জাতি ও সংস্কৃতি : একটি অপরটির সম্পূরক
- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৫ মে ২০২৩, ১৯:৫১
জাতি ও সংস্কৃতি, একটি অপরটির সম্পূরক। অর্থাৎ, একটি রাষ্ট্রের ভূখণ্ড দখল করার জন্য বন্দুক, কামানসহ পরমাণু যুদ্ধের প্রয়োজন, কিন্তু একটি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন নেই; বরং তার সংস্কৃতিকে ধ্বংস করলেই নিরাপদ পদ্ধতিতে জাতিকে ধ্বংস করা সহজ। ব্রিটিশ ভারত দখল করেছে কূটকৌশলের মাধ্যমে যার প্রধান হাতিয়ার ছিল বিশ্বাসঘাতকতা অর্থাৎ তৎকালীন উচ্চ বর্ণের হিন্দু ব্যবসায়ী ও সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর আলী খাঁ ও তার সহযোগীদের বেঈমানি। ব্রিটিশের থিওরি ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। ভারত দখলের জন্য ব্রিটিশ নিম্ন বর্ণিত পদক্ষেপ গ্রহণ করে-
১. Divide & Rule অর্থাৎ- প্রথমে তারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে এবং ব্রিটিশের সাথে যারা ব্যবসায়-বাণিজ্য করত তাদেরকে উচ্চ বর্ণ এবং কৃষিজীবী, খেটে খাওয়া হিন্দুদের নিম্ন বর্ণের মধ্যে দ্বিধাবিভক্তিকে উৎসাহিত ও প্রতিষ্ঠিত করে স্থায়ীভাবে বর্ণবাদ প্রথা সৃষ্টি করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে বর্ণ হিন্দুদের (উচ্চ বর্ণের) চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিয়ে সমাজে ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় তাদের প্রতিষ্ঠিত করে।
২. চাল চলন, চলনে বলনে, পোশাক পরিচ্ছদে ভারতীয়দের মধ্যে ব্রিটিশ সংস্কৃতি ঢুকিয়ে একটি অভিজাত শ্রেণী সৃষ্টি করে, যারা পর্যায়ক্রমে ‘বাবু’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ফিরিঙ্গি ইংরেজদের সংস্কৃতি গ্রহণ করে ‘বাবুরা’ নিজেদের কুলীন বা অভিজাত শ্রেণীভুক্ত মনে করত। এই ‘বাবু’রা ব্রিটিশ ফিরিঙ্গিদের ‘সাহেব’ হিসেবে সমাজে সম্বোধন করা শুরু করে, পরবর্তীতে সাদা চামড়া দেখলেই এ দেশের মানুষ ফিরিঙ্গিদের সাহেব বলা সম্বোধন শুরু করে যা এখনো সমাজে বিদ্যমান। পোশাক হিসেবে ফিরিঙ্গি পোশাক প্যান্ট-শার্টের সাথে ধূতি অফিস-আদালতে অনুমোদিত পোশাক হিসেবে গণ্য হতো। মুসলমানদের লুঙ্গি পরে অফিস-আদালতে যাওয়া যেত না। ব্রিটিশ বিদায় হয়েছে কিন্তু তাদের প্রতিষ্ঠিত ঢাকা ক্লাব, নারায়ণগঞ্জ ক্লাব, চট্টগ্রাম ক্লাব প্রভৃতি স্থানে লুঙ্গি পরে যাওয়া এখনো নিষিদ্ধ রয়েছে।
৩. ইসলাম ধর্মে কোনো সাম্প্রদায়িকতা নেই। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল লিখেছেন- ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম, সত্য যে চায়, আল্লায় মানে, মুসলিম তারি নাম।’ হজরত মুহাম্মদ সা:-এর এটিই শিক্ষা। সাম্প্রদায়িকতার গোড়াপত্তন হয় উচ্চ বর্ণের অভিজাত হিন্দুদের মধ্যে থেকে। তারাই নিজ ধর্মাবলম্বীদের উঁচু-নিচু দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। পাকিস্তান নামের অননৎরারধঃরড়হ-এ পূর্ববঙ্গের কথা উল্লেখ ছিল না। তা ছাড়া কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রথমে দ্বিখণ্ডিত ভারত চাননি। তিনি চেয়েছিলেন অবিভক্ত ভারতের নেতা হতে। উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের নানাবিধ অত্যাচার ও বর্ণবৈষম্যের কারণে টু-নেশন থিওরির অর্থাৎ- দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ হয়।
৪. ঢাকাকে রাজধানী করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম সমন্বয়ে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে একটি স্বতন্ত্র প্রাদেশিক প্রশাসনিক আবাসভূমির প্রয়োজন দৃশ্যমান হয়। কিন্তু কলকাতার উচ্চ বর্ণের হিন্দুদের ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ রদ করে পুনরায় আসাম ও পূর্ববঙ্গকে কলকাতার প্রশাসনিক আওতাধীন করে দেয়।
৫. পূর্ববঙ্গ ছিল কৃষিজীবী মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সাথে ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দু নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবার, উভয় জনগোষ্ঠীই ছিল জমিদারদের নির্মম অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার। কলকাতাভিত্তিক উচ্চ বর্ণের অভিজাত শ্রেণীর হিন্দুরা এ অঞ্চলকে শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নয়ন চায়নি। ফলে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধিতা করে বড়লাটের কাছে স্মারকলিপি পেশ করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তখনই তিনি রচনা করেন- ‘আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি ভালোবাসি’। অন্তে শেরেবাংলার রাজনৈতিক প্রভাব, ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহর জমি এবং ধানকুণ্ডির জমিদার নওয়াব আলীর আর্থিক অনুদানে ১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত।
উল্লেখ্য, মুসলমানদের জন্য একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার জন্য ১ অক্টোবর ১৯০৬ মুসলিম নেতারা অন্যান্য দাবির সাথে তৎকালীন গর্ভনর জেনারেল অব ইন্ডিয়া ও ভাইসরয় লর্ড মিন্টোর কাছে যে স্মারকলিপি দেন তার সংশ্লিষ্ট অংশ নিম্নে উল্লেখ করা হলো-‘We beg to approach your excellency on a subject which must closely affect our national welfare. We are convinced that our aspirations as a community and our future progress are largely dependent on the foundation of a Mohamedan University which will be the centre of our religious and intellectual life. We therefore most respectfully pray that your execllency will take steps to help us in an undertaking in which our community is so deeply interested.’ (সূত্র : ড. নূরুল ইসলাম মনজুর প্রণীত ‘শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা ইতিহাস’ পৃষ্ঠা-১৮০)
কলকাতার ওই অভিজাত পরিবারগুলোর প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে বিনয় ঘোষ লিখেছেন
‘কেউ বেতনভুক কর্মচারী হয়ে, কেউ সর্দারি পোদ্দার করে, কেউ দাদনি বণিক ও দালাল হয়ে, কেউ বেনিয়ানি করে, কেউ বা ঠিকাদারি করে, কেউ বা ঠিকাদারি ও স্বাধীন ব্যবসায়-বাণিজ্য করে, কলকাতার নতুন শহুরে সমাজে নতুন বড়লোক হয়েছিলেন। সেকালের নবাবী আমলের বড়লোকরা নবযুগের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিপর্যয়ে একেবারে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলেন বলা চলে। কোম্পানির আমলে যারা নতুন বড়লোক হলেন তাদেরকে এক পুরুষের বড় লোক বললে ভুল হয় না।’ (সূত্র : টাউন কলকাতার কড়চা, পৃষ্ঠা-১০৩)
উপরে উল্লিখিত এক পুরুষের বড় লোক ৩০টি পরিবারের সবকটিই বাঙালি হিন্দু। তাদের বেশির ভাগই উচ্চ বর্ণজাত। মুসলিম শাসনের অব্যবহিত পরের এ তালিকা! অথচ এতে একটিও মুসলিম পরিবারের নাম নেই। এখানেও চিরায়ত ঐতিহ্যের বিব্রতকর অনুশীলন! পাল, সেন, তুর্কি, পাঠান, মুঘল শাসনামলে সব উত্থান-পতনের রাজনৈতিক বিবর্তনে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ উচ্চবর্ণ হিন্দুর এই সম্মিলিত শক্তিই শাসনযন্ত্রের ছত্রছায়ায় সমাজে একটানা প্রাধান্য বজায় রেখেছে। ইংরেজ শাসনেও তার ব্যতিক্রম ঘটল না।
কলকাতার বর্ণহিন্দু অভিজাত শ্রেণীটির আত্মপ্রতিষ্ঠার যে বাস্তব চিত্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিবরণীতে পাওয়া যায় তা রীতিমতো চাঞ্চল্যকর। সুপ্রকাশ রায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন।
সুতানুটি-গোবিন্দপুর-কলকাতা-চিৎপুর-বিরজি-চক্রবেড়ি গ্রামগুলোর ধানক্ষেত ও কলাবাগানের ভেতর থেকে টাউন কলকাতার দ্রুত বেড়ে ওঠার কারণ এবং ইংরেজদের দ্বারা নব্যসৃষ্ট শ্রেণীটির অবাক উত্থানের কারণ সম্পর্কে এই বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়।
সুপ্রকাশ রায় লিখেছেন-
বঙ্গদেশে ইংরেজ বণিকদের মুৎসুদ্দিগিরি, লবণের ইজারা, প্রভৃতির মারফত যারা প্রভূত ধন-সম্পদ আহরণ করেছিল, তারা এবং মার্ক্সের ভাষায়, শহরের ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের মধ্যে নতুন জমিদার শ্রেণীরূপে আবিভূত হয়েছিল। এই নতুন জমিদার শ্রেণীটির বৈশিষ্ট্য ছিল, ইংরেজ শাসকদের প্রতি অচলাভক্তি ও কৃষির ক্ষেত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শহরে অবস্থিতি, গ্রামাঞ্চলের ভূ-সম্পত্তি থেকে ইজারা মারফত অনায়াসলব্ধ অর্থে বিলাস-ব্যসনে জীবন যাপন এবং বেনিয়ান লবণের ইজারাদার প্রভৃতি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সর্বগ্রাসী ব্যবসায়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা। ইংরেজসৃষ্ট এই নতুন বিত্তশালী জমিদার শ্রেণীটি ভূ-সম্পত্তির ওপর একচ্ছত্র প্রভুত্ব লাভ করে সমসাময়িক বঙ্গ দেশের নতুন অভিজাত শ্রেণীরূপে আবির্ভূত হয়। দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামমোহন রায় প্রভৃতি ছিলেন এই অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগণ্য। পুরো ঊনবিংশ শতাব্দীব্যাপী যখন বাংলার তথা ভারতের কৃষক প্রাণপণে ইংরেজ শাসন ও জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছিল, তখন (এই শ্রেণীটি) সংগ্রামরত কৃষকের সাথে যোগদানের পরিবর্তে বিদেশী ইংরেজ শাসনকে রক্ষা করার জন্য তাদের পুরো ধনবল ও জনবল নিয়োগ করেছিল। (সূত্র : ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, পৃষ্ঠা : ১৮৬-১৮৭)
এই লুটেরা শ্রেণীর হাতে পলাশী-উত্তরকালে তাদেরই রুচি অনুযায়ী গড়ে উঠেছিল কলকাতা। সে কারণেই স্বাধীন মেজাজে মধ্যযুগে গড়ে উঠা সোনারগাঁও, গৌড়, ঢাকা কিংবা মুর্শিদাবাদের সাথে কলকাতার কোনো মিল ছিল না। একদিকে ইংরেজ কোম্পানির রাইটার-ফ্যাক্টর-সেমি মার্চেন্ট প্রভৃতি নিম্ন শ্রেণীর ইংরেজ কর্মচারী, অন্যদিকে তাদের লুণ্ঠন-সহচর দালাল শ্রেণী। তাদের হাতে বেড়ে ওঠা কলকাতায় জন্ম নিলো এক নতুন সংস্কৃতি যার নাম ‘বাবু’ কালচার।
কলকাতার বাবু সম্পর্কে জে এইচ ব্রæমফিল্ড তার এলিট কনফ্লিক্ট ইন এ রুরাল সোসাইটি বইতে লিখেছেন- Babu : In Bengali a title of respect for an English speaking Hindu. Applied Derogatorily by the British to semi-educated Bhadralok and by extension to any Bhadrolok.
বাবু শব্দটি কোম্পানি শাসনের জন্ম স্থিতি বিকাশের সাথে সম্পৃক্ত বলে উল্লেখ করে আবুল কাশেম চৌধুরী লিখেছেন-
‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পলাশী বিপর্যয়ের মাধ্যমে যখন স্বাধীনতা দ্রুত অপসৃয়মান, বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ কুটিরশিল্প এবং অভ্যন্তরীণ ব্যবসায় ও বহির্বাণিজ্য, তখনই এই সামাজিক বিকলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিচ্ছে এই বাবু সমাজ ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আনুক‚ল্যে। কালো পথে উপার্জিত বাবুদের অঢেল টাকা শেষ পর্যন্ত গতানুগতিক ভূমিমুখীন অর্থনীতিতে আটকা পড়ে এবং তার কারণে সমাজকে বিসর্জন দিতে হয় সম্ভাব্য গতিশীলতা।’ (সূত্র : বাংলা সাহিত্যে সামাজিক নকশা, বাংলা একাডেমি, পৃষ্ঠা-৭২)
এই বাবু সমাজের পরিচয় আরো স্পষ্ট করে তিনি লিখেছেন-
‘কলকাতাবাসী জমিদার শ্রেণী যারা আভিজাত্যের স্রোতে গা ভাসিয়ে ক্ষীয়মান সমস্ত পরিবেশকে গোঁজামিল দিয়ে টিকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, তারাই ছিলেন বাবু। এদের উদভ্রান্ত যৌবন কেটেছে বৈদেশী বণিক শোষণে উৎক্ষিপ্ত সহজলভ্য ধনস্ফীতিতে।’ (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা : ৮৪-৮৫)
‘কলকাতার এই বাবুদের সামাজিক মানমর্যাদার মাপকাঠি ছিল টাকা। সেই টাকার প্রাপ্তি ঘটেছে ইংরেজদের লুণ্ঠন সহযোগীরূপে। এভাবেই তারা সারা বাংলার রক্ত শোষণ করে কলকাতায় গড়ে তুলেছিল প্রাচুর্যের পাহাড়। এই কালো টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল ইংরেজদের দেওয়ান, বেনিয়ান, মুৎসুদ্দি, সরকার, কেরানি প্রভৃতি শত নামে। আরো ছিল কোম্পানির উকিল ও জমিদারির সেরেস্তাদার। ইংরেজরা তাদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলত, ব্লাক জেমিনদার। দুর্নীতির নানা কানাগলিপথে ব্লাক মানি অর্থাৎ লক্ষ্মী এসে বাসা বেঁধেছিল এদের ঘরে।’ (পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা-৭৭)
এরূপ অনেক ব্লাক জেমিনদার বা ক্যালকাটা বাবু দুই, চার, পাঁচ টাকা বেতনের কর্মচারী থেকে সে যুগের ধনকুবেরে পরিণত হয়েছিল। রাম দুলাল দে পাঁচ টাকা বেতনের সরকার হিসেবে জীবন শুরু করেন। ১৮২৫ সালে মৃত্যুর সময় কলকাতা শহরে তিনি রেখে গেছেন ১৯টি বিশাল বাড়ি, আর সে আমলের পৌনে সাত লক্ষাধিক টাকার সম্পদ। কলকাতার বিখ্যাত ছাতুবাবু-লাটুবাবুরা ছিলেন তারই সন্তান। কলকাতার অন্যতম বিখ্যাত পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীল পুরোনো শিশি-বোতলের কারবার দিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। আট টাকা বেতনের চাকরি শুরু করে রামকমল সেন মৃত্যুর সময় নগদ রেখে যান ১০ লাখ টাকা। হেস্টিংসের মুৎসুদ্দিগিরি করে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কাশিমবাজারের রাজপরিবার, যার বার্ষিক আয় ছিল তিন লাখ টাকা। (সূত্র : সিরাজুল ইসলাম, সূর্যাস্ত আইনের সামাজিক তাৎপর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, আষাঢ়-১৩৮৫)
এই কালো টাকার মালিকদের পরিচয় ছিল চতুর ও বুদ্ধিমান, শঠ ও প্রবঞ্চক এবং হাজার রকম প্রতারণা-কৌশলের উদ্ভাবকরূপে। টাকা-পয়সা উপার্জনে তারা যে অভিনব ব্যবসায়িক কৌশলের অবলম্বন করত তা প্রকাশ্য দস্যুতার শামিল। অন্যদিকে সেই লুণ্ঠিত সম্পদ খরচ করার ব্যাপারেও তারা ছিল বেহিসাবি। নানা প্রকার বাবু বিলাস তখনকার কলকাতায় চালু হয়েছিল। বাইজি-চর্চা থেকে শুরু করে বুলবুলির লড়াই, টিকটিকির নাচ পর্যন্ত অনেক কিছুই ছিল তাদের বিকৃত রুচির তৃপ্তি সাধনের উপাদান। সে সংস্কৃতিই দিনে দিনে বঙ্গদেশে প্রবেশ করেছে যা বর্তমানে বিত্তশালী বনাম নিম্নবিত্ত ও হতদরিদ্রদের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। একদিকে ভোগ-বিলাস অন্যদিকে রয়েছে হাভাতে দিন যাপন।
চলতি বাংলা বর্ষের বর্ষবরণ (পয়লা বৈশাখ) পবিত্র রমজান মাসে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর ও মাদরাসা অধিদফতরভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ওই দিবসটি পালন উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রার নির্দেশনা জারি করা হয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠে, যেভাবে মঙ্গল শোভাযাত্রা উদ্যাপিত হয় তা কি বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতি? এ জন্য অবশ্যই ইতিহাস পর্যালোচনা করা দরকার। পূর্ববঙ্গের চৈত্রসংক্রান্তিই ছিল বাংলা নববর্ষকে বরণ করার প্রস্তুতিমূলক প্রধান উৎসব। ওই উৎসবকেই সর্বজনীন লোকজ মেলা বলা হতো। স্থানীয় কৃষিজাত পণ্য, কারুপণ্য, হস্ত ও মৃৎশিল্প, কুটিরশিল্পজাত সামগ্রী, লোকজ খাবার যেমন- চিড়া, মুড়ি, খৈ, বাতাসা, বিভিন্ন রকমের মিষ্টি/বিভিন্ন ধরনের ফল পাড়া-প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ ছিল এসব মেলার মূল আকর্ষণ। এ ছাড়া বিনোদনের অংশ হিসেবে থাকত যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান, গাজীর গান প্রভৃতি। কিন্তু সাম্প্রতিককালে চালু হওয়া ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের সংস্কৃতি ছিল না। সৃষ্টির সেরা মানুষের মুখে প্যাঁচা, সাপসহ বন্যপশুর মুখোশ পরিধান করে শোভাযাত্রা উৎসব করার সংস্কৃতি কলকাতায় উচ্চ বর্ণের হিন্দুসমাজের সংস্কৃতি থেকে প্রথমে সীমান্ত এলাকা যশোরে, পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে প্রসার লাভ করে, বর্তমানে একটি স্বার্থান্বেষী মহল দেশব্যাপী স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় মঙ্গল শোভাযাত্রা সমপ্রসারিত করার জন্য সরকারিভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলা মিডিয়ার তথ্য মোতাবেক, সম্র্রাট আকবর তার রাজত্বে খাজনা তোলার প্রক্রিয়া সহজ করতে ১৫৮৪ সালের ১০ বা ১১ মার্চ বাংলা সন প্রবর্তন করেন। নতুন সনের নাম দেয়া হয়েছিল ‘ফসলি সন’ পরে যা বঙ্গাব্দ নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু একটি মহল শশাঙ্ককে বাংলা সনের প্রতিষ্ঠাতা দাবি করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় তার মূর্তি নিয়ে পদযাত্রা করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ মহলটি শ্রীখোল, ঢাক, চামরসহ গৌড়ীয় নৃত্য, কীর্তন, কাব্য, দুর্গাপূজা, শঙ্খ, তুলসীমঞ্চ, কলাগাছ, হাতি, সাপ, প্যাঁচা প্রভৃতিকে বাঙালি সংস্কৃতি মনে করে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি হতে পারে, কিন্তু সার্বিকভাবে বাংলাদেশের বাঙালি সংস্কৃতি নয়। কারণ পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান ছাড়াও বিভিন্ন জাতি, গোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বী রয়েছে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail : [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা