জান্দিশাপুরে জ্ঞানহত্যার মিথ ও মুসলিম বিজয়
- মুসা আল হাফিজ
- ১৪ মার্চ ২০২৩, ২০:২১
খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে প্রথম শাপুরের কাছে পরাজিত হন ভ্যালেরিয়ান। শাপুরের হাতে ধ্বংস হয় অ্যান্টিওক শহর। বন্দী করা হয় ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, ডাক্তার, কারিগর ও যাজকসহ অ্যান্টিওকের জনগণকে। এই বন্দীদের দিয়ে ইরানে তৈরি করা হয় একটি নতুন শহর, যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অ্যান্টিওকের মতো। শাপুরের নাম যুক্ত করে এই শহরকে বলা হতো জান্দিশাপুর। ইরানের প্রাচীনতম খ্রিষ্টান শহরগুলোর মধ্যে জান্দিশাপুরের খ্যাতি তৈরি হয়। শহরটিতে নেস্টোরিয়ান খ্রিষ্টানদের কার্যকলাপ ছিল ব্যাপক। গির্জা ও উপাসনালয়গুলোতে ছিল তাদের আধিপত্য। দ্বিতীয় শাপুরের সময় শহরটি হয় সাম্রাজ্যের রাজধানী। কোনো কোনো ঐতিহাসিক সূত্র অ্যান্টিওক বিজয় এবং জান্দিশাপুরে বন্দীদের স্থানান্তরের কৃতিত্ব দেয় অনুশিরভান খসরো প্রথমকে। বাইজেন্টাইন সম্রাট জেনো এডেসার জ্ঞানকেন্দ্র বন্ধ করে দেন ৪৮৯ সালে। এখানকার পণ্ডিতরা যান নুসায়বিনে, সেখানে তারা নাসিবিন স্কুল আবার চালু করেন। কিছুকাল পরে, এই বিজ্ঞানীরা ইরানে প্রবেশ করেন এবং জান্দিশাপুরে মিলিত হন।
আরেক দিক থেকে জ্ঞানীদের অভিবাসন হয়েছিল এই শহরে। সেটা সম্রাট খসরু পারভেজ (৫৩১-৫৭৯) এর শাসনামলে। ৫২৯ খ্রিষ্টাব্দে এথেন্সে যখন জ্ঞানের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন চলছিল এবং বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রাচীন একাডেমি, তখন গ্রিসের বহু দার্শনিক সাসানিয়ান সাম্রাজ্যে আশ্রয় লাভের চেষ্টা করেন। সাসানি সশ্রাট জ্ঞানীদের স্বাগত জানান। নেস্টোরিয়ান পণ্ডিতদের হত্যা ও নির্বাসন দেয়া হচ্ছিল জাস্টিনিয়ানের আদেশে। এরই মধ্যে পারস্যের জান্দিশাপুরে তৈরি হলো মেডিক্যাল স্কুল। এর পেছনে সেখানে নির্বাসিত জ্ঞানীদের আত্মনিয়োগ ও পারস্য রাজার পৃষ্ঠপোষকতা যৌথভাবে কাজ করেছিল। ৩৭৬-৭৭ সালে জান্দিশাপুরে প্রতিষ্ঠিত হয় এক মঠ, সেটাই পরবর্তীতে ধর্মতাত্ত্বিক বিদ্যার কেন্দ্র হয়ে ওঠে এবং বেথ হুজায়ের মেট্রোপলিটানেটের হাত ধরে একই সাথে হয়ে ওঠে ধর্মতাত্ত্বিক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান। সময়ের ব্যবধানে জান্দিশাপুরের গৌরব অস্তমিত হয় এবং এর বিনাশের জন্য দায়ী করা হয় ইসলামের বিজয়কে।
মুসলিম বিজয়কে যেহেতু কলঙ্কিত করতে হবে, অতএব জান্দিশাপুরকে খুবই বড় অবয়বে উপস্থাপন করা হয় এবং এর সমাপ্তির সাথে জুড়ে দেয়া হয় মুখরোচক নানা গল্প, যা তৈরি হয় আরবদের ঘিরেই।
প্রকল্পটি মূলত পারসিক জাতীয়তাবাদীদের। তারা ইরানে আরব বিজয়কে বরাবরই দেখাতে চেয়ছে আগ্রাসন হিসেবে। তাদের দাবি হলো, ইসলাম ইরানে এসে যদি কিছু দিয়ে থাকে, তাহলে ধ্বংসও করেছে অনেক কিছু। সেই ধ্বংসের স্মারক হিসেবে পেশ করা হয় জান্দিশাপুরকে। শহরের বিদ্যালয় ধ্বংসের জন্য মুসলিম বিজয়কে দায়ী করেন মূলত আবদুল্লাহ ইবনে তাহির যুল ইয়ামিনাইন (আনুমানিক ৭৯৮-৮৪৪/৫)। আব্বাসি আমলে তিনি ছিলেন প্রতাপশালী এক পারসিক। খলিফা আমিন ও মামুনের মধ্যে ভয়াবহ যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন খোরাসানের সেনাপ্রধান। পারস্যের সৈন্যদের নিয়ে তিনি খলিফা মামুনকে সাহায্য করেন। বিপরীতে আরব সৈন্যদের নিয়ে খলিফা আমিনকে সহায়তা করছিলেন সেনাপতি আলী ইবনে ঈসা। আলী ইবনে ঈসাকে পরাজিত করেন ইবনে তাহের। আরব সৈন্যদের উচ্ছেদ করে তিনি বাগদাদ দখল করেন। খলিফা আমিনকে তিনিই হত্যা করেন এবং খলিফা মামুনের শাসনকে নিশ্চিত করেন। একজন আরববিরোধী হিসেবে তিনি ছিলেন খুব বিখ্যাত। আরবদের ত্রুটি ও অসৎ দিক অনুসন্ধান ছিল তার অন্যতম অন্বেষা। যেখানেই যা পেতেন, তা সংগ্রহ করতেন। তার পিতা তাহের ছিলেন আরববিদ্বেষের জন্য অধিকতর বিখ্যাত। তিনি আরবদের নিন্দায় কৌতুককর নানা উপাখ্যান নিজেই সাজিয়ে নিতেন। সেসবের একটি সঙ্কলন তৈরি করেন তিনি। বিখ্যাত সেই সঙ্কলনের নাম হলো মাসালিবে আরব, যা তখনকার পারসিক জাতীয়তাবাদীদের কাছে মহান কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। খলিফা হারুনুর রশিদের চার পাশে যে পারসিক প্রভাববলয় ছিল, তার আব্দারে খলিফা তাহিরকে এ গ্রন্থের জন্য ত্রিশ হাজার দিনার বা দিরহাম পুরস্কার প্রদান করেন। খলিফা হারুনের মৃত্যুর পরে খলিফা মামুনের ওপর আবদুল্লাহর প্রভাব ছিল অপ্রতিহত। জাজিরা, মিসর, নিশাপুর, খোরাসান ইত্যাদিতে আরবদের বিরুদ্ধে তার আক্রমণ ও সহিংস প্রয়াস প্রসিদ্ধ।
শেষ অবধি তিনি আব্বাসিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে প্রথমবারের মতো খোরাসানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বাধীন ইরানি শাসন; তাহেরিয়ান রাজবংশ। জান্দিশাপুর ধ্বংসের জন্য আরবদেরকে দায়ী করে তৈরি মিথকে প্রতিষ্ঠার পেছনে আপন প্রভাবকে কাজে লাগান আবদুল্লাহ। দৌলত শাহ সামারকান্দির ‘তাযকিরাতুশ শুয়ারা’ গ্রন্থে জান্দিশাপুর ধ্বংসের জন্য আরবদের দায়ী করা হয়েছে আবদুল্লাহ ইবনে তাহির এর ভাষ্যে ও সূত্রে।
আধুনিক কালপর্বে একে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যম বহুভাবে লক্ষণীয়। এমনকি ইরানের পাঠ্যপুস্তকেও এই ধ্বংসের গল্পকে স্থান দেয়া হয়েছিল। ব্রিটিশ পণ্ডিত স্যার জন ম্যালকম (১৭৬৯-১৮৩৩) থেকে নিয়ে লেবানিজ লেখক জুর্জি জয়দান (১৮৬১-১৯১৪) একে সত্য হিসেবে দেখার চেষ্টা করেন নানাভাবে। জয়দান আবদুল্লাহ ইবনে তাহিরের চেয়ে বরং ইবনে খালদুনের একটি ভাষ্যকে অবলম্বন করেন।
আবদুল্লাহ ইবনে তাহেরের ন্যায় অনেক ইরানিই ছিলেন যারা আরববিরোধী, আত্মগর্বী। ইসলামপূর্ব পারস্যের নানা স্মৃতিচিহ্নের প্রতি তাদের ছিল প্রচণ্ড অহং। তারা দেখাতেন, আরবদের চেয়ে কত উপায়ে পারসিকরা শ্রেষ্ঠ। তারা জান্দিশাপুরের গল্পকে এত বেশি প্রচার করেছেন যে, কিছু আরব ঐতিহাসিকও এই প্রচারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে আছে ঐতিহাসিকদের মহান গুরু ইবনে খালদুনের নাম!
সর্বজনীন ইতিহাসে তার বিখ্যাত মুকাদ্দিমা বা মুখবন্ধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছে। মুকাদ্দিমায় তিনি একটি অধ্যায় হাজির করেছেন, ‘আল উলুমুল আকলিয়া ওয়া আছনাফুহা’ বা বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞান ও তার শাখা-প্রশাখা শিরোনামে। এতে ইবনে খালদুন জানান, ‘ইরান বিজয়ের সময় এ অঞ্চলের বেশির ভাগ ভূমি আরবদের হাতে এলো। এখানে ছিল অনেক বই। সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস চাইলেন বইগুলো আরবিতে অনুবাদ করাবেন। এ জন্য হজরত উমরের কাছে পত্র লিখলেন। হজরত উমর আদেশ করলেন বইগুলোকে পানিতে ফেলে দেয়ার জন্য। তিনি বললেন : আল্লাহ্ হেদায়েতের জন্য আমাদের ওই সব গ্রন্থ হতে উত্তম কিছু দান করেছেন। এসব গ্রন্থে যদি কোনো পথভ্রষ্টতা থাকে তবে মন্দ হতে তিনি আমাদের রক্ষা করুন। ফলে বইগুলোকে আগুনে পোড়ানো হয় কিংবা পানিতে ভাসানো হয়। যার ফলে ইরানিদের লিখিত জ্ঞান এর সাথে বিলুপ্ত হয়।
ইবনে খালদুন চতুর্দশ শতকের মানুষ। অষ্টম শতকের ঘটনাকে বর্ণনা করতে হলে শক্তিশালী সূত্র লাগবে তার। এ ঘটনার কোনো শক্তিশালী সূত্র নেই। যদিও ইবনে খালদুনের বিচারে অতীতের ঘটনাকে বিচারের ক্ষেত্রে শক্তিশালী সনদ বা সূত্রের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যথার্থতা ও বস্তুনিষ্ঠতা। ইরানিদের জ্ঞানসম্পদ বিলুপ্ত করে দিলেন হজরত ওমর রা:। অভিযোগটি কত বড় ও ভয়াবহ ইবনে খালদুন নিশ্চয় জানেন। কিন্তু জ্ঞান সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এ ঘটনা যায়? অতীতের বিভিন্ন জাতির জ্ঞানের সাথে মুসলমানদের আচরণ স্থির করে দেয় কুরআন ও সুন্নাহ। কুরআন ও সুন্নাহ কি প্রয়োজনীয় কোনো জ্ঞানকে ধ্বংস করার অনুমতি দেয়, যেখানে জান্দিশাপুরের জ্ঞানসম্পদ মূলত ছিল ডাক্তারি, গণিত ও গ্রহ-নক্ষত্র বিষয়ক! খ্রিষ্টীয় ধর্মতত্তে¡র বইও ছিল এবং তাকেও ধ্বংসের বিধান ইসলামে নেই। বরং হজরত ওমর রা:-এর অন্যতম পরামর্শক আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: পূর্ববর্তী জাতি ও অন্যান্য ধর্মসংশ্লিষ্ট জ্ঞানসমূহের ওপর বিশেষজ্ঞ ছিলেন। এ ঐতিহ্য তৈরি হয় মহানবীর শিক্ষা থেকে। তিনি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে সালাম রা:-এর সেই জ্ঞানকে সত্যপ্রমাণে কাজে লাগিয়েছেন, যে জ্ঞান তিনি আহরণ করেন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ থেকে। তিনি হজরত জায়েদ ইবনে সাবিতকে রা: আদেশ করেন হিব্রু শিখতে, যা মূলত ইহুদিদের ধর্মীয় ভাষা। যদিও হজরত ওমর রা: একদা যখন প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের পাতাগুলো নিয়ে আসেন মুগ্ধতাসহ, তখন তিনি সেই মুগ্ধতাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ মহানবীর মাধ্যমে ইসলাম পূর্ণতা লাভ করেছে। মুসলিমরা ধর্মের জন্য অন্য কোনো প্রাচীন গ্রন্থের দিকে হাত বাড়াতে পারে না। ধর্মের সব বিধান ও বিশ্লেষণ ইসলামে রয়েছে। কিন্তু কৃষি, ভূগোল, গণিত, ভাষাতত্ত্ব, ইতিহাস, দর্শন, চিকিৎসা, সমর, যোগাযোগ, স্থাপত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেকোনো জাতির জ্ঞানসম্পদকে ইসলাম অভিনন্দিত করে। অন্যান্য জাতির চর্চিত দর্শন, রাষ্ট্রতত্ত্ব, অর্থনীতির কোনো বিষয় যেখানে ইসলামের কোনো নীতিকে যেখানে উত্ত্যক্ত করবে, সেখানে উলামার দায়িত্ব হলো জ্ঞানীয়ভাবে এর মোকাবেলা করা, ইসলামের নীতি ও দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতাকে প্রমাণ করা, মুসলিমরা সেটাই করেছেন, কোনো জাতির জ্ঞানকে ধ্বংস করেননি। এমনকি পূর্ববর্তীদের ধর্মতত্ত্বকেও একই নীতির চোখে দেখা হয়েছে। ইবনে খালদুন ইরানের জ্ঞানের কথা বলেছেন, জান্দিশাপুরকে আলাদাভাবে উল্লেখ করছেন না। তার বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি না গ্রন্থ ধ্বংস আসলে কোথায় হয়েছিল? তবে ইরানের জ্ঞানের রাজধানী মূলত ছিল জান্দিশাপুর। জান্দিশাপুর ছাড়া ইরানের বলখ, বুখারা, নেশাবুর, হামাদান ইত্যাদিতে লাইব্রেরি ছিল। কিন্তু কোথাও মুসলমানরা জ্ঞান ধ্বংস করেছেন, এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সেকালের ঐতিহাসিক দলিলপত্রে তৎকালীন ইরানের কোনো লাইব্রেরি বা জ্ঞানসম্পদ বিনাশের সাক্ষ্য মেলে না। ইবনে খালদুনের বয়ানকে জান্দিশাপুরের ক্ষেত্রে প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন অনেকেই। কিন্তু সেখানে কি আসলেই জ্ঞানহত্যা হয়েছিল, যার ফলে ইরানের জ্ঞানই বিলুপ্ত হয়ে গেছে? যেখানে মঙ্গোল আক্রমণের মতো একটি বর্বর আগ্রাসন ফারসি ও আরবি ভাষার বৈজ্ঞানিক কাজগুলোকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে পারেনি, সেখানে মুসলিমরা ইরানের সব জ্ঞান ধ্বংস করেছেন, দাবি করতে হলে মোঙ্গলদের চেয়ে অনেক বেশি বর্বরতা থাকতে হবে মুসলিম বিজয়-অভিযানে।
কিন্তু মোটেও তা ছিল না। মুসলিম বিজয় ছিল ইরানিদের জন্য পরিত্রাণ, করুণালাভ ও উত্তরণ। এর ফলে ইরানের জ্ঞানের বিলুপ্তি ঘটেনি এবং প্রাচীন পারসিক যেসব জ্ঞানসম্পদের সঞ্চয় রয়েছে, তা মূলত সংরক্ষিত হয়েছে মুসলিমদের আরবি অনুবাদের মধ্য দিয়ে। বস্তুত প্রাচীন ইরানে লেখালেখির তেমন প্রচলন ছিল না। পাহলভি ভাষাও ততটা সমৃদ্ধ ছিল না। ইমাম জাহিজ তার আল মুহাসিন ওয়াল আযদাদ’ গ্রন্থে লিখেন, ‘ইরানিরা গ্রন্থ প্রণয়নে তেমন আগ্রহী ছিল না, তারা স্থাপত্য শিল্পে অধিকতর আগ্রহী ছিল।’ ‘কোনো কোনো পণ্ডিতী সূত্র জানায় যে, সাসানি আমলে যারথুস্ত্র ধর্মে লেখার প্রচলন ছিল না, এমনকি গবেষকগণের মতে যারথুস্ত্রদের ধর্মীয় গ্রন্থ আবেস্তার পাণ্ডুলিপির অনুলিপি তৈরিও নিষিদ্ধ ছিল।’ আবেস্তার প্রাচীন অনুলিপি যে খুব কম পাওয়া যায়, এর কারণ মূলত সেটাই। আলেকজান্ডার যখন ইরান আক্রমণ করেন, তখন আবেস্তার দু’টিমাত্র পাণ্ডুলিপি বিদ্যমান ছিল, যার একটি ভস্ম হয় আলেকজান্ডারের হাতে। তবুও মুসলিম আমলে ইরানের যে জ্ঞানসম্পদ সুরক্ষিত হয়েছে, তার পরিমাণ অতীতের যে কোনো জাতির প্রাচীন জ্ঞানসম্পদের তুলনায় কম নয়। আরবদের বিজয়ের আগে পারস্যে জ্ঞানের বিরুদ্ধে চলছিল অভিযান। সাসানী আমলে প্রতিষ্ঠিত যরথুস্ত্রীয় পুরোহিত নিয়ন্ত্রিত শাসন ব্যবস্থা যেহেতু জ্ঞানবিরোধী অবস্থান নিয়েছিল, তাই নিজেদের অঞ্চলে জ্ঞানের বিকাশকে তারা প্রতিরোধ করতেন। এ আমলের শেষ দিকে পুরোহিত ও রাজকীয় ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ব্যাপক চরিত্রিক স্খলন ও বিচ্যুতি দেখা দেয় এবং এ ধর্মের বিভিন্ন বিচ্যুত দলের সৃষ্টি হয়। তাদের অধীনস্থ কোনো জ্ঞানকেন্দ্রের জন্য তখন কোথাও আনুকূল্য ছিল না।
জান্দিশাপুরের বিদ্যালয় যতটা না ইরানি সংস্কৃতিকে বহন করত, তার চেয়ে বেশি খ্রিষ্টীয় সংস্কৃতির ধারক। রোমক-খ্রিষ্টান মন ছিল তার মধ্যে। রোমক সম্রাটরাও তাতে সাহায্য করতেন। কিন্তু রোমকদের অবক্ষয়ের ফলে তাও অবসিত হয়। ফলে জান্দিশাপুর আপন জৌলুশ হারায়।
মুসলিমদের ইরান বিজয়ের পরে জান্দিশাপুরের জ্ঞানচর্চা নতুন মাত্রা লাভ করেছে। এখানকার বিদ্যালয় প্রধানত ছিল একটি চিকিৎসা শিক্ষাকেন্দ্র। এ বিদ্যালয় আরবদের দ্বারা কোনোভাবেই আক্রমণের শিকার হয়নি কখনো। চতুর্থ হিজরি শতাব্দী পর্যন্ত বিদ্যালয়টি চালু ছিল। খলিফাদের আমলে এ শিক্ষাগার অক্ষত ছিল, উমাইয়া আমলেও ছিল। মুসলমানদের হাতে জান্দিশাপুর বিজিত হয় ১৯ হিজরিতে। (৬৪০/৪১ খ্রিষ্টাব্দ)। অধিকাংশ ঐতিহাসিকের মতে, শহরটি মুসলমানরা অধিকার করেন কোনো রক্তপাত ছাড়াই। ড. খলিলী নাজমাবাদী তার তারিখে ইরান বাদ আয ইসলাম গ্রন্থে লিখেন, এক ইরানি ক্রীতদাসের আস্থার প্রতিদান দিয়ে মুসলমানরা শহরের কোনো ক্ষতিসাধন করেননি। জার্মান ঐতিহাসিক বার্টোল্ড স্পোলারও (১৯১১-১৯৯০) একই সত্য স্বীকার করেন। তার বিখ্যাত বই iran in the early islamic period: politics, culture, administration and public life between the arab and the seljuk conquests, 633-1055। এতে তিনি দেখান জান্দিশাপুরের সম্ভ্রান্তরা শুধু মুসলিমদের হাতে শহর সমর্পণ করেননি, বরং নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছা ও জ্ঞান অনুযায়ী ইসলাম গ্রহণ করেন। শুধু জান্দিশাপুরে নয়, এর আশপাশেও থাকত বহু খ্রিষ্টান।
স্পোলারের মতে, তারা এই নগরে মুসলিম জয়ের প্রাক্ষালে সবচেয়ে কম ঝামেলা দেখেছে। এখানে জ্ঞান সম্পদের বিনাশ ঘটলে জনগণ মুসলিমদের শ্রদ্ধা করত না। অন্তত ইসলাম গ্রহণ করত না। স্পোলার দেখান, মুসলিম বিজয়ের পরেও জান্দিশাপুর স্কুল চালু থেকেছে। এখানকার লোকেরা তাদের সামাজিক, ধর্মীয় ও বৈজ্ঞানিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। বরং এই বৈজ্ঞানিক কেন্দ্র মুসলমানদের শাসনামলে আরো উন্নতি লাভ করে, একটি বৈজ্ঞানিক ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
মুসলিমরা জান্দিশাপুরের ক্ষতি করার চেয়ে বরং জান্দিশাপুর মুসলিম সভ্যতার ক্ষতি করেছে। ইসলামকে একটি ইরানি অবয়ব দেবার চেষ্টা করেছে এবং এখানকার পণ্ডিতরা এ ক্ষেত্রে যে ধারা গঠন করেন, তা বহু শতাব্দীর বিবর্তনে মুসলিম জীবনে নানা সঙ্কটের জন্ম দিয়েছে। অপর দিকে মুসলিমরা জান্দিশাপুরের ডাক্তারি বিদ্যাকে নিজেদের প্রজাকল্যাণে কাজে লাগান।
উইল ডুরান্ট দেখিয়েছেন এ সময়ের মধ্যে ইসলামী অঞ্চলে স্থাপিত চৌত্রিশটি হাসপাতাল দেখা যাচ্ছে, যার সবগুলোই দৃশ্যত ইরানের জান্দিশাপুরের বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতালের পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়েছিল।
ইতিহাসে বনি উমাইয়া খলিফাদের কয়েকজন বিশেষ চিকিৎসকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যাদের অধিকাংশই ছিলেন খ্রিষ্টান। আব্বাসি আমলে জান্দিশাপুর বিদ্যালয় ও বাগদাদের মধ্যে দেখা যায় বিশেষ সংযোগ। খলিফা মনসুর অসুস্থ হলে ডাক্তার জেরজিস বিন বখতিশুয়াকে বাগদাদে তলব করেন। এই ঘটনা জান্দিশাপুর বিদ্যালয়ের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট। কারণ এই সময় থেকেই জান্দিশাপুরের ডাক্তাররা বাগদাদে আসতে থাকেন ব্যাপকভাবে। তারা প্রধানত আসতেন মর্যাদা ও সম্পদ অর্জনের জন্য। এখানে বিকাশের ক্ষেত্র ছিল অনেক, ডাক্তারির ফি ছিল বিপুল। অচিরেই জিবরাইল বিন বখতিশুয়া হন খলিফা হারুন ও মামুনের ডাক্তার। তিনি দরবারের নৈকট্যের কারণে অর্জন করেছিলেন প্রচুর সম্পদ ও প্রতিপত্তি। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিকেন্দ্র হিসেবে বাগদাদ ছিল তখনকার সব জ্ঞানীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। জান্দিশাপুরের গুরুত্বপূর্ণ সব পণ্ডিতই একে একে বাগদাদে অবস্থান নিলেন।
জান্দিশাপুরের প্রাণভোমরা ছিলেন বাখতিশু পরিবারের পণ্ডিতরা। এ পরিবার বাগদাদে স্থায়ী হয়।
পরিবারের ১২ জন সদস্য কয়েক প্রজন্ম ধরে খলিফাদের উপদেষ্টা এবং চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং চিকিৎসাসংক্রান্ত বই পুস্তক অনুবাদের কাজেও নিয়োজিত থাকেন। বাগদাদে যখন বায়তুল হিকমাহ প্রতিষ্ঠিত হলো, সেখানে সিরিয়াক, গ্রিক, পাহলভি এবং সংস্কৃত থেকে আরবি ভাষায় বই অনুবাদে নেতৃত্ব দেন নেস্টোরিয় ডাক্তার হুনাইন বিন ইসহাক। এ সময়ে জান্দিশাপুরের জ্ঞানসম্পদকে কাজে লাগিয়ে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হন ইসা বিন সাহার বখত, ঈসা বিন শাহলাকা, ইব্রাহিম সেরাফিয়ন, ইউহান্না ইবনে বাখতিশু উবায়দুল্লাহ বিন বাখতিশুসহ অনেকেই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে জান্দিশাপুর মুসলিমদের হাতে বিনাশ হবে দূরে থাক বরং বিকশিত হয়েছে। এর জ্ঞানীরা ও জ্ঞানসম্পদ ধ্বংসের কবলে পড়ার বদলে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপিত ও বরেণ্য হয়েছে।
জান্দিশাপুরের পণ্ডিতরা বরং এই উদযাপনের সুযোগে রাজধানীর নতুন কেন্দ্রে নিজেদের সমৃদ্ধি কামনা করেছেন। বাগদাদে এসেছেন দলে দলে। ফলে জান্দিশাপুর পাদপ্রদীপের আড়ালে চলে যায়। যেভাবে ইতিহাসের নানা প্রান্তে নিজের গুরুত্ব হারিয়েছে বহু বিদ্যাকেন্দ্র। ফলে পারস্যে মুসলিম বিজয়ের ওপর জান্দিশাপুরে জ্ঞানহত্যার অভিযোগ আরোপ শুধু অনৈতিহাসিক নয়, মিথ্যার চর্চাও বটে!
লেখক : কবি, গবেষক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা