ইসলাম বিচারে মুহাম্মদ আরকৌনের ফ্যালাসি
- মুসা আল হাফিজ
- ২৭ মার্চ ২০২৩, ১৯:৫২
আলজেরিয়ান শিক্ষাবিদ ও দার্শনিক মুহাম্মদ আরকৌন (১৯২৮-২০১০) সমকালীন দুনিয়ার বিদ্যায়তনে বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। ফ্রান্সে বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন তিনি। প্যারিসের সরবোনে ইসলামিক চিন্তাধারার ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক ছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন ভিজিটিং প্রফেসর। দার্শনিক হিসেবে লাভ করেছিলেন খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা। ইতিহাসবিদ হিসেবে ছিল তার স্বীকৃতি। লন্ডনের ইসমাইলি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের গভর্নর বোর্ডের সদস্য ছিলেন তিনি এবং এরাবিকা পত্রিকায় কাজ করেন বৈজ্ঞানিক পরিচালক হিসেবে। তিনি সদস্য ছিলেন ইউরোপিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেস অ্যান্ড আর্টসের এবং মরক্কোর রয়্যাল একাডেমি অব সায়েন্সেস অ্যান্ড আর্টসের। তিনি ফরাসি, ইংরেজি, আরবি, ডাচ ও ইন্দোনেশীয় ভাষায় লিখেছেন বহু গ্রন্থ।
তার আগ্রহ ও কাজের কেন্দ্রে ছিল ইসলাম ও আধুনিকতার মুখোমুখি বিচার। ধ্রুপদ ও সমসাময়িক বিষয়গুলোকে তিনি স্পর্শ করতেন নিজস্ব হাত দিয়ে।
ইউরোপ, ইসলাম আর ভূমধ্যসাগরীয় দুনিয়ার মধ্যে সম্পর্কের গতকাল, আজ ও আগামীকাল ছিল তার দৃষ্টির মধ্যে। সেই সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা এবং পুনর্র্নিমাণের জন্য বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় উদ্যোগের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান লিজিয়ন অফ অনার এর কমান্ডার মনোনীত হন ১৯৯৬ সালে।
আরকৌন এর কাজ মুসলিম পণ্ডিতি পরিসরে যতটা বিতর্কিত হয়, পশ্চিমা চৈন্তিক পরিসরে ততটাই সমাদৃত। তিনি আহ্বান করেন ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ অন্তর্দৃষ্টিসমূহের পুনরুদ্ধারের জন্য। মুসলিম চিন্তার ঐতিহ্যে যে মাত্রাগুলো অচিন্তিত, সেগুলোকে পরীক্ষা করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এরাবিকার সম্পাদক হিসেবে যে চেষ্টাগুলো তিনি করেন, তার অন্যতম হলো ইসলামের সাথে পশ্চিমা মেধার মিথষ্ক্রিয়া নিশ্চিত করা।
জালালুদ্দীন সুয়ুতির বিখ্যাত গ্রন্থ আল ইতকানকে কেন্দ্রে রেখে তিনি আল কুরআন বিষয়ক গবেষণাকর্ম পরিচালনা করেন। এতে দেখান কুরআনের ভাষ্য কতটা সুস্থির, এর পরিধি কতটা বাধ্যতামূলক আর এর বর্ণনা কতটা cloture dogmatique বা গোঁড়ামি আচ্ছন্ন। কুরআনকে তিনি কি বিশ্বাস করতে পারছেন আল্লাহর বাণী বলে? আরকৌন এই জায়গায় অস্বচ্ছ। আল কুরআনের যা কিছু অভেদ্য, তাকে তিনি ভেদ করতে চান। কুরআনে বর্ণিত ঘটনাবলির পুনর্বিবেচনা তিনি করতে চান সমকালীন মানবতাবাদী ও সামাজিক বিজ্ঞান স্কলারশিপের লেন্সে। বিশেষত বাইবেল বা সাহিত্যের গ্রন্থগুলোর ব্যাখ্যা সম্পর্কিত যে হারমেনিউটিক বা ব্যাখ্যাবিজ্ঞান, তাকে তিনি কুরআনের ব্যাখ্যায় প্রতিস্থাপন করতে চান।
বর্তমানের যা কিছু অতীতের চিন্তায় প্রতিফলিত হয়নি, অতীতকে তিনি তার মুখোমুখি করতে চান। আরকৌনের জবঃযরহশরহম ওংষধস মূলত ইসলামের সমসাময়িক প্রতিকূলতার একটি চিত্র কিংবা আধুনিক মোডে ইসলামের পুনর্বিবেচনার একটি আহ্বান। পশ্চিমা সংবাদপত্র আরকৌনকে আল কুরআনের নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী হিসেবে উপস্থাপন করে, নিজেও বোধ হয় এই দাবিতে পুলকিত ছিলেন। আল কুরআনের আধ্যাত্মিক রূপান্তরকারী শক্তিকে স্বীকার করলেও তিনি দেখাতে চান যে, সেই শক্তি আর মানুষের হৃদয় ও মনের মধ্যখানে আড়াল তৈরি করা হয়েছে। খোদা আর মানুষের মধ্যকার বিনিময়ের আধ্যাত্মিক সারাংশকে আচার ও নিয়মের নামে অবলুপ্ত করা হয়েছে। সেটা করেছে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অভিজাত গোষ্ঠী। এই বক্তব্যে সত্যের কিছু দিক থাকলেও তিনি সাধারণীকরণ করেন এবং ফিকহ বা ইসলামের আইন ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অভিজাতদের স্বার্থের হাতে তৈরি একটি ব্যবস্থা হিসেবে দাবি করেন প্রকারান্তরে। আর খোদা ও মানুষের মধ্যকার বিনিময়ের আধ্যাত্মিক সারাংশকে একেবারে অবলুপ্ত মনে করাটা তার নিজস্ব বিকার। তার বিচারে সেটি অবলুপ্ত মনে হওয়াটা মানুষের সাথে পরমের সম্পর্কের শুদ্ধতার অবলুপ্তিকে প্রমাণ করে না।
আরকৌনের বিখ্যাত অনুমান হলো কুরআনের প্রজ্ঞা এবং গ্রিক যুক্তিবাদী দার্শনিক মানবতাবাদকে একত্র করার জন্য মুসলিম সভ্যতার প্রাথমিক বিকাশকালে যেসব চেষ্টা হয়েছিল, সেগুলো মহান এবং সেই চেষ্টার ফলে সাংস্কৃতিক যেসব অর্জন নিশ্চিত হয়, তা দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে। ইসলামের সেই সম্পদকে তিনি উদ্ধার করতে চান নতুন অর্থে ও তাৎপর্যে।
কিন্তু ইসলামের মহান সম্পদ সেগুলোই, যা অহি হিসেবে অবতীর্ণ এবং এর মধ্যে পার্থিব-অপার্থিব সঙ্কটের উত্তরণ প্রস্তাব করে ইসলাম। এরই আলোকে গ্রিক দর্শনকে সে মোকাবেলা করেছে। বোঝাপড়া করেছে তার সাথে। এই বোঝাপড়ার নানা ধারা ও ধরন আছে। যারা গ্রিক দর্শনের মন নিয়ে গ্রিক যুক্তিবাদের হাত দিয়ে ইসলামকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছেন, সেই মুতাজিলা চিন্তা বরং আরকৌনের চোখে মহান সম্পদ, মহান অর্জন। আরকৌন যখন ধ্রুপদী যুগের দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক, মানবতাবাদী ইসলামী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনের কথা বলেন, তখন তিনি মুতাজিলাবাহিত সেই সাংস্কৃতিক সম্পদের কথা বলেন।
কিন্তু মুসলিম উম্মাহ মুতাজিলা চিন্তাকে কবুল করেনি; কী তত্ত্বে, কি ব্যবহারে।
এর ধর্মীয় বয়ানকে প্রত্যাখ্যান করেই ইসলামী কালাম শাস্ত্র অগ্রসর হয়েছে এবং জন্ম নিতে পেরেছেন কালামের স্বর্ণযুগের মহান দার্শনিক মনীষীরা। যে অচিন্তিত চিন্তা-ভাবনার জন্য আরকৌন ইসলামের কাছে অনুমতি চান, সেই অনুমতি ইসলাম আগেই দিয়েছে। কিন্তু ইসলামকে অন্য কোনো রূপকল্পে রিপ্লেসমেন্টের অনুমতি দেয়নি। সেটি ইসলামের গোঁড়ামি নয়, আপন সত্যস্বরূপে অবিচল দৃঢ়তা।
আরকৌন যখন মুসলিমদের বলেন শিল্প ও তথ্য বিপ্লবের আত্মীকরণের জন্য, তখন ঠিকই বলেন। যখন তিনি বলেন আধুনিক সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, ধর্মতাত্ত্বিক এবং দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টি অর্জনের জন্য, তখনো ঠিকই বলেন। কিন্তু যখন বলেন ইসলামের নবায়নের কথা, যার মধ্য দিয়ে ইসলাম একেশ্বরবাদী ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতিতে সহাবস্থান ভাগাভাগি করবে, তখন তিনি এমন এক প্রস্তাব করেন, যা ফ্যালাসির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ইসলাম অন্যান্য একেশ্বরবাদী ভূমধ্যসাগরীয় সংস্কৃতির সাথে সহাবস্থান করেছে নিজস্ব নিয়মে। সেটি ছিল সৃষ্টিশীল এবং সুফল দায়ী। সেই সম্ভাবনা ও সামর্থ্য এখনো ইসলাম ধারণ করে। এ জন্য ইসলামের নবায়নের প্রয়োজন নেই আদৌ।
আরকৌন হাদিসকে বানোয়াট আধিপত্য এবং গোঁড়ামিমূলক প্রতিপত্তির ভয়াবহ প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করেন, যা মুসলিম সমাজকে সরাসরি স্থবিরতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল। হাদিসকে তিনি হিজরি দ্বিতীয় শতকের উদ্ভাবন হিসেবে জবরদস্তিমূলক রায় দেন। তার বিচারে হাদিসের কারণে বহুবর্ষজীবী সাম্প্রদায়িক বিভাজনের সৃষ্টি হয়, যা ছিল অমীমাংসিত এবং গুরুতর সমস্যাযুক্ত। তাঁর দৃষ্টিতে হাদিস সাহিত্য উপভোগ করছিল অবাঞ্ছিত প্রাধান্য, যার আশ্রয়ে সম্প্রদায়গুলো নিজ নিজ মতবাদ এবং অ্যাজেন্ডাকে সমর্থন করার হাতিয়ার পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনো সম্প্রদায় নিজেদের প্রমাণ করার চেষ্টা চালাবে, এটি হাদিসের সাথে সম্পর্কিত নয়। এটি চিরন্তন বাস্তবতা। সম্প্রদায়সমূহের জন্মও চিরন্তন বাস্তবতা। বিভিন্ন সম্প্রদায় হাদিসকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করেছে, এটি যদি হাদিসের ক্ষতিকর দিক হয়, তা হলে আল কুরআনকে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আরো বেশি। সেটি কি আল কুরআনের ক্ষতিকর দিক? এবং সে কারণে কি আল কুরআনের প্রাধান্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়?
বস্তুত হাদিসকে অন্যায্য প্রক্রিয়ায় প্রমাণ হিসেবে ব্যবহারের পথ বন্ধ করে দিয়েছে হাদিস বিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানসমূহে রয়েছে তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক বহু শাস্ত্র। হাদিস বিশেষজ্ঞ ইবনুস সালাহ এমন ৬৫ শাস্ত্র নিয়ে সবিস্তারে আলোকপাত করেছেন, যা হাদিস বিজ্ঞানের সাথে সম্পৃক্ত। হাদিস বিজ্ঞানের নির্দিষ্ট ব্যবহারবিধিমূলক শাখাসমূহ হাদিসের প্রয়োগ-অপপ্রয়োগের ওপর রায় প্রয়োগ করে। যা চরিত্রগতভাবে সর্বজনীন এবং ইসলামের বিভিন্ন চিন্তাগোষ্ঠীর মধ্যে এই সব নীতিমালার ব্যবধান খুব প্রকট নয়। হানাফি-শাফেয়ি, মালেকি ও হাম্বলি স্কুলসমূহের হাদিস বিচারের ভিন্নতা কোনো গুরুতর ভিন্নতা নয় এবং সবগুলো বিচারধারাই স্বীকৃত ও যথার্থ। উম্মাহের যে অংশ যে ধারার ওপর আমল করবেন, তাদের জন্য সেই ধারা ন্যায্য। এক ধারা অপর ধারার সাথে প্রধানত তর্ক করে উত্তমতা-অনুত্তমতা নিয়ে, এই তর্কও প্রধানত দলিলসর্বস্ব। স্কলারলি তর্ক, যা বিশেষ পরিসর এবং বিশেষ চরিত্রের সাথে সম্পর্কিত। একে ঘিরে বৃহত্তর বিভক্তি ও সামাজিক সঙ্ঘাতের অনুমোদন ইসলামে নেই। যদিও শিয়ারা ভিন্নভাবে হাদিসকে বোঝেন ও বোঝান। কিন্তু শিয়াবাদের জন্মের পেছনে হাদিস দায়ী নয় বরং শিয়াদের হাতে হাদিসের ভিন্ন চরিত্রের জন্য শিয়াবাদের জন্মই দায়ী। সেই জন্মের মূলে আছে প্রধানত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটন-অঘটন।
উম্মাহর বিভিন্ন অংশের বিভক্তির বেদনাদায়ক বাস্তবতা যেসব কার্যকারণের ওপর প্রতিষ্ঠিত, তার ধর্মতাত্তি¡ক, ঐতিহাসিক, সামাজিক, মনোজাগতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। সব কারণের উপরে আছে রাজনৈতিক কারণ। কিন্তু আরকৌন যেহেতু হাদিসের ধর্মীয় কর্তৃত্বকে অস্বীকার করতে চান, তাই হাদিসকেই বানিয়ে ফেললেন সব কারণের কারণ। কিন্তু বাস্তবতা হলো বিভিন্ন বিবদমান গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে নানা কারণে। তার পরে গোষ্ঠীসমূহ নিজেদের প্রয়োজনে যেখানে যা ব্যবহারযোগ্য মনে করেছে, সে দিকে হাত বাড়িয়েছে। হাদিসের দিকেও তারা হাত বাড়িয়েছে। কিন্তু হাদিস যাতে কোনো গোষ্ঠীর স্বেচ্ছাচারিতার অনুক‚লে প্রমাণ হিসেবে ব্যবহৃত না হতে পারে, ব্যবহৃত হলেও এর ন্যায্যতা যাতে খারিজ হতে পারে, তার সুরক্ষা বলয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উলুমুল হাদিস বা হাদিস বিষয়ক শাস্ত্রপুঞ্জ। হাদিস ও সুন্নাহ যেখানে কুরআনের মাধ্যমে ইসলামের দ্বিতীয় প্রামাণ্য সূত্র বলে প্রমাণিত, সেখানে আরকৌন দাবি করেন ইমাম শাফি প্রথমবার সুন্নাহকে ইসলামের দ্বিতীয় সূত্র বানান। সুন্নাহ থেকে অর্জিত বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও সুন্নাহজাত উদ্ভাবনের ওপর আপত্তি এনেছেন আরকৌন। তার মনোযোগের দিক হলো কী প্রক্রিয়ায় সন্দেহকে সক্রিয় ও প্রভাবশালী করা যায়! তিনি সুন্নাহকে রাজনৈতিক আধিপত্য ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফসল হিসেবে চিত্রিত করেন। যেমনটি করেন গোল্ডযিহার, যোসেফ শাখত প্রমুখ। কিন্তু শেষ অবধি যোসেফ শাখত এই অবস্থান থেকে কিছুটা হলেও সরেছেন। সরেননি তাদের অনুসারী আরকৌন।
আরকৌন প্রায়ই প্রাচ্যবাদী পক্ষপাতিত্ব ও কুসংস্কারের প্রচারক হয়ে ওঠেন। তিনি সব সময় ভয় পান, কোনো বিশ্লেষণ তার আধুনিকতাবাদী পরিচয়কে আহত করে কী না! উদারবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ, উত্তরাধুনিক আরকৌন পশ্চিমা বিশ্লেষণের সব পথ ধরে ইসলামকে বিশ্লেষণ করতে রাজি, শুধু মুসলিম জ্ঞানকলার তুরাস বা জ্ঞানীয় ঐতিহ্য ও পদ্ধতিকে অবলম্বন করতে প্রস্তুত নন।
আরকৌন ইসলামকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেন : প্রথমত, দ্বীন; উপাসনা, আচার ও রীতিনীতির ধর্মীয় ক্ষেত্র। দ্বিতীয়ত, দুনিয়া; বস্তুজগতে অস্থায়ী জীবন। তৃতীয়ত, দাওলাহ; রাষ্ট্র, যা রাজনীতির অন্তর্গত। তার মতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় ক্ষেত্রে ধর্মের আধিপত্যের প্রয়োজন নেই। এখানে অনুসরণ করতে হবে সেই নীতি, যা উচ্চারিত হয়েছিল যিশু খ্রিষ্টের কণ্ঠে : সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও, ঈশ্বরকে দাও ঈশ্বরের প্রাপ্য। কিন্তু আরকৌন এই প্রশ্নের সুরাহা করেননি যে, বাইবেলের নিয়ম দিয়ে কেন মুসলিমদের চলতে হবে? কেন তাদের ধর্মের নানা অংশ ও তার বিধান অনুসন্ধান করতে হবে বাইবেল অধ্যয়নের অভিজ্ঞতার ভেতর? যিশুর বাণীর ভেতর- যেখানে আল কুরআন ও হাদিসে রয়েছে এ বিষয়ক সুস্পষ্ট বয়ান।
ধর্ম থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে আলাদা করা আরকৌনের অন্যতম দাবি। যেহেতু রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ধর্ম থেকে পৃথক করাটাই তার বিচারে ইউরোপীয় উন্নয়নের প্রধান কারণ। পশ্চিমা উন্নয়নে অবশ্য বুর্জোয়ারা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অতএব উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে বুর্জোয়াদের ভ‚মিকার গুরুত্ব দিতে হবে। বুর্জোয়া প্রশ্নে আরকৌনের বয়ানের সারবত্তা স্বতন্ত্র বিষয়। কিন্তু উনিশ শতকের পশ্চিমা উন্নয়নের অভিজ্ঞতা একুশ শতকের প্রাচ্যে কেন ও কীভাবে সমান ফলাফল নিশ্চিত করবে, সেই প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।
পশ্চিমে খ্রিষ্টধর্মের সাথে বিজ্ঞান ও রাষ্ট্রের যে দ্বন্দ্ব হয়েছিল, সেই দ্বন্দ্বের মর্মমূল প্রোথিত ছিল খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্ত্বে। চার্চ আপন পাপ ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে এতে নতুন মাত্রা যোগ করে। এই দ্বন্দ্বের রাষ্ট্র ও বিজ্ঞান বিজয়ী হয় এবং ধর্ম থেকে রাজনীতি-অর্থনীতি বিযুক্ত হয়। কিন্তু এটাই পশ্চিমা উন্নয়নের আসল কারণ, সেটি আরকৌনের অনুমান। তার সাথে সব পশ্চিমা পণ্ডিতও একমত হবেন না। তবে সেখানকার প্রেক্ষাপটে এই পার্থক্যকরণ বস্তুগত উন্নয়নের একটি দরোজা খুলে দিয়েছিল পশ্চিমে। যার সুফল একদিক থেকে ভোগ করেছে তারা। কুফলও ভোগ করছে নানা দিক থেকে।
কিন্তু ইসলাম কি ইহজাগতিকতার পথ রোধ করে? ইসলাম কি বিজ্ঞান চর্চাকে নিষেধ করে বা শেকল পরাতে চায়? ইসলাম কি রাষ্ট্রকে গণকল্যাণ থেকে বিমুখ করে চার্চের বৃহত্তম সংস্করণ বানাতে চায়? ইসলাম কি বৃহত্তর জীবন ও জগতকে বাস্তবতা দিয়ে দেখার ও সঙ্কটের সমাধান উদ্ভাবনের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে? অবশ্যই জবাবগুলো দিতে হয় না দিয়ে। কোনো কোনো মুসলিম যদি এটি করে থাকে, সেটি তার বা তাদের সমস্যা। ইসলাম এমন কিছুকে কখনোই অনুমোদন দেয় না। ফলে ইসলামের সাথে খ্রিষ্টবাদকে সমান্তরাল করা এবং মুসলিমদের উন্নয়নের জন্য ইসলামকে প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা ঔপনিবেশিক প্রচারণার অংশ, ফ্রান্সে বসে যার সূচনা করেছিলেন বিশেষত আর্নেস্ট রেনান। তার জবাবও তিনি পেয়েছিলেন আপন সময়ে। কিন্তু উত্তরাধুনিক পণ্ডিত মুহম্মদ আরকৌন সেই চর্বিত চর্বণেই আছেন!
রাজনীতিকে তিনি দায়ী করেন আধ্যাত্মিকতাকে রাজনৈতিক করে তোলার জন্য এবং অযৌক্তিকতাকে মুসলিমদের পরম মতবাদ বানিয়ে ফেলার জন্য। কিন্তু আধ্যাত্মিকতার সাথে রাজনীতির সম্পর্ক থাকাটা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি ‘অযৌক্তিকতাকে মুসলিমদের পরম মতবাদ’ করার জন্য রাজনীতি একমাত্র দায়ী নয়। তার চেয়েও গুরুতর ভুল হলো অযৌক্তিকতা কোনো কালেই মুসলিমদের পরম মতবাদ নয়। মুসলিমদের বড় একটি অংশ অযৌক্তিকতাকে অবলম্বন করলেও তা নয়। এটি হচ্ছে অষ্টাদশ শতকের পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্ববাদী পণ্ডিতদের বর্ণবাদী দাবি, যার পুনরাবৃত্তি করেছেন আরকৌন।
যখনই মুসলিমরা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা বলে, তখনই তারা একটি কাল্পনিক দুনিয়ায় প্রবেশ করে, আরকৌন এটিই বলতে চান। কিন্তু ঈমানের ব্যাপারগুলোকে কেন বস্তুগত হতে হবে? কেন তাকে হতে হবে ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তির অধীন? এই পরিসরের বাইরে গেলেই কোনো প্রত্যয় যদি কল্পনার অবাস্তব জগত হয়ে ওঠে, তাহলে ধর্মের গোটা কাঠামোটাই হয়ে ওঠে অবাস্তবতার ফসল। নিজের প্রসিদ্ধ সাধারণীকরণের ধারায় আরকৌন দাবি করেন, মধ্যযুগে মুসলিম শাসকরা কখনোই আল্লাহর আদেশের অধীন ভাবেনি নিজেদের। ক্ষেত্র বিশেষে এটা হয়তো ঠিক, কিন্তু সাধারণভাবে এটি কখনোই সত্য নয়। নিজেদেরকে আল্লাহর আদেশের অধীন ভাবেননি, মধ্যযুগে এমন কিছু মুসলিম শাসক ছিলেন বটে। কিন্তু সবাই এমন ছিলেন, এমন দাবি ঐতিহাসিকতার প্রতি অবজ্ঞা।
কুরআনের তাফসিরকে তিনি কখনো স্ট্রাকচারালিজম, কখনো ডিকনস্ট্রাকশন তত্ত্বের আশ্রয়ে বোঝার চেষ্টা করেন। তিনি দেখাতে চান কুরআনের ব্যাখ্যাতাগণ ছিলেন রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গনে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতার শিকার। এই প্রতিযোগিতার ফলাফল হিসেবে তাদের ব্যাখ্যা প্রায়ই অন্যায়ভাবে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির সেবায় নিয়োজিত থেকেছে। কিন্তু কুরআন ব্যাখ্যা মূলত মহানবী সা:-এর ব্যাখ্যাপদ্ধতির সেই সম্প্রসারণ, সাহাবাদের মাধ্যমে যা বিকশিত হয়েছে। এই ঐতিহ্যকে অবলম্বন না করে বা পরিহার করে যে ব্যাখ্যাই সামনে এসেছে, তা উম্মাহ কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছে সেই মাত্রায়, যে মাত্রায় সে আদি উৎস থেকে দূরে সরেছে। ফলে কোনো রাজনৈতিক স্বার্থের পাহাদারির দায়িত্ব পালন করেনি তাফসির।
আরকৌনের ইসলাম চিন্তা শেষ অবধি এই উপসংহারে উপনীত হয় যে, হাদিস, ফিকহ বা তাফসিরের মতো রাজনৈতিক ত্রুটিপূর্ণ ভাষ্যগুলোকে সাধারণত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করে জনগণ। যা একজন বিশ্বাসীর অবয়বধারীর মুখে উচ্চারিত অবিশ্বাসীদের স্লোগান!
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা