০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

হাদিস গবেষক রফিক আহমদের বিদায়

হাদিস গবেষক মাওলানা রফিক আহমদ মোহরভী রহ: । - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাংলাদেশের অন্যতম প্রসিদ্ধ দ্বীনি শিক্ষায়তন পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ার প্রবীণ মুহাদ্দিস, লেখক ও গবেষক মাওলানা রফিক আহমদ মোহরভী রহ: দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর গত ১৪ ডিসেম্বর-২০২২ এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। তার ইন্তেকালে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণ হতে সময় লাগবে।

তিনি ছিলেন তীক্ষ্মধী ও সৃজনশীল মননের অধিকারী। ১৯৬৭ সালে ‘আঞ্জুমানে ইত্তিহাদুল মাদারিস বাংলাদেশে’-এর অধীনে দাওরায়ে হাদিসের বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭২ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও ফারসি ভাষায় তার পারঙ্গমতা ছিল। ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার মোহরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

১৯৬৫ সালে ক্ল্যাসিক্যাল যুক্তিবিদ্যা ও হিকমত-ফলসফার কিতাবাদি বিশেষত সদরা, শামসে বাযেগাহ, হামদুল্লাহ, উকলিদস, মুল্লা হাসান, খুলাসাতুল হিসাব, খিয়ালি, উমুরে আম্মা ইত্যাদির পঠন সমাপ্ত করেন। মেধাবী ও দক্ষ ওস্তাদদের তত্ত্বাবধানে তার জীবন ফলে-ফুলে সমৃদ্ধ হয়।

ভারত-পাকিস্তানের অনেক বিদগ্ধ আলেম গবেষকের তিনি সান্নিধ্যপ্রাপ্ত হন এবং ইলমি বিষয়ে মতবিনিময়ের সুযোগ লাভ করেন। এতে তার দৃষ্টিভঙ্গি ও জ্ঞানের অনুষদ ঋদ্ধ হয়। বিখ্যাত তাফসির গ্রন্থ মা’আরিফুল কুরআনের লেখক মাওলানা মুফতি শফী রহ:, দারুল উলুম দেওবন্দের সাবেক মহাপরিচালক মাওলানা কারি তৈয়ব রহ:, ‘এলাউস সুনান’ গ্রন্থের লেখক মাওলানা যফর আহমদ উসমানী রহ:, মাওলানা শামশুল হক আফগানী রহ: প্রমুখের সান্নিধ্য অর্জন এবং তাদের সাথে বসে আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ হয়। তাদের সম্মানে তিনি স্বরচিত আরবি কবিতা পাঠ করেন। হাফিজে বুখারি নামে খ্যাত আল্লামা আব্দুল্লাহ (দরখাস্তি) রহ:-এর কাছে বুখারি শরিফের সমাপ্তিতে হাদিস পড়ার সুযোগ পান এবং তার কাছ থেকে হাদিসের অনুমতিপ্রাপ্ত হন। ভারতের প্রখ্যাত দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র নদওয়াতুল উলামা লক্ষ্মৌয়ের প্রধান পরিচালক লব্ধপ্রতিষ্ঠ আরবি সাহিত্যিক শায়খ সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ:-এর সাথে দীর্ঘ সময় আলাপ-আলোচনা ও মতবিনিময়ের সুযোগ লাভ করেন। হজরত নদভী রহ:-এর রচিত কাসাসুন্নবিয়িন সিরিজটির চতুর্থ খণ্ডের ব্যাখ্যা লিখেন তিনি। গ্রন্থটির ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা করেন স্বয়ং রচয়িতার সাথে। হজরত নদভী সাহেব রহ: মাওলানা রফিক আহমদ রহ:-কে তার লেখালেখির বিষয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেন। তার সাথে মতবিনিময়ের কিছু স্মৃতিকথা কাসাসুন্নবিয়িন চতুর্থ খণ্ডের ভূমিকায় উল্লিখিত হয়েছে।

মাওলানা রফিক আহমদ রহ: পটিয়া আল জামিয়া আল ইসলামিয়ায় ৪৪ বছর শিক্ষকতার খিদমত আঞ্জাম দেন। দীর্ঘ পরিক্রমায় দারসে নিজামীর গুরুত্বপূর্ণ কিতাবগুলো পাঠদান করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি। এতে তার ইলমি গভীরতা ও বিষয়ভিত্তিক পাণ্ডিত্যের পরিচয় মেলে। কিতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে- সহিহ মুসলিম, তাহাবি, জামে তিরমিজি, শামায়েলে তিরমিজি, সুনান নাসায়ি, মুয়াত্তা মালিক, মুয়াত্তা মুহাম্মদ, মিশকাত (সম্পূর্ণ), নুখবাতুল ফিকার, ইবনে কাছির, তাফসিরে বায়যাবি, তাফসিরে মাদারিক, শরহে আকাঈদ, হেদায়া প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ খণ্ড, কাওয়ায়েদ ফি উলুমিল হাদিস, মায়বুযি, সুল্লামুল উলুম, দিওয়ানে হামাসা, মাকামাতে হারিরি, মুখতাসারুল মাআনি, সাবয়ে মুআল্লাকাত, দিওয়ানে মুতানাব্বি, হুসামি ও কাফিয়া ইত্যাদি। দারস ও তাদরিসের পাশাপাশি তিনি দীর্ঘকাল ছাত্রাবাস তত্ত্বাবধায়ক, মুনাজারা বিভাগ ও তাফসিরুল কুরআন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিপুল দারসি ও গায়ের দারসি কিতাবের তিনি লেখক। তার রচিত গ্রন্থাবলির মধ্যে অন্যতম- ১. ইফাদাতুল মুসলিম শরহে সহিহ মুসলিম; ২. ঈজাহুল মিশকাত; ৩. আকরাবুল ওয়াসায়েল ইলা শরহিশ শামায়েল; ৪. কুররাতুল আইনাইন ফি হষয়-ই মুগ্লাকাত-ই মুআত্তাআইন; ৫. দরসে হিদায়া; ৬. হাদিস পরিচিতি: ভারত-বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় আউলিয়া ও মুহাদ্দিসিন; ৭. ইরশাদুত্তালিবিন ফি আহওয়ালিল মুসাল্লিফিন; ৮. জাহরুন নুজুম ফি মারিফাতিল ফুনুনি ওয়াল উলুম; ৯. আল ইনশাউল জাদিদ মাআল-লুগাতি ওয়াল খিতাবাত; ১০. হিদায়াতুল মুস্তারশিদিন ইলা হল্লি আভিসাতি কাসাসুন্নাবিয়িন; ১১. কাসাসুন্নাবিয়িন অনুবাদ; ১২. আল কালামুল মুতাবার ফি তাউজিহি নুরি সায়িদিল বাশার; ১৩. মহামানব সা:-এর নূর প্রসঙ্গসহ আরো প্রায় অর্ধশত গ্রন্থ তিনি রচনা করেন।

ছাত্রদের উপযোগী করে লেখা ‘ইজাহুল মিশকাত’ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে ভারত-পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেওবন্দের আল্লামা আনযার শাহ কাশ্মিরি রহ., আল্লামা আবদুল হক আযমি রহ:, আল্লামা মুফতি সাঈদ আহমদ পালনপূরী রহ:-এর মতো খ্যাতনামা বিদ্বজন ‘ইজাহুল মিশকাত’-এর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘শব্দ বিশ্লেষণ, জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা ও বিতর্কিত মাসায়েলে প্রমাণসহ ইমামদের অভিমত উপস্থাপন করতে লেখক যে অকৃত্রিম পরিশ্রম করেছেন তা সত্যই প্রশংসার যোগ্য। এতে ফিকহুল হাদিস, শরহুল হাদিস ও হুকমুল হাদিসের ওপর নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পেশ করা হয়েছে এবং পূর্ববর্তী ও পরবর্তী মনীষীদের সূ² কথাগুলো অত্যন্ত সহজভাবে লেখা হয়েছে। এ ব্যাখ্যা গ্রন্থটি বিরক্তিকর দীর্ঘতা ও ক্ষতিকর সংক্ষিপ্ততা থেকে মুক্ত। গ্রন্থটি অত্যন্ত সহায়ক, সহজ ও পরিপূর্ণ, এতে শিক্ষার্থীদের সামনে দীর্ঘতা পরিহার করে সারাংশ পেশ করা হয়েছে। এ সময়ের ছাত্র-শিক্ষক-প্রবীণ সবার জন্যই এ কিতাব অত্যন্ত উপকারী।’

‘মাওয়ায়েজে খতিবে আযম রহ:’ গ্রন্থে তিনি পটিয়া জামিয়ার শায়খুল হাদিস খতিবে আযম আল্লামা ছিদ্দিক আহমদ রহ:-এর মূল্যবান আলোচনা, বক্তৃতা এবং দুর্লভ নসিহতগুলো সঙ্কলন করেন। ‘আনওয়ারে আহমদি’ নামে গ্রন্থটি আল-জামিয়া পটিয়ার শায়খুল হাদিস ও সদরুল মুদাররিসিন মাওলানা আহমদ রহ:-এর (ইমাম সাহেব হুজুর) উর্দু ভাষায় রচিত জীবন চরিত। ‘আল ইনশাউল জাদিদ মা’আললুগাতি ওয়াল খিতাবাত’ গ্রন্থে দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় ৩২টি বিষয়ের বিষয়ভিত্তিক আরবি-উর্দু-বাংলা-ইংরেজি শব্দভাণ্ডারসহ গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক আরবি রচনাবলি, পত্র, বক্তৃতা, সম্ভাষণপত্র ও আবেদনপত্র সংবলিত এক চমৎকার সঙ্কলন। ‘হাদিস পরিচিতি’ নামক গ্রন্থটি ভারত-বাংলাদেশের প্রাতঃস্মরণীয় আউলিয়া ও মুহাদ্দিসিন হাদিস শাস্ত্রের উৎস, উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের ইতিহাস, হাদিসের বিস্তারিত পরিচিতি এবং উপমহাদেশে হাদিসচর্চার ইতিহাসসহ ভারত ও বাংলাদেশের মহান ও বিদগ্ধ হাদিস বিশারদদের জীবনী সঙ্কলন। ‘জাহরুন নুজুম ফি মারিফাতিল ফুনুনি ওয়াল উলুম’ শীর্ষক গ্রন্থে ৩৩টি শাস্ত্রের পরিচিতি, আলোচ্য বিষয়, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, নামকরণ, উদ্ভব-উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশের সুবিন্যস্ত বিশ্লেষণ রয়েছে। বিশেষত উলুমে কুরআনের আলোচ্য বিষয়, তাফসির শাস্ত্রের বিকাশধারা ও পাশ্চাত্যের কুরআন বিকৃতিকারী ও তার জবাবদানকারীদের নামের তালিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কর্মনিষ্ঠা ও সময়ানুবর্তিতা মাওলানা রফিক আহমদ রহ:-এর জীবনকে ঐতিহ্যমণ্ডিত করেছে। হেলাফেলা ও অবহেলায় তিনি সময় নষ্ট হতে দেননি। শিক্ষকতার পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগের সাথে তিনি জ্ঞানগবেষণায় জীবন উৎসর্গ করেন। এক-দুই বছর নয়, পুরো জীবন। কওমি অঙ্গনে টীকাটিপ্পনিসহ এতগুলো গ্রন্থ রচনার কৃতিত্ব অন্য কারো আছে কি না জানা নেই। থাকলেও যাদের আছে তিনি তাদের অন্যতম। আমাদের সমাজে অনেক দক্ষ ও প্রাজ্ঞ আলেম রয়েছেন কিন্তু লেখার হাত নেই। লেখার হাত আছে কিন্তু সময়ানুবর্তিতা নেই। ওয়াজের ময়দানে যেসব আলেম সক্রিয় তাদের পক্ষে কলম ধরা কঠিন। দারস-তাদরিস ও ওয়াজ-নসিহতের আবেদন সাময়িক, লেখালেখির ফল দীর্ঘস্থায়ী। যে সময় বয়ে যায়, তা আর ফিরে আসে না।

মাওলানা রফিক আহমদ রহ:-এর ছেলে মাওলানা রিজওয়ান রফিক জমিরাবাদী বলেন, ‘তিনি সর্বাধিক যে মহান ব্যক্তির দীর্ঘ সান্নিধ্য অর্জন করেছেন তিনি হলেন নিজ পিতা আমার দাদা আল্লামা আহমদ (ইমাম সাহেব হুজুর) রহ:। তিনি যেমন তার পিতা ছিলেন তেমনি ছিলেন তার ওস্তাদ ও মুরশিদও। পিতাজি ৫০ বছর ধরে দাদাজির যে সান্নিধ্য পেয়েছেন তা বড়ই মহোত্তম জীবন ছিল বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন, যখনই সুন্নাত ও মুস্তাহাব পরিপন্থী কোনো সামান্য কিছুও দাদাজির নজরে পড়ত সাথে সাথে তিনি কঠোরভাবে তা সংশোধনের তাগিদ দিতেন। যার ফলে তার সুন্দর চরিত্র গঠনও প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নাতের চর্চায় তিনি বেশির ভাগ দিকনির্দেশনা ও তত্ত্বাবধান দাদাজির কাছেই পেয়েছেন।’

ব্যক্তিজীবনে মাওলানা রফিক আহমদ রহ: ছিলেন প্রচারবিমুখ, সাদাসিধে, মুত্তাকি ও নরম মেজাজের মানুষ। রুটিনমাফিক জীবন পরিচালনায় তিনি ছিলেন অভ্যস্ত। ফরজ-ওয়াজিবের পাশাপাশি নফল ইবাদতের প্রতি তার ঝোঁকপ্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি তার অনুসারীদের পাপ থেকে মুক্ত থেকে সৎ ও পরিচ্ছন্ন জীবন নির্বাহের ওপর গুরুত্ব দিতেন। আমরা নিভৃতচারী এই জ্ঞানতাপস মনীষীর রূহের মাগফিরাত কামনা করি ও দোয়া করি আল্লাহ তায়ালা হজরতকে জান্নাতুল ফেরদাউসে উচ্চ মাকাম নসিব করুন, আমিন।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
কুষ্টিয়ায় পদ্মায় ভাঙন রোধে কুষ্টিয়া-পাবনা মহাসড়ক অবরোধ ভারতের সাথে বাণিজ্যে রাজনৈতিক কারণ প্রভাব ফেলবে না : অর্থ উপদেষ্টা মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের মাস্টার প্ল্যান পুনর্গঠন করা হচ্ছে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে শহীদ ইয়াসির বলতেন, ‘তোমরা কি রাজাকার?’ অভিশংসনের মুখে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি এখন আর নেই : মুশফিক আনসারী খুলনায় দুর্বৃত্তের হামলায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু সিরিয়ার সরকারকে যে বার্তা দিলেন এরদোগান এসপি বাবুল আক্তারের জামিন বহাল, মুক্তিতে বাধা নেই নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা যুক্তরাষ্ট্রের বেনজীরের ক্যাশিয়ার জসিম গ্রেফতার

সকল