মুরগি কেনারও সাধ্য নেই
- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ১২ মার্চ ২০২৩, ২০:১৪, আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২৩, ০৬:৩৬
কোথায় সঙ্কট তৈরি করেনি এই বিনা ভোটের সরকার, সঙ্কট কখনো সৃষ্টি হয়, কখনো সরকার সঙ্কট তৈরি করে। এ যেমন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি, নিয়ন্ত্রণহীন দ্রব্যমূল্য, অবারিত লুট, অর্থপাচার। কোনো কোনো পদক্ষেপ একেবারে মানুষের গায়ের ওপর এসে পড়ে। কোনো কোনো সঙ্কট দূরবর্তী। কে কোথায় টাকা পাচার করছে, তা আমাদের সরাসরি গায়ে লাগে না। উদ্বিগ্ন হই। তারপর কী হলো দেখার জন্য অপেক্ষা করি। এর মধ্যে খবর ছাপা হয়, ছাত্রলীগ কোথায় কোথায় লুট করছে। চাঁদাবাজি করছে। চাঁদার জন্য ছাত্রদের হলগেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে, গণরুমে কিভাবে একজন ছাত্রীর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরিয়েছে। নির্মাণ শেষ হওয়ার আগে সেতু ভেঙে পড়েছে। এ সেতু যাদের চলার পথে তারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয়। আমরা দূর থেকে তা অনুধাবন করার চেষ্টা করি। ছাত্রলীগের নির্যাতনের কাহিনী পড়ে শিউরে উঠি এবং আমরা নিশ্চিত জানি এসব অপরাধের কোনো বিচার হবে না।
ছাত্রলীগ ও পুলিশের অপরাধের দু’টি বিচার আমরা লক্ষ্য করি। ছাত্রলীগের ক্ষেত্রে তা হলো, অল্প কিছু দিনের জন্য সাময়িক বহিষ্কার, সাময়িক বহিষ্কারের মধ্যে এবং তারপরও তারা তাদের স্বমূর্তিতে তাদের অপকর্ম চালিয়ে করেছে অপরাধ। বিচার যেন সাময়িক বহিষ্কার? কেনো তাদের আইনের আওতায় নিয়ে বিচার করা হবে না? এ প্রশ্ন করা যায় না। প্রশ্ন করতে ভয়- যদি সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের দায়ে আটক হয়ে যাই। এ এমন নিগড় যা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন। এ ধরনের সমালোচনাকে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতা বলেও চিহ্নিত করতে পারে। মানুষকে এভাবে ভয়ের ভেতরে আবদ্ধ করে ফেলেছে সরকার।
পুলিশ যখন হত্যা করে, গুম করে, নির্যাতন করে, তখন তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি ‘ক্লোজ’ করা বা বদলি করা। এটা কেমন করে শাস্তি হয়? বদলি করে যেখানে পাঠানো হয়, সেখানেও সে যে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করবে না, তার নিশ্চয়তা নেই। ক্লোজ করলে কিছু দিন পর অন্য কোনো থানায় তার পোস্টিং হয়ে যাবে। আদালতে যেতে পারে কিন্তু আদালতে গেলেও ন্যায়বিচার পাওয়া যাবে- এমন আশা ক্রমে দুরাশায় পরিণত হয়ে পড়েছে। উচ্চ আদালতও সব ক্ষেত্রে স্বাধীন এমন দাবি করা যায় না। তাই যদি হতো, তা হলে ক্যাসিনো সম্রাট বা মোমিনুল হকরা নির্বিঘ্নে জামিন পেত না। ক্যাসিনো ঘটনার পর সম্রাট যত দিন জেলে ছিলেন, তার সবটা সময় ছিলেন হাসপাতালের ভিআইপি কেবিনে। ক্যাসিনো সেনাপতি মোমিনুল হক পাসপোর্ট নিয়ে দেশ ছেড়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বিদেশে কোটি কোটি ডলার পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এরা দুর্দান্ত সন্ত্রাসী। কিন্তু ব্যবস্থা কিছুই নেয়া হলো না। মোমিনুল হক চোরা পথে দেশে ফিরেছেন। এই নেতা ফিরে এসে তার স্বপদে বহাল হয়েছেন। কেউ জিজ্ঞেস করেননি। কোন পথে কি করে তিনি ফিরে এলেন। এদের প্রতি সরকারের এই নমনীয় মনোভাবের কারণ, এসব টাকাওয়ালা সন্ত্রাসীদের আসন্ন নির্বাচনে কাজে লাগবে। তাই চুপ থাকাই তাদের জন্য বেহতের।
এর মধ্যে সরকারের রিজার্ভ ফাঁকা কিন্তু ফাঁকা বুলির কমতি নেই। কখনো কখনো এসব ফাঁকা বুলি আওরাতে গিয়ে যে গোঁজামিল দেয়া হয় সেগুলো ধরা পড়ে যায়। যেমন একবার বলা হলো, ব্রিটেনে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে শতকরা ৮০ ভাগ। কিছুকাল পরেই বলা হলো লন্ডনে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৫০ ভাগ। মনে হয় ব্রিটেন বা লন্ডন সম্ভবত আলাদা দুটি দেশ। এ রকম গোঁজামিল হামেশায় পাওয়া যায়। কখনো বলা হয়, পৃথিবীর কোথাও বিদ্যুতের ভর্তুকি দেয়া হয় না। একমাত্র বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুতে ভর্তুকি দিচ্ছে। তখন সংবাদপত্রে সাংবাদিকরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে, পৃথিবীর কোন কোন দেশে বিদ্যুতের কী পরিমাণ ভর্তুকি দেয়া হয়। ফলে আমরা একটা ধোঁকার মধ্যে পড়ে যাই। এভাবে দেশ চলছে। রিজার্ভ যখন ক্রমে কমছে। ডলারের অভাবে যখন এলসি খোলা যাচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার জন্য বিদেশে যেতে পারছে না। ডলারের অভাবে মাসের পর মাস বন্দরে রোজার পণ্য আটকে আছে। খালাস করা যাচ্ছে না। ফলে সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠে যে, রোজায় পণ্যের দাম কতগুণ বাড়বে।
এতো গেল জাহাজের খবর কিন্তু বাজারের খবর আরো ভয়াবহ। বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। এসব দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো পদক্ষেপ নেই। দরিদ্রদের জন্য পণ্য সরবরাহের ট্রাকের লাইনে এখন মধ্যবিত্তরা এসে দাঁড়িয়েছে। সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। ফলে অনেককে শূন্য হাতে ফিরতে হচ্ছে। যে মধ্যবিত্ত ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছেন তিনি হয়তো কোনো দিন কল্পনাও করেননি যে, তাকে দরিদ্রদের এই ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়াতে হবে। আমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয়, ট্রাকের লাইনে দাঁড়াই। তেল, চিনি, ডাল, পেঁয়াজ সস্তায় কিনে নিয়ে যাই। কিন্তু এই বয়সে খরতাপ মাথায় নিয়ে সে সাহস করে উঠতে পারিনি। মাছ গোশতের দামও বেড়েছে অনেক। সর্বশেষ ভরসা ছিল ডিম। ডিমের হালি ৫০ টাকা। দরিদ্র মানুষের প্রোটিন হিসেবে পরিচিত ডিম তাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। আগে দুপুরের খাবারে খিচুড়ির সাথে একটি ডিম তাদের বরাদ্দ ছিল এখন তা অর্ধেক হয়ে গেছে। দুপুরের খাবার খিচুড়ি ও আধখানা ডিম ভুনা। বয়লার মুরগিও ছিল দরিদ্রদের প্রোটিনের আরো একটি উৎস। মাস তিনেক আগেও ব্রয়লার মুরগির কেজি ছিল ১৫০ টাকা এখন ২৬০ টাকা। আগে দরিদ্র সাধারণ মানুষও ছোট হোক বড় হোক একটি আস্ত মুরগি কেনার কথা চিন্তা করতেন। এখন সে রকম একটি মুরগির দাম ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। গরুর গোশতের কেজি ৭৫০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে আগেই। এমনকি মধ্যবিত্তরাও গরুর গোশত খাওয়ার চিন্তা কম করেন। দরিদ্ররা অপেক্ষা করেন কবে ঈদ আসবে। কোরবানির ঈদে শুধু তারা গরুর গোশত খেতে পান। এর একটি করুণ উদাহরণ দেয়া যায়, আওয়ামী লীগ রংপুরের জনসভায় যাদের নিয়ে এসেছিল তাদের বলেছিল, দুপুরে গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাওয়ানো হবে আর নগদ ৫০০ টাকা। গরুর গোশতের আকর্ষণ এতটাই প্রবল ছিল যে, শতাধিক কিলোমিটার বাসে করে তারা আওয়ামী লীগের জনসভাস্থলে এসেছিলেন। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্ত জনসভায় আগত লোকেরা। যারা তাদের নিয়ে এসেছিলেন আগত লোকেরা তাদের গিয়ে ধরলেন। বললেন, খাবার কই, টাকা কই। তারা জবাব পেয়েছিলেন, খাবার শেষ। আওয়ামী লীগ তাদের টাকা দেয়নি। তাদের টাকা দেবে কোথা থেকে? ফলে তারা লুট করে খেয়েছেন বোতলের পানি। আহা, না জানি কতকাল এরা গরুর গোশত দিয়ে ভাত খাননি।
এর মধ্যে এসেছে সরকারের জন্য আরেক সুসংবাদ, জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার খুলদীঘি বাজারে মুরগির গোশত কিনতে গেছেন রেজাউল করিম। তার বাড়ি খুলদীঘি বাজার থেকে তিন কিলোমিটার দূরে পাচুইল গ্রামে। দিনমজুর রেজাউলের বাড়ির কাছাকাছি গোশত কেনার একাধিক দোকান আছে। তারপরও এতটা পথ হেঁটে এই খুলদীঘিতে যাওয়ার কারণ হলো এই দোকান থেকে চাইলে কয়েক টুকরো গোশত বা সর্বনিম্ন ১৫০ গ্রাম গোশতও কিনতে পারবেন। এমন দোকান এ তল্লাটে আর নেই। রেজাউল করিম আধা কেজি মুরগির গোশত কিনলেন। তবে জানালেন, কোনো কোনো দিন এর চেয়েও কম গোশত কেনেন। এই দোকানের নিয়ম হলো ন্যূনতম ১৫০ গ্রাম গোশত এখানে বিক্রি হয়। রেজাউলের মতো এমন নিম্নবিত্ত মানুষের সাধ মেটাচ্ছে এসব দোকান। শুধু ক্ষেতলাল নয় দেশের ৭ জেলায় দোকানগুলো তৈরি হয়েছে। এই বিশেষ ধরনের দোকানগুলোর নাম প্রাণিসম্পদ পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে মুরগিসহ সব ধরনের গোশতের দাম নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। তাই এসব দোকানে প্রতিদিন ভিড় বাড়ছে। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, এমন দোকানের সংখ্যা আরো বাড়ানো দরকার। এ কঠিন সময়ে মাছ, গরুর গোশতসহ অন্যান্য পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা থাকলে ভালো। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সহায়তায় তাদের সহযোগী বিভিন্ন সংগঠন এসব দোকান পরিচালনা করছে। সহযোগী সংগঠনের যারা উপকারভোগী সদস্য আছেন তারা ঋণ নিয়ে মুরগি ও হাঁস পালন করেন এবং বিক্রি করেন। তবে শর্ত একটাই স্বল্প পরিমাণে গোশত বিক্রি করতে হবে। খুলদীঘি বাজারের দোকানটি অল্প পরিমাণে গোশত কিনতে প্রতিদিন ২৫-৩০ জন লোক আসেন। হাটের দিন ক্রেতার সংখ্যা দ্বিগুণ তিনগুণ হয়।
সরকার বলতে পারে যার সাধ্য নেই সে তো কমই কিনবে। কিনতে যে পারছে সেটাই তো বড় কথা। এর মাধ্যমে আমরা তো ঘরে ঘরে আমিষের স্বাদ পৌঁছে দিয়েছি।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
[email protected]
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা