০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

আদর্শিক মূল্যবোধই শিক্ষার মূলনীতি

- ফাইল ছবি

প্রাচীন যুগ থেকে আধুনিক কাল অবধি প্রাজ্ঞ মনীষীরা শিক্ষাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়াস পেয়েছেন।Puritan যুগের শ্রেষ্ঠ ইংরেজ কবি মিল্টনের মতে- দেহ, মন আত্মার সুসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নই হচ্ছে শিক্ষা। ব্যাপকতর অর্থে শিক্ষা বলতে এমন এক প্রক্রিয়াকে বোঝায় যার মাধ্যমে ব্যক্তি জ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে পারে অথবা অনুভূতি বা দক্ষতার উন্নয়ন সাধনে সক্ষম হয় (Encyclopedia Americana, vol.ix, USA, 1983 CE, p.642). অনেক লেখকের মতে, শিক্ষা এমন এক শক্তির নাম যা মানবীয় উন্নয়নকে প্রভাবিত করে। Compton’s Encyclopedia শিক্ষার সংজ্ঞা নিরূপণ করতে গিয়ে বলা হয়েছে, Education is the process through which man endeavors to pass along to his children his hard-won wisdom and his aspiration for a better world. অর্থাৎ ‘শিক্ষা হচ্ছে এমন প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মানুষ তার কষ্টার্জিত প্রজ্ঞা ও আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তার সন্তানদের কাছে হস্তান্তরের প্রয়াস চালায় উন্নততর বিশ্ব গঠনের জন্য (Compton’s Encyclopedia, Chapter Education, vol.vii, University of Chicago, USA, 1986 CW, p.74).

যেকোনো জাতির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষ সাধনের মূল মাধ্যম হচ্ছে শিক্ষা। যেকোনো জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর লালিত আকিদা বিশ্বাস ও জীবনবোধের বাস্তব দর্পণ হচ্ছে শিক্ষা। যুগে যুগে মানবগোষ্ঠীর কাছে নবী ও রাসূল প্রেরণের তাৎপর্য বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটিই শিক্ষার ব্যাপকতার সংজ্ঞা। যেমন- ‘আমি পাঠিয়েছি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের জন্য একজন রাসূল, যিনি তোমাদের কাছে আমার বাণীসমূহ পাঠ করবেন এবং তোমাদের পবিত্র করবেন, আর তোমাদের শিক্ষা দেবেন কিতাব ও তার তত্ত¡জ্ঞান এবং শিক্ষা দেবেন এমন বিষয় যা কখনো তোমরা জানতে না।’ (আল-কুরআন, সূরা বাকারা-১৫১) সুতরাং পবিত্র কুরআনের ভাষায় অজানাকে জানার নাম শিক্ষা। মহাকবি আল্লামা ইকবালের মতে, ‘শিক্ষার দর্শন হচ্ছে খুদী যার অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যক্তিত্বের ঔৎকর্ষ সাধন, আত্মিক শক্তির উজ্জীবন ও আত্মার উন্নতি বিধান।’ এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি ব্যক্তির মনস্তাত্তি¡ক অবস্থার মধ্যে ঐক্য ও অখণ্ডতাবোধ সৃষ্টি করে, মহান স্রষ্টার দিকে আকৃষ্ট করে, ব্যক্তিকে পশুত্বের স্তর থেকে মনুষ্যের স্তরে উন্নীত করে, অহংসর্বস্ব ভাবপ্রবণতা বিদূরিত করে, আল্লাহর বিধানের প্রতি আনুগত্যের জন্ম দেয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই জীবনের একমাত্র লক্ষ্যরূপে পরিণত করে (ইসলামী বিশ্বকোষ, তৃতীয় খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৩০৫-৩১৬)।

শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বহুবিধ ও সুদূরপ্রসারী। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও সুখসমৃদ্ধ সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও মানবীয় গুণাবলির বিকাশ সাধনপূর্বক দায়িত্বশীল জনগোষ্ঠী তৈরি করাই শিক্ষার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য। একটি দেশের জনগোষ্ঠীর ব্যক্তি ও সামষ্টিক চাহিদা পূরণ এবং তাদের আশা আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়নই হচ্ছে শিক্ষার লক্ষ্য। এককথায় শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান আল্লাহ পাকের সাথে বান্দার সম্পর্ক নিরূপণ, হকের বিকাশ ও সত্যের অšে¦ষা, আদর্শিক মূল্যবোধের বিকাশ, স্বকীয় সংস্কৃতির সংরক্ষণ এবং মহৎ জীবন সাধনায় ও সচ্চরিত্র গঠনে সঞ্জীবিত শক্তির সঞ্চার। শিক্ষার ব্যবহারিক উপযোগিতা ব্যক্তি ও সামাজিক উভয় পর্যায়ে সমানভাবে কার্যকর। শিক্ষার সামাজিক কাজ হচ্ছে প্রতিটি ব্যক্তিকে সহায়তা প্রদান করা যাতে করে সে সমাজের কার্যকর সদস্য হিসেবে দাঁড়াতে পারে এবং বর্তমান ও অতীতের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা যেন তার কাছে স্থানান্তরিত হয়। শিক্ষার Individual function হচ্ছে সফলতার সাথে নতুন অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে নিজের মধ্যে সৃষ্টিধর্মী জীবনের সঞ্চার করা এবং সুপ্ত মেধার স্ফুরণের মাধ্যমে নিজকে অধিকতর যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলা (Encyclopedia Americana, vol.ix, USA, 1983 CE, p.642). জন স্টুয়ার্ট মিল শিক্ষার উদ্দেশ্য নিয়ে বলেন- Education includes whatever we do for ourselves and whatever is done for us by others for the express purpose of bringing us nearer to the perfection of our nature. অর্থাৎ ‘আমাদের প্রকৃতির পূর্ণতা সাধনের পথে নিয়ে যাওয়ার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নিজেদের জন্য আমরা যা করি এবং অন্যরা আমাদের জন্য যা করে তাই শিক্ষা (Encyclopedia of Religion and Ethics edited by James Hastings, Chapter `Education’, vol.v, Edinbargh, 1981, p.166)’ ব্যাপকতর অর্থে মানবীয় অনুষদ ও চরিত্রের উপর প্রত্যক্ষ প্রভাব সৃষ্টিই শিক্ষার উদ্দেশ্য।

শিক্ষার উপর্যুক্ত সংজ্ঞা ও লক্ষ্য উদ্দেশ্য পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়- দেহ, মন ও আত্মার সুসমন্বিত ঔৎকর্ষের জন্য নৈতিক ও আদর্শিক মূল্যবোধ অপরিহার্য পূর্বশর্ত। শিক্ষার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে Encyclopedia Britannica যে মন্তব্য করেছে তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য : Education can be viewed as the transmission of the values and accumulated knowledge of a society.

ঐশী চেতনায় লালিত আদর্শ ও মূল্যবোধ ছাড়া কেবল ইহজাগতিক ও বস্তুতান্ত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো আদর্শ ও সৎ নাগরিক তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। পাশ্চাত্যে প্রচলিত আদর্শিক মূল্যবোধ বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার স্খলন রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো। ইউরোপে কুমারী মাতার প্রচলন, পারিবারিক প্রথার বিনাশ, লিভ টুগেদার সংস্কৃতি, সমকামিতার আইনগত সিদ্ধতা প্রভৃতি নৈতিকতা গর্হিত কার্যাবলি বস্তুতান্ত্রিক শিক্ষাব্যবস্থারই সাক্ষাৎ কুফল।

শিক্ষা জাতির নিয়ামক শক্তি। জ্ঞান বিজ্ঞান মানবজাতির এক অফুরন্ত সম্পদ। শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে এবং মিথ্যা থেকে সত্যের দিকে পরিচালিত করে। যে জ্ঞান ও শিক্ষা মানুষকে মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা:-এর সাথে পরিচিত করে, পরকালীন জবাবদিহি সৃষ্টি করে এবং সৎ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে তাই প্রকৃত জ্ঞান ও শিক্ষা। ইসলামে ইহকাল থেকে পরকাল বিচ্ছিন্ন নয়। পরকালের কর্ষণক্ষেত্র ইহকাল। ইসলামী রীতিনীতি ও বিধি অনুসারে কর্মসম্পাদন করলে সব কর্মই ইবাদতে পরিণত হয়। জ্ঞান ব্যক্তির চেতনা ও বুদ্ধিকে শাণিত করে, মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত করে এবং চরিত্র পরিশীলিত করে। রাসূলুল্লাহ সা:-এর নির্দেশনা অনুযায়ী জ্ঞান (ইলম) অর্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরজ বা বাধ্যতামূলক। ইসলামী পরিভাষায় একে ইলমুল হাল তথা অবস্থার জ্ঞান বলে। অর্থাৎ মানুষ যখন যে অবস্থায় পতিত হয় ওই অবস্থার করণীয় জ্ঞানার্জনই তার ওপর ফরজ। যেমন মানুষ যখন মুসলমান হয় তখন তার ওপর আল্লাহর অস্তিত্ব, গুণাবলি, ক্ষমতা এবং যা ছাড়া ঈমান পরিশুদ্ধ হয় না, তা অর্জন করা ফরজ।

যেকোনো জাতির জন্য একটি মজবুত শিক্ষাব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হলে সে দেশের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ সামনে রাখতে হবে। শিক্ষানীতি হতে হবে আদর্শভিত্তিক ও জাতীয় চেতনার পরিপূরক। আধ্যাত্মিক, মানবিক, নৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতিই শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য হওয়া উচিত। একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনানির্ভর। প্রাচ্য বা প্রতীচ্যের অন্ধ অনুসরণ আমাদের আদর্শিক দীনতার অতলান্তে নিক্ষেপ করবে। জনগণের বোধ ও বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতি নয় এমন কোনো শিক্ষানীতি বা পাঠক্রম গ্রহণযোগ্য হবে না। আধুনিক শিক্ষার বিভিন্ন স্তর হতে ধর্মীয় শিক্ষা তুলে দিলে এবং মাদরাসায় প্রচলিত ধর্মীয় শিক্ষা সঙ্কুচিত হলে মানুষ ধর্মবিমুখ, জীবনবিমুখ ও সমাজবিমুখ হয়ে পড়বে। আমাদের শিক্ষানীতি হতে হবে অবশ্য ধর্মবিশ্বাস ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে। বিজ্ঞান শিক্ষা ও ধর্মশিক্ষা আলাদা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা একটি প্রহসন মাত্র। আদর্শ ও চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম প্রধান দেশ। এ দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ধর্মপরায়ণ ও অসাম্প্রদায়িক। শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ধর্মশিক্ষার বিদায় অথবা ধর্মশিক্ষা সঙ্কোচন জনগণ সহজে মেনে নেবে না। ধর্মবিবর্জিত ও নাস্তিক্যবাদী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ দেশ ও জাতির জন্য সমূহ বিপর্যয় ও অকল্যাণ বয়ে আনবে। এ রকম শিক্ষা ধারা হবে বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ।

ব্রিটিশ যুগে লর্ড মেকলে (১৮০০-১৮৫৯) ভারত উপমহাদেশে সেক্যুলার যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন তার ধারাবাহিকতা আংশিক সংশোধন সাপেক্ষে বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে আজো চালু রয়েছে। লর্ড মেকলের পরিকল্পনা ছিল সুদূরপ্রসারী। ১৮৩৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় শিক্ষার উপর ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন,
‘ÔI have travelled across the length and breadth of India and I have not seen one person who is a beggar, who is a thief. Such wealth I have seen in this country, such high moral values, people of such calibre, that I do not think we would ever conquer this country, unless we break the very backbone of this nation, which is her spiritual and cultural heritage, and, therefore, I propose that we replace her old and ancient education system, her culture, for if the Indians think that all that is foreign and English is good and greater than their own, they will lose their self-esteem, their native self-culture and they will become what we want them, a truly dominated nation.’
অর্থাৎ ‘আমি ভারতের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত পরিভ্রমণ করেছি এবং একজনকেও ভিক্ষা করতে দেখিনি; একজন চোরকেও পাইনি। এমন সম্পদ, এমন উন্নত নৈতিক মূল্যবোধ, এমন মেধাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী আমি দেখেছি, যাদের জয় করতে পারব বলে আমার মনে হয়নি। হ্যাঁ, যদি তাদের শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারি তাহলে সম্ভব। তাদের শিক্ষার ভিত্তি হলো আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যধারা। অতএব আমি তাদের পুরনো ও প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্থলে নতুন শিক্ষা ও সংস্কৃতি প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব করি। এতে ভারতীয়রা মনে করবে ইংরেজ ও ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতি নিজেদের শিক্ষা ও ঐতিহ্যের তুলনায় অধিকতর উন্নত ও সমৃদ্ধ। ফলে তারা আত্মমর্যাদা ও নিজেদের দেশজ সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হবে এবং সত্যিকার অর্থে আমাদের শাসিত জাতিতে পরিণত হবে; মূলত আমরা যা চাই। (sundayposts, January 28, 2008; http://sundayposts.blogspot.com/2008/01/lord-macaulays-quote-on-india.html#.U1IbvaKZvfs)

ঈমান, আকিদা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় কৃষ্টি ও যুগচাহিদার প্রেক্ষাপট সামনে রেখে স্বাধীন বাংলাদেশের উপযোগী কোনো জাতীয় শিক্ষানীতি এ পর্যন্ত ঘোষিত ও প্রবর্তিত হয়নি। শিক্ষাব্যবস্থা চলছে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে ঔপনিবেশিক ধারায়। ফলে চরিত্রবান, আদর্শিক, খোদাভীরু নাগরিক সৃষ্টিতে এ শিক্ষাব্যবস্থা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। প্রাপ্তি যে একেবারে নেই এটি বলা যাবে না তবে প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির ফারাক দুস্তর।

বেদনার সাথে বলতে হয়- বাংলাদেশের বেশির ভাগ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সন্ত্রাসী, দুর্বৃত্ত, আর্মড ক্যাডার ও ধর্ষকদের অভয়রাণ্য। উপরন্তু ছাত্র-রাজনীতির অসুস্থ চর্চা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতোই অসহনীয়। রাজনীতিকরা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থে নিরীহ ছাত্রছাত্রীদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশকে করেছেন কলুষিত অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধ। আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় শিক্ষা ও আদর্শের দীক্ষা নেই; নেই আমাদের সমাজ ও সাংস্কৃতিক বোধের কোনো সম্পর্ক। ফলে চিন্তার বিভ্রান্তি, দুর্বৃত্তপনা, হানাহানি, শিক্ষাবিপর্যয় ও ধর্ষণ আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছে। এখানে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে অস্ত্রবাজ, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভর্তিবাণিজ্যবাজরা সক্রিয় থাকে, মাঝে মধ্যে তাদের মধ্যে দখলদারিত্ব নিয়ে বন্দুকযুদ্ধ হয়- যেখানে নামধারী ‘ছাত্র’, অস্ত্রধারী যুবকরা অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে ‘যুদ্ধে’ লিপ্ত হয়, জীবন সংহার করে। ফলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চার চত্বর পরিণত হয় রক্তাক্ত রণাঙ্গনে। উচ্চতর শিক্ষার উদ্দেশ্যে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গমনকারী শিক্ষাজীবনের মাঝপথে লাশ হয়ে ঘরে ফেরে। ‘খুন কা বদলা খুন’ এর যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে তা এ দেশের ভবিষ্যৎকে নিশ্চিতভাবে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলবে।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামী শিক্ষাই ছিল এ দেশের একটি জীবন্ত ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা। হিজরি প্রথম শতাব্দী থেকেই মালাবার উপকূল হয়ে পুরো ভারতবর্ষে মসজিদকেন্দ্রিক ইসলামী শিক্ষা চালু হয় সুফি, দরবেশ ও মুবাল্লিগদের মাধ্যমে। ১২০৫ খ্রিষ্টাব্দে নাসিরউদ্দীন কুবাচা কর্তৃক মুলতানে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর থেকে চারদিকে ইসলামী শিক্ষা ছড়িয়ে পড়ে। ইংরেজ শাসন-শোষণ চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশরা ইসলামী শিক্ষাকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে লর্ড মেকলের মাধ্যমে সেক্যুলার শিক্ষা প্রবর্তন করেন। ব্রিটিশ রাজশক্তির অনুগত বাহিনী সৃষ্টির লক্ষ্যে ইংরেজি স্কুল ও কলেজ গড়ে তোলা হয় সর্বত্র। নানা সংস্কার, আইন ও বিধি প্রণয়নের বেড়াজালে আটকা পড়ে মাদরাসা তথা ইসলামী শিক্ষা অনেকটা অস্তিত্বহীন হয়ে দাঁড়ায়। শত বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও এ দেশের সংগ্রামী ওলামা-মাশায়েখ নিজেদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে মাদরাসা শিক্ষাকে টিকিয়ে রেখেছেন।

আমাদের দেশে ঐতিহ্যগতভাবে ত্রিমুখী শিক্ষাধারা চালু রয়েছে। সাধারণ শিক্ষা, যা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবর্তিত; কওমি শিক্ষা, যা দেওবন্দের ধারায় দরসে নিজামীর ভিত্তিতে প্রবর্তিত এবং তৃতীয় আলিয়া শিক্ষা, যা কলকাতা আলিয়ার ধারায় সরকার নিয়ন্ত্রিত। প্রচলিত এ ত্রিধারাকে নির্দিষ্ট স্তর (অষ্টম শ্রেণী) পর্যন্ত একমুখী করা যায় কি না বিশেষজ্ঞ ওলামা ও শিক্ষাবিদদের ভাবতে হবে। ঐতিহাসিক কারণে ত্রিধারার জন্ম। সমন্বয়ের নামে আলিয়া সিলেবাসকে কাটাছেঁড়া করলে বা স্কুলের পাঠ্যপুস্তক মাদরাসায় সিলেবাসভুক্ত করলে মাদরাসার স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হবে। সাধারণ শিক্ষার্থী যারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে ইচ্ছুক তাদের ১০০ নম্বরের ইসলামিয়াত বিষয়াবলি পড়তে আগ্রহী করতে হবে।

অপর দিকে কওমি শিক্ষা আরেকটি স্বতন্ত্র ধারা, এতে আধুনিক বিষয়াবলির আধিক্য ঘটলে ঐতিহ্যবাহী এ শিক্ষাধারার অপমৃত্যু ঘটবে। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে পৃথিবীর কোনো দেশে শিক্ষার বহুবিধ ধারার অস্তিত্ব নেই, এমনকি আরব দেশেও। আসলে এ বিষয়ে কওমি, আলিয়া, সাধারণ শিক্ষা ও সরকারি প্রতিনিধিদের নিয়ে দীর্ঘ পর্যালোচনা প্রয়োজন। ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে চলতি বছর থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ইংরেজি, গণিত ও সমাজ সিলেবাসভুক্ত করেছে এবং বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পাঠক্রম ও শিক্ষাপদ্ধতি নিরীক্ষা করা যেতে পারে। যেকোনো শিক্ষা কমিশনে এবং পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি ত্রিধারার প্রতিনিধি থাকা বাঞ্ছনীয়, যাতে গ্রহণযোগ্য সুপারিশ প্রণীত হতে পারে।

লেখক : অধ্যাপক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement