আমরা ভোঁতা হয়ে গেছি
- ড. মাহবুব হাসান
- ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২১:০৪
সত্য সত্যই কি আমরা, মানে আমজনতা ভোঁতা হয়ে গেছি? না হলে আমরা কেন প্রতিবাদে নেমে আসছি না রাজপথে? কেন আমরা প্রতিবাদ না করে নীরবে সহ্য করছি? এই যে অস্থির কাঁচা-পাকা বাজার, সর্বত্রই যে অনাচার চলছে, সরকার তা রোধ করে গণমানুষকে স্বস্তি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে-তারপরও রাজপথে আমাদের আওয়াজ উঠছে না। কেন?
আমরা যে দেখি মানুষ প্রতিবাদ মিছিল করে রাজপথ গরম করে না- এর কারণ জনগণ ভয়ের ভেতরে বাস করে। অর্থাৎ সরকার একটি রাজনৈতিক ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টি করে নিয়েছে, যাতে কোনো মানুষ, কোনো গোষ্ঠী প্রতিবাদ না করে, প্রতিবাদ করার সাহস না পায়। আর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা পণ্যমূল্য নিয়ে রাজপথে নেমেছে, যারা দলের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নেমেছে এবং অব্যাহতভাবে সরকারের সমালোচনা করছে, যেমন বিএনপি, তাদের বিরুদ্ধেও সরকারি দলের নানামাত্রার অভিযোগ, বক্তব্য, দুর্নীতির কথা বলছে সরকারি দল। এই উভয়পক্ষের কথাই আমজনতা শুনছে। কেউ বিশ্বাস করছে, কেউ করছে না। যারা বিশ্বাস করছে তারা বিএনপি করে না; কিন্তু বিএনপির প্রতি আস্থা ও ভালোবাসা আছে। যারা অবিশ্বাস করছে তারা ক্ষমতাসীন দলের বেনিফিসারি, তারা দলীয়কর্মী, তারা সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাভোগী, তারা চলতি হাওয়ার পন্থী। এদের সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। তবে, আম জনতার চেয়ে তারা বহুগুণ কম। যেহেতু সরকারি দলের জনসভাগুলোতেও তারা হাজির হয়, তাই সরকারি দলের নেতারা বলতে পারেন, দেখে যান আমাদের জনসভার লোক কত হয়েছে। বিষয়টি তো আর লোকগল্পের বা পুঁথির কাহিনীর মতো নয় যে লোক মরে লাখে লাখে; কিন্তু শুমার করে দেখে চব্বিশ হাজার।
প্রশ্ন উঠবেই আমি জানি, বিরোধী দলের সমাবেশে কেন তাদের কর্মীর চেয়ে সাধারণ মানুষ বেশি বলছি আমি। কারণ একটাই, দ্রব্যমূল্য। এমন আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, ঘণ্টায় ঘণ্টায় যা বাড়ছে। আর এই বাড়াটা কেবল কাঁচাবাজারে নয়, আড়তদারদের পাইকারি বাজারেও। এটা দেশী পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি আমদানি করা পণ্যের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। সয়াবিন তেল, চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম হোলসেলারগণ যেমন বাড়াচ্ছে তেমনি খুচরা দোকানিরাও বাড়াচ্ছেন। খুচরা দোকানি বা ভাসমান ফলের দোকানি, সামনের দিনগুলোর কথা ভেবে যে লোভ সামাল দেবে, এমন কোনো আভাস নেই। বরং উল্টোটাই দেখতে পাচ্ছি আমরা বহুকাল ধরেই। মার্চের ২৫ তারিখ থেকে রোজা। তাই গরিবেরা কিছু নিত্যপণ্য কিনে রাখছেন। টের পেয়ে ওই ভাসমান ঠেলার দোকানিও দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। মাত্র ৬০ গজের মধ্যে দু’টি ফলের ভাসমান ঠেলা দোকানি আঙুর ফলের দাম হাঁকলো ১২০ টাকা কেজি ও ১৫০ টাকা কেজি।
কম দাম বলে যে লোকেরা হুমড়ি খেয়ে পড়বে, এমনটা ভাবা সহজ, কিন্তু বিষয়টি অত সহজ না। গাঁটে বা ট্যাকে টাকা থাকতে হবে তো? সর্বক্ষেত্রে যেন অরাজকতা চলছে। সরকার কোনো বাজারই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ভাসমান, কাঁচাবাজার ও আড়তদারদের বাজার কোনোটাই না। কেন পারছেন না? কারণ সরকারি দলের লোক তারা কিংবা তারা সরকারি দলের রাজনৈতিক শাখায় চাঁদা দেন কোটি কোটি টাকা। ফলে সেখানে নিয়ন্ত্রণের কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না সরকার। দল আর সরকারি দলের মধ্যে যে ফারাকটা থাকার কথা, তা আজ আর নেই। তা অ্যালগেমাল হয়ে এমন এক রসায়নের মণ্ড তৈরি হয়েছে যে তার রূপই চেনা যায় না। কোথা থেকে শুরু করবেন সেই হিত তো পাচ্ছেন না তারা। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি তো বলেছেন, বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই সরকারের বেঁধে দেয়া দামে পণ্য বিক্রি করছে না। খুচরা দোকানি সেই বেঁধে দেয়া সরকারি ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রি করবে কেমন করে? লোকসান দিয়ে তো আর ব্যবসা হয় না। আর তারাই বা লোকসান দেবেন কেন? কী দায় পড়েছে তাদের? দায় তো সরকারের, সেই দায় কেন হোলসেলার ও খুচরা বিক্রেতারা নেবে?
সামনের দিনগুলোতে আমদানি করা ও দেশী পণ্যের দাম বাড়বে, স্বভাবসূত্রানুযায়ী আমরা তা বুঝি। গত ৫০ বছর ধরে তো এটাই দেখছি। জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছিল ৫২ শতাংশ। যেহেতু উৎপাদক দেশ দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা বাড়িয়েছে উৎপাদন কম হওয়ার যুক্তিতে। এভাবে গোটা বাণিজ্য ব্যবস্থাপনাটাই এমন এক পুলসিরাতের মতো চিকন ও পাতলা সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, সেখানে সংস্কার বা হাত দেয়া কঠিন। ফলে সরকার সেখানে হাত দেন না। তাতে সরকারি হাত পুড়ে যেতে পারে। সরকারি হাত পুড়ে গেলে তার দুর্নাম হবে, তার রাজনৈতিক ক্ষতি হবে। এটা তো আর হতে দিতে পারেন না সরকার বাহাদুর। কেউ কি জেনে-বুঝে নিজের পায়ে কুড়াল মানতে পারে? তাই ভয়ের পরিবেশ সৃজন করা সহজ।
২.
ভয় জিনিসটা এমনই পলকা যে তাকে সহজেই জয় করা যায়। যেমন আমরা পাকিস্তানি আমলে ১৯৬৯ সালে করেছি। যেমন আমরা করেছি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর স্বাধীনতা-উত্তরকালে ১৯৯০ সালেও আমরা তা করে দেখিয়েছি গণ-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে। তারপরও রাজনৈতিক সরকারগুলোর প্রথম ও প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে জনমনে ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রাণের ভেতরে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া। এই যেমন আমরা দেখছি এখনকার রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সরকার পক্ষ ভয়কে ব্যবহার করছেন। বিএনপির ঘোষিত কর্মসূচিগুলো ছিল জনগণের সাথে তাদের দূরত্ব কমিয়ে আনার প্রোগ্রাম। তাদের ভাষায় জনগণকে সরকারের দুর্নীতি ও লুটপাট সম্পর্কে সজাগ করে তোলা। ৫০ বছরের ভুক্তভোগী ক্রেতা-জনগণ জানে তারা কিভাবে প্রতারিত হয়েছে এবং নিজেদের সম্পদ হারিয়েছে। বিএনপি শাসনামলে একবার সারের মূল্য যথাযথ রাখার দাবিতে মিছিল করলে কৃষকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সরকারের চরিত্র হলো এমনটাই। আবার রাজনৈতিক সরকারের চরিত্র যে মিথ্যাচারে ঠাসা থাকে সেটা প্রমাণ হয় আওয়ামী লীগ সরকারের মিথ্যা প্রতিশ্রুতির মধ্যে। নির্বাচনের আগে তারা ঘোষণা দিয়েছিল যে জনগণকে সরকার ১০ টাকা কেজিতে চাল খাওয়াবেন। আর কৃষকদের সার দেবেন মাগনা। সেই মাগনা সারের দাম কত করেছেন, সেটা কৃষক জানেন। কারণ, তারাই সারের প্রকৃত ক্রেতা। তারা যাতে টুঁ-শব্দটি না করতে পারে, তাই মুখ বন্ধ করার ওষুধ হচ্ছে রাজপথ রক্তে ভিজিয়ে দেয়া। বিএনপির মিছিল-সমাবেশগুলো ছিল অহিংস। কোনো রকম ধ্বংসাত্মক কর্মসূচির পথ তারা পরিত্যাগ করেছে। তৃণমূলে তাদের সম্মেলন ও রাজধানীতে সমাবেশের মধ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তার পরও সাত-আটটি প্রাণ গেছে পুলিশ ও ছাত্রলীগের হাতে। সরকারদলীয় কর্মসূচিতে যে ভাষায় বিএনপিকে নাজেহাল করা হয়, উসকে দেয়া হয় যেসব অকথ্যপ্রায় ভাষায়, তাতে করে মনে হতে পারে যে, সরকারি দল চায় বিএনপি ভায়োলেন্ট হয়ে উঠুক। বিএনপি ভায়োলেন্স করলেই এটা বলা যাবে যে দলটি সন্ত্রাসী। আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস করে আর তার দোষ চাপায় বিএনপির ঘাড়ে। আগুন সন্ত্রাস তার একটি। বিহঙ্গ পরিবহনে গানপাউডার দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল কিছু যাত্রী-মানুষকে। সেই ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় বিএনপিকে। আবার বিএনপিও উল্টো দাবি করে চলেছে যে কাজটি আওয়ামী লীগের লোকেরাই করেছে ওই পরিবহনের মালিকের সরাসরি নির্দেশে। পরে একটি ভিডিও দেখেছি যেখানে আওয়ামী লীগেরই কয়েকজন নেতা মূল ঘটনাটি ভিডিও করেছেন।
৩.
এখন চলছে ছাত্রলীগের ভয় সৃষ্টির সন্ত্রাস। ছাত্রীনিবাসে যেমন নিজ সংগঠনের ছাত্রীকে পিটিয়ে শায়েস্তা করছে তারা, তেমনি পাড়ার/ মহল্লার দোকানির ক্যাশ লুট করার ঘটনা অহরহই ঘটছে। এমনকি সাধারণ ছাত্রের মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে টাকা নিয়ে গেছে ছাত্রলীগের এক নেতা। সংবাদপত্রগুলো পড়লে এসব সুকীর্তির অনেক নিউজই আমরা পাই। এই ভয়ঙ্কর ছাত্রলীগকে কি ওউন করেন সরকারপ্রধান? তিনি যদি ওই সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হন, তাহলে ছাত্রলীগের সব অপকর্ম তার কাঁধে গিয়ে পড়ে। এই দোষ কি তিনি বহন করবেন নাকি ঝেড়ে ফেলবেন?
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা