২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

পাকিস্তান : অর্থনীতির পুনর্গঠনের পথ

লেখক মুসা আল হাফিজ। - ছবি : নয়া দিগন্ত

পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর দিয়ে বয়ে গেছে ২০২২ এর তীব্র বন্যা। অন্যান্য অর্থনীতির মতো সেও করোনার ধাক্কা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের শিকার। কিন্তু পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কটের আসল কারণ পাকিস্তানেই নিহিত। সঙ্কটের জন্ম ও বিকাশ এখান থেকেই। ফলে উত্তরণও এখান থেকেই নিশ্চিত করতে হবে। মার্কিন ডলারের বিপরীতে পাকিস্তানি রুপির দরপতন ঘটেছে দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ মাত্রায়। বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ যে পর্যায়ে আছে, তা দিয়ে বড়জোর এক মাস আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। গবেষকরা বলছেন, অক্ষমতার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে দেশটির অর্থনীতি। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এর কাছ থেকে ঋণ গ্রহণের চেষ্টা করছে দেশটি। স্বাধীনতার পর থেকে এ অবধি ২৩ বার আইএমএফের সহায়তা নিয়েছে পাকিস্তান। আর কোনো দেশ এই সময়ে এতবার আইএমএফের কাছে যায়নি। দেশটির সবচেয়ে কাছের বন্ধু হিসেবে বিবেচিত চীন ও সৌদি আরব অব্যাহত ঋণ ও অন্যান্য সহায়তা দিতে দিতে বিরক্ত।

কিন্তু একটি আত্মঘাতী অর্থনীতিকে কি রক্ষা করতে পারে বিদেশী সহায়তা? পাকিস্তানকে অবশ্যই নিজের অর্থনীতির সমস্যাগুলোকে মোকাবেলা করতে হবে। দেশটির অর্থনীতিতে ভারসাম্যহীনতা প্রকট। বার্ষিক রফতানি আয় ২৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে; কিন্তু আমদানি ব্যয় ৮০ থেকে ৯০ বিলিয়ন ডলার।

একটি অর্থনীতিতে যদি কাঠামোগত সমস্যা থাকে, তাহলে সে ভারসাম্যহীন হবেই। সেখানে অর্থনীতির টেকসই প্রবৃদ্ধি ঘটবে না। এমন অর্থনীতি নিজেই নিজের উন্নয়নের পথে বাধা। পাকিস্তানের অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা জন্ম নিয়েছে গভীরতর কারণে। এর যে কাঠামো, তা সরকারের মাত্রাছাড়া সম্পৃক্ততার ভারে ন্যুব্জ। রাজনৈতিক নেতাদের অযোগ্যতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে সামরিক নেতৃত্বের অতিমাত্রায় সম্পৃক্ততা পাকিস্তানের অর্থনৈতিক গতিশীলতার জন্য বড় এক বাধা। পাকিস্তানে আছে বড় এক ইনফর্মাল ইকোনমি, যা অরক্ষিত এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কৃষির ভূমিকা অনেক বড়, তুলার সাথে সম্পর্কিত উৎপাদন কার্যক্রমে এ অর্থনীতি অনেক বেশি মনোযোগী। এখানে আমদানি প্রতিস্থাপন (import substitution) কর্মকাণ্ড পক্ষপাতমূলক নীতির দ্বারা পক্ষাঘাতগ্রস্ত এবং সার্ভিস ইকোনমি অবহেলার শিকার।

কম বিনিয়োগ, কম রফতানি, সরকারি নীতিতে সঞ্চয়ের কম হার এবং নিম্ন উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির চক্র পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোকে বিশেষ চরিত্র দিয়েছে। এর সাথে যুক্ত আছে মানবসম্পদে অপর্যাপ্ত বিনিয়োগ, যথোচিত কর রাজস্ব সংগ্রহে সরকারের ব্যর্থতা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতি অবহেলা। সব কিছুর উপরে আছে অকার্যকর শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব এবং জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি। এ অর্থনীতিকে বহন করতে হচ্ছে সাড়ে পাঁচ লাখের সেনাবাহিনীসহ সাত লাখের একটি সশস্ত্রবাহিনীর বোঝা। প্রতিরক্ষার জন্য বাহিনী জরুরি। কিন্তু সামরিক এস্টাবলিশমেন্ট দেশটির ক্ষমতাকে সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে, যা দেশটির সমস্যা-সঙ্কটের অন্যতম ভরকেন্দ্র।

বিদ্যমান বাস্তবতায় পাকিস্তানের অর্থনীতি কিভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি করবে, উদ্যোক্তাদের নিজের দিকে টানবে এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নিশ্চিত করবে? কিভাবে সে দূর করবে ভারসাম্যহীনতা? এজন্য অবশ্যই সংস্কারের বিকল্প নেই। চক্রীয় ম্যাক্রোইকোনমিক সিস্টেম যখন আর ফলাফল দেয় না, তখন অর্থনীতির যারা চালক, তাদেরকে মৌলিক কাঠামোগত সংস্কারের দিকে যেতে হয়। পাকিস্তান এখন সেই পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

পাকিস্তানের রিজার্ভ যে এখন ধুকছে, বিদেশী পুঁজিকে সে যে আকর্ষণ করতে পারছে না এবং রেমিট্যান্স যে কমছে, তা মূলত অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যাগুলোকে সময়মতো সমাধান করতে না পারার খেসারত। এই যে জ্বালানি সঙ্কটে দেশটি কম্পমান, এর কারণ এই নয় যে, জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে না। বরং লক্ষ্যবিহীন ভর্তুকি নিজেই একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালের মার্চ মাসে জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ঘোষণা করেছে সরকার। কিন্তু এসব ভর্তুকি দীর্ঘমেয়াদে কোনো কাজ দেয় না। দেশটিতে রাজস্ব ও জ্বালানির ঘাটতি যে লেভেলে, তাতে ভর্তুকির বাস্তবায়নও খুব জটিল। এর সাথে যুক্ত আছে সার্কুলার ঋণ, বিতরণ সমস্যা ও অব্যবস্থাপনা এবং অব্যাহত চুরি। কিন্তু সস্তা শ্রম মজুদ থাকার পরও উৎপাদন খরচ বাড়ে অব্যবস্থাপনা ও বহুমুখী দুর্নীতির কারণে। পাকিস্তানে বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়েছে। বলা হয়, তেলের অধিক মূল্য, চুরি ও অধিক সাইন লসের কারণে বিদ্যুতের দাম বাড়ে। কিন্তু এর চেয়েও বড় কারণ বোধ করি অদক্ষতা, বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী অপ্রচলিত প্রযুক্তির ব্যবহার, অপচয় এবং ঘন ঘন প্লান্ট ভেঙে যাওয়া। অন্যতম আরেক কারণ, বিদ্যুৎ ও সঞ্চালন ব্যবস্থা সেকেলে এবং প্রায়ই অনুপযোগী।

পাকিস্তানে ইনফর্মাল ইকোনমির বড় এক অংশ জাতীয় আইন ও প্রবিধানের আওতার বাইরে থেকে যায়। এ অর্থনীতির আছে অলিখিত প্রকৃতি। ফলে সরকারি পরিসংখ্যানে তার অনেক কিছুই জায়গা পায় না। ফলে প্রায়ই অফিসিয়াল অর্থনৈতিক সূচক হতাশাজনক অবস্থানে থাকে। সরকারের জন্য অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির নথিপত্রও জরুরি।

সরকার কর্তৃক বাণিজ্যিক কার্যক্রমে জড়িত থাকার উদ্দেশ্যে গঠিত পূর্ণ বা আংশিকভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এন্টারপ্রাইজ বা SOE সমূহের ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। লোকসানে থাকা SOEগুলো একদিকে বিপুল ঋণ দান করছে, তেমনি বড় বড় ও অনিয়ন্ত্রিত বাজেটও হাতে নিচ্ছে, যা জনসাধারণের অর্থকে চাপে ফেরছে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও আনছে স্থবিরতা। কিন্তু SOE কেন লোকসানে পড়ছে? কারণ দুর্নীতি, অদক্ষতা, অতিরিক্ত জনবল এবং অদক্ষ কর্মী। সংস্কার সত্ত্বেও পাকিস্তানের ট্যাক্সব্যবস্থা অসুস্থ। ট্যাক্স সংস্কারে সরকার দোলাচলের শিকার ছিল। কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যথেষ্ট প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনও ছিল না এতে। বারবার পাকিস্তান উইথহোল্ডিং ট্যাক্স প্রথারই আশ্রয় নিচ্ছে। যা কর আদায়ে সরকারের দক্ষতার অভাবের জানান দেয়, সদিচ্ছার অভাবের কথা বলে। কর ব্যবস্থায় রয়েছে অনেক ফাঁক ও ফাঁকি। নির্দিষ্ট কিছু কার্যক্রমকে করের আওতার বাইরে রেখে দেয়া হয়। আর সেটি হচ্ছে কোনো পাবলিক বিতর্ক ছাড়াই। করের আওতার বাইরে আছে বেশির ভাগ সেবা খাত ও ব্যবসা। আদায় করা হচ্ছে না কৃষি খাতের আয়কর। আনুষ্ঠানিক খাতের শিল্পগুলো সরকারের পক্ষ থেকে ভোক্তাদের কাছ থেকে বিক্রয় কর আদায় করে। কিন্তু সরকারকে তা যথাযথভাবে পরিশোধ করছে না। রাঘববোয়ালরা কর ফাঁকি দিচ্ছে নিয়মিতই। তাদের সাথে আছে করকর্মকর্তাদের যোগসাজশ। সিস্টেমের মধ্যে যেহেতু প্রচুর ফাঁক-ফোকর রয়েছে, তাই কর না দিয়ে বা নাম মাত্র কর দিয়ে দিব্যি পার পেয়ে যাচ্ছে লোকেরা।

বলা যায়, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সঙ্কটের গোড়ায় রয়েছে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার জটিল ও গভীর সমস্যা। সেখানকার অর্থনৈতিক কাঠামোর সংস্কার একান্তই জরুরি। সেই সংস্কারকে অবশ্যই হতে হবে পরিকল্পিত, বাস্তব ও কৌশলগতভাবে সুদূরপ্রসারি। সংস্কারের ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে বেকারত্বের কথা, পরিবেশের অবনতির কথা, অর্থনৈতিক স্থানচ্যুতির কথা। সামাজিক প্রভাবও বিবেচনায় রাখতে হবে। কোনো প্রদেশের সাথে বৈষম্য না করেই সংস্কার সম্পাদন করতে হবে। কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারগুলোর সদিচ্ছা ও পরামর্শ এ জন্য জরুরি। জরুরি বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য। যদি উচ্চ বিনিয়োগ কামনা করেন, তাহলে তাকে উৎসাহিত করুন বাণিজ্য, SOE এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের ক্ষেত্রে কাঠামোগত সংস্কার দিয়ে। SOE-কে পুনর্গঠন করতে হবে আর্থিক স্থিতিশীলতার পুনরুদ্ধারের জন্য, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সম্ভাবনা উজ্জীবিত করার জন্য এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ানোর জন্য। যেন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত হয় এবং কর্মসংস্থান বাড়ে।
রফতানিবিরোধী নীতি চলবে না। রফতানি বাজারে বৈচিত্র্য আনতে হবে। রফতানিতে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক বাজারে পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলতে হবে। ব্যবসার পরিবেশ বন্ধুত্বপূর্ণ করা, স্টার্ট-আপ পদ্ধতি সহজ করা, কোম্পানির আন্তর্জাতিকীকরণ, উদ্যোক্তাদের শিক্ষা, প্রশাসনিক ভার কমানো এবং উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে পুরস্কার প্রবর্তন দরকার।

পাকিস্তানের জন্য জরুরি উচ্চতর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি। সে জন্য বেসরকারি খাতকে সহযোগিতা করতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানে আছে এই খাতের প্রতি অসহযোগিতার নীতি। তাকে সহযোগিতার পাশাপাশি কার্যকর, যথাযথ নিয়ন্ত্রক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে অবশ্যই রাজস্ব ব্যবস্থাপনা ঢেলে সাজাতে হবে। অপব্যয় রোধ করতে হবে। আর্থিক বিকেন্দ্রীয়করণ কাঠামো শক্তিশালী করতে হবে। অর্থনীতিতে সরকারের সম্পৃক্ততা কমাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ দূর করতে হবে; বরং সামাজিক ভৌত কাঠামো এবং দরিদ্রদের সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিতকরণে অধিক নিয়ন্ত্রণ সক্রিয় করা যেতে পারে। অকৃষি খাত ও নন-টেক্সাটাইল খাতের প্রতি অমনোযোগ ও অসহযোগিতা দূর করতে হবে। বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করতে হবে। লক্ষ্যহীন ভর্তুকি বন্ধ করে জ্বালানি খাতের সংস্কার করতে হবে। আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। সে জন্য বাস্তবায়ন করতে হবে আর্থিক নীতি। মুদ্রাস্ফীতি কমাতে হবে। প্রতিযোগিতা আইনের সংস্কার করতে হবে। এর অপূর্ণতা দূর করতে হবে। এর প্রয়োগ জোরদার করতে হবে। এসব প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। কিন্তু এর বিকল্প নেই পাকিস্তানের অর্থনীতির উত্তরণের জন্য। সময় লাগবে বলে শুরু করতে দেরি করা যাবে না।

লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement