন্দোলনকারীরা বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। অপর দিকে হিন্দুত্ববাদীদের পরাজয় ঘটেছে। ৮৪ শতাংশ উদার হিন্দু ভোটার ১৫ শতাংশ মুসলমান প্রার্থীদের ভোট দিয়ে বিজয়ী করেন। যে শিক্ষামন্ত্রী হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন জনগণ তাকে ভোট দেননি। তিনিও নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। এ নির্বাচন প্রমাণ করে দিলো দক্ষিণ ভারতের জনগণ উগ্রসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করেন না। তারা বিভিন্ন ধর্ম ও কৃষ্টির বৈচিত্র্যের মধ্যে সম্প্রীতির মেলবন্ধন তৈরি করতে আগ্রহী।

ভারতের কর্নাটকের যে প্রার্থীদের দিকে অনেকের নজর ছিল তাদের মধ্যে হিজাব পরিহিতা সমাজকর্মী কানিজ ফাতিমা অন্যতম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুসলিম মেয়েদের হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের তীব্র বিরোধিতা করে আন্দোলনে নামেন তিনি। ২০২০ সালে নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইনের বিরুদ্ধে নারীদের বিক্ষোভের অগ্রভাগে ছিলেন তিনি। গুলবার্গ উত্তর নির্বাচনী কেন্দ্রে তিনি কংগ্রেসের একমাত্র মুসলিম নারী প্রার্থী। ২০১৮-তে বিজেপির প্রার্থী লিঙ্গায়েত নেতা চন্দ্রকান্ত বি পাতিলকে ছয় হাজার ভোটে পরাজিত করেছিলেন। জয়ী হয়ে আরো একবার চর্চায় এলেন ফাতিমা। ফাতিমা মনে করেন, হিজাব মেয়েদের অধিকার। তিনি বলেন, স্বাধীন ভারতে কাউকে পোশাক দেখে বিচার করা যায় না। হিজাবের জন্য মেয়েদের কলেজে আসা বন্ধে করে দেয়া যায় না। ফাতিমা স্পষ্ট বলেছিলেন, ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীদের উসকানি দিয়েছিল বিজেপি।

কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিজেপিকে বড় ব্যবধানে হারিয়েছে কংগ্রেস। ফলে দেখা যায়, কংগ্রেস জিতেছে ১৩৬টি আসনে। বিজেপি জয়ী হয়েছে ৬৫টিতে। কর্নাটকের ২২৪ আসনের বিধানসভায় ১১৩টি আসন পেলে সরকার গঠন করা যায়। নাগেশ একা নন, কর্নাটকে জনতার রায়ে বাসবরাজ মুম্বাই মন্ত্রিসভার ২৫ জন মন্ত্রীর মধ্যে ১২ জন এবার হেরেছেন। জনতার রায়ে খড়কুটোর মতো ভেসে গেছে সব। এমনকি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভাবমর্যাদাও। আগামী বছর লোকসভা ভোটে কী হবে, সেটি পরের কথা; রাজ্যের স্বার্থে এবার মোদির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো রাজ্যের মানুষ। গত ৩৪ বছরে কোনো দল এত আসন জিতে কর্নাটকে সরকার গড়তে পারেনি। রাজ্যের উপজাতি সমাজ মোদির দিকে মুখ তুলে তাকায়নি। ১৫টি সংরক্ষিত আসনের একটিও বিজেপি এবার জিততে পারেনি। জনতার রায় ও রোষের তীব্রতা কতখানি, এটি তারই প্রমাণ (প্রথম আলো, ১৪ মে-২০২৩)।

বিজেপি তিন বছর ধরে কর্নাটকে ‘সাম্প্রদায়িক কার্ড’ খেলার চেষ্টা করে এসেছে। কিন্তু কর্নাটকের বহুত্ববাদী সমাজে ধর্মীয় বিভাজন তৈরি করা সহজ নয় এবং শেষ পর্যন্ত সেটি প্রমাণিত হয়েছে। মোদি-শাহর ‘হিজাব’, ‘হালাল গোশত’, ‘আজান’, ‘লাভ জিহাদ’, ‘ল্যান্ড জিহাদ’, মুসলমানদের জন্য ৪ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ প্রত্যাহার ও টিপু সুলতানকে নিয়ে বিষোদগারের মতো মুসলিমদের কাছে স্পর্শকাতর ও আবেগী বিষয়কে এ রাজ্যের নির্বাচনে ইস্যু হিসেবে সামনে রেখেছিল বিজেপি। এগুলো নিয়ে বেশ আক্রমণাত্মকও ছিল দলটি। হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মুসলমান সমাজকে কংগ্রেসের পেছনে জোটবদ্ধ করে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দুর্নীতি ও বেকারত্বের মতো ‘জ্বলন্ত ইস্যু’ থেকে জনগণের চোখ সরিয়ে রাখতে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা কৌশল নিয়েছিল বিজেপি। কিন্তু কর্নাটকের জনগণ মোদির সাম্প্রদায়িক কার্ডের ফাঁদে পা দেননি।

কর্নাটকের নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে রাজ্য বিজেপির সভাপতি নলিন কুমার কাতিলের বিতর্কিত মন্তব্য জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলে। কোপ্পাল জেলার ইয়েলাবুর্গায় বিজেপির এক জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় তিনি বলেন, ভারতের মহীশূরের আঠারো শতকের শাসক টিপু সুলতানের বংশধরদের তাড়িয়ে জঙ্গলে পাঠানো উচিত। টিপু সুলতানের অত্যুৎসাহী অনুসারীদের হত্যা করতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা টিপু সুলতানের বংশধর নই। আসুন, টিপুর বংশধরদের তাদের দেশে ফেরত পাঠাই।’ নলিন কুমার বলেন, ‘আমি একটি চ্যালেঞ্জ জারি করছি, যারা টিপুর অত্যুৎসাহী অনুসারী, তাদের এ উর্বর ভূমিতে বেঁচে থাকা উচিত নয়।’ অথচ টিপু সুলতান ছিলেন মহীশূরের সুলতান। শৌর্য-বীর্যের জন্য তিনি মহীশূরের বাঘ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হন। তিনি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম নায়ক। টিপু সুলতান মুসলিম শাসক হওয়ার কারণে বিজেপি তাকে নিয়ে বিষোদগার করে বেড়াচ্ছে।

কর্নাটকের বিজেপি সরকার গো-হত্যা রোধে আইন করায় জনগণ এটিকে ভালো চোখে দেখেননি। মানুষ মনে করে এটি সরকারের ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও প্রবীণ কংগ্রেস নেতা সিদ্দারামাইয়া যিনি আবারো মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, ২০২০ সালে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, ‘অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক ও স্বৈরাচারী পন্থায় ওই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। আমি চাই গরুর গোশতের রফতানি বন্ধ হোক। আর এই বিষয়ে গোটা দেশজুড়ে একটিই মাত্র আইন করা হোক। কিন্তু আপনারা যদি খতিয়ে দেখেন তাহলে লক্ষ করবেন যারা গরুর গোশতের রফতানির কাজে যুক্ত রয়েছে তারা বেশির ভাগ বিজেপি সমর্থক। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার ক্ষমতায় আসার পরে গরুর গোশত রফতানি বেড়েছে। পুরোনো বছরগুলোর পরিসংখ্যান দেখলে প্রমাণ পাওয়া যাবে। ২০১৩ সালে যেখানে ভারত থেকে ১০ লাখ ৭৬ হাজার টন গরুর গোশত রফতানি করা হয়েছিল, ২০১৫ সালে তা ১৪ দশমিক ৭৫ লাখ টনে পৌঁছায়। এর পরের তিন বছরও ১৩ লাখ টন করে রফতানি করা হয়েছে’ (আজকাল, কলকাতা, ১২ ডিসেম্বর-২০২০)।

২০২১ সালে কর্নাটকের বিজেপি সরকার সরকারি স্কুল-কলেজে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরিধান করা নিষিদ্ধ করে। বিজেপিপন্থী হিন্দু শিক্ষার্থীরা হিজাবের বিরুদ্ধে গেরুয়া চাদর ও ওড়না পরে প্রতিবাদ জানান। এ নিয়ে অনাবশ্যক বিতর্ক ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। মুসলিম শিক্ষার্থীরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। পরে বিষয়টি আদালতেও গড়ায়। কিন্তু সেখানে মুসলিম শিক্ষার্থীর পক্ষে রায় হয়নি। হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কর্নাটকে হিজাব বিতর্কের জেরে ম্যাঙ্গালোর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর ১৬ শতাংশ মুসলিম ছাত্রী টিসি নিয়ে অনেকে অন্য কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আবার অনেকে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছেন।

কর্নাটক রাজ্যে মুসকান নামের এক মুসলিম ছাত্রী ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেন। তার ভিডিও ভাইরাল হয়। হিজাব পরিধান করায় তার কলেজের সামনে গেরুয়া উত্তরীয় পরা একদল ছাত্রের কাছে উত্ত্যক্ত ও লাঞ্ছিত হন। এনডিটিভিকে তিনি বলেন, আমি যখন কলেজে প্রবেশ করতে যাচ্ছিলাম, তখন তারা আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। কারণ, আমি বোরকা পরিহিতা ছিলাম। উত্ত্যক্তকারী ছাত্রদের মুখোমুখি হওয়া নিয়ে চিন্তিত নন তিনি। হিজাব পরার অধিকার রক্ষার এ লড়াই চালিয়ে যাবেন। গেরুয়া উত্তরীয় পরা ছাত্ররা চিৎকার করে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে মুসকানও ‘আল্লাহু আকবার’ বলে পাল্টা জবাব দিয়ে কলেজ ভবনের দিকে যেতে থাকেন। অধ্যক্ষ ও শিক্ষকরা তাকে সাহায্য ও রক্ষা করেন। অনেক হিন্দু বন্ধু তার পাশে দাঁড়িয়েছেন জানিয়ে মুসকান বলেন, ‘ওই ঘটনার পর সবাই বলছেন, আমরা তোমার সাথে আছি। নিরাপদ মনে হচ্ছে নিজেকে।’ এ পরিস্থিতিতে মুসকানের ভাষ্য, ‘ওরা আমাদের পড়াশোনা করার অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায়, এক টুকরো কাপড়ের জন্য!’ তিনি বলেন, ‘নারী কোন কাপড় পরবে, না পরবে সেটি ঠিক করার অধিকার নারীর এবং ভারতীয় সংবিধানে তাদের সেই অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।’ মুসকান দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান করে নেয়। হিজাব আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী তাবাসসুম শায়খ নামের আরেক ছাত্রী দ্বাদশ শ্রেণীর পরীক্ষায় কলা বিভাগে প্রথম হয়েছেন। মোট ৬০০ নম্বরের পরীক্ষায় ১৭ বছরের এ কিশোরী ৫৯৩ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়েছেন। হিন্দি, সমাজবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানে তিনি ১০০-তে ১০০ পেয়েছেন। তাবাসসুম বলেন, ‘কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পোশাকের ওপর সরকারি বিধিনিষেধ থাকা উচিত নয়। শিক্ষা গ্রহণ ও ধর্মাচরণ দু’টিই আমার অধিকার।’

ভারতীয় সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, হিজাবই অন্তরালে পাঠিয়ে দিলো বিসি নাগেশকে। রাজনৈতিক জীবনের বড় এক শিক্ষা পেলেন ভারতের কর্নাটক রাজ্যের সাবেক এই শিক্ষামন্ত্রী। এটুকু পড়ে মনে হতে পারে, কে নাগেশ আর কেনইবা হিজাবের অবতারণা। কর্নাটকে বহুচর্চিত এই মানুষটিই সরকারি স্কুলের মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরে ক্লাস না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেড় থেকে পৌনে দুই বছর আগের সেই ফরমানে উত্তাল হয়েছিল রাজ্য। রেশ ছড়িয়েছিল দেশের অন্যত্রও। অনুরোধ-উপরোধে কাজ না হওয়ায় দাবি-আন্দোলনের পথে নেমেছিল সমাজের একাংশ। তাতেও নির্দেশ অপরিবর্তিত থাকায় আইন-আদালতের পথে যাওয়া শুরু হয়। সুপ্রিম কোর্ট এখনো সেই মামলার রায় শোনাননি। তবে রায় দিয়েছে কর্নাটকের জনতা। টুমকুর জেলার টিপটুর কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থীর কাছে সাড়ে ১৭ হাজারেরও বেশি ভোটে হেরেছেন নাগেশ। হিজাব নিষিদ্ধকরণ নাগেশকে দেশের সর্বত্র পরিচিতি দিয়েছিল। হিজাবই তাকে পাঠিয়ে দিলো অন্তরালে! (প্রথম আলো, ১৪ মে-২০২৩)।

ভারতের ২৮টি রাজ্য এবং দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল মিলিয়ে মোট ৩০টি সরকারের অর্ধেক এখন বিরোধী দলগুলোর দখলে। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিজেপির শাসনাধীনে রয়েছে ১৫টি সরকার। বিজেপি এককভাবে ৯টি রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। বিজেপির শরিক দলগুলো ক্ষমতায় রয়েছে ছয়টি রাজ্যে। বিজেপি বিরোধী বলে পরিচিত আঞ্চলিক দলগুলোর হাতে রয়েছে আটটি রাজ্য। কংগ্রেস এবং কংগ্রেস সমর্থিত দলগুলো সাতটি রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। সেই তালিকায় যুক্ত হলো কর্নাটকের নামও। নানা ভাষা, কৃষ্টি ও বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐতিহ্যের দেশ ভারত। ভারতের স্বাধীনতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতির পেছনে মুসলিম জাতিগোষ্ঠীর অবদান অস্বীকার করার জো নেই। নাগরিক সমাজ মনে করে উগ্রহিন্দুত্ববাদনির্ভর রাজনীতি ও চানক্যকৌশল ভারতের হাজার বছরের বহুত্ববাদী সমাজব্যবস্থার অস্থিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement