২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

কাঁচাবাজারে লুটের মনোভাব কেন

কাঁচাবাজারে লুটের মনোভাব কেন। - ছবি : সংগৃহীত

মাছ-গোশত, শাক-সবজি, তেল-নুনের দাম যদি প্রতিদিনই বাড়ে, তাহলে গরিব মানুষের দশা কেমন হতে পারে? এই কথাটা একবারও দেশের সরকার বা কাঁচাপণ্যের ব্যবসায়ীরা কেন ভাবেন না, তার কারণ গবেষণা করে বের করতে হবে। কারণ, এর মধ্যে ব্যবসায়ীদের চিরায়ত দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। আর সেই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আছে মুনাফার লোভ।

মাত্র একমাস দাম বাড়িয়ে ব্রয়লার মুরগির খামারিরা এক হাজার কোটি টাকা বেশি মুনাফা করেছে। এই অভিযোগ ক্যাবের। কিভাবে তারা দাম বাড়ানোর টেকনিক নিয়েছে, তা এখন আম পাবলিকও জানে। হঠাৎ করেই একদিন ব্রয়লার সঙ্কট কৃষ্টি করে দাম বাড়িয়ে দেয় তারা। তারপর এক মাস ধরে সেই ব্যবসা চালিয়ে গিয়ে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের অনুরোধে ২০ টাকা কমিয়ে দেয়। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তারা খুশি। জনগণের জন্য তারা ব্রয়লার মুরগির দাম কমিয়ে দিতে পেরে তা সগৌরবে প্রচার চালানো হয়। ওই একমাসে ব্রয়লার এগ্রো ইন্ডাস্ট্রির মালিকরা মাত্র এক হাজার কোটি টাকা লুটে নেয় ওই মুরগির ক্রেতা গরিব জনগণের পকেট থেকে। এই হচ্ছে মূল কাহিনী।

জাগোনিউজেই পড়েছিলাম ড. মোহাম্মদ ফরাশউদ্দিনের একটি সাক্ষাৎকার। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অর্থনীতিবিদ হিসেবে তার বেশ খ্যাতি আছে। তিনি বলেছেন, আসলে পণ্যের দাম তো বাড়ায় সরকার। তার ভাষ্য : ‘এ কারণেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ব্যবসায়ীরা। তারা মনে করেন, এই রাষ্ট্রে যা ইচ্ছা তাই করা যায়। কোনো কৈফিয়ত দিতে হবে না। কৃষক পায় ২০ টাকা আর ভোক্তা কেনে ৮০ টাকায়। বাকি ৬০ টাকা কাদের পকেটে যায়? এর হিসাব তো রাষ্ট্রের কাছে থাকার কথা।

কষ্টে বুক ফেটে যায়। ব্রয়লার মুরগির দাম হঠাৎ করে ১০০ টাকা বাড়ানো হলো। সরকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে ২০ টাকা কমাল এবং ঢাকঢোল পিটিয়ে বাহবা নিচ্ছে। এই বাহবাই ৮০ টাকা বৈধ করে দিলো ব্যবসায়ীদের জন্য। চিন্তা করা যায়! এক কেজি মাংসে ৮০ টাকা বাড়িয়ে দিলো মাত্র কয়েক দিনে! কোনো বিবেক কাজ করে না। ঠিকমতো মনিটরিং করলে তো এমন হওয়ার কথা নয়।’ (জাগোনিউজ-৩০/০৩/২৩)
কি মনে হয় ড. ফরাশউদ্দিন আহমদের কথা শুনে? তিনি তো ১৯৯৬-২০০০ সালে হাসিনা সরকারের প্রথম আমলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলেন। ওই যে বলেছেন ১০০ টাকা দাম বাড়িয়ে ২০ টাকা কমিয়ে দিয়ে বাহবা নিচ্ছেন- সেই বাহবা প্রাপক কারা? তিনি কি সরকারপ্রধান নাকি তার চার পাশের সরকারি ও রাজনৈতিক আমলারা? যারা দাম কমিয়ে ক্রেতাদের পকেট কেটে প্রতি কেজিতে ৮০ টাকা বেশি দিতে বাধ্য করছে? যেসব মুরগির ফার্মের ব্রয়লার বাজারে আসে তাদের অন্যতম হচ্ছে কাজী এগ্রো। বাল্ক উৎপাদন তাদেরই। মন্ত্রীর পাশে বসে তিনি দাম কমিয়ে দিলে ১৯০ টাকায় বিক্রি করবেন বলে জানালেন। ব্রয়লারের খাদ্য তৈরিতে লাগে গম। দেশেই তো তার উৎপাদন হয় বছরে ১১ লাখ মেট্রিক টন। সেই গমের মূল্যও কি উৎপাদক কৃষকরা বাড়িয়েছেন? বাড়ালেও, তা কত টাকা বা কত পার্সেন্ট? কিন্তু তিনি ও তারা একলাফে কেজিতে ১০০ টাকা বাড়ালেন কোন যুক্তিতে? তাদের কুযুক্তি হচ্ছে ইউক্রেনের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ। সেখানে দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্রয়লারের দাম বাড়িয়েছে এগ্রো কোম্পানি। আর সরকার বাহাদুর তিনি কি কিছুই চোখে দেখেন না? কানেও কি শোনেন না ক্রেতা ভোক্তাদের হাহাকার? আমরা জানি, সরকারের সেসব যোগ্য মানবদরদি বলবেন, কেননা, সরকার তো মূল্য কমিয়ে দর ঠিক করে দিয়েছে ১৯০ টাকায়। কিন্তু তিনি তো জানেন না যে ওই দামে কাঁচাবাজারে ব্রয়লার মুরগি পাওয়া যায় না। এখনো ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। আবার এক মাসের ব্রয়লারের দাম বাড়িয়ে মাত্র এক হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন কাজী এগ্রোসহ তাদের ব্রয়লার মুরগি উৎপাদক সিন্ডিকেট। সেই টাকাটা জনগণের পকেটে কি ফিরিয়ে দিতে পারবেন মাননীয় নিয়ন্ত্রকগণ? কিংবা অবৈধ ও অন্যায়ভাবে যে ওই অর্থ লুটে নেয়া হয়েছে, সেই লুটের অপরাধে কি তাদের জরিমানা করা হবে? নাকি তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে? দাম বাড়িয়ে লুটে নেবার অপরাধের জন্য কোনোরকম আইন আছে কিনা তা আমরা জানি না। আবার আইন থাকলেই কি তার প্রয়োগ আছে বা হবে? বাংলাদেশে ব্রিটিশ আইন সচল আছে, কিন্তু জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে পারে, সেরকম আইন কি আছে বা তার প্রযোগ আছে? যারা ব্রয়লারের দাম বাড়িয়ে ক্রেতা/ভোক্তার পকেট ফাঁকা করে দিলেন, সেই অপরাধের জন্য কি তারা জবাবদিহির মধ্যে আসবে? ড. ফরাশ যথেষ্ট ভদ্রভাষায় বলেছেন, দাম কমানোর টাকাটার বাড়তি অংশের টাকা কার পকেটে যায়? সেটা তিনি জানেন এবং আমরাও অনুমান করতে পারি। কারণ যিনি দাম কমানোর তরিকাকে মুনাফায় ৮০ টাকা পাক্কা করে দিলেন, তিনি তো তার ভাগ পাবেনই।

আমাদের কাঁচাবাজারে কেন পণ্যমূল্যে আগুন লেগে থাকে, তার কারণ নিহিত আছে সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারা তো সরকারের হয়ে কাজ করছেন না। তারা সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করছেন। সয়াবিন তেলের মূল্য বাড়িয়ে/কমিয়ে তারা যে দর বেঁধে দিয়েছেন, তা তো আমদানি ব্যয়ের চেয়েও অনেক বেশি। দাম বাড়িয়ে দিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলরা আলোচনা করে ১১ টাকা কমিয়ে দিয়ে জনসেবা/ভোক্তাসেবা করার যে প্র্যাকটিসটা করছেন, তা অনেক পুরোনো রীতি বা চাল। এই চাল দিয়ে ভোক্তাদের মন জয় করা যাবে না। সরকারের মনোতুষ্টি করা যাবে। কারণ সরকার যাদের চোখ দিয়ে বাজারের হালচাল দেখেন, তারা নির্জলা ঘুষদোহনকারী রাজনৈতিক প্রশাসনের কর্মকর্তা। তারা ভোক্তা-জনগণের আয়-রোজগার মনে রাখেন না। তাদের সেই দায় থাকলেও, সরকার যেহেতু তাদের কাছে কোনো জবাবদিহি চান না, তাই তারা সাহসী, কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুঃসাহসী।
২.
বাজারে নিত্যপণ্যের একটি মূল্যতালিকা দেয়া থাকে, যা সবাই জানেন। তারপরও সেই তালিকা দিচ্ছি। ভোজ্যতেল ২০২২ সালের রমজানে প্রতিকেজি ছিলো ১৫৪ টাকা, ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ১৯০ টাকা। ছোলা প্রতিকেজি ২০২২ সালে ছিল ৭০ টাকা, ’২৩ সালে ৯৫ টাকা। ডিম ’২২ সালে এক ডজন ছিল ১১০ টাকা, ’২৩ সালে হয়েছে ১৪০ টাকা। ব্রয়লার মুরগি প্রতি কেজি ছিল ’২২ সালে ১৫০ টাকা, ’২৩ সালে হয়েছে ৩০০ টাকা। পরে কমিয়ে ২২০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গরুর গোশত ’২২ সালে ছিল ৬৫০ টাকা, ’২৩ সালে ৭৫০ টাকা থেকে ৮০০ টাকা, চিনি ’২২ সালে ছিল ৮০ টাকা, ’২৩ সালে ১২০ টাকা, ডাল ’২২ সালে ১১৫ টাকা, ’২৩ সালে ১৩৫ টাকা, খেজুর মানভেদে ‘২২ সালে ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা, ২৩ সালে ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা (এই দর যখন লেখা হয়েছে তখনো প্রকৃতপক্ষে খেজুরের বাজারে দাম বাড়েনি। বাড়ানো হয়েছে নতুন আমদানির পর। গড়ে আমদানি করা মানভেদে খেজুর আমদানি হয়েছে ৬০ টাকা থেকে ১০০ টাকা দরে। কিন্তু বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে এক হাজার ৮০০ টাকা কেজিদরে।) চাল সরু ৬০ টাকা, ’২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৮৫ টাকা, আটা খোলা ৩৫ টাকা কেজি, ’২৩ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা কেজি। মাত্র ৩৬৫ দিন পর, অর্থাৎ গত বছর রমজানের পর বাজারের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে প্রায় ডবল।

এই দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের ভোক্তা অধিদফতর এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকটি অফিস বেশ তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি টিভিতে। বাস্তবে তাদের মনিটরিং কতটা, তা বলতে পারছে না ভোক্তা জনগণ। বেশ কিছু দোকানিকে ফাইন করা হয়েছে সরকারের বেঁধে দেয়া দামে পণ্য বিক্রি না করার অপরাধে। তারা দাম বাড়ানোর কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হচ্ছে কর্তারা চলে গেলেই যে পরিমাণ অর্থদণ্ড দিয়েছেন তারা, তা তোলার জন্য তৎপর থাকেন দোকানিরা। তাদের বক্তব্য, বেশি দামে কিনে আনি আমদানিকারকের আড়ত থেকে, কম দামে বিক্রি করব কেমন করে? আমাদের ফাইন করে তারা মহাখুশি, কিন্তু তারা কি আমদানিকারকের আড়তে যাবেন। তাদের ফাইন করতে পারবেন? কথা সত্য। সরকার তাহলে আমদানিকারকদের ধরেন না কেন? তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না কেন? কেবল খেজুরের আমদানি মূল্য আর বিক্রিমূল্য দেখলেই অনুমান করা যায়, আমদানিকারকগণ পণ্য নিয়ে মুনাফা লোটেন কতটা।

এই কেনর কোনো জবাব নেই। কারণ কোনো ব্যক্তি নয়, ওটা একটি বাজার লুটের ব্যবস্থা বা সিস্টেম। আর মূল্য বাড়াবার সিস্টেমটাইতো সরকার বরণ করে পথ চলছেন। যেহেতু দায় সরকারের না আড়তদারের না আমদানিকারকের সেটাই আগে ঠিক করতে হবে। কিন্তু ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়া হয় না বা তারা সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নয় বা তারা অনেকটাই জবাবদিহির ঊর্ধ্বে বাস করেন। তাই গোড়ার গলদ ঠিক করতে কেউ বলে না এবং এই ঝুঁকিতে যাবে না কোনো সংবাদপত্রই। তাহলে স্বাধীনতা ভোগকারী সংবাদপত্র সরকারের রোষে পড়বেই। কিংবা যেকোনো অছিলায় ডিজিটাল আইনে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। তখন তো সংবাদপত্রের মালিক ও সাংবাদিকদের আম-ছালা দুটোই যাবে।

ড. ফরাশউদ্দিন যতটুকু বলতে পেরেছেন, সেটুকুও আমরা বলতে পারব না


আরো সংবাদ



premium cement