একজন দেশপ্রেমিকের চলে যাওয়া
- সৈয়দ আবদাল আহমদ
- ২৪ এপ্রিল ২০২৩, ২১:৩৩
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যু দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। সম্প্রতি নিজের প্রতিষ্ঠিত ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আমার চোখে ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী একজন অসাধারণ দেশপ্রেমিক এবং দেশ অন্তপ্রাণ মানুষ। তাকে প্রথম দেখি হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ রেলওয়ে জংশন স্টেশনে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে। ১৯৭৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেনারেল ওসমানীর সমর্থনে প্রচারকাজে অংশ নিতে হবিগঞ্জে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে এবং পরবর্তীতে সাংবাদিকতা পেশায় এসে তার সাথে পরিচয় হয় এবং জাফর ভাইয়ের ¯েœহধন্য হই। সাভারের নবীনগরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার ও মাঠপর্যায়ের কাজের রিপোর্ট করতে গিয়ে তার কাছাকাছি এসেছি। ফলে তাকে জানার সুযোগ হয়েছে। যে বিষয়টি লক্ষ করেছি বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ কামনা ছাড়া তিনি কিছু ভাবেন না এবং এটাকেই তিনি তার ব্রত হিসেবে নিয়েছেন।
ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী লন্ডনে ডাক্তারি পড়েছেন। চিকিৎসাক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন ভাস্কুলার সার্জন। তবে পরবর্তীতে দেশের একজন জনস্বাস্থ্য চিন্তাবিদ হিসেবে আবির্ভূত হন। বাংলাদেশের ওষুধ এখন সারা বিশ্বে রফতানি হচ্ছে। দেশের ওষুধ শিল্প এখন এক সাকসেস স্টোরির নাম। সে ক্ষেত্রেও তার অবদান রয়েছে। ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে। ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এ ব্যাপারে তার সুনাম রয়েছে। গরিব দেশের মানুষকে কম পয়সায় কিভাবে চিকিৎসা দেয়া যায়, ওষুধের দাম কিভাবে কম রাখা যায়, গ্রামে কিভাবে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে যাওয়া যায় এসব নিয়ে ছিল তার যত চিন্তা।
তিনি যখন বিলেতে ডাক্তারি পড়া শেষ করেন এবং চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত হন, তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে কায়দা করে ভারতে চলে আসেন। ডাক্তারি পেশাকে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগিতায় নিবেদিত করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলার বিশেষ ভূমিকা ছিল জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। তিনি যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত চিকিৎসকদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেও সংগঠিত করেন। ফিল্ড হাসপাতালের জন্য ওষুধসহ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহের ক্ষেত্রেও তার অনন্য ভূমিকা ছিল। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে ওই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তুলেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা যে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের মাধ্যমে দেয়া সম্ভব তা গণস্বাস্থ্য প্রমাণ করে এবং গ্রামীণপর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ছড়িয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে নারীদের প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। নারীদের কাজে নেয়া বিশেষ করে নারী ড্রাইভারের চাকরির উদাহরণ গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে প্রথম দেখা যায়। ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরীর গাড়িও চালাতেন একজন নারী।
১৯৮৮ সালের প্লাবনের সময় ধানমন্ডির নগর হাসপাতালের সামনে বিশাল শামিয়ানা টানিয়ে তার উদ্যোগে রাত-দিন শুকনো খাবার বিশেষ করে রুটি তৈরি হয়েছে লাখ লাখ পিস। এসব খাবার বন্যার্তদের মাঝে বিতরণ হয়েছে। বন্যার্তদের মাঝে সহজলভ্য শুকনো খাবার দেয়ার চিন্তা তার মাথা থেকে আসে। এভাবে দেশের প্রতিটি দুর্যোগে তাকে দেখেছি আর্তমানবতার সেবায় খাবারসহ মেডিক্যাল টিম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। তার গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের বেশির ভাগ রোগী গরিব। এত কম মূল্যে অন্য কোনো হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেয়ার নজির নেই। গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালের ওষুধের দামও খুব কম।
কিডনিরোগীদের ডায়ালাইসিস খুব ব্যয়বহুল। তিনি নিজেও ডায়ালাইসিস করাতেন। তাই তার শেষ উদ্যোগ ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে ডায়ালাইসিস সেন্টার খোলা। কম মূল্যে ডায়ালাইসিস করানোর উদ্যোগটি তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পেরেছেন।
দৈনিক বাংলায় আমার অনেক অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টের বিষয় তার কাছ থেকে নেয়া। সে ক্ষেত্রে জাফর ভাই তথ্য ও পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালে ক্লাবের সদস্যদের চিকিৎসা প্রদানে আমাদের অনুরোধে তিনি এগিয়ে আসেন এবং তার হাসপাতালের একটি টিম নিয়মিত ক্লাবে অবস্থান করে সদস্যদের চিকিৎসা করেছেন প্রায় বিনা খরচে। দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট মোকাবেলায়ও তিনি তার আন্তরিকতার ছাপ রেখেছেন। এ বিষয়ে সবসময় সময়োপযোগী বক্তব্য দিয়েছেন। সর্বশেষ গত ২৬ মার্চ বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হুইল চেয়ারে করে তিনি অংশ নিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করতে গিয়ে তিনি রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানের আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রীকে তিনি বলেন, ‘বিএনপিকে ডাকুন, বিরোধী দলগুলোকে ডাকুন, কথা বলুন, সঙ্কটের সমাধান করুন।’
ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদামাটা সরল জীবন-যাপন করতেন। অপচয়কে খুব অপছন্দ করতেন। নিজে অপচয় করতেন না এবং কাউকে অপচয় করতে দেখলে রেগে যেতেন। তার পরনের এমনও শার্ট ছিল যার বয়স ৩০ বছর। প্যান্ট সেলাই করে পরতেও দ্বিধা করতেন না। এত বছরের পুরনো শার্ট কেন পরেন- এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘শার্ট না ছিঁড়লে আমি কী করব?’ প্রেস ক্লাবে এলে এক কাপ কফি খেতেন। সঙ্গে বড়জোর একটি টোস্ট বিস্কুট কিংবা একটা ডালপুরি। সাভারের গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে গেলে আমাদের নিয়ে রঙ-চা খেতেন। সঙ্গে খাবার হিসেবে থাকত মুড়ি। ধূমপানের বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন। তার প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে শর্ত ছিল ধূমপায়ীরা দরখাস্তের অযোগ্য।
জাফর ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি আর কখনো আসবেন না, আমরা তাকে পাবো না। লিখতে বসে শুধু তার অমায়িক হাসির মুখখানা ভেসে উঠছে। সুদূরে ভালো থাকুন জাফর ভাই। মহান আল্লাহর কাছে দোয়া করি তিনি যেন ভুলত্রুটি ক্ষমা করে আপনাকে বেহেশত নসিব করেন।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক
সাধারণ সম্পাদক
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা