০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে স্বার্থের সঙ্ঘাত

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ। - ছবি : সংগৃহীত

২০২১ সাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি কাগজে-কলমে বন্ধ থাকলেও ছাত্রনেতাদের আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি সমানে অব্যাহত রয়েছে। স্বার্থের সঙ্ঘাতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ছাত্রজীবন। দক্ষ চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন উবে যাচ্ছে। মানবসেবার ব্রত মুখ থুবড়ে পড়ছে। কলেজ কর্তৃপক্ষ অসহায়। থেমে থেমে রক্ত ঝরছে ক্যাম্পাসে। নিভে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় জীবনের আলো। সরকারদলীয় দুই নেতার অনুসারী দাবিদার ছাত্রনেতারাই মেডিক্যাল ছাত্রাবাস দখল করে আছে। মেডিক্যাল কলেজ বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পড়ালেখার চাপ বেশি। সমাজের অতি মেধাবী শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতামূলক ভর্তিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এতে পড়ালেখার সুযোগ পায়। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা না থাকায় অভিভাবকরা স্বভাবতই উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েন।

চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ৬২তম ব্যাচের চার শিক্ষার্থী- জাহিদ হোসেন ওরফে ওয়াকিল, সাকিব হোসেন, এস এ রায়হান ও মোবাশ্বির হোসেনকে ছাত্রশিবির সন্দেহে ৮ থেকে ৯ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা পর্যন্ত চমেকের প্রধান ছাত্রাবাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নির্যাতন করেন বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। একই সময় এস এ রায়হান ও মোবাশ্বির হোসেনকে নির্যাতন করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। নির্যাতনে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। অপর দুই ছাত্রকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়েছে।

নির্যাতনের শিকার সাকিব হোসেন ও জাহিদ হোসেন ৭ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে কলেজ অধ্যক্ষ সাহেনা আক্তার বরাবর অভিযোগ করে বলেন, ‘টিউশনি থেকে আসছি, বলার সাথে সাথে আমাকে ক্রিকেটের স্টাম্প দিয়ে আঘাত করে ইমতিয়াজ আলম। তারপর আমাকে বেঁধে ফেলে এবং সে অবস্থায় মুখে পানি ঢালতে থাকে। একপর্যায়ে নিশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলে পানি ঢালা বন্ধ করে। এরপর তালিকা ধরে কয়েকজনের নাম বের করে বলে, আমরা কোথাও (রেটিনা কোচিং সেন্টার) ক্লাস নিই কি না। আমি আমারটির উত্তর দিলাম, না। অন্যদেরটা জানি না। সাথে সাথে শুরু হয় স্টাম্প, প্লাস্টিকের পাইপ, কাঠের তক্তা- এসব দিয়ে মারপিট। একপর্যায়ে মাটিতে শুয়ে পড়লে দুই মিনিট চেয়ারে বসিয়ে পানি খাওয়ানো হয়। এরপর আবার জয়েন্টগুলোতে স্ট্যাম্প দিয়ে আঘাত করতে থাকে।’ দুই শিক্ষার্থীই জানিয়েছেন, ‘বড় ভাইয়া’ ডাকছে বলে তাদের ছাত্রাবাসের তিন তলার ১৭/সি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। পৃথক হাতে লেখা ছয় পৃষ্ঠা করে ১২ পৃষ্ঠার অভিযোগে নির্যাতনের কারণ হিসেবে একই শ্রেণীর সহপাঠীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ইসলামী ছাত্রশিবির পরিচালিত রেটিনা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়ার বিষয়টির উল্লেøখ রয়েছে। ওই কোচিংয়ে ক্লাস নেন না বলার পরে তাদের ওপর নির্যাতন শুরু হয়। ২০ থেকে ২২ জন তাদের মারধরে অংশ নেন। নির্যাতনের কথা বাইরে প্রকাশ না করার হুমকি ও হাসপাতালে গিয়ে আবার মর্গে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকির কথা উল্লেখ রয়েছে লিখিত অভিযোগে। চট্টগ্রাম মেডিক্যালের ৬২ ব্যাচের এই দুই ছাত্রই তাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তির পাশাপাশি পড়ালেখা শেষ করার নিশ্চয়তা চেয়ে নিরাপত্তার দাবি জানান। অভিযোগ প্রসঙ্গে ছাত্রলীগের অভিজিৎ দাশ বলেন, ‘তারা ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত। রেটিনায় ক্লাস নেয়। তাদের মোবাইল থেকে অনেকগুলো প্রমাণ পাওয়া গেছে। এগুলো আমরা যথাযথ জায়গায় দিয়েছি। আর তাদের ওভাবে মারা হয়নি, অনেকটা অভিনয় করছে।’ (প্রথম আলো, ১৪ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)

সহযোগী দু’টি জাতীয় দৈনিক প্রশ্ন তুলেছে- ‘ছাত্রলীগকে কি সামলানো যাবে না। শিবির কি নিষিদ্ধ সংগঠন? শিবির যদি কেউ করে তাহলে তাদের ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার দায়িত্ব ছাত্রলীগকে কে দিয়েছে? কেউ যদি সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডেও জড়িত হয়, তাহলে তার বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আইনি কর্তৃপক্ষ কি ছাত্রলীগ? ছাত্রলীগের কমিটি না থাকার দায়ই-বা কার? ছাত্রলীগকে আইন হাতে তুলে নেয়ার ক্ষমতা কি কেউ দিয়েছে?’ (আজকের পত্রিকা, ১২ ফেব্রুয়ারি-২০২৩) ‘ছাত্রলীগ কি আইনকানুনের ঊর্ধ্বে, এই চার ছাত্র যদি বেআইনি কোনো কাজ করে থাকেন, আইনি ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর; ছাত্রলীগের নয়। ভবিষ্যতে যাদের চিকিৎসক হওয়ার কথা, যাদের প্রকৌশলী হওয়ার কথা, ছাত্রলীগ নামের সংগঠনটি তাদের কেন সন্ত্রাসী ও খুনের আসামি বানাচ্ছে? সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগ যত শক্তিশালীই হোক না কেন, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই।’ (প্রথম আলো, ১২ ফেব্রুয়ারি-২০২৩)

আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই অশান্ত হয়ে ওঠে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ। চট্টগ্রাম মহানগরে শাসকদলের এক নেতার অনুসারীরা প্রায় ৩৩ বছর ধরে নিয়ন্ত্রণ করছে চমেক। এ আধিপত্য খর্ব করে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করতে প্রায় দুই বছর আগে থেকে সক্রিয় অপর এক নেতার অনুসারীরা। দুই বছরে অন্তত ৮-১০ বার সংঘর্ষে জড়িয়েছে বিবদমান দু’টি গ্রুপ। সর্বশেষ ২৯ ও ৩০ অক্টোবর তিন দফা সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হন। এ সময় মাথায় গুরুতর চোট পান এমবিবিএস ৬২তম ব্যাচের মাহাদী জে আকিব। চিকিৎসকরা তার মাথার খুলি অস্ত্রোপচার শেষে সাদা ব্যান্ডেজে জুড়ে সেখানে লিখে দেন, ‘হাড় নেই, চাপ দেবেন না’। নিচে একটি বিপজ্জনক চিহ্নও এঁকে দেয়া হয়। এ ঘটনায় দু’পক্ষ থানায় পৃথক তিনটি মামলা করে। এসব মামলায় প্রায় ৪০ জনকে আসামি করা হলেও গ্রেফতার হয়েছে মাত্র দু’জন। (যুগান্তর, ২৪ নভেম্বর-২০২১)

২০১১ সালের ১৯ অক্টোবর চমেক ছাত্রাবাসে পিটুনির শিকার হয়ে মারা যান আবিদুর রহমান আবিদ। তিনি ‘ব্যাচেলর অব ডেন্টাল সার্জারি’ তৃতীয়বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বজনদের অভিযোগ, ছাত্রদলের কমিটি গঠনের চেষ্টা করায় তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতারা কয়েক দফা পিটিয়েছিলেন আবিদকে। ওই নির্যাতনের দুই দিন পর ২১ অক্টোবর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবিদ। বারবার সংঘর্ষের পর ক্যাম্পাসে সভা-সমাবেশ ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলেও তা কেউ মানছে না। চলতি বছরে মারামারির ঘটনায় দ্বিতীয় দফা রাজনীতি নিষিদ্ধ করে কর্তৃপক্ষ।
কোতোয়ালি আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল সংবাদপত্রের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘চমেকে আমার কোনো গ্রুপ নেই। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষার্থীদের দু’পক্ষের সঙ্ঘাত-সংঘর্ষের ঘটনাকে অত্যন্ত দুঃখজনক ও অনাকাক্সিক্ষত- এমন মন্তব্য করেছেন। এ সাক্ষাৎকারে অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক কারণে নয়; বরং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) রাজনীতির সাথে জড়িত একজন ব্যক্তির হাসপাতালকেন্দ্রিক ব্যবসায়-বাণিজ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে শুনেছি। ওই পক্ষকে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকার কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রস্বীকৃত কোনো কমিটি নেই। নেই ছাত্র সংসদও। যেকোনো ঘটনা ঘটলেই সেটিকে রাজনৈতিক রূপ দেয়া হচ্ছে। এখানে দু’টি পক্ষ দু’জন নেতার অনুসারী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলেও প্রকৃত অর্থে চমেকে কোনো নেতার অনুসারী বা কোনো পক্ষ আছে বলে আমি মনে করি না।’ নওফেল বলেন, ‘ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অনেক বিষয় তদন্ত হচ্ছে। তাকে যদি প্রশাসন ডেকে জিজ্ঞেস করত, সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া যেত, তাহলে চমেকে এ ধরনের পরিস্থিতি কখনো তৈরি হতো না।’ ব্যারিস্টার নওফেল আরো বলেন, ‘হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হিসেবে হাসপাতালের উন্নয়ন নিয়ে আমি কথা বলছি। এসব বিষয়-আশয় দেখা আমার দায়িত্ব। ছাত্রদের বিষয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার আমার নেই। তাই আমি সেসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করি না। চমেকের ছাত্রদের নিয়ন্ত্রণ করেন অধ্যক্ষ। তাদের ভালো-মন্দ দেখভাল করার দায়িত্বও অধ্যক্ষের। অথচ কোনো ঘটনা ঘটলেই আমার অনুসারী বা অন্য কোনো নেতার অনুসারী হিসেবে দাবি করে পক্ষগুলো। কিন্তু আমি তাদের ‘ওন’ করি না। কারণ আমার কোনো পক্ষ নেই। আমি আমার নামে কাউকে ¯স্লোগান দিতেও বারণ করে দিয়েছি। তবে কোনো ছাত্রের ইনজুরি হলে, আমার সাহায্য চাইলে তাকে সাহায্য করা বা তার পাশে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব।’ নওফেল আরো বলেন, ‘হাসপাতালকেন্দ্রিক কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। ওষুধবাণিজ্য, টেন্ডারবাণিজ্যসহ নানা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করেন একজন ব্যক্তি। যিনি বিএমএর রাজনীতির সাথে যুক্ত। নগর আওয়ামী লীগেও বড় পদ নিয়ে বসে আছেন। ওই ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন না হলে বা তার স্বার্থে আঘাত আসবে মনে হলেই তিনি গণ্ডগোল পাকান। আমি যখন হাসপাতাল ভিজিটে যাই তখন আমার বিরুদ্ধে ¯স্লোগান দেয়া হয়। আমি যখন হাইফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা দিতে যাই তখন আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া হয়। আমার পক্ষেও অনেকে স্লোগান দেন। এখানে একটি পক্ষ দীর্ঘদিন ধরে বারবার হয়রানির শিকার হচ্ছে। আর এই পক্ষটিই আমার পক্ষে স্লোগান দেয়। যদিও আমি বারণ করে দিয়েছি আমার নামে কাউকে ¯স্লোগান না দিতে।’ নওফেল আরো বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে এক হাজারের মতো ছাত্র আছে। নিয়মিত ছাত্র আছে ৫০০ জন। সেখানে আমার কোনো ভোটার নেই। তাই তাদের নিয়ে গ্রুপ বা রাজনীতি করারও আমার প্রয়োজন নেই। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা এসব শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে জেলায় ফিরে যাবে। দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবে। তাদের নিয়ে রাজনীতি করার কী আছে? অথচ এটি করতে গিয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরাই মেধা ধ্বংসে জড়িয়ে পড়ছে। আকিব নামে যে মেধাবী ছাত্রটির মাথায় আঘাত করা হয়েছে, আইসিইউতে ওই ছাত্রটি জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে চলে যায়। এমন ঘটনা কখনো মেনে নেয়া যায় না।’ তিনি বলেন, ‘আমি ওই ঘটনায় যারাই জড়িত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে চট্টগ্রামের পুলিশ কমিশনারকে বলে দিয়েছি। জড়িত বা হামলাকারী কেউ যদি আমার নাম বিক্রি করে আমি তাদেরও আইনের আওতায় আনতে বলেছি। কারণ মেডিক্যালের মতো দেশের একটি শীর্ষ বিদ্যাপীঠে এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকুক, তা আমি চাই না। দেশের আর কোনো মেডিক্যাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন ঘটনা ঘটেনি বা এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি।’ (যুগান্তর, ২ নভেম্বর-২০২১)

আমাদের বড় বড় রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় স্বার্থে ও ক্ষমতার মোহে ছাত্রদের রাজনীতিতে ব্যবহার করে আসছে দীর্ঘকাল ধরে। ফলে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্নিত; লজ্জাজনক সেশনজট লেগেই আছে; যেকোনো মুহূর্তে আপন সন্তান লাশ হয়ে ঘরে ফেরার অজানা আশঙ্কায় অভিভাবকরা প্রহর গোনেন। কত মেধাবী ছাত্র অকালে ঝরে পড়েছে তার হিসাব রাখে কে? ছাত্ররাজনীতি আমাদের যা দিয়েছে, নিয়েছে তার শতগুণ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের শিকার মেধাবী ছাত্র আবু বকরের লাশ পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ২০১০ সালে। মৃত্যুর পর তার পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হলে দেখা যায়, তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন। বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সরকারি উচ্চপদস্থ অফিসার হতে পারতেন তিনি। অথচ পরে আদালতের রায়ে এই মামলার ১০ আসামি বেকসুর খালাস পান। এর যদি বিচার হতো, খুনিদের সাজা হতো, তাহলে হয়তো বুয়েটের আবরারের মৃত্যু হতো না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ১০ বছরে আটজন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চারজন খুন হয়েছেন। আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি এবং খুনির সাজা হয়নি। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বাদ দিলেও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতিতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ৬৪ জন ছাত্র। ক্যাম্পাসে সংগঠিত এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য এখন পর্যন্ত কেউ শাস্তি পায়নি। একমাত্র ১৯৭৪ সালে সংগঠিত চাঞ্চল্যকর সাত খুনের পর একটিমাত্র মামলার বিচার ও রায় পাওয়া গেছে। কিন্তু পরে খুনিদের সেই শাস্তিও বাতিল হয়ে গেছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড ও হতাহতের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। আইন অনুযায়ী মামলাও দায়ের করা হয়। কিছু অভিযুক্তকে আটকও করা হয়। তবে মামলাগুলো বিচারের মুখ দেখে না।

কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলাদেশের প্রায় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কোনো না কোনো ছাত্র সংগঠনের দখলে। ভর্তিবাণিজ্য, সিট দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস এখন লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতির স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্য। ছাত্রনেতারা একাডেমিক স্বার্থের পরিবর্তে রাজনৈতিক দলের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে অধিক মনোযোগী। ক্যাম্পাসে অস্ত্র হাতে ‘যুদ্ধ করার’ ছবি দেশ বিদেশের মিডিয়ায় প্রকাশ পাচ্ছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল আরেক দলের সাথে অথবা একই দলের দুই গ্রুপের মধ্যে যেভাবে সশস্ত্র সংঘর্ষ হয় এবং যেভাবে প্রকাশ্যে হকিস্টিক, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, দা, চাইনিজ কুড়াল, কাটা রাইফেল, চাপাতি নিয়ে প্রতিপক্ষের ওপর হামলে পড়ে, সে দৃশ্য বাংলাদেশের ভাবমর্যাদাকে কালিমালিপ্ত করে। চিহ্নিত ক্রিমিনালদের লালন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ প্রতিপক্ষের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে বেশি সংখ্যক ক্রিমিনালকে সংগঠনে রাখতেই হবে। নিরীহ ছাত্রদের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহারের দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো উন্নত দেশে তো নেই-ই, এমনকি প্রতিবেশী দেশ ভারতেও নেই। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস ও সিপিএমের মতো দলের নেতারা ছাত্রদের রাজনীতির স্বার্থে ব্যবহারকে রীতিমতো পাপ ও গর্হিত কাজ মনে করেন।

আমাদের সবার মনে রাখা দরকার, দেশের ছাত্র-জনগোষ্ঠী আমাদের সন্তান, ভাই ও আপনজন। তাদের জীবন নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলতে পারি না। মানবজীবনের সর্বোৎকৃষ্ট সময় ছাত্রজীবন। জ্ঞানার্জনের নিরবচ্ছিন্ন সাধনা ছাড়া ছাত্রজীবন অর্থহীন। অর্জিত জ্ঞানের আলো নিয়েই তাকে সুখী সমৃদ্ধিশালী সমাজ নির্মাণে ভূমিকা রাখতে হবে। একজন ছাত্র ভবিষ্যৎ জীবনে কী ধরনের ব্যক্তিরূপে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার প্রস্তুতির ওপর। আদর্শ মানুষরূপে গড়ে তোলার সাধনা চলে ছাত্রজীবনে। অধ্যয়ন ও নিয়মানুবর্তিতা ছাত্রজীবনের অন্যতম প্রধান কর্তব্য। রীতিমতো অধ্যয়ন, সৎগুণাবলি অর্জন ও কর্তব্যনিষ্ঠা ছাড়া মনুষ্যত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে না। তাই আমাদের উচিত ছাত্রদের পড়ার টেবিলে ফিরিয়ে নেয়া ও অধ্যয়নে মনোযোগী করা। ছাত্ররাজনীতির নামে এই ঔদ্ধত্য, দুর্বৃত্তপনা ও খুনাখুনি বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে।

লেখক : শিক্ষক ও গবেষক
[email protected]


আরো সংবাদ



premium cement
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের মাস্টার প্ল্যান পুনর্গঠন করা হচ্ছে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করলে শহীদ ইয়াসির বলতেন, ‘তোমরা কি রাজাকার?’ অভিশংসনের মুখে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট হাসিনার পররাষ্ট্রনীতি এখন আর নেই : মুশফিক আনসারী খুলনায় দুর্বৃত্তের হামলায় আহত বিএনপি নেতার মৃত্যু সিরিয়ার সরকারকে যে বার্তা দিলেন এরদোগান এসপি বাবুল আক্তারের জামিন বহাল, মুক্তিতে বাধা নেই নাগরিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের প্রশংসা যুক্তরাষ্ট্রের বেনজীরের ক্যাশিয়ার জসিম গ্রেফতার দিল্লি জামে মসজিদ নিয়ে হিন্দুসেনার দাবি কক্সবাজার সৈকতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের তৈরি রোবট দানব

সকল