০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

দাও ফিরায়ে সে তাওয়া পিঠা

লেখক : জয়নুল আবেদীন - ফাইল ছবি

(শেষ পর্ব)

৭ সেপ্টেম্বর, ২০০৭ সালে গাঁয়ের শতবর্ষের পুরনো মসজিদটি নদীতে তলিয়ে যায়। মুসল্লীরা ইউনিয়ন পরিষদসংলগ্ন আমাদের খালি জমিতে জুমার নামাজ আদায় করতে শুরু করেন। সবার চেষ্টাসহ স্রষ্টার ইচ্ছায় মাত্র ছয় মাসের মধ্যে ১০ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে ‘খাজা চিশতি জামে মসজিদ’ নামে সুরম্য ও সুদর্শন একটি মসজিদ স্থাপন হয়। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এখানে নামাজ আদায় করতে আসেন। জুমা আদায় করার জন্য প্রতি শুক্রবার আমিও যাই গাঁয়ের মসজিদে। আমি যখন ঢাকা হাটখোলার বাসায় তখন ২০০৯ সালের শাবান মাসের শুরুতে গ্রাম থেকে কয়েকজন যুবক আসে। যুবকদের একজন,
# আংকেল, মহাধুমধাম করে শবেবরাত পালন করতে চাই।
# কী করতে হবে?
# মুসল্লীদের আরামের জন্য কয়টা ফ্যান দরকার।
# এলাকায় কারেন্ট নেই, ফ্যান চলবে কী করে?
# জেনারেটরের সাহায্যে।
# ফ্যান-জেনারেটর! অনেক টাকা দরকার!
# আপনি বললেই হয়ে যাবে।
# আমি বললেই হয়ে যাবে, এ কথার অর্থ?
# আমাদের গাঁয়ের বহু ছেলে বিদেশে থাকে। তারা পুরোনো মসজিদ তলিয়ে যাওয়াসহ টাইলস বসানো নতুন মসজিদের কথা শুনে মহাখুশি। সবাই ধুমধাম করে শবেবরাত পালন করতে চায়। আলোকসজ্জায় সজ্জিত করতে চায়। মুসল্লীদের আরামের জন্য জেনারেটরসহ ফ্যান লাগাতে চায়। বিস্ময়করভাবে তিন দিনের ভেতর নতুন জেনারেটরসহ ফ্যানের টাকা জোগাড় হয়ে যায়। বিদ্যুৎহীন নিরেট পল্লী এলাকায় নতুন মসজিদটি পবিত্র শবেবরাতকে কেন্দ্র করে বিরানির আয়োজনসহ আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে ওঠে। সেদিন অনুদানকারী ছেলেদের অনেকেই বিদেশ থেকে চলে এসেছিল। জ্যোৎস্নার আলোয় নামাজ আদায়ের ফাঁকে ফাঁকে গ্রাম ঘুরেছি, বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। যার বাড়িতে গিয়েছি তারাই তাওয়া পিঠাসহ পরিবেশন করেছে নানা প্রকার হালুয়া। সবশেষে গিয়েছি গোরস্তানে। পূর্ণিমার চাঁদচুয়ানো রাতে গোরস্তানে গিয়ে দোয়া-দরুদ পাঠসহ প্রয়াত পরিবার পরিজনের জন্য দুই হাত তুলে দোয়া। ভাবগম্ভীর ধর্ম-কর্মও যে আনন্দঘন-উৎসবমুখর হতে পারে সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম। সেদিনের আনন্দের কথা মনে করে প্রতি বছরই শবেবরাতের রাতে বাড়ি যাই। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে রাতটি পালন করার জন্য মসজিদ কমিটির লোকজন শবেবরাতের কয়েক দিন আগেই আমার সাথে যোগাযোগ শুরু করেন। মহাধুমধামের সাথে নামাজ আদায় করে ভোরে শহরে চলে আসি।

গত দেড় দশক থেকে তাওয়া পিঠার বাধ্যবাধকতার ওপর ধর্মীয় বিধিনিষেধ শুরু। ২০১৫ সালের শবেবরাতের রাতে বাড়ি গিয়ে জানতে পারি, তাওয়া পিঠার প্রচলন বন্ধ, বরং গুনাহ কর্মের মধ্যে পড়ে। বানোয়াট শবেবরাতের কিচ্ছা-কাহিনীও। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, ‘শবেবরাত পবিত্র রজনী’ সমর্থনে, পোস্ট দিতে না দিতেই শুরু হয় প্রতিবাদ। প্রতিবাদসহ পাল্টা প্রশ্ন-
‘শবেবরাত কুরআনের কোথায় আছে! দেখান! যা নবী সা: তাঁর জীবদ্দশায় পালন করেননি তা আমরা পালন করব কেন?’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেউ ছেড়ে দিয়েছে ভিডিও। ভিডিওতে উলামায়ে কেরামদের কেউ কেউ বেশ কিছু হাদিসের বর্ণনাসহ জোরালো ভাষায়, ‘আল্লাহর রাসূল সা: এ রাতে গোসল করেছেন, মসজিদে উপস্থিত হয়ে নফল নামাজ আদায়সহ জিকর-আজকার করেছেন, কোরআন তিলওয়াত করেছেন, সারারাত জাগ্রত থেকেছেন, ওয়াজ-নসিহত করেছেন কিংবা এ রাতে অন্যদের ইবাদত বন্দেগিতে উৎসাহিত করেছেন, প্রমাণিত হয় না। জন্ম-মৃত্যু, হায়াত, রিজিক সম্পর্কে এই রাতে ফয়সালা করার কথা, হালুয়া রুটি বা ভালো খানা তৈরি করে বাড়ি বাড়ি বিলানোর কথা, রাসূল সা: নিজে কিংবা সাহাবায়ে কেরাম দলে দলে কবর জিয়ারতের কথা, এমনকি রাসূল সা:-এর যুগ বাদ দিয়ে খোলাফায়ে রাশেদিনের ত্রিশ বছরের ইতিহাসেও এর কোনো একটা আমল পাওয়া যায় না। মৃত ব্যক্তিদের আত্মা গৃহে আসার কথাও বানোয়াট। মৃত ব্যক্তির আত্মা গৃহে ফেরার ধারণাটা হিন্দুদের ধর্মবিশ্বাস।’

সব কিছু দেখে ভড়কে যাই। তাদের যুক্তির কাছে আমার যুক্তি ম্লান মনে হওয়ায় আস্তে করে উঠিয়ে নিই আমার দেওয়া পোস্টটি। বিষণ্ণ মনে রাত ১০টার দিকে রূপায়ণ টাউন মসজিদে যাই। মসজিদের বাইরে রাস্তার পাশে বেঞ্চে বসে মসজিদ থেকে ভেসে আসা ওয়াজ শুনছিলাম। ওয়াজ করছেন বিশিষ্ট মুফাসসিরে কুরআন রূপায়ণ টাউন মসজিদের খতিব জামাল উদ্দিন সাহেব। তাঁর দরাজ কণ্ঠে ভেসে আসছে, ‘হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) এই রাত সম্পর্কে বলেন যে, আমি একদা রাতে ঘুম থেকে উঠে দেখি, রাসূল সা: তাঁর বিছানায় নেই। ঘরের আশপাশে খোঁজ করে তাঁর সন্ধান পেলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাঁকে জান্নাতুল বাকি এলাকায় পেলাম। তাঁর শয্যাত্যাগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘হে আয়েশা (রা:), হজরত জিব্রাইল (আ:) কিছুক্ষণ আগে আমাকে জানিয়ে গেলেন, ‘হে নবী সা:, শয্যাত্যাগ করেন। আজ শবেবরাতের সেই পুণ্যময় রাত।’

আয়েশা সিদ্দিকা (রা:) এই রাত সম্পর্কে আরো বলেন, ‘একবার রাসূল করিম (সা:) নামাজের সেজদায় গিয়ে উঠছেন না দেখে আমি বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন কি না তা দেখার জন্য তাকে নাড়া দিতেই তিনি জেগে উঠে বলেন, হে আয়েশা, আজ কোন রাত তুমি জানো কি? আজ পবিত্র শবেবরাতের রাত। এই রাতে আল্লাহ পাক দুনিয়াবাসীকে অশেষ করুণায় ভূষিত করেন। এ রাত ভাগ্য ও রহমত বণ্টনের রাত। রাসূল করিম সা: আরো বলেন, শবেবরাতকে সম্মান করো। মানুষের জন্ম, মৃত্যু, মঙ্গলামঙ্গল, রিজিক, দৌলত ও ভালো-মন্দ সবকিছুই এই রাতে নির্ধারণ হয় এবং আল্লাহর দরবারে প্রত্যেক বান্দার আমলগুলো পেশ করা হয়।’

এ বছরও খতিব জামাল উদ্দিন সাহেবের বক্তব্য শোনার জন্য একই স্থানে গিয়ে বসি। ২০১৮ সালে প্রদত্ত বক্তব্যের মতো এবারের বক্তব্য তত জোরালো নয়। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ধর্মের মিশেলে বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতির পাতা থেকে ‘খোদার নামের সিন্নি, পীর-সুফিদের মাজারে মানত, প্রথম বীজ বপনে দোয়ার রেওয়াজ, ফসল কাটার উৎসব, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা-দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষার নামাজ, শিলাবৃষ্টির থেকে রক্ষার জন্য পাট পড়া, মুসলিম সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে বহু আগেই। ১২ রবিউল আউয়াল প্রিয়নবী সা:-এর ইহলোকে আগমন ও গমনের তারিখ। একসময় পবিত্র দিনটি পালন করা হতো মহাসমারোহে। সম্পূর্ণ বিদআত বলে হারিয়ে যাওয়ার তালিকায় এই দিনটিও। শবেবরাত পুণ্যময় রজনীও তালিকা থেকে মুছে যাওয়াসহ স্লো পয়জনিংয়ের মতো তাওয়া পিঠার নাম গন্ধও একদিন মুছে যাবে বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতির পাতা থেকে।

নবী করিম সা: মক্কা ছেড়ে মদিনা যাওয়ার পর মুসলমানের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে শুরু করে। তখন মদিনায় ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ নামে দু’টি উৎসবের প্রচলন ছিল। নও মুসলিমগণও এ দু’টি উৎসবে যোগ দিতেন। উৎসব দু’টিতে কিছু অনৈতিক দিক ছিল। তা লক্ষ করে নবী করিম সা: এ দুই উৎসবের পরিবর্তে ‘ঈদুল আজহা’ ও ‘ঈদুল ফিতরের’ প্রবর্তন করেন। নবী করিম সা: বুঝতে পারতেন, মানুষ মাত্রই পরিমিত পরিমাণ বিনোদন আবশ্যক। শরীর সুস্থ থাকার জন্য গুরুপাক (পোলাও-কাচ্চি) খাবারের সাথে যে কারণে লঘুপাক (সালাদ জাতীয়) খাবার অনিবার্য, সে কারণে মন সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন পরিমিত পরিমাণ বিনোদনও। নবী করিম সা: অনৈতিক বিনোদনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য যেখানে ইসলামী সংস্কৃতিতে বিনোদনের প্রবর্তন করতেন, সেখানে কেউ কেউ অত্যন্ত ভাবগম্ভীর ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত ইসলামী সংস্কৃতিগুলো বন্ধ করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। এই লাগার পেছনে সুদূরপ্রসারী কারো কলকাঠি রয়েছে কি না তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে।

সুধীজনের মতে, এসব প্রচলিত প্রথা ও রীতি-নীতি ইসলামিক সংস্কৃতির অংশ। হাজার বছর থেকে চলে আসা ইসলামিক সংস্কৃতিগুলোয় কোনো অনৈসলামিক কিংবা অনৈতিক দিক নেই। ইসলামিক সংস্কৃতিগুলো বাদ পড়ার কারণে মানুষ ঝুঁকে পড়ছে অনৈতিক ও অনৈসলামিক সংস্কৃতির দিকে। বাড়ছে ভয়ঙ্কর অপরাধ, নোংরামি ও অনৈতিকতা।

সুদূরপ্রসারী কারো কলকাঠি বলার কারণ, মদিনা থেকে শিশু মুহাম্মদ সা:, দাসী উম্মে আইমানসহ মক্কা রওনা হওয়ার পথে বদর প্রান্তরের কাছাকাছি এসে মা আমেনা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মরুভূমিতে শিশু মুহাম্মদ সা: ও দাসী আইমানকে রেখে যেখানে পরলোকগমন করেন সেখানেই সমাহিত করা হয়েছিল মা আমেনাকে। সে সমাধিকে কেন্দ্র করে জনবহুল হয়ে উঠেছিল মরুভূমিও। আমরা ইতিহাসের পাতায় মহাবীর হামজা (রা:)-এর শহীদ হওয়ার স্থানসহ সমাধিস্থল দেখেছি। যেখানে তিনি শহীদ হয়েছেন, এর কয়েক গজ উত্তরেই মহাবীর হামজা (রা:)-এর সমাধিস্থল ছিল। মক্কায় জান্নাতুল মোয়াল্লায় ছিল ইসলামের প্রথম মুসলমান হজরত খাদিজাতুল কুবরা (রা:)-এর সমাধি। হজরত সা: পরলোকগমনের কয়েক মাস পরেই পরলোকগমন করেন মা ফাতিমা (রা:)। জান্নাতুল বাকিতে সমাহিত করা হয় মা ফাতিমাকেও (রা:)।

ইমাম মালিক (রহ:)-এর কথামতে, জান্নাতুল বাকিতে প্রায় ১০ হাজার সাহাবার কবর রয়েছে। এই কবরস্থানের গোড়াপত্তন ইসলামের সূচনালগ্ন থেকেই। হজরত রাসূলুল্লাহ সা: প্রায়ই শেষ রাতে জান্নাতুল বাকিতে যেতেন এবং কবরবাসীদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। হাদিসে আছে, হজরত আয়েশা (রা:) হতে বর্ণিত, ‘হজরত রাসূলুল্লাহ সা: শেষ রাতে বাকির দিকে বেরিয়ে যেতেন এবং বলতেন, ‘হে মুমিন সম্প্রদায়, তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, তোমাদের নিকট এসেছে, যা তোমাদেরকে ওয়াদা দেয়া হয়েছিল, কাল কিয়ামত পর্যন্ত তোমরা অবশিষ্ট থাকবে এবং ইনশাল্লাহ নিশ্চয়ই আমরা তোমাদের সাথে মিলিত হবো। হে আল্লাহ! তুমি বাকিবাসী কবরবাসীদের ক্ষমা করে দাও (সহিহ মুসলিম)। সমাধিগুলো ১৮০৫ সাল পর্যন্ত ছিল। হাজীগণ প্রাণ ভরে দেখাসহ জিয়ারত করতেন। কিন্তু সমাধির ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয়। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে পুনর্নির্মাণের পর ১৯২৫ বা ১৯২৬ কিন্তু আবার ধ্বংস করা হয়। সবই করেছে, ‘ওয়াহাবি’ আন্দোলনের অনুসারীরা। ডি.এফ মুল্লা প্রণীত ‘মুসলিম আইনের মূলনীতি’ আইন শিক্ষার্থীদের পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। গ্রন্থের সূচনা পর্বেই লেখক বলেন, ‘মুসলিম আইনের উৎস চারটি- ১. কোরআন ২. সুন্নাহ ৩. ইজমা ও ৪. কিয়াস। বর্তমান আরবে মুসলিম আইনের পরবর্তী তিনটি আইনের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে।

উপমহাদেশে ইসলাম প্রচারিত ও প্রসারিত হয়েছে সুফিসাধকদের মাধ্যমে, যারা আরব, ইয়েমেন, পারস্য, মধ্য এশিয়া থেকে এ দেশে এসেছিলেন। তাঁরা আরব বণিকদের সাথে পৃথিবীর দূর-দূরান্ত ছড়িয়ে পড়েন। পরে মুসলিম নৃপতিগণের ছত্রছায়ায় দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে তোলেন খানকা, দরবার, মাজার, দরগাহ ইত্যাদি। সমাধি ভাঙার ঢেউ লাগে আমাদের দেশেও। আজমির ও দিল্লি ঘুরতে গিয়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম হজরত খাজা মুঈনুদ্দিন চিশতি (রা:)-এর নির্মোহ জীবনাদর্শ দেখে।

ড. মো: গোলাম দস্তগীরের ভাষায়, ‘ঊনবিংশ শতক সুফিবাদের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই সময় ইউরোপে সুফিবাদের ওপর একাডেমিক গবেষণা শুরু হয়। কেবলমাত্র সুফিবাদ নয়, ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্মীয় শিক্ষা ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে স্থান পায়। এ শতকে সুফিবাদের বিক্ষিপ্ত দর্শনতত্ত্ব সমন্বিত এবং সংগঠিত করা হয় এবং সুফিতত্ত্বসমূহ একটি তরিকা বা সিলসিলার রূপ পরিগ্রহ করে।... ঠিক এ সময় সুফিবাদের প্রসঙ্গে বিরোধিতা চরম আকার ধারণ করে। আর এই বিরোধিতা আসে মূলত দুই দিক থেকে। এদের একটি হলো ‘আধুনিকতাবাদ’, আর অন্যটি হলো তথাকথিত ‘শুদ্ধিবাদী শক্তি’ যা ওহাবিপন্থী হিসেবে পরিচিত’ (he Garden of Truth; The Vision and Promise of Sufism, Islam's Mystical Tradition, New York Harper Collins page 154)

‘ধর্ম থেকে শিরক মুক্তির অভিযান শুরু আবদুল ওয়াহাবের আমল থেকেই। জান্নাতুল বাকি ও জান্নাতুল মোয়াল্লার সব সমাধি গুড়িয়ে ওহাবি আন্দোলনের যাত্রা শুরু যার ফলে, ‘সমগ্র আরব জুড়ে ধর্মের অন্তঃসলিলা মিলাদ মাহফিল, মাজার-সমাধি, খানকা-দরবার, সুফি-সাধক এবং ধেয়ান-দর্শন নেই- নেই সুন্নত-নফলসহ হাত তুলে মুনাজাত পদ্ধতিও। আগাছা পরিচ্ছন্নতার নামে কোনো অদক্ষ মালীর নির্বিচার কাঁচির কচকচানিতে মহীরুহের লতাপাতা, ডালপালা, ছালছিটা ও ফুল পাপড়ি (সুন্না, ইজমা কিয়াস) ছাঁটা হয়ে প্রধান মূলের উপর ন্যাড়া কাণ্ড ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলে যেমন হয়ে পড়ে, ঠিক তেমন হয়ে পড়তে শুরু করেছে মহীরুহের মতো আমাদের শাশ্বত ইসলামও। শানানো কাঁচির কপচানি আরব থেকে ছড়িয়ে পড়ছে বহির্বিশ্বে।’ (আমার দেখা আরব, পৃষ্ঠা ২১০- ২১১)।

সমাজ থেকে শিরক দূর করতে গিয়ে দূর করতে শুরু হয়েছে আমাদের প্রিয়নবী সা: নিয়ে। ড. মো: গোলাম দস্তগীরের ভাষায়, ‘তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সুফিদের মাজার জিয়ারত, মানত, মাজারের ওপর সৌধনির্মাণ, পীরের বাইয়াত গ্রহণ ইত্যাদি পৌত্তলিকতা মাত্র। এমনকি হজরত মুহাম্মদ সা: যেখানে আল্লাহর হাবিব, যার নামের সাথে দরুদ পাঠ করতে হয় সেখানে ওহাবিদের কাছে, তিনি নিতান্তই একজন সাধারণ মানুষ। তাঁর মাজারে গিয়ে ধূলিকণা স্পর্শ করা, পবিত্র বলে ধূলিকণা চুম্বন করা বা কপালে ছোঁয়ানো ফাতিহা শরিফ পাঠ করা, মাজারের দিকে মুখ করে মুনাজাত করা, মাজারের দেয়াল ধরে আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করা ইত্যাদিকে ওহবিরা শিরক বলে মনে করে (বাংলাদেশে সুফিবাদ পৃষ্ঠা ৪৭)।

পবিত্র কুরআনের পরই বুখারি শরিফ মুসলমানদের জন্য মূল্যবান গ্রন্থ। হামিদিয়া লাইব্রেরি কর্র্তৃক প্রকাশিত দ্বিতীয় খণ্ডের ১১২ পৃষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ সা:-এর বিদায় হজ বিষয়ে উল্লেখ আছে; যা পড়েছিলাম ইসলামের ইতিহাসেও। আধুনিক বিশ্বে প্রতিটি উন্নত দেশের সংবিধানে মানুষের যেসব মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হয়েছে সেসব মৌলিক অধিকার চৌদ্দশ’ বছর আগেই সংরক্ষণ করে গেছেন নবী করিম সা:। হজরত মুহাম্মদ সা: এক লাখ ৩০ হাজার মুসলমানের সামনে যে ভাষণ দিয়ে গেছেন, সে ভাষণ বুখারি শরিফের ৯০৮ থেকে ৯১১ নং হাদিসে উল্লেখ রয়েছে। এই ভাষণের আরেক নাম ‘বিদায় হজের ভাষণ’। কারণ এই হজের পূর্বক্ষণে এবং সমাপনের মধ্যে হজরত সা: ইহজগৎ ত্যাগ আসন্ন হওয়ার বিভিন্ন আলামত আল্লাহর তরফ থেকে পেয়েছিলেন। হজরত সা: স্বয়ং বলেছিলেন, ‘এই বছরের পরে এই দিনে এই স্থানে হয়তো তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ আর হবে না।’ বুখারি শরিফের ভাষণটি বর্ণনার সময় যারা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা যেন পরবর্তী উম্মতদের কাছে ভাষণটি প্রচার করেন, এই মর্মে হজরত সা: উপস্থিত সবাইকে নির্দেশও দিয়েছিলেন। খোদ আরব দেশেই বিদায় হজের ভাষণের প্রচার ও প্রয়োগ নেই। প্রচার হয় না হজের সময়ও। মাওলানা আজিজুল হক সাহেব অনূদিত বুখারি শরিফ দ্বিতীয় খণ্ডের ১১৪ পৃষ্ঠায় উল্লিখিত অংশ থেকে জানা যায়, নবী করিম সা: ভাষণের পরিবর্তে, ‘মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধান বা তাঁরই নিয়োজিত বিশেষ প্রতিনিধি, জিলহজের সাত তারিখ মক্কায়, নয় তারিখ আরাফায় আর এগার তারিখ মিনায় ভাষণ দিয়ে থাকেন।’

পাক-ভারতের মুসলমান সমাজ বারবার পতিত হয়েছিল ইতিহাসের ব্লাকহোলে। উদ্ধারের আশায় তাকিয়েছিল ধর্মের শায়েখ-উলামাদের দিকে। ১৭৫৭ সালে প্রহসনমূলক যুদ্ধে ভারতবর্ষে মুসলমানদের শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতন হয়। এই পতনের মধ্য দিয়ে মুসলিম সমাজের ওপর শুরু হয় মহাবিপর্যয়। কোম্পানি আমলে বাংলার মুসলমানগণ পরাজিত জাতি হিসেবে পীড়ন ও বঞ্চনার শিকার হয়ে গভীর হতাশার মধ্যে নিমজ্জিত হন। ব্যবসা, বাণিজ্য, শিক্ষা, চাকরি ও রাজনীতি সব দিক থেকে ছিটকে পড়ে মুসলিম সম্প্রদায়। যেখান থেকে ছিটকে পড়েছিল সেখানে ঘুরে দাঁড়াবার চেষ্টা না করে ইংরেজের সব কিছু বর্জনসহ নিজের তৈরি খোলসে নিজেই প্রবেশ করেন। এ অবস্থায় ধর্মের শায়েরগণ ইসলামের অতীত গৌরব, শৌর্যবীর্য, মহত্ব ও ঐশ্বর্য নিয়ে বস্তুনিষ্ঠ ঘটনার পরিবর্তে অলৌকিক কাহিনী নিয়ে আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষার মিশ্রণে রচনা করেন পুঁথি সাহিত্য; যা এখন সাহিত্যের ডাস্টবিনে আশ্রয় নিয়েছে। পুঁথিসাহিত্যের প্রাচুর্য ও মুসলমান শায়েরদের কর্মকাণ্ড দেখে কবি ফররুখ আহমদ পাঞ্জেরী কবিতায় জানতে চেয়েছিলেন,

‘রাত পোহাবার কত দেরি পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
কোন দরিয়ার কালো দিগন্তে আমরা পড়েছি এসে?’

অ্যানালগ বিশ্ব প্রবেশ করছে ডিজিটাল বিশ্বে। ডিজটাল বিশ্বে নেই কোনো সীমারেখা। বাংলাদেশের আরবি শিক্ষক বাড়ি বসে আরবি পড়াচ্ছেন পেরিস শিশুদের। লন্ডন বসে অফিস চালাচ্ছেন বাংলাদেশে। সুইডেন বসে কিনছেন চাঁদপুরের তাজা ইলিশ। অর্থাৎ ‘ছোট হয়ে আসছে বিশ্ব’। ঠিক এ অবস্থায় আমরা ফিকাহ-ফেসাদ নিয়ে উম্মাদনায় মেতে উঠছি। এক ফেরকা আরেক ফেরকার লোককে কাফির-জাহিল বলছি। এই নিয়ে খুনাখুনিসহ একজন আরেকজনকে খুনসহ জিহবা কেটে নিচ্ছি।

পবিত্র কোরআনুল করিমে, ডজনখানেক সূরায় ডজন তিনেক আয়াতে ‘ধৈর্য’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা ধৈর্য ধরো। ধৈর্য ধারণে প্রতিযোগিতা করো, নিজেরা নিজেদের মধ্যে শৃঙ্খলাবদ্ধ হও এবং সর্বদা প্রস্তুত থাকো, আর আল্লাহকে ভয় করো যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো (সূরা আলই ইমরান আয়াত ২০০)। নবী করিম সা:-এর অসংখ্য ধৈর্য কর্মের মধ্যে নবী করিম সা:-এর পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখা বুড়ির কাহিনী কে না জানে? হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ইসলামে ভালো রীতি চালু করবে, সে তার নিজের এবং সব লোকের সওয়াব পাবে, যারা তাঁর (মৃত্যুর) পর তাঁর ওপর আমল করবে, তাঁদের সওয়াবের কিছু পরিমাণও কম করা হবে না (৮৪) (মুসলিম)। ধৈর্যধারণ না করলে ১৭৫৭-পরবর্তী মুসলমানদের যে হাল হয়েছিল, পুনরায় সেহাল হয়ে নিজের তৈরি খোলসে নিজেরাই প্রবেশ করে একসময় ডিজিটাল বিশ্ব থেকে ছিটকে পড়ব আমরাও।

লেখক : আইনজীবী ও কথাসাহিত্যিক
E-mail: [email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
দেশের ৬৯ কারাগারের মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ : কারা মহাপরিদর্শক আমরা হিন্দু-মুসলমান একসাথে লড়াই করে দিল্লির দাসত্বকে খান খান করে দেবো : রিজভী আজমির শরিফ : খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহের ইতিহাস জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া ও আমেরিকার বাকবিতণ্ডা ‘শেখ হাসিনা সরকার সবকিছু ধ্বংস করে গেছে’ পুলিশের ওপর হামলার মামলায় ১২ আসামির রিমান্ড মঞ্জুর দেনার দায়ে শক্ত অবস্থান হারাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র? বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করছে : প্রধান উপদেষ্টা নতুন মামলায় আনিসুল-ইনু-রাশেদ-পলকসহ গ্রেফতার ৯ যুবদল নেতা শামীম হত্যা : আ.লীগের রোকেয়া-মোস্তফা রিমান্ডে লেবানন থেকে বৃহস্পতিবার দেশে ফিরবেন ১০৫ বাংলাদেশী

সকল