২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

মুক্ত নির্বাচন রক্ষা করে গণতন্ত্র

মুক্ত নির্বাচন রক্ষা করে গণতন্ত্র। - ছবি : সংগৃহীত

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া তিনটি নির্বাচন আমাদের মতো দেশের কানাগলিতে আটকে পড়া রাজনৈতিক ব্যবস্থার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। এর মধ্যে বৈশ্বিক মনোযোগ সবচেয়ে বেশি ছিল তিনটি মহাদেশের মাঝে অবস্থিত তুরস্কের নির্বাচনে। একনাগাড়ে দুই দশক ক্ষমতায় থাকা রজব তাইয়্যেব এরদোগান পশ্চিমাদের দৃষ্টিতে ‘কর্তৃত্ববাদী’ শাসক। এর সাথে সারা বিশ্বের মুসলিমবিদ্বেষীরা এমনকি ভারত উপমহাদেশের বাম রাজনীতির উত্তরাধিকারী, প্রায় দেউলিয়া হয়ে যাওয়া নেতারা, তার সমালোচনায় একদণ্ড এগিয়ে। আতশি কাচের নিচে রেখে এভাবে আর কোনো বৈশ্বিক নেতার ত্রুটি বিচ্যুতি যাচাই করতে দেখা যায় না তাদের। জনতুষ্টিবাদী হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান, সংখ্যালঘু নিধনকারী নরেন্দ্র মোদির মতো নেতাদের এভাবে সমালোচনা শুরু থেকে করা হলে মানবতার প্রভূত উপকার হতো।

এরদোগানের ওপর পশ্চিমা ও বাম মিডিয়ার দোষারোপের দৃষ্টিকটু চেষ্টা কম অপরাধের জন্য বেশি দায় আরোপের অন্যায্য প্রতিক্রিয়াশীলতা বলা যায়। একটি অবাধ সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে তিনি সমালোচকদের উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পশ্চিমা প্রভাবিত মিডিয়া এরদোগানের প্রতিদ্ব›দ্বীকে এগিয়ে রেখেছিল। তারা এক প্রকারের নিশ্চিত মন্তব্য করেছিল, এরদোগানের শাসনের সমাপ্তি হবে এবার। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে কেমাল কিলিচদারোগ্লুর চেয়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ বা ২৬ লাখ ভোট বেশি পেয়েছেন তিনি। মাত্র দশমিক ৬ শতাংশ ভোট বেশি পেলে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনের প্রয়োজন পড়ত না। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের ভোট কারচুপির বিষয়টি তুলনা করা যায়।

ইঞ্জিনিয়ারিং করে ভোটের সামান্য গ্যাপটি পূরন করতে এরদোগান লজ্জা পেলেও, আমাদের দেশে সরকারি দল নিজেদের পছন্দের প্রার্থীদের জয়ী করার জন্য যেকোনো ধরনের জালিয়াতি করতে কোনো ধরনের কুণ্ঠাবোধ করে না। এই ক্ষেত্রে জালভোট, ইভিএম ইঞ্জিনিয়ারিং এমনকি ভোট সম্পন্ন হয়ে যাওয়ার পর প্রয়োজনে ভোটের ফলাফল পরিবর্তন করতে দেখা গেছে। সিটি করপোরেশনের একটি ফল ঘোষণার সময় দেখা গেল, এক প্রার্থী এগিয়ে যাচ্ছে। এই সময় নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ফলাফল ঘোষণা বাদ রেখে, মোবাইলে আলাপ করতে স্থান ত্যাগ করেন। কিছুটা সময় নিয়ে পরে তিনি সম্পূর্ণ এক নতুন ফলাফলসহ হাজির হন। সেখানে দেখা গেল, ক্ষমতাসীনদের খাস পছন্দের প্রার্থী জয় পেল। এমন ঘটনা এক দুটো নয় অগণিত। প্রতিযোগী প্রার্থীকে প্রার্থিতা বঞ্চিত করার জন্য পিটিয়ে এলাকা ছাড়া করা, সাময়িক গুম করে ফেলা, ইভিএমের বাক্স কেন্দ্রের বাইরে নিয়ে যাওয়া এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যা পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না, সেটা বাংলাদেশে হতে দেখা গেছে। অথচ প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করার ক্ষমতা আমাদের দেশের সরকারি দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের চেয়ে এরদোগানের কম নয়। তারপরও কোনো ধরনের অনিয়মের পথে না গিয়ে, এরদোগান ও তার সমর্থকরা জোর আশা করছেন পুনরায় ভোটে তারা জয় পাবেন।

এরদোগানের পরাজয় নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার জরিপের ফলাফল ভুয়া কিংবা পরীক্ষাগারে বিকৃত করা হয়েছে কি না তা তারাই বলতে পারবেন। জরিপে এগিয়ে রেখে তারা হয়তো জনমনস্তত্ত্ব ঘোরাতে চেয়েছিল। যাতে ৫ শতাংশের ব্যবধান সুইপ করে কেমালের পক্ষে নেয়া যায়। সেটা বাস্তবে ঘটেনি। অথচ বাংলাদেশে এই ধরনের জরিপ আরো বেশি প্রয়োজনীয়। বর্তমান সরকার কতটা জনপ্রিয় সেটা জানার জন্য বিগত ১৫ বছরে কোনো জরিপ হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিশ্বের সামনে বিতর্কিত দুটো নির্বাচন আয়োজনের পরও এই সরকারই আবারও তাদের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে চায়। এর জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি অগ্রাহ্য করে সংসদ সদস্যদের মধ্যে থেকে সরকার গঠনের প্রস্তাব করা হচ্ছে। বর্তমান সংসদ সদস্যরা জনগণের ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়েছেন কি না সেই বিবেচনা নেই। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ নিয়ে কোনো ধরনের জরিপ করতে উৎসাহ দেখায় না।

এরদোগানের বিরুদ্ধে জনমত ‘বিগড়ে’ যাওয়ার জন্য তার কর্তৃত্ববাদকে দায়ী করা হচ্ছে। কর্তৃত্ববাদ বলতে এরদোগানের ক্ষেত্রে কি বোঝানো হচ্ছে সেটা খোলাসা করা হয় না। দীর্ঘ শাসনে প্রকৃতপক্ষে তিনি কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের পকেটস্থ করলে অন্তত কিছুটা নিজের কর্মীর মতো বানালে তারাই তাকে কিছুটা এদিক সেদিক করে প্রথম দফায় তার প্রেসিডেন্টের পদে জয় নিশ্চিত করে দিতেন। ভোট নিয়ে তার বিরোধীরাও কোনো ধরনের অভিযোগ তোলেনি। ভোটের আগে পশ্চিমা মিডিয়া যতটা সরব ছিল, ভোটের ফলাফল আসতে শুরু করতেই তারা যেন আগ্রহ হারাল। বড় বড় সংবাদমাধ্যমে তুরস্কের নির্বাচনের সর্বশেষ খবর পাওয়া গেল না সেভাবে। সংসদ নির্বাচনের ফলাফল এরদোগান আরো ভালো করায় তার জনপ্রিয়তার পারদ এখনো উঁচু বলেই জানান দিচ্ছে। ৬০০ আসনের মধ্যে তার একে পার্টির নেতৃত্বাধীন জোট পেয়েছে ৩২০টি আসন। একে পার্টি একাই ২৬৭টি আসন পেয়েছে।

একই সময় ভারতের কর্নাটকের নির্বাচন কয়েকটি বার্তা গণতন্ত্র পছন্দ মানুষের কাছে স্পষ্ট করছে। এটি দেশটির জাতীয় নির্বাচন নাহলেও জাতীয় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ওই রাজ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার হিজাব পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি নিষিদ্ধ করে। গায়ের জোরে এ ধরনের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার ফল হাতেনাতে ধরিয়ে দেয়া হয়েছে বিজেপিকে। ২২৪ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেস জিতেছে ১৩৬ আসন। গত বারের তুলনায় তারা দ্বিগুণ আসন পেয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি পেয়েছে ৬৫ আসন যা গতবারের প্রায় অর্ধেক। শিক্ষামন্ত্রী যিনি ওই আইন চাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি গো-হারা হেরেছেন। অন্য দিকে, পোশাকের স্বাধীনতা নিয়ে আন্দোলন করে কানিজ ফাতেমা কংগ্রেসের পক্ষে দাঁড়িয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। বিজেপি ও তার উগ্র সাম্প্রদায়িক শাখা প্রশাখার সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডের খবর বিশ্ববাসী জেনে গেছে। এমনকি মোদির বিরুদ্ধে গুজরাট দাঙ্গার অভিযোগ নিয়ে বিবিসি ডকুমেন্টারি করে সব খোলাসা করে দিয়েছে। আমাদের দেশের অবস্থা সম্ভবত এতটা খারাপ নয়। তবে ভারতে সংখ্যালঘুরা উৎখাত হওয়ার মুখে পড়লেও দেশটির কিছু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের চরিত্র অটুট রয়েছে। যেমন তাদের নির্বাচন ব্যবস্থা এমন এক সুযোগ তৈরি করে রেখেছে যে তারা অচিরেই দানবদের হাত থেকে হয়তো বাঁচতে পারবে। কর্ণাটক নির্বাচন সেই আশাব্যঞ্জক ইঙ্গিতই দিল।

ভারতের মতো এই সুযোগটি যেসব দেশে বিদ্যমান রয়েছে সেসব দেশের গণতন্ত্র নিজেদের সংশোধন করার পথটি মুক্ত রাখতে পেরেছে। একই সময় থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সেনা সমর্থিত সরকারি দল পরাস্ত হয়েছে। সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠলেও এসব দেশে তাদের বিচারের হাতটি জনগণের ওপর ন্যস্ত রয়েছে। গণতন্ত্রের একটি ফুটো রয়েছে সেটা তার ভোট ব্যবস্থা। এই ফুটো দিয়ে দানবেরা প্রবেশ করে যেতে পারে। জনগণের জন্য দুর্ভাগ্য তখনই নেমে আসে যখন এই দানবেরা ভোট ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণকে রুদ্ধ করে দিতে পারে। ভারতে উদার বহুত্ববাদী সমাজের ব্যাপক ক্ষয় হলেও ভোট ব্যবস্থায় তার নখর বসাতে পারেনি। ফলে দেশটির জনগণ পরিস্থিতি পাল্টে দেয়ার ক্ষমতা রাখছে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে সেটা হয়তো দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থাপনা লুপ্ত হয়েছে। তাই আমাদের মুক্ত হওয়ার পথও সঙ্কুচিত হয়ে আছে।

jjshim146@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement