আগুন নিয়ে খেলা বিপজ্জনক
- মুজতাহিদ ফারুকী
- ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ২০:১১
সম্প্রতি টক অব দ্য টাউন বা টক অব দ্য কান্ট্রি অগ্নি দুর্ঘটনা। খোদ রাজধানীতে একের পর এক বড় বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। এর পাশাপাশি যোগ হয়েছে নতুন ফেনোমেনা। সব অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সরকার নাশকতার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গত ১৭ এপ্রিল বলেছেন, সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর আগে ১৫ এপ্রিল স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন ঘনঘন আগুনের ঘটনার পেছনে কোনো ষড়যন্ত্র বা নাশকতার যোগসূত্র আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে হবে।
যেকোনো দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখা রাষ্ট্রের বা সরকারের স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সে জন্যই কোনো ঘটনা ঘটলে ঘটনার গুরুত্ব বুঝে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, প্রতিটি তদন্তের ক্ষেত্রেই একটি স্বাভাবিক প্রত্যাশা বা পূর্বশর্ত থাকে। সেটি হলো, তদন্ত নিরপেক্ষ হবে এবং কেবল যথাযথ কারণ বা ঘটনার পেছনের সত্য উদঘাটনই হবে তদন্তের একমাত্র লক্ষ। ঘটনা বা দুর্ঘটনার কারণ উদঘাটন করে তার ভিত্তিতে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়ার অভিপ্রায় নিহিত থাকে তদন্তের পেছনে। সুতরাং সরকারের ‘খতিয়ে দেখার নির্দেশ’ সম্পর্কে কারো কিছু বলার থাকতে পারে না। আমাদেরও নেই। তবে সে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে যদি ভিন্ন কোনো আলামত বা মতলবের আভাস দেখা যায় তাহলে অবশ্যই দুকথা বলার থাকে।
প্রধানমন্ত্রী শুধু তদন্তের নির্দেশই দেননি। অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে ‘বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাসের বিষয়টি’ জড়িত কিনা তা-ও তদন্ত করে দেখতে বলেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (বিএনপি-জামায়াত) অগ্নিকাণ্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে। এই নির্দেশনা একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। গত ১৫ বছরের বাংলাদেশের ঘটনাবলি যারা ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করেন তাদের জন্য এ নির্দেশের মরতবা বোঝা দুরূহ নয়। নিজেদের প্রতিটি ব্যর্থতা ঢাকার জন্য এক বা একাধিক বলীর পাঠার কাঁধে দায় চাপানোর যে সংস্কৃতি চলমান রয়েছে তা এখন ১০ বছরের শিশুরও অজানা নয়।
এ দেশে নির্বাহী দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী থেকে শুরু করে জনপ্রশাসনের প্রতিটি দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন একটি বিশেষ জায়গা থেকে আসা নির্দেশের অপেক্ষা করতে বাধ্য হন তখন আর স্বউদ্যোগে কোনো কাজ করার গরজ তার মধ্যে থাকে না। কাজ করতে গিয়ে ভুলত্রুটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ভুলের কারণে যদি নাশকতার দায়ে পড়তে কিংবা কোনো বিশেষ দলের সাথে জড়িয়ে কাঠগড়ায় তোলার শঙ্কা থাকে অথবা ক্ষমতাসীন দলের বা অঙ্গ সংগঠনের এমপি, নেতা-কর্মীদের রোষের শিকার হয়ে লাঞ্ছনার মুখে পড়ার ভয় থাকে তাহলে কে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে যাবে? দেশে এখন সেই পরিস্থিতিই বিরাজ করছে। আগুনের ঘটনা তদন্তের নির্দেশে প্রধানমন্ত্রী যে সুনির্দিষ্ট পক্ষের দিকে আঙুল তুলেছেন তাতে তদন্তের ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে তার যথেষ্ট ইঙ্গিত রয়ে গেছে আকলমন্দ্ লোকের জন্য।
তবুও কয়েকটি বিষয় এমনভাবে সামনে এসেছে যেগুলো এড়িয়ে বিশেষ পক্ষের ওপর দায় চাপানো কঠিন হবে। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা অনুমান করেন, ৪ এপ্রিল তাদের মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পেছনে সিটি করপোরেশনের ইন্ধন থাকতে পারে। মার্কেট নিয়ে সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা এবং মার্কেট কমিটির সাথে মামলার বাস্তবতা এড়ানোর উপায় নেই। ব্যবসায়ী নেতাদের স্বার্থের দ্বন্দ্বের বিষয়গুলোও এতটাই স্পষ্ট যে, সেগুলোও আমলে না নিয়ে উপায় নেই।
নিউ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ভোর সাড়ে ৫টার সময় সিটি করপোরেশনের পোশাক পরা কয়েকজন লোক মার্কেটের সামনের ফুটওভার ব্রিজ ভেঙে দেয়ার কাজ করছিল। তারা লোহা কেটে সিঁড়িগুলো ভেঙে দিয়েছিল। এ সময় শর্ট সার্কিট হয়ে সেখানে আগুন লেগে যায়। তখন আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারা পালিয়ে যায়। ভোর ৫টায় সিটি করপোরেশনের লোকেরা কাজ শুরু করে এমন দায়িত্ববান তাদের কখনই দেখা যায়নি। যদি বিশেষ উদ্দেশ্য বা স্বার্থের বিষয় না থেকে থাকে। আর প্রতিটি ঘটনাতেই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টতা কেন উঠে আসছে সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। এই মার্কেটটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয় ২০১৬ সালে। ২০১৮ সালে সিটি করপোরেশন এটির দোকানের লাইসেন্স নবায়ন ও ভাড়া তোলা বন্দ করে। পরে কার নির্দেশে, কেন এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটের তালিকা থেকে কেন বাদ দেয়া হলো তা নিয়েও দেখা দিয়েছে রহস্য। এই মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সম্পর্কে বিএনপি নেতার অভিযোগের প্রেক্ষিতে পুরো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা আরো জরুরি হয়ে উঠেছে।
কিছু ঘটলেই উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর সরকারি দলের অভ্যাসের বিষয়টি তুলে ধরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, এসব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পেছনে আওয়ামী লীগ ও বর্তমান সরকারের হাত আছে। তিনি বলেন, মানুষের দাবি উঠেছে সারের দাম কমাও, চালের দাম কমাতে হবে, বাঁচতে দিতে হবে, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে দিতে হবে, ভোটের অধিকার দিতে হবে। এসব দাবি পাশ কাটানোর জন্য, মানুষের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে নেয়ার জন্য আপনারাই আগুন লাগিয়ে বেড়াচ্ছেন।
অভিযোগ গুরুতর। মির্জা ফখরুল মাঠের বক্তৃতায় যা মুখে আসে তাই বলা রাজনীতিক নন। লোকেরা তাকে ভদ্র, সৎ ও সজ্জন বলে জানে। আর এ কারণেই তার বক্তব্য জনমনে আবেদন সৃষ্টি করে। এর মধ্যে সত্যের আভাস থাকতে পারে বলে মানুষ ধরে নেয়। সুতরাং তার অভিযোগ আমলে নিতে হবে।
উপর্যুপরি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোকে এভাবেই একটি অনাকাক্সিক্ষত জটিলতার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে কী?
চলতি গ্রীষ্মের একটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্য আছে। আছে ভিন্ন মাত্রা। এ মৌসুমে দেশের তাপমাত্রা প্রায় ৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। মৃদু ও মাঝারি তাপপ্রবাহের পর্যায় ছেড়ে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছে। পাবনার ঈশ্বরদীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। অন্য সব বছরের মতো এটি কেবল সাত আট দিনের জন্য নয় বরং গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে। বাতাসের আর্দ্রতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। আগুনঝরা রোদের তেজে ঘরবাড়ি দালান কোঠা সব কিছুই শুকনো বারুদের মতো বিস্ফোরক হয়ে থাকছে সারা দিন এবং রাতেরও অনেকটা জুড়ে।
এর মধ্যে ঢাকার মার্কেটগুলো রয়েছে অগ্নি দুর্ঘটনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। নগরীর বেশির ভাগ মার্কেটই নানা দিক থেকে ঝুঁঝিপূর্ণ। অগ্নি-দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে আছে ৫৮টি। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে এমনটা কমই দেখা গেছে। প্রতি বছরই গ্রীষ্মকালে দেশে অসংখ্য অগ্নিকাণ্ড ঘটে। সামান্য হিসাব দিলে বিষয়টির ব্যাপকতা স্পষ্ট হবে।
২০০৯ সালে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড ঘটে ১২ হাজার ১৮২টি। মারা যান ১১৮ জন। ২০১৮ সালে অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে ১৯ হাজার ৬৪২টি। এতে প্রাণহানি হয় ১৩০ জনের। ২০২২ সালে সারা দেশে ঘটেছে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ড। এসব ঘটনায় ৩৪২ কোটি টাকার বেশি সম্পদ পুড়েছে। এর আগের বছর (২০২১) ঘটে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ড। আর ২০২০ সালে সারা দেশে ২১ হাজার ৭৩টি আগুনের ঘটনা ঘটে। সব তথ্যই ফায়ার সার্ভিস তথা দমকল বাহিনীর। তবে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত। এসব ঘটনার কোনোটিতে নাশকতা বা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য কখনো খুঁজে পাওয়া গেছে এমন জানা যায় না। শুধু তাই নয়, গার্মেন্ট বা অন্য কারখানায় অথবা রাসায়নিকের ডিপোতে যেসব বড় বড় অগ্নিকাণ্ডে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে সেগুলোরও সুষ্ঠু তদন্ত বা যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এমন রেকর্ড প্রায় নেই বললেই চলে। কাউকে শাস্তি দেয়া বা আইনের আওতায় আনার ঘটনাও বিরল।
আমাদের দমকল বাহিনীর শক্তি সামর্থ্য ও সরঞ্জামের অবস্থা কী? যেকোনো বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটলেই সেটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পানির গাড়ির স্বল্পতা, উদ্ধার সরঞ্জামের অভাব এগুলো প্রতিবারই দেখা যায়। তেলের, গ্যাসের বা রাসায়নিকের আগুন নেভানোর উপকরণ নেই। ভবন কেটে আটকে পড়া মানুষ উদ্ধারের মতো কাটার মেশিন নেই। অথচ সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সম্প্রতি দেশের প্রতি জেলায় এবং কোনো কোনো থানায় অচল সুইমিং পুল বানিয়ে রেখেছে। পুলগুলো ব্যবহার উপযোগী হলেও না হয় বলা যেত, ঠিক আছে ছেলে-মেয়েরা সাঁতার শিখছে। কিন্তু তা হয়নি। শতকরা পাঁচটি পুলও সচল নয়। এই অচল পুল বানাতে সরকারের টাকার অভাব হয়নি। কিন্তু মানুষের জীবন রক্ষার প্রয়োজনে টাকার সংস্থান হয় না।
মাত্র ক’বছর আগে ডয়েচে ভেলে রেডিওর এক রিপোর্টে বাংলাদেশে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবেলায় সরকারের বাজেট কী নিদারুণভাবে অপ্রতুল তার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছিল। তাতে বলা হয়, দেশের মোট প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে দুর্যোগ, দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ রাখতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের জন্য যে বাজেট ছিল তাতে মাথাপিছু বরাদ্দ পড়ে বছরে ৩০ টাকা। হ্যাঁ, ঠিকই পড়ছেন। আপনার আমার নিরাপত্তায় সরকার সারা বছরে ব্যয় করেন মাত্র ৩০ টাকা। অবিশ্বাস্য হলেও এটিই সত্য (এই মুহূর্তে বরাদ্দের পরিমাণ কয়েক টাকা বেড়ে থাকতে পারে। সর্বশেষ হিসাব পাওয়া যায়নি।)
উন্নত দেশগুলোতে এই বরাদ্দ মাথাপিছু বছরে মোটামুটি ১৫ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকার মতো। অগ্নিনিরাপত্তায় জাপানে মাথাপিছু ব্যয় ১৩৪ ডলার, ফ্রান্সে ১০৪ ডলার, জার্মানিতে ১০৭, সুইডেন ১০২, সুইজারল্যান্ড ৯৭ এবং যুক্তরাজ্যে ৫৮ ডলার। সেখানে বাংলাদেশ ব্যয় করছে মাত্র ৩৬ সেন্ট, বছরে।
আমাদের ফায়ার সার্ভিসের লোকবল যে অপ্রতুল সে প্রসঙ্গ না হয় না-ই তুলি। দমকল বাহিনীর সদস্যরা সব সীমাবদ্ধতার পরও যে জীবন বাজি রেখে দুর্যোগে উদ্ধার তৎপরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ছাড়াই বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে আগুনের বিরুদ্ধে জান লড়িয়ে দেন সেটিই বরং বিস্ময়কর। তাদের বাহবা দিই।
আগুন নিয়ে রাজনীতি অনেক হয়েছে। আর না হোক সেটাই কাম্য। কারণ আগুন নিয়ে খেলা সব সময়ই বিপজ্জনক। আর এই বারুদতপ্ত সময়ে সেটি ভয়ঙ্করতম হতে পারে। উত্তাপ তো শুধু আবহাওয়া বা প্রকৃতিতে নয়, রাজনীতিতেও সমভাবে ছড়িয়ে আছে। রাজপথে চলন্ত বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার ইতিহাস কলঙ্কের। কিন্তু অমীমাংসিত কি? সত্যটা সবারই জানা। আর এটাও সত্য যে, গুম খুন, গুপ্ত হত্যার দেশে সব সময় সব সত্য প্রকাশ পাবে না, উন্মোচিত থাকবে না। তবে সময় অজঙ্গম নয়। সে নিজের গতিতেই এগিয়ে যায়। পাল্টে যায়। সন্দেহ নেই, এখানেও পাল্টাবে। আজ অথবা কাল।
ই-মেল: [email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা